বৃষ্টিস্নাত ইউরোপে দুর্বার টের স্টেগান, লেস্টারের রোমাঞ্চ
ইউরোপিয়ান ফুটবলের গত দুইদিনের হালচাল। কেমন করল কোন দল, কী পাবে কারা?
১) আড়ালে থেকে গেলেন টের স্টেগান
লিওনেল মেসি যথারীতি আরও একবার শিরোনাম কেড়ে নিয়েছেন। নেওয়ারই কথা অবশ্য। বৃষ্টিস্নাত ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোতে এক মুহুর্তের জাদুতে জয় এনে দিয়েছেন বার্সেলোনাকে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে হারানোয় বার্সা উঠে গেছে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন একবার বলেছিলেন একজন ভালো গোলরক্ষক থাকা মানে মৌসুমে অন্তত ১৫ পয়েন্টের নিশ্চয়তা পাওয়া। মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান প্রতি মৌসুমেই ১৫ পয়েন্টের বেশিই এনে দিচ্ছেন। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ-বার্সেলোনার ম্যাচে ছোট আরেকটি লরাই ছিল টের স্টেগান আর ইয়ান অবলাকের ভেতরও।
অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে ১৭ মিনিটে হেরমোসোর যে শট ঠেকিয়ে দিয়েছেন তাতে নিজেকে বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক দাবি করতে পারেন টের স্টেগান। মৌসুমের সেরা সেভও হয়ে যেতে পারে সেটা। ওখানেই থেমে থাকেননি, আলভারো মোরাতার আরেকটি নিশ্চিত গোলও প্রথমার্ধে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন জার্মান গোলরক্ষক। বার্সাও তাই ছিটকে যায়নি ম্যাচ থেকে। পরে মেসিই উদ্ধার করেছেন দলকে। এ সপ্তাহে পর্দার পেছনের নায়ক খুঁজতে হলে তাই বেশি কষ্ট করতে হবে না, টের স্টেগান আছেন না?
২) দুই মাদ্রিদ, দুই পথে
শুরুতে নড়বড়ে থাকলেও জিনেদিন জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ সময়ের সঙ্গে ছন্দে ফিরছে। পিএসজির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচটা জিদানের পুরনো রিয়ালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে বারবার। ধারাবাহিকতাটা পরের সপ্তাহেও ধরে রেখেছে রিয়াল। দেপোর্তিভো আলাভেজের বিপক্ষে জয় পেতে অবশ্য খাটতে হয়েছে রিয়ালকে, কিন্তু ম্যাচের লাগাম হাতছাড়া করেনি তারা। টনি ক্রুস ফিরেছেন পুরনো ফর্মে, লুকা মদ্রিচও খারাপ সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন বলেই মনে হচ্ছে। মিডফিল্ডে নতুন প্রাণের সঞ্চার করছেন ফেদেরিকো ভালভার্দেও। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যাওয়ার পর থেকে এই রিয়াল মাদ্রিদ এখন সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল। পয়েন্ট টেবিলও সেরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে। শীর্ষস্থানে রিয়াল নেই, তবে বার্সেলনার সমান ৩১ পয়েন্ট তাদের। দুইদলের এখনও দেখা না হওয়ায় বার্সা আপাতত গোলব্যবধানে এগিয়ে আছে শীর্ষস্থানে।
উলটো চিত্র অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের। ডিয়েগো সিমিওনের দল এখন ছয় নম্বরে, রিয়াল-বার্সার চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে তাদের পয়েন্ট ২৫। বার্সার কাছে হারের পর শিরোপা সম্ভাবনা একরম শেষই হয়ে গেছে অ্যাটলেটিকোর। এই অ্যাটলেটিকো বড় অচেনা। এক গোল যে দলের জয়ের জন্য যথেষ্ট হত তারাই এখন ড্র এর বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্তিম মুহুর্তে গোল খেয়ে বসছে।
এই মৌসুমে বড়সড় একটি পরবির্তন এসেছে অ্যাটলেটিকোর দলে। নিয়িমিতদের অন্তত ছয়জন ক্লাব ছেড়ে গেছেন। নতুনদের নিয়ে শুরু হয়েছে সিমিওনের। সেই পথটা মোটেই মসৃণ না। বার্সার কাছে লিগের মাত্র দ্বিতীয় হারের স্বাদ পেয়েছে অ্যাটলেটিকো। কিন্তু ১৫ ম্যাচের ভেতর তারা ড্র করেছে ৭ বারই। আর শেষ সাত ম্যাচে তারা গোল খেয়েছে মোট ৮টি। এই অ্যাটলেটিকোকে চেনেন আপনি?
৩) লেস্টার রূপকথা, অধ্যায় দুই
২০১৫-১৬ মৌসুমে লেস্টার সিটির লিগ জেতা রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে। সেটাকে উদাহরণ হিসেবে না ধরাই ভালো। এরকম কিছু আবার দেখতে কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে সেটা অসীমতার হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে প্রিমিয়ার লিগের খবর নিয়মিত না রেখে থাকলে এবার একটু চমকেই যাবেন। লিভারপুল আছে সবার ওপরেই, কিন্তু দুইয়ে কারা? লেস্টার সিটি। ১৪ ম্যাচে ৩২ পয়েন্ট নিয়ে ফক্সরা এখন লিভারপুলের চেয়ে আট পয়েন্টে পিছিয়ে। তিনে থাকা সিটি চেয়ে ৩, চারে থাকা চেলসির চেয়ে ৬ আর পাঁচে থাকা টটেনহামের চেয়ে পুরো ১২ পয়েন্টে এগিয়ে লেস্টার সিটি। এ সপ্তাহেও এভারটনকে শেষ মুহুর্তের গোলে হারিয়ে পুরো তিন পয়েন্ট অর্জন করেছেন জেমি ভার্ডিরা। ব্রেন্ডন রজার্সের দলকে শেষ পর্যন্ত শীর্ষ চারে থাকতেও প্রায় অসাধ্য সাধন করতে হবে। কিন্তু পাঁচ বা ছয়ে থাকাও তো অর্জন তাদের জন্য। রূপকথার গল্প রচনার চার বছর পর লেস্টার সিটি মনে করিয়ে দিচ্ছে পুরনো দিনগুলোর কথা। এই রোমাঞ্চ কতোদিন থাকে সেটাই এখন প্রশ্ন।
৪) দুর্ভাগা শুধু অ্যালিসন
ব্রাইটনকের বিপক্ষে লাল কার্ড দেখতে হয়েছিল অ্যালিসনকে। এ সপ্তাহটা কেবল অ্যালিসনেরই মনোমতো হয়নি। বাকিরা সবাই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। সাবেক লিভারপুল ম্যানেজার ব্রেন্ডন রজার্স তো লেস্টার সিটিকে নিয়ে ছুটছেনই। আরেক সাবেক মিডফিল্ডার জঞ্জো শেলভি খুব সম্ভবত শিরোপাও তুলে দিয়েছেন লিভারপুলকে। ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে নিউক্যাসেলের ২-২ এ ড্র করা ম্যাচে শেষ গোলটি করেছিলেন শেলভি। বক্সের বাইরে থেকে ফাঁকা জায়গাটা দেখেছেন, এমন ফাঁকা সাধারণত খুঁজে পাওয়ায় কঠিন। আর দলটা যখন ম্যান সিটি, তখন অতোখানি জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। শেলভি সেটুকু কাজে লাগিয়ে দুর্দান্ত এক স্ট্রাইকে এক পয়েন্ট এনে দিয়েছেন নিউক্যাসেলকে। আর সিটিকে আরও দুই পয়েন্ট দূরে সরিয়ে দিয়েছেন লিভারপুলের কাছ থেকে। সোনায় সোহাগা।
৫) মেসি মেসি মেসি…
প্যাভিলিয়নের বার্সেলোনার ম্যাচ রিপোর্টের ক্যাপশনে একটু মজা করেই লিখা হয়েছিল, পুরো ম্যাচের হিসেবে মেসি হয়ত পাস নম্বরও পেতেন না। কিন্তু ৮৬ মিনিটে যে এক মুহুর্ত এনে দিয়েছেন তাতেই দশ দশ। মন্তব্যটা অবশ্য অনেকে মেসি সমর্থকেরাই পছন্দ করেননি। তবে মেসি যে কাল প্রায় পুরোটা সময়ই নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন সেটা নিয়ে সংশয় নেই।
মেসি বা রোনালদোদের মুন্সিয়ানা এখানেই। প্রতি ম্যাচে তারা অতিমান হয়ে উঠবেন না, আবার এমন কিছু ম্যাচ যাবে যেখানে জ্বলেই উঠতে পারবেন না। মেসি গতকাল এমন একটি ম্যাচই পার করছিলেন। এর পর তার দরকার হলো এক মুহুর্তের জাদু। ওই দিন ঠিক ১০ বছর আগে প্রথমবার ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন মেসি। ষষ্ঠবারের মতো জিততে পারেন পরদিনই।
৬) নিজেকে নতুন করে চেনাচ্ছেন লাউতারো
সিরি আ-তে ইন্টার মিলান যে শীর্ষে উঠেছে তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান লাউতারো মার্টিনেজের। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড ইন্টারে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে এসে নতুন করে চেনাচ্ছেন। অক্টোবরের ১২ তারিখের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২ ম্যাচে তার গোল ১২, অ্যাসিস্ট আছে আরও দুইটি। সবশেষ স্পালের বিপক্ষেও জোড়া গোল করেছেন মার্টিনেজ।
রোমেলু লুকাকুর সঙ্গে তার নতুন জুটি জমেছে বেশ। ফুটবলের নতুন ব্রোমান্সও তারা। দুইজন মিলে এরিমধ্যে করে ফেলেছেন ২৬ গোল। মৌসুমের বড় একটা সময় বাকি, তবে লাউতারো-লুকাকু জুটি নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারে ইন্টার। রোনালদ-দিবালা-হিগুয়াইনরা তো তাদের তুলনা কিছুটা ম্লানই এই মৌসুমে।
৭) একদিন বৃষ্টিতে ইউরোপে…
রিয়াল মাদ্রিদ আর আলাভেজের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল এই সপ্তাহের ইউরোপিয়ান লিগ। প্রথমার্ধে বৃষ্টি না হলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই মেন্ডিজারোজায় শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আর থামেনই। তুরিন, মিলান হয়ে পরদিন মাদ্রিদের ওয়ান্ডার মেট্রোপলিটানোতেও ম্যাচ হয়েছে ঝুম বৃষ্টিতে। আর অতিরিক্ত বৃষ্টিতে খেলাই মাঠে গড়ায়নি ফ্রান্সে। পিএসজি তাই একটি সপ্তাহ কাটিয়েছে বিশ্রামে। মোনাকোর বিপক্ষে ম্যাচ ছিল তাদের, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে মাঠ ভারী হয়ে যাওয়ায় ম্যাচ বাতিল করা হয় পরে। আসলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের অনুভূতিটা নিতে চায়নি তারা!