মেসির রেকর্ড এবং তিন চ্যাম্পিয়নের হতাশার রাত
অবিশ্বাস্য মেসিই যখন স্বাভাবিক
পিটার ড্রুরি বা মার্টিন টাইলার ধারাভাষ্যকারের জায়গায় লেখক হয়ে থাকলে হয়তো মেসিকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহেই লিখতেন ‘উই আর রানিং আউট অফ সুপারলেটিভস টু ডেস্ক্রাইব দিস ম্যান।’ হয়তো অনেকেই মেসির এই নিয়মিত প্রশংসা অতিরঞ্জিত বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে যারা বার্সেলোনার খেলা দেখেন, শুধুমাত্র তারাই জানবেন নিজেকে কীভাবে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন মেসি। আর রিয়াল মায়োরকার বিপক্ষে আবারও বার্সেলোনা সমর্থকদের রাত জাগা সার্থক হিসেবে প্রমাণ করেছেন মেসি।
ম্যাচের আগে ন্যু ক্যাম্পের ৯৩ হাজার দর্শকের সামনে উঁচিয়ে ধরেছিলেন নিজের ষষ্ঠ ব্যালন ডি’অর। বিশ্বসেরা হওয়ার দৌঁড়ে আবারও সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ম্যাচটি মেসি রাঙালেন তার মতই, রেকর্দ ভেঙে। লা লিগায় ২৮৮ ম্যাচে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ৩৪ হ্যাটট্রিক এতদিন ছিল লা লিগার রেকর্ড।
গত মাসেই সেল্টা ভিগোর সাথে হ্যাটট্রিকে রোনালদোর রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছিলেন মেসি। ৪৬২তম ম্যাচে মায়োরকার বিপক্ষে টপকে গেলেন ‘সিআর৭’-কে (৩৫)। তিনটি গোলই ছিল তার ‘ট্রেডমার্ক’, ডিবক্সে বাইরে থেকে বাঁ-পায়ের মাপা শটের নিশানা যেন মার্ভেল অ্যাভেঞ্জার্সের সুপারহিরো ‘হক আই’-এর মতই অব্যর্থ। জাদুকরী বাঁ-পায়ে আক্ষরিক অর্থেই এসব গোলকে রীতিমত ডালভাত বানিয়ে ফেলেছেন মেসি।
এই মৌসুমে বার্সেলোনার ফুটবলারদের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে একাধিকবার। কিন্তু মেসির সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ইনজুরির কারণে লিগে মোটে খেলেছেন ১০ ম্যাচ, তাতেই ১২ গোল নিয়ে লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন তিনিই। সবচেয়ে দুর্দান্ত ব্যাপার হল, লিগে মেসি এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৮১০ মিনিট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী করিম বেনজেমার ১১ গোল করতে লেগেছে ১২১৪ মিনিট। নতুন মৌসুমের শুরু থেকেই দুর্দান্ত মেসির জন্যই একের পর এক গড়পড়তা পারফরম্যান্সের পরও লা লিগার শীর্ষে আছে বার্সেলোনা, নিশ্চিত করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ নকআউটও।
ফেদেরিকো ভালভার্দে: রিয়ালের নতুন গ্যালাকটিকো
এই শতাব্দীর শুরুতে ফিগো, জিদান, বেকহামদের মত এক ঝাঁক বিশ্বমানের তারকা নিয়ে দল সাজিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। ঐ সময় থেকেই রিয়ালের চড়াদামে কেনা ফুটবলারদের ডাকা হয় ‘গ্যালাকটিকো’ নামে। এই মৌসুমে রিয়ালের গ্যালাকটিকো সাইনিং এডেন হ্যাজার্ড। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে হলেও সেই ট্যাগটা নিজের করে নিয়েছেন রিয়ালের তরুণ উরুগুইয়ান মিডফিল্ডার ফেদেরিকো ভালভার্দে। এস্পানিওলের বিপক্ষে আবারও সেটা প্রমাণ করেছেন তিনি।
এস্পানিওলের বিপক্ষে গ্যারেথ বেল, হ্যাজার্ডকে ছাড়া নেমেছিল রিয়াল। কেতাবী নিয়মে বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার হলেও রীতিমত ‘প্লেমেকার’ হিসেবে খেলেছেন ভালভার্দে। আক্রমণ, রক্ষণ- সবখানেই তার উপস্থিতি সরব। দুর্দান্ত সব ট্যাকেলে বল কেড়ে প্রতি-আক্রমণ গড়ে দিয়েছেন, আবার বল পায়ে আক্রমণে পাস বাড়িয়েছেন বেনজেমার জয় নিশ্চিত করা গোলে। বার্সেলোনা শহরের ক্লাবটির বিপক্ষে ম্যাচসেরাও হয়েছেন তিনিই।
গত মৌসুমে হুলেন লোপেতেগি এবং সান্তিয়াগো সোলারিদের দলে সুযগ পেয়েছিলেন, কিন্তু সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। কিন্তু রিয়ালের হটসিটে ফেরার পর জিনেদিন জিদানের প্রথম পূর্ণ মৌসুমে ভালভার্দে ছাড়িয়ে গেছেন সবধরণের প্রত্যাশা। একের পর এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে এতদিন রিয়ালের মিডফিল্ডের অতন্দ্র প্রহরী লুকা মদ্রিচকে বসিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছেন জিদান। শুধু জিদান নন, ভালভার্দে জয় করেছেন বোর্ডের আস্থাও। ২০২৫ সাল পর্যন্ত তার চুক্তি নবায়ন করেছে রিয়াল।
‘রেড ডেভিল’-এ ‘শেষ’ গার্দিওলার সিটির স্বপ্ন
এই মৌসুমে একের পর এক হতাশাজনক ফলাফলে প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষ দশের বাইরেই চলে গিয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। টটেনহাম হটস্পারকে হারালেও ম্যানচেস্টার ডার্বিতে ওলে গানার সোলশারের দলের পক্ষে হয়তো বাজি ধরেননি ‘রেড ডেভিল’দের কট্টর সমর্থকেরাই। কিন্তু ইতিহাদে আহত বাঘের মত ফিরে আসা ইউনাইটেড আবারও প্রমাণ করল, এখনও প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ দলগুলোকে টক্কর দিতে পারে তারা।
অবশ্য ইংলিশ লিগের শীর্ষ দলগুলোর বিপক্ষে ইউনাইটেডের এই মৌসুমের রেকর্ড আগে থেকেই দারুণ। চেলসির বিপক্ষে ৪-০ গোলের বড় জয়, লিভারপুলের থেকে পয়েন্ট ছিনিয়ে আনা, বা হোসে মরিনহোর স্পার্সকে হারানো- এই মৌসুমে শীর্ষ ছয় দলের বিপক্ষে এখনও অপরাজিত ইউনাইটেড। কিন্তু ইতিহাদে সিটি রীতিমত অদম্য, এই বছর হোমে খেলা ২৬ ম্যাচে মাত্র ১বার হেরেছে তারা। কিন্তু এতকিছুর পরও নিজেদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা সিটির বিপক্ষে ভয়ডরহীন ফুটবলই খেলেছেন রাশফোর্ডরা। কাজেও লেগেছে সোলশারের টোটকাটি।
আক্রমণের দিক দিয়ে দুর্দান্ত সিটির বিপক্ষে দারুণ খেলেছেন ম্যাগুয়ের-ওয়ান বিসাকারা। বের্নার্দো-ডি ব্রুইনদের সুযোগই দেননি তারা। তবে সিটির ‘অ্যাকিলিস হিল’ রক্ষণকে প্রথমার্ধে রীতিমত গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইউনাইটেড। রাশফোর্ড-মার্শিয়াল-জেমসের বিদ্যুৎগতির প্রতি-আক্রমণে দিশেহারা মনে হয়েছে সিটিকে।
প্রথমার্ধে দুই গোল দিলেও সুযোগগুলো ভালমত কাজে লাগাতে পারলে হয়তো তিন, চার গোলেও এগিয়ে যেতে পারত তারা। মাঝমাঠে ম্যাকটমিনে-ফ্রেডের ‘ডবল পিভোট’-এ নিষ্ক্রিয় হয়েছে সিটির আক্রমণ। ইউনাইটেডের উল্লাসের রাতে মিলিয়ে গেছে সিটির শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন। লিভারপুলের চেয়ে এখনই ১৪ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে তারা, লেস্টার সিটিও উঠে গেছে দুইয়ে। শেষ পর্যন্ত হয়তো এবারের প্রিমিয়ার লিগে পেপ গার্দিওলার দলের মূল লক্ষ্য হয়তো পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলাই।
‘পরাজিত’ জুভেন্টাস
ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগের ক্লাবগুলোর ভেতর একমাত্র ক্লাব হিসেবে সব প্রতযোগিতায় এতোদিন অপরাজিত ছিল কেবল জুভেন্টাস। লাৎসিওর কাছে ৩-১ গোলে হারের সঙ্গে সিরি আর শীর্ষে ওঠার সুযোগটাও হাতছাড়া করেছে বিয়াঙ্কোনেরিরা। এখন সিরি আর শিরোপা লড়াই হয়ে গেছে তিন দলের। ইন্টার মিলান টপকাতে গিয়ে জুভেন্টাসের তাদের সঙ্গে পয়েন্ট ব্যবধান বেড়ে হয়েছে ২।
জুভেন্টাস প্রথমবার হেরেছে ২০ তম ম্যাচে এসে। এই রেকর্ডে জুভেন্টাসকে যতখানি অপ্রতিরোধ্য শোনাচ্ছে, ততোখানি ছাপ অবশ্য মাঠের খেলায় পাওয়া যায়নি। পুরো ম্যাচ সেভাবে নিয়ন্ত্রণ না করেও শেষদিকে রোনালদো-হিগুয়াইন-দিবালাদের একক কৃতিত্বে উতরে গেছে জুভেন্টাস। দলে অবশ্য নামকরা এতজন ফরোয়ার্ড থাকলে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে যেভাবে হয়েছে সেটা নিয়েই যত কথা।
মিডফিল্ডে সৃজনশীলতার অভাব প্রায় প্রতি ম্যাচেওই ভোগাচ্ছে জুভেন্টাসকে। শেষ ম্যাচে অবশ্য রদ্রিগো বেন্টাঙ্কুর ভালোই সাহায্য করছিলেন রোনালদো-দিবালাদের। তবে তিনি ইনজুরির কারণে ছিটকে যাওয়ার পরই পথ হারিয়েছিল জুভেন্টাস। পরে রোনালদোর গোলে এগিয়ে থেকেও হেরে এসেছে লাৎসিও।
মাউরিসিও সারির বিখ্যাত ‘সারিবলের’ দেখা তাই এখনও মেলেনি জুভেন্টাসের খেলায়। চ্যাম্পিয়নস লিগ যেহেতু অনেকদিন ধরেই জুভেন্টাসের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে- তাই উন্নতির সময়ও ফুরিয়ে আসছে। লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ ডাবল জিততে হলে বড়সড় পরিবর্তনই দরকার এই জুভেন্টাসের।
বায়ার্নের মুকুটে গ্লাডবাখের হানা
গত ৭ মৌসুমের প্রতিটিতেই বুন্দেসলিগার শিরোপা জিতেছিল বায়ার্ন মিউনিখ। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সাথে তার শিরোপা রেসটা অনেকটা একঘেয়েই বানিয়ে ফেলেছিল বুন্দেসলিগাকে। কিন্তু এই মৌসুমে শিরোপাপ্রত্যাশী দুই দলের কেউই নেই জার্মান লিগের শীর্ষে। সবার ওপরে আছে বরুশিয়া মুনশেনগ্লাডবাখ। গত সপ্তাহে বায়ার্নকে হারিয়ে শীর্ষস্থানটা আরও সুসংহত করেছে তারা।
নিজেদের মাঠে ম্যাচের শুরু থেকে অবশ্য চাপে ছিল গ্লাডবাখই। প্রথমার্ধে একাধিক গোলের সুযোগ হাতছাড়া করলেও দ্বিতীয়ার্ধে এসে লিড নেয় বায়ার্ন। তবে কিছুক্ষণ বাদেই সমতায় ফেরে গ্লাডবাখ। ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে লাল কার্ড দেখেন হাভি মার্টিনেজ, পেনাল্টি পায় গ্লাডবাখ। ১২ গজ থেকে দলের রুদ্ধশ্বাস জয় নিশ্চিত করেন রামি বেনসেবিয়ানি। ১৪ ম্যাচ শেষে লিগ টেবিলের ৭-এ নেমে গেছে বাভারিয়ানরা, টেবিলের শীর্ষে গ্লাডবাখের লিডটাও ৭ পয়েন্টেরই। টানা অষ্টম বুন্দেসলিগা জেতার মিশনটা তাই হয়তো কঠিনই হয়ে উঠল লেভানডফস্কি-মুলারদের।
এই মৌসুমে লিগে খারাপ করার জন্যই বরখাস্ত হতে হয়েছিল নিকো কোভাচকে। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ‘ডের ক্লাসিকার’ জিতে সুদিন ফেরানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন কোভাচের বদলি হান্সি ফ্লিক। কিন্তু এক সপ্তাহে রীতিমত দুমড়েমুচড়ে গেছে বাভারিয়ান সমর্থকদের সেসব স্বপ্ন। গত সপ্তাহে বেয়ার লেভারকুসেনের পর এবার গ্লাডবাখের কাছে হার। কোভাচের মত তাই হয়তো চাকরি হারাতে হতে পারে ফ্লিককেও।