রোনালদোর ৩৫ এবং একটি 'মোটিভেশনের' গল্প
৩৫ বছর বয়সে একজন মানুষের কথা বললে আপনার মাথায় কোন ছবিটা আগে ভাসে?
বাংলাদেশের বাস্তুবতায় আপনার চোখে ভাসবে, মধ্যবয়সী কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া একজন লোকের কথা। জীবনযুদ্ধের ঘানি টানতে যে হিমশিম খাচ্ছে। নটা পাঁচটা অফিসের পর পরিবারকে ছাড়া পৃথিবীকে দেওয়ার তার আর কিছুই নেই। সে হয়তো হিসেব করে, এই মাসের লোনের টাকাটা কীভাবে শোধ করা যাবে। সেটা ভাবতে ভাবতেই মাথা থেকে নেই হয়ে যেতে থাকে চুল, অথবা পাক ধরতে শুরু করে।
একজন সাধারণ চাকুরীজীবি হলে তাও একটা সান্ত্বনা থাকে, অন্তত ষাট হলে অবসর নেওয়ার পর পেনশন কিছু হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু একজন খেলোয়াড়ের ওই বয়সে চিন্তা করার কথা অন্য কিছু। বিশেষ করে ফুটবলার হলে ভাবতে পারেন, অবসরের পর কি কোচিংয়ে যাওয়া ঠিক হবে? আর এখনো খেললে পরিকল্পনা থাকতে পারে কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এমএলএস বা মধ্যপ্রাচ্য বা চীনের কোনো একটা ক্লাবে যাওয়ার। সেখানে এক দুই বছর একটু আরাম করে খেলে এরপর না হয় আরও কিছু টাকাকড়ি কামিয়ে ফুটবলকে বিদায় বলা যাবে। তারপর কোচ, বিশেষজ্ঞ বা অন্য কোনো ভূমিকায় কাজ করতে হবে।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বয়স যে ৩৫, সেটা হয়তো আপনার এখনও মনে নেই। আপনি আসলে বিশ্বাস করতে পারছেন না, সত্যি সত্যি রোনালদোর বয়স ৩৫ হয়ে গেছে। মনে হতে পারে, এই তো সেদিন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সিতে ছেলেটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতল। আর না হলে বার্নাব্যুর গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে সেই প্রথম অভিবাদনের কথা আপনার মনে থাকার কথা। একটু চিন্তা করে দেখুন, রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ারও দশ বছর হয়ে যাচ্ছে। সময় কত তাড়াতাড়ি যায়, তাই না?
তবে রোনালদো আপাতত সময়ের ঘড়িটা স্তব্ধ করে দিচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে। ইংল্যান্ড আর স্পেন জয়ের পর যে লোক ৩৩ বছর বয়সে নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য ইতালিতে পাড়ি জমায়, তার জন্য অন্য জগতের কোনো একটা ঘড়ি দরকার। সেই ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা এগোয় মিনিটের মতো, মিনিটের কাঁটা ঘন্টার মতো। তারপরও মনে হয়, রোনালদোর বয়স বোধ হয় আর বাড়ছে না। নইলে এই ৩৫ বছর বয়সে এসেও সিরি তে টানা নয় ম্যাচ গোল পাওয়ার হিসেবটা আপনি কোন নশ্বর পাল্লায় করবেন?
