নামিবিয়া : আশ্রিতরাই যখন 'হন্তারক'!
স্টিফেন বার্ড শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছিলেন। ওমানের উচ্ছ্বাস। প্রথমবার আইসিসির মেজর কোনো টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পেয়ে ওমানের খেলোয়াড়দের আনন্দ যে ছিল বাঁধভাঙ্গা। ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপের টিকেট পাওয়া হয়ে গেছে। নামিবিয়া শিবিরে তখন হতাশার কালো মেঘটা আরও বেশী জমাট বেঁধে উঠেছে যেন। আশাভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হলো আরেকবার। ২০০৩ সালের পর আইসিসির মেজর আর কোনো টুর্নামেন্টেই যে খেলা হয়নি নামিবিয়ার। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক বার্ডের বলারই বা ছিল কী! ওদিকে রাগবি ওয়ার্ল্ড কাপে আবার খেলছে নামিবিয়া। দেশের শীর্ষ তিন খেলার একটা হতে যে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে খেলাটা জরুরী, একান্তই। ক্রিকেট সে সুযোগটা হারালো আরেকবার। দেশের বিশ লাখ জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে আঠারো লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্বই যে নেই ক্রিকেটে! আফ্রিকান এই দেশটির ক্রিকেট মানেই ‘সাদা’দের দাপট, ‘কালো’রা সেখানে অচ্ছুত প্রায়।
স্টিফেন বার্ডের দুঃখটা কি আজ কমলো কিছুটা? শুধু বার্ডরা নয়, নামিবিয়ার কোনো খেলার কোনো দলই যা করতে পারেনি, জেন গ্রিনের দল যে করে দেখালো তাই! নামিবিয়ার ইতিহাসে কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল যে খেলেনি এর আগে কোনো দল! ঢাকায় কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাই নতুন ইতিহাস গড়া হবে নামিবিয়ার। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ নামিবিয়াকে দিচ্ছে এমনই অনন্য স্বাদ!
*
দুই দলের জার্সিতে হলুদ রঙটা ‘সাধারণ’। অল্প করে হলেও ছোঁয়া আছে এ রঙের। এ হলুদ বাদ দিলে নামিবিয়ার গায়ে নীলের আধিক্য, দক্ষিণ আফ্রিকার সবুজের। নামিবিয়ার নীলেই আজ ফিকে হয়ে গেল আফ্রিকার সবুজ। কক্সবাজারে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রতিবেশীদের কাছে হেরে এবারের আসরকে বিদায় বলতে হলো বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের। দক্ষিণ আফ্রিকান যুবারা আসলে শুধু প্রতিবেশীদের কাছে নয়, হারলো তো নিজেদের ক্রিকেটের একটা ‘অংশের’ কাছেই!
দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে নামিবিয়ার ক্রিকেটীয় সম্পর্কটা জার্সির রঙেই যে সীমাবদ্ধ নয় শুধু। সেই ২০০৬ সাল থেকে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের একটা অংশই নামিবিয়ানরা। শুধু প্রথম শ্রেণী নয়, লিস্ট ‘এ’ বা টি-টোয়েন্টি, আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের সব ফরম্যাটেই খেলে নামিবিয়া, একটা স্বতন্ত্র দল হয়ে।
শেখ কামাল স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠ আজ দেখলো নামিবিয়ার ক্রিকেট উত্থানের এক নমুনা। যে উত্থানে অনেক বড় একটা ‘হাত’ আছে দক্ষিণ আফ্রিকারও!
মাইকেল ভ্যান লিংগেনের চার উইকেট আর ফ্রিটজ কোয়েটজির তিন উইকেট, বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের বেঁধে ফেলেছিল ১৩৬ রানেই। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হোঁচট খাওয়াতে গিয়ে নিজেরাই একটা হোঁচট খেয়েছিল নামিবিয়ানরা, ১০ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে। ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে কার্ল ব্রিটজের সঙ্গে লোহান লউরেন্সের ৫২ রানের জুটি স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যেতে দেয়নি। ব্রিটজ আউট হওয়ার পরও ছিলেন লউরেন্স, নামিবিয়াকে ইতিহাস গড়া জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেয়া যখন হয়ে গেছে, তখনও তিনি অপরাজিত ৫৮ রানে। যে লউরেন্স শেষে এসে 'হন্তারকের' ভূমিকা পালন করলেন, তাঁর প্রথম শ্রেণীর অভিষেক গত বছর, মানে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের এ মৌসুমেই! কে জানে, আফ্রিকানদের মনে হয়তো 'দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পোষার' অনুভূতিটাই হলো কিনা!
*
যুবাদের বিশ্বকাপে নামিবিয়া খেলছে ১৯৯৮ সাল থেকেই। তবে ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর আর কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের যুবাদের হারানো হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ১৪ বছরের আক্ষেপটাও ঘুচালো নামিবিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে সামনে আসবে হয়তো ভারত। নামিবিয়ার যুবারা কি অপেক্ষা করে আছে আরও বড় কোনো ‘অঘটন’ এর ধাক্কা নিয়ে?
তেমন হোক বা না, নামিবিয়ার জন্য আজকের দিনটা স্মরণীয়ই বটে। স্টিফেন বার্ডরাও হয়তো এ যুবাদের নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। ক্রিকেটকে দেশের শীর্ষ খেলা বানানোর স্বপ্ন, বিশ্ব ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্বের স্বপ্ন।
হোক না ‘ছোট’দের টুর্নামেন্ট, কক্সবাজারের আদিগন্ত সমুদ্রের মতো স্বপ্নের পরিধিটাও নিশ্চয়ই অনেক বড় নামিবিয়ান যুবাদের!