ওমান দিয়ে মানদন্ডের বিচার না হোক জামালদের
ওমানের কাছে বাংলাদেশের হারটা অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। মাসকাট থেকে ড্র নিয়ে ফিরতে পারলে সেটা হয়ে যেত বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সফল ফল। যেটা হওয়ার কথা সেটাই হয়েছে। হারের পর আফসোসও সঙ্গী হয়নি বাংলাদেশের। একপেশে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছে। এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল না?
প্রথমার্ধে বাংলাদেশ-ওমানের খেলা দেখে ২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি ম্যাচের কথা মনে পড়ে যেতে পারে আপনার। দ্বিতীয় লেগের সেমিফাইনালে সেবার কোমর বেঁধে হোসে মরিনহোর ইন্টার মিলান রক্ষণে পড়ে ছিল পুরো ৯০ মিনিট। ওই আমলের বার্সেলোনাকে আটকানোর ওই একটা উপায়ই ছিল। ইন্টার আর বার্সেলোনার পার্থক্য তখন উনিশ-বিশ। সেটা আঠারো-বিশও হতে পারে। বাংলাদেশ ওমানের বিপক্ষে প্রথমার্ধে, অর্থাৎ ম্যাচের অর্ধেকটা সময় একই কৌশলে ওমানকে হতাশ করে যাচ্ছিল। এখানে দুই দলের পার্থক্য দশ-বিশের কাছাকাছি কিছু একটা হওয়ার কথা। ফিফা র্যাঙ্কিং বলছে, একশ ধাপ।
দুই দলের মানের বিরাট পার্থক্যটা সময়ের সঙ্গেই আরও বেশি করে ফুটে উঠেছে মাঠের খেলায়। এক গোল খাওয়ার পর বাংলাদেশকে আক্রমণে উঠতেই হত, সেটা করতে গিয়ে শেষ পঁচিশ মিনিটে বাংলাদেশ হজম করেছে আরও তিন গোল। বাংলাদেশ কোচ জেমি ডে পুরো ম্যাচে বদলি করিয়েছেন একটি। সেটাও ৯০ মিনিটে। কেন আরও আগেই তিনি কৌশল বদলালেন না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ ফুটবলে ডের হাত ধরে উন্নতি করছে বলে তিনি সমালোচনার উর্ধ্বে চলে যাননি। বাংলাদেশ কোনোদিন তার হাত ধরে বিশ্বকাপ জিতলেও হয়ত সেই সুযোগ নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে ওমানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আসলেই বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বিচার করা সম্ভব?
ম্যাচের পর বাংলাদেশ কোচের কথায় সে জবাব আছে, “সত্যি বলতে ওমানের এই দলে আমাদের একজন খেলোয়াড়েরও সুযোগ হবে না। আমি অসম্মান করে বলছি না। ওমান আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। বরং বাংলাদেশ যেভাবে ম্যাচের বড় একটা সময় ওমানকে আটকে রেখেছিল- সেটাই পজিটিভ দিক। এটা আমাদের জন্য দারুণ শিক্ষা। বড় দলগুলোর বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল হজম না করা, কম গোল হজম করা-এগুলোর দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে।”
ওমানের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম গোল হজম করেছিল ৪৮ মিনিটে। প্রথমার্ধে বাংলাদেশ যেভাবে রক্ষণ করছিল, তার সঙ্গে বড্ড সাংঘর্ষিক খালদির গোলের চিত্রটা। ইয়াসিন খান বলের নাগাল পাননি, রিয়াদুল হাসান রাফিও ফাঁকা জায়গা করে দিয়েছিলেন গোলদাতাকে। বড় দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ মূলত খেলে আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে। ওই গোলটা ৪৮ মিনিটের বদলে ৫৮ মিনিটে হলেও বোধ হয় বাংলাদেশের হারের ব্যবধান কম হয় আরও! ডে নিজেও ম্যাচের পর এই কথাই বলেছেন, বিরতির পর গোল হজম করাটাই কাল হয়েছে তার দলের।
এই কথাগুলো একদিক দিয়ে আশা জাগানিয়াও। ২০১৬ সালে ভুটানের কাছে হারের পর প্রায় দেড় বছর নির্বাসনে ছিল জাতীয় দল। এই দলটা একসঙ্গে খেলা শুরু করেছে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। মাত্র ছয় মাস আগেও মিডফিল্ডে পর পর তিনটি পাস দিতে ধুঁকতে হত বাংলাদেশকে। কম্বিনেশন প্লে তো মরীচিকা। সেসব পেছনে ফেলে বাংলাদেশ যে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছে সেটার প্রমাণ আছে ওমানের বিপক্ষেও। বেশিরভাগ সময় নিজেদের অর্ধ থেকে কোনোমতে বল ক্লিয়ার করতে দেখা গেছে বাংলাদেশকে, কিন্তু এর ভেতর প্রথমার্ধে বেশ কয়েকবার গুছিয়ে খেলার চেষ্টাও ছিল। সেটা মিডফিল্ড পর্যন্ত আগানোর পরই খেই হারিয়েছে। বাংলাদেশের উন্নতিকে যদি একটি রাস্তা ধরেন, আর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য যদি গোল হয়, তাহলে এই বাংলাদেশ এখনও আটকে আছে রক্ষণে। সেখান থেকে অন্তত মিডফিল্ড পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তায় আপাতত বাংলাদেশের অবস্থান।
ডে জানিয়েছেন ম্যাচের পর মুষড়ে পড়েছেন বাংলাদেশ খেলোয়াড়রা। অথচ কয়েক বছর আগে একটি আন্তজার্তিক ম্যাচ খেলতে পারলে সেটাই অর্জন মনে হত এই ফুটবলারদের। ওমান নিয়মিত এশিয়া কাপ খেলছে, সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাও হয় না। সেই দলের বিপক্ষে হার প্রত্যাশিত, কিন্তু অবধারিত নয়- সেটা এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা।
ফুটবলের মানচিত্রটা পৃথিবীর মতো বিশালাকায়। এখানে হুট করে উন্নতি অসম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার কথাই ধরা যাক। সেখানে কি বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে? সেখানে বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ তো অবাস্তব স্বপ্ন। এই সময়টা সমর্থক হিসেবে আপনার ধৈর্য্যের, ধৈর্য্য পরীক্ষার।
বাংলাদেশের বিচার হোক ভারতের ম্যাচ দিয়ে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। কাতার, ওমানরা ভেনচিত্রে বৃত্তের বাইরে থাক আপাতত। ওমানের বিপক্ষে দারুণ একটি ফল বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফকে এক ধাক্কায় উঠিয়ে দিতে পারত। কিন্তু হারটা উন্নতির ধারাবাহিকতায় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
অতীত থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকার সুবাদে সরাসরি বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেবার ভারত প্রাক-বাছাই খেলে উঠেছিল দ্বিতীয় পর্বে। অস্ট্রেলিয়া, জর্ডানের মতো দলের কাছে একের পর এক বড় ব্যবধানের হারের পর আত্মবিশ্বাস যখন তলানীতে এরপরই ভুটানের কাছে হেরে অগ্রযাত্রা তো দূরে থাক, যাত্রাই থেমে গিয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবলের। এবারের প্রতিপক্ষরাও কম শক্তিশালী নয়। এবার অন্তত একটি জিনিস প্রমাণ হয়েছে, শুধু অংশ নেওয়ার জন্য খেলছেন না জামালরা। বাছাই করার লক্ষ্যেও খেলছেন না, খেলছেন উন্নতির ধারাটা চালু রাখতে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কাতারের বিপক্ষে ভুরি ভুরি গোলের সুযোগ তৈরি, কলকাতায় ভারতের স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শককে প্রতিপক্ষ বানিয়েও প্রায় জিতে আসা, এর পর ওমানের সঙ্গে এক অর্ধ গোলশূন্য রাখা- এসবকে প্রেরণা হিসেবে কাজে লাগাতে না পারলে শুধু নেই নেই আর নেই এর ফুটবলে ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস জুটবে কোত্থেকে?
আপাতত তাই ডের কথার ওপরই ভরসা রাখতে হচ্ছে। ওমানের বিপক্ষে ফলটা কোনোভাবেই তিনি ‘সেটব্যাক’ মানতে রাজি নন শিখতে চান ভুল থেকেই। বাছাই পর্বে বাংলাদেশের অ্যাওয়ে ম্যাচ বাকি আর একটি, সেটা কাতারের মাঠে। সেখানেও এমন কিছু হতে পারে- সেটা আগেভাগেই সতর্ক করে দিয়েছেন ডে। এর আগ পর্যন্ত ওই ভুলগুলোই শুধরে নিতে থাকুক বাংলাদেশ, আর রক্ষণ থেকে অন্তত মিডফিল্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাক উন্নতির ধারাবাহিকতা। অযাচিত চাপে মচকে না গিয়ে, উন্নতি হোক, সেটা ধীরেই হোক। স্থায়িত্ব থাকুক। থমকে গেলেই তো আবার শূন্য থেকে শুরুর শঙ্কা জেঁকে বসবে।