কিক অফের আগে: অপরাজেয় অ্যানফিল্ডে সিটির প্রতিপক্ষ লিভারপুল এবং ইতিহাস
কবে, কখন
লিভারপুল-ম্যানচেস্টার সিটি
প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯-২০
অ্যানফিল্ড
১০ নভেম্বর, রাত ১০.৩০
মৌসুমের আর মাত্র তিন ম্যাচ বাকি তখন। ২০১৮-১৯ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাপ্রত্যাশী দুই দল ম্যানচেস্টার সিটি এবং লিভারপুলের পয়েন্টের ব্যবধান মাত্র ১। ২৬ এপ্রিল হাডার্সফিল্ডকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে সিটিকে টপকে গেল ’অল রেড’রা। দু’দিন পর বার্নলির মাঠ টার্ফ মুরে কোনোভাবেই গোলের দেখা পাচ্ছিল না সিটি। লিভারপুল হয়তো তখন ১৯৯০-এর পর প্রথমবার লিগ জেতার স্বপ্নে বিভোর।
কিন্তু তখনই লিভারপুলকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলেন সিটি স্ট্রাইকার সার্জিও আগুয়েরো, ২০১১-১২ মৌসুমে যার গোলে অবসান ঘটেছিল সিটির ৪৪ বছরের লিগ শিরোপা জয়ের। বের্নার্দো সিলভার পাস থেকে তার শট লাইন থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন বার্নলির ম্যাট লোটন। কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য বল অতিক্রম করল গোললাইন। প্রিমিয়ার লিগ যেন ফিরে গেল এ বছরের জানুয়ারিতে। ইতিহাদ স্টেডিয়ামে সাদিও মানের শট অবিশ্বাস্যভাবে গোললাইন থেকে ফিরিয়ে দিলেন জন স্টোনস, কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য গোলবঞ্চিত হল লিভারপুল। সেদিন ২-১ গোলে জিতে লিভারপুলের অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভেঙে দিল সিটি, ঐ ম্যাচটিই হয়ে দাঁড়াল ব্যবধান।
শেষ পর্যন্ত ঐ কয়েক সেন্টিমিটারই পার্থক্য হয়ে দাঁড়াল লিভারপুলের দীর্ঘশ্বাস এবং সিটির উল্লাসের। ৯৭ পয়েন্ট নিয়েও লিগ জেতা হল না লিভারপুলের, ১ পয়েন্ট বেশি নিয়ে শেষ হাসল সিটিই। গত মৌসুম থেকেই মূলত প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে হাইভোল্টেজ ফিক্সচার হিসেবে পরিচিত হল লিভারপুল-সিটির মহারণ। অনেকের মতে, এই ম্যাচটিই প্রিমিয়ার লিগের ‘এল ক্লাসিকো’।
নব্বইয়ের দশক বা একবিংশ শতাব্দীর চিরাচরিত প্রিমিয়ার লিগের চিত্রনাট্য বদলে গেছে অনেকটাই, বিশেষ করে গত বছর তিনেকে। ইউনাইটেড, চেলসি, আর্সেনালরা চলে গেছে পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায়, মূল চরিত্রে এসেছে লিভারপুল এবং সিটি। পেপ গার্দিওলার সিটি আগে থেকেই ছিল অদম্য, কিন্তু গত দুই বছরে টানা দুই চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলা লিভারপুলই একমাত্র দল, যারা এখন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সিটি লিগ জয়ে- স্বীকার করেছেন আগুয়েরো নিজেই।
প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের মত এত ধারাবাহিকভাবে গার্দিওলার দলকে সমানে সমান টেক্কা দিতে পারেনি কেউই। অবশ্য এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে লিভারপুলকে মূলচরিত্রে আনার পেছনে যার কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি, সেই ক্লপকে গার্দিওলার নেমেসিস মনে করেন অনেকেই। গার্দিওলা ব্যাটম্যান হয়ে থাকলে ক্লপ হবেন জোকার, গার্দিওলা সুপারম্যান হয়ে থাকলে ক্লপ হবেন লেক্স লুথার। কোচিং ক্যারিয়ারে নিজের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মরিনহোকে ২১ দেখায় ১০বার হারিয়েছেন পেপ, হেরেছেন মাত্র ৫বার।
তবে ক্লপের বিপক্ষে ব্যক্তিগত রেকর্ড সুবিধার নয় তার। ১৭ দেখায় গার্দিওলাকে ৮বার হারিয়েছেন ক্লপ। শুধু দুই ম্যানেজারের ব্যক্তিগত দ্বৈরথ নয়, অ্যানফিল্ডে সিটির সাথে লিভারপুলের লড়াইটাও একপেশে। ২০০৩-এর পর থেকে লিভারপুলের মাঠে জিততে পারেনি তারা। গত বছর অ্যানফিল্ডে চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ আটেও সিটিকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল সিটি।
পরিসংখ্যান, সাম্প্রতিক ফর্ম- গত মৌসুমেও এসব ছিল লিভারপুলের পক্ষেই। কিন্তু ছিল না একটা জিনিস, ‘চ্যাম্পিয়নস ইন্সটিঙ্কট’। শেষদিকে গোল করে পয়েন্ট ছিনিয়ে আনা, ভাল না খেলেও জেতার দিক দিয়ে লিভারপুল কিছুটা পিছিয়েই ছিল। কিন্তু এবার দৃশ্যপট ভিন্ন। লিগে নিজেদের শেষ চার ম্যাচে (লেস্টার, ইউনাইটেড, স্পার্স, অ্যাস্টন ভিলা) শেষদিকে গোল করে ড্র বা জয় ছিনিয়ে এনেছে লিভারপুল। প্রতিবছরই লিভারপুল সমর্থকের ‘দিস উইল বি আওয়ার ইয়ার’ পরিণত হয়েছে রীতিমত বিদ্রূপে। কিন্তু এবার লিভারপুলের হাতেই লিগ শিরোপা দেখার সম্ভাবনাকে এগিয়ে রাখছেন অ্যালেন শিয়েরাররা।
লিভারপুল নিয়ে আলোচনা বেশি হলেও অবস্থা যেমনই হোক; সিটিও যে হাল ছাড়বে না শেষ পর্যন্ত, সেটা অনুমিতই। কিন্তু হারতে ভুলে যাওয়া লিভারপুলের সাথে এই ৬ পয়েন্টের ব্যবধানে কমিয়ে আনা কতটা কষ্টসাধ্য- সেটা ভালমতই জানেন গার্দিওলা। কিন্তু জয়টা হয়তো সিটিরই দরকার বেশি। ড্র করলেও ব্যবধান থাকবে একই, সিটি হারলে হয়তো অ্যানফিল্ডেই লেখা হয়ে যাবে ২০১৯-২০ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নদের নাম।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকলেও অবশ্য লিভারপুলকে ঠিক অপরাজেয় বলা যাবে না। সিটির বিপক্ষে জোয়েল মাতিপকে পাচ্ছে না লিভারপুল। ভার্জিল ভ্যান ডাইকের সাথে দেয়ান লভ্রেনকেই দেখা যাবে হয়তো। লিভারপুলের ‘উইক লিঙ্ক’ হিসেবে হয়তো লভ্রেনকেই দেখবে সিটি। সালাহ-ফিরমিনো-মানে ছাড়াও আক্রমণে লিভারপুলের অন্যতম উৎস দুই ফুলব্যাক।