অথচ খুব বেশি দিন নয়, এই মৌসুমের শুরুতেও কত কথা হচ্ছিল। রোনালদো গোল পাচ্ছিলেন না একের এক ম্যাচে, চোটের জন্য বাইরেও থাকতে হয়েছে। বয়স শেষ পর্যন্ত রোনালদোকে গ্রাস করতে শুরু করেছে, গুঞ্জনটা প্রবল থেকে প্রবলতর। ডিসেম্বর মাসের আগ পর্যন্তও সিরি তে গোল ছিল মাত্র ছয়টি, রোনালদোর স্ট্রাইকার থেকে উইংয়ে সরে আসা উচিত কি না এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এরপর রোনালদোর একেকটা গোল যেন সশব্দে বন্ধ করতে শুরু করল সমালোচনার একেকটি কবাট। দেখতে দেখতে ১৯ গোল হয়ে গেল সিরি আ তে, সামনে আছেন শুধু চিরো ইমমোবিলে।
যাক, সে কথা। রোনালদো ফুরিয়ে যাননি- এটা প্রমাণ করার জন্য আসলে এ লেখা নয়। আপনি ফুটবলের মোটামুটি খবর রাখলে এসব জেনে যাওয়ার কথা। আর রোনালদোর ভক্ত হলে তো কথাই নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ৩৫ তম জন্মদিনে নিজেকে নিজে কী বলেছেন রোনালদো? বিদায় তো অমোঘ, সেটা একদিন না একদিন নিতেই হবে। ৩৫ বছর বয়সে একজন গড়পড়তা ফুটবলারের সেটা নিয়ে ফেলারই কথা। ডিফেন্ডারদের ক্ষেত্রে সেটির ব্যতিক্রম অবশ্য অনেক আছে, ৩৫ পেরিয়েও স্কোলস, ডি রসিরা মধ্যমাঠ দাপিয়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু ৩৫ পেরিয়ে এখনো ইউরোপের শীর্ষ লিগে গোলের পর গোল করে যাচ্ছেন, এমন স্ট্রাইকার কমই আছে। সিরি আতেও আন্তোনিও ডি নাটালি আর ফ্রান্সেসকো টট্টি ছাড়া আর কারও নাম চট করে মনে আপনার নাও পড়তে পারে। রোনালদো যদি নিজে নিজেকে বলে থাকেন, আরও অন্তত পাঁচ বছর আমি ইউরোপের শীর্ষ লিগে দাপটের সাথে খেলে যেতে চাই- তাহলে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন, এই যুগটাই আসলে কিংবদন্তিদের বয়সের সঙ্গে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। রজার ফেদেরার সাইত্রিশে এসে হাঁটুর বয়সীদের হারিয়ে যাচ্ছেন, ত্রিশ পেরিয়ে সপ্রাণ রাফায়েল নাদাল আর নোভাক জোকোভিচ। ৪৩ বছর বয়সে এসে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে মাস্টার্স জিতেছেন টাইগার উডস। উসাইন বোল্ট সব সমীকরণ বদলে দিয়ে ত্রিশ পেরিয়েও হয়েছেন দ্রুততম মানব। মাইকেল ফেলপস ত্রিশ ছাড়িয়েও তোলপাড় ফেলেছেন জলে। রোনালদোর বছর দুয়েকের ছোটো লিওনেল মেসিও নিজেকে প্রতিদিন নিয়ে যাচ্ছেন অন্য উচ্চতায়। তারপরও রোনালদো যেন একটু আলাদা। এখনও যেন বছর দশেক আগের সেই রোনালদোর মতোই যেন চনমনে, পায়ে যেন আগের মতোই সেই খিদে।
রোনালদোর জন্মদিনে আসলে এই বিস্ময়টাই সব অনুভূতিকে গ্রাস করে। কী পরিমাণ ইচ্ছাশক্তি থাকলে মাদেইরার ছাদ ফুটো হয়ে থাকা বাসার সেই কিশোর থেকে এরকম মহীরূহ হওয়া যায়? কতটা অধ্যবসায় থাকলে অল্পবয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলার ধাক্কা সামলে এতোটা বড় হওয়া যায়? কতটা উদ্যম থাকলে একজন অখ্যাত পর্তুগিজ থেকে ছয় বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হওয়া যায়? কতটা মনের জোর থাকলে মেসির মতো একজনের অনেকটা পেছনে পড়ে থেকেও তাঁকে ছুঁয়ে ফেলা যায়? মোটিভেশনাল স্পিকাররা তো রোনালদোর কাহিনি বলেই সারা মাসের বন্দোবস্ত করে নিতে পারেন।
আপনি যদি জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে থাকেন, তাহলে শুধু রোনালদোর কথা চিন্তা করুন। লড়াই করার জ্বালানির জন্য আপনার খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই।