২০১৯-এ ফুটবলকে বিদায় বললেন যারা
আগের দশকে ফুটবল শাসন করেছেন তারা। তাদের পায়ের জাদুতে ফুটবলকে করে রেখেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধ। সোনালী সময় পেরিয়ে ক্যারিয়ার সায়াহ্নে এসে বয়সের কাছে হার মেনেছেন তাদের সবাই। ২০১৯ এ উল্লেখযোগ্য যে ফুটবলাররা বুট তুলে রাখলেন তাদের ক্যারিয়ারটাই বছর শেষে আরেকবার ফিরে দেখা।
১. জাভি হার্নান্দেজ
পেপ গার্দিওলার অদম্য বার্সেলোনা, বা ভিসেন্তে দেল বস্কের সর্বজয়ী অমর স্পেন- দু’দলেরই প্রাণভোমরা ছিলেন জাভি। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ, রক্ষণে সাহায্য করা, অসামান্য দূরদর্শীতা, দুর্দান্ত সব সেটপিস; আক্ষরিক অর্থেই জাভি ছিলেন ‘দ্য পারফেক্ট মিডফিল্ডার’। মাত্র ১১ বছর বয়সে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। কাতালানদের হয়ে অভিষেক হল ১৮ বছর বয়সে, ন্যু ক্যাম্পে কাটালেন জীবনের পরের দেড় যুগ।
ফুটবলকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন তিনি, পেয়েছেনও সমানে সমান। বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা, ইউয়েফা সুপারকাপ- জাভির ট্রফিকেসে অভাব নেই কিছুরই। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ‘ট্রেবল’ জেতার পর অশ্রুসজল নয়নে বিদায় জানালেন বার্সাকে, যোগ দিলেন আল সাদে। ৪ বছর পর ২০১৯-এর মে-তে ফুটবলকেই বিদায় বললেন তিনি। মাঝমাঠের শিল্পী গত দেড় যুগ ধরে ফুটবল মাঠকে বানিয়েছেন নিজের ক্যানভাস, জন্ম দিয়েছেন অসাধারণ সব স্থিরচিত্রের। বর্তমানে আল সাদের ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন জাভি, স্বপ্ন দেখেন বার্সেলোনা দায়িত্ব নেওয়ার।
২. ফার্নান্দো তোরেস
জাভির মতই স্পেনের অমর সোনালী প্রজন্মের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। তার গোলেই ৪৪ বছর পর ইউরোর শিরোপা পুনরুদ্ধার করেছিল ‘লা রোহা’রা। সোনালী চুল, কালো হেডব্যান্ড, পায়ে নাইকির টি-৯০ বুট; ‘এল নিনো’-কে দেখে পা কাঁপেনি, এমন ডিফেন্ডার মেলা ভার।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের যুবদলে ক্যারিয়ার শুরু করা তোরেসকে লোকে চিনেছে লিভারপুলে তার খেলা দেখে। ১৪২ ম্যাচে ৮১ গোল, পরিসংখ্যানটা হয়তো এখনকার ফুটবলে খুব একটা যুতসই নয়। কিন্তু ‘অল রেড’দের জার্সিতে তোরেসের খেলা যারা দেখেছেন, শুধু তারাই জানেন; ঠিক কতটা দুর্ধর্ষ ছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারের উঠতির গ্রাফটা যতটা দুর্দান্ত, পতনেরটাও ততটাই হতাশার। ইংলিশ ট্রান্সফার রেকর্ড গড়ে তাকে দলে নিয়েছিল চেলসি, কিন্তু এরপর থেকে আর নিজেকে ফিরে পাননি।
নাড়ির টানে ফিরেছিলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদেও, কিন্তু লিভারপুল বা স্পেনের সোনালী প্রজন্মের সেই তোরেস ততদিনে দূর আকাশের তারা। স্পেনকে ২০০৮ ইউরো জেতানো তোরেস ২০১২-এর আসরে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা, পরের বছর কনফেডারেশনস কাপে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট। ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বেই বিদায় নেয় স্পেন, ইতি টানে স্পেনের সোনালী প্রজন্ম। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলেন তোরেস। ক্লাব ফুটবলে অবশ্য খেলেছেন আরও পাঁচ বছর, শেষটা টেনেছেন জাপানিজ ক্লাব সাগান তোসুতে। আগস্টে ভিসেল কোবের বিপক্ষে শেষবারের মত মাঠে নেমেছিলেন তিনি, প্রতিপক্ষ ছিলেন তার স্পেনের দুই সতীর্থ ডেভিড ভিয়া এবং আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা।
৩. ডেভিড ভিয়া
স্পেনের সোনালী প্রজন্মে জাভি, ইনিয়েস্তারা মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন, রক্ষণে দুর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রামোস-পুয়োল-পিকে। কিন্তু গোলমুখে স্পেনের মূল অস্ত্র ছিলেন ডেভিড ভিয়াই। ইউরো ২০০৮ ফাইনাল স্পেনকে জিতিয়েছিলেন তোরেস, কিন্তু টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন ‘এল গুয়াজে’। বছর দুয়েক বাদে এসেছিল স্পেনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, সেবারও স্পেনের মূল ভরসা ভিয়াই। থমাস মুলার, ওয়েসলি স্নাইডারদের সাথে টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫ গোল করেছিলেন তিনি।
