এভারেস্ট ছুঁতে চাইছে নেপাল!
১.
“নিউজিল্যান্ডের সাথে ম্যাচটা জেতার পর থেকে ফোনের উপরই আছি। অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে পুরো দল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মাও ফোন করেছিলেন, পরবর্তী ম্যাচের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন…”, নেপাল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের নম্রভাষী সহ-অধিনায়ক আরিফ শেখের বয়ানেই স্পষ্ট যুবাদের সাফল্য পৌনে তিন কোটি মানুষের দেশটিতে কতোটা আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। যে ম্যাচের জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর শুভকামনা, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সেটিও অনায়াসে জিতে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের শেষ আটে পৌঁছে গেছে নেপাল।
২.
গত বছরই স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার ছোট্ট দেশটি। অন্য অনেক স্থাপনার সাথে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নেপাল ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠটিও। সদ্যই বসানো ইনডোর নেটগুলো চাপা পড়ে সে ধ্বংসস্তূপেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই নেপালে দেখা দেয় মানবসৃষ্ট আরেক দুর্যোগ। গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক রূপান্তরে বন্ধ হয়ে যায় ভারতের সাথে বাণিজ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার চড়া হতে শুরু করে। এক লিটার ডিজেলের দাম গিয়ে ঠেকে সাড়ে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ রূপিতে। এই অস্বাভাবিক মূল্য দিয়েও সেটা কিনতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হতো। যেখানে মানুষের জীবনই চলছে না সেখানে আবার ক্রিকেট! জ্বালানির অভাবে একমাত্র বোলিং মেশিনটি অব্যবহৃতই পড়ে থাকে। ওদিকে বাজারে বিক্রি হওয়া ক্রিকেট বলের দামও এতো চড়ে যায় যে সেগুলো কিনে অনুশীলন করা বিলাসিতার নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ক্রমেই চরম হয়ে ওঠা এই সংকটের মাঝেই প্রতিবেশী দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারতীয় বোর্ড। শ্রীনিবাসনের প্রভাবমুক্ত হয়ে বিসিসিআই তখন দ. এশিয়ার অন্যান্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে ভারতে লম্বা সময় অনুশীলনের সুযোগ পায় নেপালের যুবারা। স্থানীয় বেশ ক’টি ক্লাবের বিপক্ষে জয় বাড়িয়ে দেয় আত্মবিশ্বাসটাও।
৩.
কুড়ি বছর আগের সময়টা এখনও স্পষ্ট চোখে ভাসে পবন আগারওয়ালের। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো এসিসি (এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল) ট্রফিতে খেলার সুযোগ পাওয়া নেপাল জাতীয় দলটার অধিনায়ক রোমাঞ্চটুকু আজ অব্দি টের পান, “বিমানে চেপে বসার আগ পর্যন্ত দলের কেউ বিশ্বাসই করতে চাইছিল না যে সত্যি সত্যিই আমরা মালয়েশিয়া যাচ্ছি টুর্নামেন্ট খেলতে!”
নেপালের ক্রিকেট সেই শৈশব পেরিয়ে একটু একটু করে পরিণত হয়ে উঠতে শুরু করেছে কেবল। লম্বা সময়ের পথচলাটা যে খুব সুখকর ছিল না তা বলাই বাহুল্য। এখনও যে এমন কিছু উন্নতি হয়ে গেছে তা নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো আগের মতোই দুর্বল রয়ে গেছে। নেই অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুবিধা। মাঠ পর্যায়ের প্রতিভাদের তুলে আনতে কার্যকর কোন উদ্যোগও নেই। প্রশাসন, ব্যবস্থাপনায় অপরিপক্কতার ছাপটা বেশ চোখে লাগে। সবমিলিয়ে ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নেবার মতো পরিবেশটা তাই এখনও তৈরি হয়ে ওঠে নি।
কিন্তু এতো সীমাবদ্ধতার মাঝেও পবনকে আশাবাদী করে নেপালের ক্রিকেট পাগল মানুষ। সাধারণের এই ভালোবাসাই যে একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছে নেপালের ক্রিকেটকে। এই গত বছরই মিলেছে 'টিটোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটাস'। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলার কুড়ি বছরে দাঁড়িয়ে ছোট করে বলার মতো অর্জন খুব কম নয়।
এখান থেকে আরও সামনের পথটা যে ক্রমেই বন্ধুর হতে থাকবে সেটা জানেন পবন। কিন্তু ওটুকুও অপ্রত্যাশিত গতিতে বাড়তে থাকা ভালোবাসা পুঁজি করে পাড়ি দেয়া সম্ভব হবে বলেই বিশ্বাস তাঁর। কত-শত স্বেচ্ছাসেবক নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর; গণমাধ্যমে আগ্রহ বাড়ছে, এগিয়ে আসছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেই পবনদের উত্তর প্রজন্ম দিয়ে গড়া বয়সভিত্তিক দলগুলো একটু একটু করে পরিণত হয়ে উঠছে। সে ধারাবাহিকতায় আসতে থাকা ছোট ছোট সাফল্যই একদিন বড় হয়ে ধরা দেবে- এমন বিশ্বাস অন্তত পবনের আছে পুরোপুরিই।
৪.
যে মদেশী জনগোষ্ঠীর কারণে নেপাল-ভারত বানিজ্যের ওই অচলাবস্থা, নেপালের যুব দলটায় আরিফ শেখসহ চারজন আছেন সে গোষ্ঠীর। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যায়ের গোষ্ঠীগত বিভেদ চিড় ধরাতে পারে নি দেশের পতাকাদলে এক হওয়া তরুণদের মাঝে, “আমাদের মধ্যে নেপালের প্রায় প্রতিটি ধর্ম-বর্ণের ক্রিকেটার আছে। কিন্তু এখানে সবাই আমরা একটা দল হয়ে খেলছি। রাজনৈতিক পর্যায়ে যতো বিভেদই থাকুক, গোটা দেশ এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের পিছনে।”
দল-মত নির্বিশেষে পুরো দেশকে এক করে দেয়ার যে শক্তি ক্রিকেট দিয়েছে, সেটাই প্রেরণা জ্ঞান করে সামনে এগোতে চান আসিফ-সন্দীপরা। সে প্রেরণা কি একটু চাপও বাড়িয়ে দিচ্ছে না? “চাপ নয়, ওটা কেবল আমাদের আত্মবিশ্বাসই বাড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা খুব বড় কিছুই করে ফেলতে যাচ্ছি!”
পবনদের বিশ্বাসটা যে আরিফদের মাঝে পাকাপাকিভাবেই বাসা বেঁধেছে, তা কি আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন আছে?