ভালভার্দেকে ছাঁটাই করাই কি বার্সেলোনার একমাত্র উপায়?
স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে প্রথম লেগের ম্যাচ শেষে মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান সতীর্থদের একটা সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছিলেন। নিজেদের খেলার ধরন নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। সঙ্কট আগেই টের পেয়েছিলেন টের স্টেগান। সেই বার্সেলোনা এর পর লা লিগায় হেরেছে লেভান্তের কাছে, ঘরের মাঠে স্লাভিয়া প্রাগের সঙ্গে করেছে ড্র। এখন চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্ব পেরুনোর সমীকরণও কঠিন হয়ে গেছে বার্সেলোনার জন্য। লা লিগা আর চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপের শীর্ষে আছে বার্সেলোনা, কিন্তু মাঠের খেলা সেটা বলছে না।
কী শিখল বার্সা?
টের স্টেগান সতীর্থদের সঙ্গে কী কথা বলেছেন সেটা জানার উপায় নেই। আদৌ কোনো কথা হয়েছিল কী না সেটা নিয়েও সংশয় থাকতে পারে আপনার। কারণ এর পরও তো উন্নতির কোনো ছাপ নেই বার্সেলোনার খেলায়।
লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদ আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ সুযোগ হাতছাড়া করেছে বলেই এখনও শীর্ষস্থানটা দখলে রাখতে পেরেছে বার্সেলোনা। এর্নেস্তো ভালভার্দের অধীনে প্রথম মৌসুমে লিগে বার্সা হেরেছিল মাত্র এক ম্যাচ, পরের বার ৩ ম্যাচ। এবার ১১ ম্যাচেই তিনবার হেরে বসেছে বার্সা।
ভালভার্দের অধীনে অন্তত লা লিগায় স্বস্তি এতোদিন মিলেছিল বার্সার। দুই মৌসুমে দুইবার স্পেনের চ্যাম্পিয়ন- কাজটা সহজ নয় মোটেও। ভালভার্দেকে তার প্রাপ্য কৃতিত্বটা এখানে দিতে হবে। তবে দলে লিওনেল মেসি মানের পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় থাকলে সেই কৃতিত্ব আবার কিছুটা কমেও যাবে ভালভার্দের। লা লিগার শিরোপা তাই যথেষ্ট নয় বার্সার জন্য।
প্রথম বছর রোমা, পরের বার লিভারপুল- চ্যাম্পিয়নস লিগে ভালভার্দের বার্সেলোনা পর পর দুইবার নিয়েছে নাটকীয় বিদায়। টুর্নামেন্ট থেকে বাদ যাওয়াটা মূল কারণ নয়, যেভাবে বার্সা খেই হারিয়েছে সেটা দিয়েই বিচার করা হয়েছে তার দলকে। এর পরও খেলোয়াড় ও বোর্ড তার ওপরেই ভরসা রেখেছিল। কিন্তু তৃতীয় মৌসুমে পরিবর্তন কি আনলেন ভালভার্দে?
স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে প্রথম লেগের ম্যাচের কথাই ধরা যাক, শুরুতে এগিয়ে গিয়েও এক মুহুর্তের জন্য ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছিল না বার্সার কাছে। রক্ষণ, মিডফিল্ড খাপছাড়া- কারও সঙ্গে কারও সংযোগ নেই। চেক প্রজাতন্ত্রের ক্লাবের বিপক্ষে বার্সার খেলা একটা সময় খেলা মনে করিয়ে দিয়েছে রোমা আর লিভারপুলের বিপক্ষে বার্সাকে। মাঠের কেউ জানেন না কী হচ্ছে, ভালভার্দেও ডাগ আউটে দিশেহারা।
এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সা যে চারটি ম্যাচ খেলেছে তার সবগুলোতে একই অবস্থা বার্সার। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত সব সেভ করে জার্মানি থেকে বার্সাকে এক পয়েন্ট জুটিয়ে দিয়েছিলেন টের স্টেগান। ইন্টার মিলান ন্যু ক্যাম্পে গিয়ে ৩২ ম্যাচ পর অ্যাওয়ে দল হিসেবে জয় পেয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলে। লুইস সুয়ারেজের দুইটি দুর্দান্ত মুহুর্তে পরে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে বার্সা। তবে মাঠের খেলায় দলগত পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে কোনোভাবেই সেদিন ইন্টারের চেয়ে বার্সাকে এগিয়ে রাখার অবস্থা নেই। আর স্লাভিয়া প্রাগ দুই লেগেই প্রমাণ করে দিয়েছে চাপে ফেললেই মচকে দেওয়া সম্ভব এই বার্সাকে। আর চাপে ফেলাটা খুব কঠিন কিছুও নয়।
লা লিগায় শেষ ম্যাচে লেভান্তের বিপক্ষে এক গোলে এগিয়ে ছিল বার্সেলোনা। বাকি ছিল ২৩ মিনিট। এরপর সাত মিনিটের ঝড়ে লন্ডভন্ড তারা। ৩-১ গোলের হারের ব্যবধান আরও বড় হতে পারত সহজেই। বার্সার খেলা দেখে মনে হতে পারে দলটা সঙ্কটময় মুহুর্ত পার করছে। এসব কিছুই ইঙ্গিত করছে রোমা বা লিভারপুল- কোনো অভিজ্ঞতা থেকেই এখনও কিছু শেখেনি বার্সা।
বার্সায় আর্জেন্টিনার মেসির ছায়া
দলে মেধাবী ফুটবলারের অভাব নেই। এর পরও মেসিনির্ভরতা কমার চেয়ে বরং দিন দিন আরও বাড়ছে বার্সেলোনার। অথচ মেসি ছাড়া ম্যাচ জেতার মতো সবধরনের সক্ষমতাই আছে দলটার। এই ব্যর্থতার দায় ভালভার্দে এড়াবেন কী করে?
জাভি-ইনিয়েস্তা দল ছাড়ার পর মেসি মূলত খেলছেন মিডফিল্ডারের ভূমিকায়। এর পরও যে প্রতি মৌসুমে ভুরি ভুরি গোল করে যাচ্ছেন সেটা তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে। কিন্তু যে ম্যাচে মেসি খেই হারাচ্ছেন সে ম্যাচে অন্য কেউ এগিয়ে আসছেন না। স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটা ২০১২ সালের পর প্রথম- যেবার ঘরের মাঠে মেসি কোনো গোল বা অ্যাসিস্ট কিছুই করতে পারেননি। এর পরও ওই ম্যাচে বার্সার সেরা খেলোয়াড় মেসিই। বাকিরা কতখানি অকার্যকর হয়ে পড়েছেন তার ছোট একটি উদাহরণ মাত্র এই ঘটনা।
এই বার্সেলোনা সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে আর্জেন্টিনার কথা। জাতীয় দলের হয়ে মেসি যখন মিডফিল্ডে খেলেন তখন আক্রমণে তাকে সঙ্গ দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অ্যাটাকিং থার্ডে থাকলে তখন নিঃসঙ্গ সময় কাটাতে হয় তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগের অভাবে। অথচ আর্জেন্টিনার চেয়ে এই বার্সেলোনা দলের সামর্থ্য কাগজে-কলমে কয়েক গুণ বেশি।
দুই বছরে বার্সার চ্যাম্পিয়নস লিগের রেকর্ডও মেসি নির্ভর। প্রথম মৌসুমে আন্তোনিও কন্তের চেলসির বিপক্ষে প্রায় একাই জিতিয়ে দিয়ে মেসি দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। ন্যু ক্যাম্পে রোমার বিপক্ষে প্রথম লেগেও উজ্জ্বল ছিলেন মেসি। রোমে পারেননি, পারেনি বার্সাও, ধ্বস নামিয়ে সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় বার্সার। পরেরবার দ্বিতীয় রাউন্ড কোয়ার্টার ফাইনালের পর সেমিফাইনালের প্রথম লেগেও দুর্দান্ত খেললেন মেসি। লিভারপুলের বিপক্ষে অ্যানফিল্ডে মেসি যেদিন নীরব, সেদিন তার সঙ্গে যোগ দিলেন আরও এগারো জন। ফলটা তো সবারই জানা। সেবার গ্রুপ পর্বে টটেনহাম ও ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচগুলোতে বার্সার ভঙ্গুর দশার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সবকিছু পরে সত্যি হয়েছে অ্যানফিল্ডে। আর এবার তো শুরু থেকেই ভেঙে পড়ার দশা বার্সার।
বার্সেলোনার আইডেন্টিটি কই?
ভালভার্দে প্রথম দুই মৌসুমে দলকে খেলিয়েছেন ৪-৪-২ ফর্মেশনে। ট্যাকটিকসের হিসাবে বার্সেলোনার জন্য আমূল এক পরিবর্তন। এবার অবশ্য ৪-৩-৩ এ চেষ্টা করে দেখছেন ভালভার্দে। এটুকু বোধ হয় জোর দিয়েই বলা যায়- এখন পর্যন্ত নতুন কৌশলে সফল হতে পারেননি ভালভার্দে।
দল হিসেবে প্রতিপক্ষকে প্রেস করার যে সুনাম বার্সার ছিল সেটাও হারিয়েছে ভালভার্দের দল। প্রতিপক্ষের পায়ে বল গেলে এখন আর গলা চেপে ধরে না এই দলটা। সার্জিও বুস্কেটস চ্যাম্পিয়নস লিগে চার ম্যাচ খেললেও একবারও পুরো ৯০ মিনিট খেলেননি। লিগেও নিয়মিত বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে তাকে। বয়সের কারণে সেটা অনুমিতও। নতুন আসা ফ্রাঙ্কি ডি ইয়ং দারুণ মানিয়ে নিয়েছেন বার্সার মিডফিল্ডে। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রতিটি ম্যাচে ১০ কিলোমিটারের বেশি কভার করেছেন তিনি। কিন্তু এর বেশি একা আর কি করবেন ডি ইয়ং? মিডফিল্ডে তার সঙ্গী আর্থারকে রক্ষণে মনোযোগী মনে হচ্ছে এবার বেশি। আর্তুরো ভিদাল উলটো, তিনি আক্রমণে বেশি মনোযোগী। আর ইভান রাকিটিচ তো ক্লাব ছাড়ার দিন গুণছেন। সবমিলিয়ে খাপছাড়া বার্সার মিডফিল্ড।
বল হারালেই তাই রক্ষণের ওপর চাপ পড়ছে বেশি। আর সেই চাপ সামালও দিতে পারছেন না জেরার্ড পিকেরা। ফলাফল- চ্যাম্পিয়নস লিগে এখন পর্যন্ত চার ম্যাচে গড়ে প্রায় সাড়ে তিনটি করে গোল আটকাতে হয়েছে টের স্টেগানকে। লিগেও প্রায় প্রতি ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ সব সেভ যাচ্ছেন জার্মান গোলরক্ষককে। তার অবদান বেশিরভাগ সময় থেকে যাচ্ছে আড়ালে। এসব কিছু আর যাই হোক, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে চাওয়া দলের সঙ্গে বড্ড বেমানান।
নেইমার নাটকের পর...