২০১২ ইউরোতে অবশ্য ইনজুরির কারণে ছিলেন না তিনি, ফিরেছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপ দিয়ে। এর মধ্যে রাউল গঞ্জালেজকে টপকে হয়েছিলেন স্পেনের সর্বোচ্চ গোলদাতা, যে রেকর্ড ভাঙেনি এখনও। দেশের মত ক্লাব ফুটবলেও দুর্দান্ত ছিলেন ভিয়া। ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে টানা ৪বার হয়েছিলেন লা লিগার সর্বোচ্চ গোল করা স্প্যানিশ ফুটবলার।
‘লস চে’দের হয়ে ৫ বছর কাটিয়ে যোগ দেন বার্সেলোনায়। জিতেছেন লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ। ন্যু ক্যাম্প থেকে পরের ঠিকানা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। এরপর খেলে বেড়িয়েছেন এমএলএস এবং অস্ট্রেলিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও। ক্যারিয়ারের শেষ ঠিকানা হিসেবে বেছে নেন সাবেক সতীর্থ ইনিয়েস্তার ক্লাব ভিসেল কোবে। জাপানিজদের হয়ে ৭ ডিসেম্বর ক্যারিয়ারে শেষবারের মত মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারে দুর্ধর্ষ গোলদাতা হিসেবে পরিচয় তার, বিদায়টাও নিয়েছেন শেষ ম্যাচে গোল করেই।
৪. রবিন ফন পার্সি
‘ইনভিন্সিবলস’ পরবর্তী যুগে ডেনিস বার্গক্যাম্প, ইয়ান রাইটরা বিদায় নিলে একজন বিশ্বমানের স্ট্রাইকারের খোঁজে নামে আর্সেনাল। পাকা জুহুরি আর্সেন ওয়েঙ্গার হীরে চিনতে ভুল করেননি, দলে ভেড়ান ২১ বছর বয়সী একজন ডাচ স্ট্রাইকারকে, ফেইনুর্দের হয়ে দারুণ পারফরম্যান্সে যিনি পেয়েছেন ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’ ডাকনাম।
সেই ২০০৪ থেকে শুরু ফন পার্সির আর্সেনালের সাথে পথচলা। আর্সেনালকে পরের ৮ বছরের অনেকটা সময় প্রায় একাই টেনে নিয়েছেন, ছিলেন আক্রমণের মূল এবং একমাত্র ভরসা। কিন্তু ২০১২ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেওয়ায় ভ্যান পার্সিকে এখনও ক্ষমা করেননি ‘গানার’ সমর্থকেরা।
তবে ফন পার্সি ঠিকই নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন, জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগ। আর্সেনালের মাঠে পেয়েছেন ‘গার্ড অফ অনার’ও। ইউনাইটেডের পর ফেনেরবাচে হয়ে নাড়ির টানে ফিরেছিলেন ফেইনুর্দেই। ইনজুরি, বয়সের ভার- কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। শেষ মৌসুমে গোল করেছেন ২১টি। ১২ মে, ২০১৯-এ শেষবারের মত নেমেছিলেন ফেইনুর্দ সমর্থকদের সামনে, যে মাঠে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। আর্সেনাল, ইউনাইটেড, ফেইনুর্দের মত নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের হয়েও উজ্জ্বল ছিলেন ‘আরভিপি’। দেশটির সর্বোচ্চ গোলদাতা এখনও তিনি (৫০)। অবসরের পরও ফুটবলের সাথেই আছেন ফন পার্সি, বিটি স্পোর্টসের ফুটবল বিশ্লেষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি।
৫. বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার
ক্যারিয়ারের শুরুতে তাকে ভাবা হত ইঁচড়ে পাকা হিসেবে। বিতর্ক, মাঠের বাইরের কান্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। জার্মান ফুটবল পেয়েছিল তাদের নতুন ‘ব্যাডবয়’। তার সামর্থ্য, ফুটবল জ্ঞান অবশ্য সবসময়ই ছিল প্রশ্নাতীত। একজন ‘ব্যাডবয়’ থেকে ফুটবলপাগল একটি দেশের অধিনায়ক কীভাবে হওয়া যায়- ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় যেন সেটাই প্রমাণ করেছেন ‘শোয়েইনি’।