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইউনাইটেড দেখিয়েছে, ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ড এবং অ্যান্ডি রবার্টসনকে দমিয়ে রাখতে পারলে আক্রমণে লিভারপুলকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব। আর্নল্ড-রবার্টসন দুজনই আক্রমণেই সময় কাটান বেশি, তাই প্রতি-আক্রমণে দুই প্রান্তে পাওয়া ফাঁকা জায়গা দিয়ে সুযোগ তৈরি করতে পারেন স্টার্লিং-মাহরেজরা। আর মাঝমাঠে লিভারপুলের প্রাণভোমরা ফাবিনহোকে কড়া মার্কিংয়ে রাখতে পারলে লিভারপুলকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব।
লিভারপুলের চেয়ে দূর্বলতা হয়তো সিটিরই বেশি। ইনজুরির কারণে লাপোর্তে, এডারসন, রদ্রি, ডেভিড সিলভার কাউকেই পাচ্ছেন না গার্দিওলা। এডারসনের বদলে প্রিমিয়ার লিগে দেড় বছর পর নামবেন ক্লদিও ব্রাভো, মৌসুমের শুরুতে কমিউনিটি শিল্ডে তার কারণেই লিভারপুলকে টাইব্রেকারে হারিয়েছিল সিটি। রক্ষণে ফিট ডিফেন্ডারদের ফর্ম নিয়েও দুশ্চিন্তায় গার্দিওলা। ফর্মে নেই নিকোলাস অটামেন্ডি, জন স্টোনস। অগত্যা ফার্নান্দিনহোকেই সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলাতে হচ্ছে গার্দিওলাকে।
লিভারপুলের বিপক্ষে মাঝমাঠে তার অভাবটা ভোগাতে পারে সিটিকে। ফার্নান্দিনহো মাঝমাঠে খেললে রক্ষণে নামবেন অটামেন্ডি-স্টোনস; রীতিমত উভয় সংকটেই পড়েছেন গার্দিওলা। ফার্নান্দিনহোকে রক্ষণে খেলালে মাঝমাঠে তার জায়গায় খেলবেন ইলকে গুন্ডোয়ান, যিনি রক্ষণের চেয়ে আক্রমণাত্মক বেশি। রক্ষণের মত মাঝমাঠ নিয়েও তাই দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে গার্দিওলাকে।
প্রিমিয়ার লিগের ‘এল ক্লাসিকো’ মর্যাদা পাওয়া লিভারপুল-সিটি ম্যাচের আগে ক্লপ বা গার্দিওলা- কেউই কথার লড়াইয়ে জড়াননি তেমন। কিন্তু কিছুটা স্বভাববিরুদ্ধ হলেও এবার ম্যাচের আগে কথার লড়াইটা শুরু করেছেন গার্দিওলাই, মানের বিরুদ্ধে এনেছেন ডাইভ দেওয়ার অভিযোগ। ক্লপ বা মানে- কেউই অবশ্য তাতে কর্ণপাত করেননি তেমন।
কিন্তু কথার লড়াইয়ে গার্দিওলার টোপকে অনেকেই দেখছেন চাপে থাকা একজন ম্যানেজারের প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবয়ে বিচলিত করার চেষ্টা হিসেবে। ক্লপ বা মানের প্রতিক্রিয়া দেখে তাতে যে সফল হচ্ছেন গার্দিওলা- সেটা হয়তো বলা যাচ্ছে না।
সম্ভাব্য একাদশ
লিভারপুল (৪-৩-৩): অ্যালিসন; আলেকজান্ডার-আর্নল্ড, লভ্রেন, ভ্যান ডাইক, রবার্টসন; হেন্ডারসন, ফাবিনহো, ওয়াইনাল্ডাম; সালাহ, ফিরমিনো, মানে
ম্যান সিটি (৪-৩-৩): ব্রাভো; ওয়াকার, ফার্নান্দিনহো, স্টোনস, মেন্ডি; গুন্ডোয়ান, ডি ব্রুইন, বের্নার্দো; মাহরেজ, আগুয়েরো, স্টার্লিং
সংখ্যায় সংখ্যায়
- প্রতিপক্ষের মাঠে নিজেদের শেষ ১২ অ্যাওয়ে ম্যাচের ১১টিতেই জিতেছে সিটি
- লিভারপুলের বিপক্ষে শেষ ৫ ম্যাচে একবার হেরেছে সিটি
- প্রিমিয়ার লিগে শেষ ৫০ ম্যাচে মাত্র ১বার হেরেছে লিভারপুল