বার্সেলোনার আক্রমণভাগের পেছনে খরচ ৩৪৫ মিলিয়ন ইউরো। এত পরিমাণ অর্থ ঢেলেও আক্রমণভাগে সঠিক কম্বিনেশনটাই খুঁজে পাচ্ছে না বার্সা। উসমান ডেম্বেলে নিজের তৃতীয় মৌসুমে এরইমধ্যে দুইবার ইনজুরিতে পড়েছেন। স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে ৬৫ মিনিটে তিনি যতগুলো সুযোগ তৈরি করেছেন তার চেয়ে বেশি বদলি হয়ে নেমে ২৫ মিনিট সময়ের ভেতর করে দেখিয়েছেন আনসু ফাতি। অ্যান্টোয়ান গ্রিযমান নিজের পজিশনেই খেলতে পারছেন না, সেরাটা এখনও দেখাতে না পারার দোষ তাই শুধুমাত্র তার ওপরেই চাপানো যায় না।
দলবদলে নেইমারকে নিয়ে এবার জলঘোলা হয়েছে অনেক বেশি। মাত্রাটা এতোটাই বেশি যে জেরার্ড পিকেরা দলবদলের তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এখনও সাক্ষাৎকারে নিয়মিত নেইমার ইস্যু টেনে আনছেন। নিজেদের পকেটের টাকা দিয়েও খেলোয়াড়রা এবার নেইমারকে ভেড়াতে চেয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন পিকে। নেইমারকে বার্সায় ফেরাতে না পারায় খেলোয়াড়দের অসোন্তোষ বা হতাশা যেটাই থাকুক না কেন, সেটা মাঠের খেলায় প্রভাব ফেলছে না তো?
মেসি-গ্রিযমানের সম্পর্ক নিয়েও কয়েক রকমের খবর আছে স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যম গুলোয়। এই দুইজনের ভেতর সম্পর্ক এখনও জমে ওঠেনি, মাঠেও না, মাঠের বাইরেও না। ‘উড়ো খবর’ গুলোও উড়িয়ে দেওয়ার উপায় কই?
মেসি-পিকেরা ক্লাবের সঙ্গে আছেন বহুদিন ধরে। ড্রেসিংরুমে তাদের বড় সড় প্রভাব থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোচের দায়িত্ব হলো নতুনদের সঙ্গে পুরনোদের মেলবন্ধনের পর দল হিসেবে দৃঢ়তা অর্জন করা। এর্নেস্তো ভালভার্দের কি সে ক্ষমতা আছে? বা কখনও ছিল? এসব নিয়ে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। প্রচ্ছন্নভাবে নেইমারের দলবদলের নাটকের প্রভাবটাও তাই ফেলে দেওয়ার মতো যুক্তি নয়।
ভালভার্দে সরে যাওয়াই একমাত্র উপায়?
স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে মেসির শরীরী ভাষা বলে দিয়েছে নিজেদের পারফরম্যান্স নিয়ে রীতিমত বিরক্ত তিনি। মেসি চাইলে কোচ বদলে যায় বার্সার- এমন একটা ধ্যান-ধারণার চল আছে বেশ। অবশ্য এই তথ্যের সত্য-মিথ্যা অজানা থাকবে চিরকাল। বার্সেলোনা বোর্ডের সমর্থন এখনও আছে ভালভার্দের ওপর। দুইবার অমনভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায়ের পরও সীমাহিন ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে বার্সা বোর্ড। মেসি চাইলে ধৈর্য্যের বাধটা ভাঙতে সময় লাগার কথা নয় বেশি।
ভালভার্দে দলকে উজ্জীবিত করতে পারেননি, নিজের দর্শনও প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি পুরোপুরিভাবে। এই দল আপাতত সামর্থ্যের বেশিরভাগটাই দেখাতে পারছে না মাঠে। এর দায় কোচ ছাড়া আর কে নেবেন? বেশকিছু জায়গায় এখনও ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বার্সা। ভালভার্দে আর বার্সার বিক্রিয়া আটকে আছে এক জায়গাতে, সঞ্চারণ শক্তির অভাবে। সবরকম ইঙ্গিত মাঠের ফুটবলেই আছে। এখান থেকে রাতারাতি উন্নতি আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।