বায়ার্ন মিউনিখের যুবদলে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ২০০২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে যখন অভিষেক হল তার, তখন থেকে তার প্রতি জার্মান সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদটা কেবল বাড়তেই থাকল। ক্লাব এবং দেশ- দুখানেই পাল্লা দিয়ে নিজেকে চেনাতে লাগলেন তিনি। ‘ব্যাডবয়’ শোয়েনস্টেইগার হয়ে গেলেন বায়ার্নের অধিনায়কও, জিতে গেলেন ‘ট্রেবল’। বাকি ছিল কেবল বিশ্বকাপ, সেটাও হয়ে গেল ২০১৪-তে। দু’বছর পর তার বিদায়ের দিনে কাঁদল পুরো জার্মানি। ক্লাব ফুটবলটা চালিয়ে গেলেন আরও বছর তিনেক। বায়ার্ন ছেড়ে যোগ দিলেন ইউনাইটেডে, বনে গেলেন ক্লাবটির প্রথম জার্মান। অবশেষে শিকাগো ফায়ারের হয়ে এমএলএস-এ বুটজোড়া চিরতরে তুলে রাখার ঘোষণা দিলেন শোয়েন্সটেইগার।
৬. পিটার চেক
প্রিমিয়ার লিগের সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকদের যেকোনো তালিকায় শুরুর দিকেই থাকবে তার নাম। ২০০৪ সালে রেঁনে থেকে তাকে চেলসিতে ভেড়ান হোসে মরিনহো। প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সেরা ক্লাব হিসেবে চেলসির উত্থানের পেছনে তার টানা ১১ বছরের দুর্দান্ত ধারাবাহিকতার অবদান দুর্দান্ত। প্রিমিয়ার লিগ জিতেছেন ৪বার, জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগও।
২০১৫-তে চেলসি ছেড়ে পাড়ি জমান আর্সেনালে। এমিরেটসে থাকাকালীন সময় একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে ২০০ ক্লিনশিটের রেকর্ড গড়েন চেক। ক্লাবের মত দেশের হয়েও চেক ছিলেন ধারাবাহিক। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ম্যাচ খেলেছেন ১২৪টি, যা দেশের হয়ে সর্বোচ্চ। এ বছর সাবেক ক্লাব চেলসির বিপক্ষে ইউরোপা লিগ ফাইনাল দিয়েই ফুটবলকে বিদায় বলেছেন চেক। 'ব্লুজ'দের হয়ে প্রায় এক যুগ কাটানো চেক ফিরেছেন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজেই, চেলসির স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে।
৭. আরিয়েন রোবেন
ডানপ্রান্ত থেকে ভেতরে ঢুকে বাঁ-পায়ের বাঁকানো শট। ফুটবলে এখন এরকম যেকোনো গোলকেই নিজের ‘ট্রেডমার্ক’ বানিয়ে ফেলেছেন আরিয়েন রোবেন। ক্ষীপ্র গতি, দুর্দান্ত ড্রিবলিং- কী ছিল না তার! চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, বা বায়ার্ন- যেখানেই গেছেন; সাফল্য পায়ে লুটিয়েছে তার। নিজেকেও ছাড়িয়ে গেছেন নতুন করে, প্রতিনিয়ত।
আরও পড়ুন: বিদায়, 'রোবারি!'
নেদারল্যান্ডসের ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনাল, বা ২০১৪-এর সেমিফাইনাল যাত্রায় রোবেন ছিলেন অনবদ্য। স্পেনকে ব্রাজিল বিশ্বকাপে ৫-১ গোলে ধরাশায়ী করার ম্যাচে রোবেন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। রোবেনের সামর্থ্য প্রশ্নাতীত, কিন্তু ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় ইনজুরির সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। এজন্যই ৩৫ বছর বয়সেই ফুটবলকে বিদায় বলেছেন তিনি। বিদায়বেলাও জিতেছেন শিরোপা, পুরো ক্যারিয়ারে যা দাঁড়াল ৩০-এ।
৮. ওয়েসলি স্নাইডার
ইন্টার মিলানের ট্রেবলজয়ী দলের কথা উঠলেই হয়তো হোসে মরিনহোর ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কথাই আসবে সবার আগে। কিন্তু ‘নেরাজ্জুরি’দের সর্বজয়ী দলের আক্রমণে মূল ভরসা ছিলেন ওয়েসলি স্নাইডার। ইন্টারের হয়ে ট্রেবল, এবং নেদারল্যান্ডসের হয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল- এখনও অনেকেই মনে করেন; লিওনেল মেসি নয়, ২০১০ সালে ব্যালন ডি’অরটা প্রাপ্য ছিল স্নাইডারেরই।
আয়াক্সের বিখ্যাত একাডেমি থেকে উঠে আসা স্নাইডার আলো ছড়িয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান, গালাতাসারায়ের হয়ে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের যেকোনো তালিকায় তার নাম থাকবে শুরুর কাতারেই। ক্যারিয়ারের শেষটা করেছিলেন জাভির মত কাতারেই, আল ঘারাফার হয়ে। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে যেখানেই খেলেছেন, সেখানেই জিতেছেন শিরোপা। ডাচদের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তারই (১৩৪)। আল ঘারাফার হয়ে এ বছর ১২ আগস্ট ঘোষণা দেন অবসরের। ড্রিবলিং, আগুনে শট- ‘নম্বর টেন’ হিসেবে স্নাইডার ছিলেন রীতিমত অপ্রতিরোধ্য।