স্বপ্ন দেখা যায় বিনামূল্যে | কিলিয়ান এমবাপের গল্প
প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক লেখায় কিলিয়ান এমবাপে জানিয়েছেন তার জীবনের গল্পটা। প্যাভিলিয়নের পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে লেখাটি।
বন্ডির বাচ্চারা শোন,
ইল-দ্য-ফ্রান্সের বাচ্চারা শোন,
প্যারিসের শহরতলির বাচ্চারা শোন,
তোমাদের আজ একটা গল্প শোনাব।
গল্পটা ফুটবলের, আমার অন্যান্য সকল গল্পের মতই। কেউ অবাক হতেও পারে, তবে আমার জীবনের সব গল্পই ফুটবলের। আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো তোমরা, উনিও একই কথাই বলবেন। আমার তৃতীয় জন্মদিনে বাবা আমাকে ৪ বাই ৪ এর একটা খেলনা ট্রাক কিনে দিয়েছিলেন, কোন ধরনের ট্রাক বুঝেছো তো? ঐ যে মোটর লাগানো আবার প্যাডেলও মারা যায় ধরনের ট্রাকগুলো, ভেতরে বসে আসল গাড়ির মত করে চালানোও যায়। বাবা-মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন আর আমি আমার ঐ ট্রাক চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ফুটবল মাঠে যেতাম, ঠিক পেশাদার ফুটবলারেরা যেমন ট্রেনিংয়ে যায়, অমনই! ছোটবেলায় এই গাড়ি চালিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ছোট ছিলাম বলে কেবল কিট ব্যাগটা ছিল না, নয়তো আমি ছিলাম পুরোদস্তুর পেশাদারি ফুটবলার!
কিন্তু দশ বারো প্যাডেলে খেলার মাঠে পৌঁছে যাওয়ার পর মাঠের কোণায় সেটা পার্ক করে রেখে যখন আমি খেলার মাঠে নেমে যেতাম তখন আমার সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ গাড়িটার কথা আর আমার মাথায় থাকতো না। আমার ৪ বাই ৪ এর সেই ট্রাক, যেটা দেখে আমার বন্ধুরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতো, সেটা আর পাত্তা পেতো না।
তখন আমি কেবল একটা জিনিসই চাইতাম, ফুটবল।
আমার কাছে বলটাই ছিল সবকিছু।
হ্যাঁ আমার গল্পটা ফুটবলের। তবে ফুটবল যদি তুমি ভালো নাও বাসো তাও এই গল্পটা শুনে দেখতে পারো, কারণ গল্পটা আসলে স্বপ্ন দেখা নিয়েও। প্যারিসের ঐ ছোট্ট শহরতলি বন্ডিতে আমাদের টাকা-পয়সা তেমন ছিল না, তবে আমরা স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের ওভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম। আমরা জানতাম, স্বপ্ন দেখতে টাকা লাগে না। স্বপ্ন দেখা যায় বিনামূল্যে।
আমাদের পাড়া ছিল এক বিচিত্র জায়গা। ফ্রেঞ্চ, আরব, আফ্রিকান, এশিয়ান - দুনিয়ার সব জায়গার, সব সংস্কৃতির লোকেরাই সেখানে থাকতো। ফ্রান্সের বাইরের লোকেরা সবসময় শহরতলিগুলোকে খারাপ চোখে দেখে। সত্যিটা হল, তুমি আমাদের মাঝে যদি কখনো না থাকো তাহলে কখনোই ব্যাপারটা তোমাকে বোঝানো যাবে না। মানুষ এখানকার গুন্ডা-মাস্তানদের কথা এমনভাবে বলে যেন মাস্তানি ব্যাপারটা এখানেই আবিষ্কার হয়েছে। গুন্ডা-মাস্তান দুনিয়ার সবজায়গায় আছে। জীবনযুদ্ধে কোনমতে টিকে থাকা মানুষও দুনিয়ার সবজায়গাতেই আছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের পাড়ার সবচেয়ে ভয়ানক মাস্তানেরা আমার দাদীর বাজারের ব্যাগ বয়ে দিত। আমাদের জীবনের এ অংশগুলো তোমরা পত্রিকায় কখনো দেখবে না। তোমরা কেবল আমাদের খারাপটাই শোন, ভালোটা জানার সুযোগ তোমাদের হয় না।
বন্ডিতে কিছু আদব কায়দা আছে যা সকলেই মানে। ছেলেবেলাতেই আমাদের ভেতরে ওসব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় যদি দেখ মোড়ে ১৫জন দাঁড়িয়ে আছে যাদের মাঝে কেবল একজনকে হয়তো তুমি চেনো। এখন তোমার কাছে দুটো রাস্তা খোলা আছে। হয় তুমি দূর থেকে সবার দিকে হাত নাড়িয়ে হেঁটে পার হয়ে যাবে। অথবা কাছে গিয়ে ১৫জনের সাথেই হ্যান্ডশেক করবে।
যদি তুমি শুধু তোমার পরিচিত একজনের সাথেই হ্যান্ডশেক কর তবে ঐ মোড়ের বাকি ১৪জন তোমাকে মনে রাখবে। তারা জানবে হয় তুমি বন্ডিতে বড় হওনি অথবা তোমাকে পরিবার থেকে ভালভাবে শিক্ষা দীক্ষা দেওয়া হয় নি।
বন্ডির এই শিক্ষা মনে হয় সারাজীবনই আমি বয়ে বেড়াব, ব্যাপারটা আমার ভালই লাগে। এইতো গত বছরই ফিফার বেস্ট পুরষ্কারের দিন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আগে আমি বাবা মার সাথে মিলানের স্কালা থিয়েটারে পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ রুমের অন্যপাশে হোসে মরিনিয়োর দিকে আমার চোখ পড়লো। ওনার সাথে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল, তবে মরিনিয়োর সাথে তাঁর আরো চার পাঁচজন বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলেন। বন্ডির শিক্ষা আমার মনে খোঁচা দিতে লাগল, আমি কী দূর থেকে হাত নাড়াব নাকি কাছে গিয়ে হ্যান্ডশেক করব? শেষমেশ মনস্থির করে কাছে গিয়ে মরিনিয়োকে হ্যালো বললাম, তাঁর সাথে হ্যান্ডশেক করলাম। এবং প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাঁর বন্ধুদের দিকেও এগিয়ে গেলাম।
‘বঁজুর!’ তারপর হ্যান্ডশেক।
‘বঁজুর!’ তারপর হ্যান্ডশেক।
‘বঁজুর!’ তারপর হ্যান্ডশেক।
‘বঁজুর!’ তারপর হ্যান্ডশেক।
বেশ মজার ছিল পুরো ব্যাপারটা। কারণ মরিনিয়োর বন্ধুরাও বেশ অবাক হয়েছিলেন,’ও আমাদেরকেও হ্যালো বলছে? ওহ, হ্যালো!’
একটু দূরে যাওয়ার পর টের পেলাম বাবা হাসছেন। তিনি আমার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ‘খাস বন্ডির ছেলে!’
বন্ডির আদব কায়দা আর অভ্যাসগুলো আমার রক্তে ঢুকে গিয়েছিল আসলে। কেবল ফুটবল নয়, বন্ডি আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে মানুষকে সম্মান করতে হয়। সবার সাথে কীভাবে একইরকম আচরণ করতে হয়। কারণ আমরা সবাই একই জায়গা থেকে এসেছি, আমরা একই স্বপ্ন দেখি।
আমি আর আমার বন্ধুরা কখনোই আশা করতাম না আমরা ফুটবলার হব। ফুটবলার হলে কী করব এ নিয়ে হাজারো প্ল্যান পরিকল্পনা আমরা করতাম না, আমরা কেবলই স্বপ্ন দেখতাম, পার্থক্যটা কী বোঝা যাচ্ছে? যেখানে বেশিরভাগ বাচ্চাদের ঘরের দেওয়ালে সুপারহিরোদের পোস্টার টাঙ্গানো থাকতো, সেখানে আমাদের দেওয়াল আলো করতেন ফুটবলাররা। আমার ঘর জিদান আর ক্রিশ্চিয়ানোর পোস্টারে ভর্তি ছিল। একটু বড় হওয়ার পর বেশ কিছু নেইমারের পোস্টারও আমদানি করেছিলাম। নেইমার এটা নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে, কেন জানি না!
কিছু নেইমারের পোস্টারও আমদানি করেছিলাম। নেইমার এটা নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে, কেন জানি না!
মাঝে মাঝে মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমাদের পাড়া থেকে এত প্রতিভা উঠে আসে কীভাবে? তারা এমনভাবে জিজ্ঞেস করে যেন আমরা ভিন্ন কোন চালের ভাত খাই, বা বিশেষ কোন প্রক্রিয়ায় ট্রেনিং করি - বার্সেলোনার মতন। কিন্তু আসলে এমন কিছুই না। তুমি যদি কোনদিন বন্ডি ফুটবল ক্লাব দেখতে আসো তবে দেখতে পাবে একটা সাদাসিধে ঘরোয়া পাড়ার ক্লাব, কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আর কৃত্রিম ঘাসের একটা ছোট মাঠ। কিন্তু কোন একটা জায়গায় ফুটবল ব্যাপারটা আমাদের জন্য একটু ভিন্ন। ফুটবল আমাদের ভাত কাপড়, ফুটবল আমাদের সবকিছু।
আমার মনে আছে আমাদের স্কুলে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো, ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট আর নাইনের সবাইকে নিয়ে। ওটা ছিল আমাদের বিশ্বকাপ। ২ ইউরোর একটা সস্তা প্লাস্টিকের ট্রফির জন্য আমরা পারলে জান দিয়ে দিতাম। সেই ছোটবেলায় পুরো ব্যাপারটাই মান ইজ্জতের ব্যাপার ছিল। আরো মজা হল, কড়া একটা নিয়ম ছিল যে প্রতিটা দলকেই হতে হবে মিক্সড, ছেলে এবং মেয়েরা একসাথে খেলবে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সব মেয়েরা এই টুর্নামেন্টে খেলার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী ছিল না। আমাদের অনেক দেনদরবার করে তাদের রাজী করাতে হতো। আমার মনে আছে আমি আমার এক বান্ধবীকে রাজি করানোর জন্য কথা দিয়েছিলাম যে সে যদি আমার দলে খেলে এবং আমরা কাপ জিতি তাহলে তাকে আমি একটা নতুন রঙের খাতা কিনে দেব! পা ধরাটাই কেবল বাকি ছিল আমার!
তোমাদের মনে হতে পারে আমি হয়তো বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু ব্যাপারটা এমনই ছিল। ফুটবল আমাদের জন্য ছিল সবকিছু। তখন আমরা বুক ফুলিয়ে বলতাম, এটা আমাদের পাড়া। আমরা হারতে জানি না!
ঐ ২ ইউরোর ট্রফি আমার কাছে জুলে রিমে ট্রফির থেকেও বড় কিছু ছিল। ঐ সময়ে আমি স্কুলের শিক্ষকদের অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার মনে আছে একবার স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছিলাম ডায়রিতে স্কুলের প্রিন্সিপালের লেখা ৯টি ওয়ার্নিং নিয়ে।
কিলিয়ান আজ বাড়ির কাজ করে নি।
কিলিয়ান আজ ক্লাসে খাতা-পেন্সিল আনতে ভুলে গিয়েছে।
কিলিয়ান আবারো অংক ক্লাসে ফুটবল নিয়ে আলোচনা করছিল…
এগুলোর কিচ্ছুই তখন আমাকে স্পর্শ করতো না, আমি মেঘের উপর দিয়ে ঘোরাফেরা করতাম। আর আমি আসলেই বেশ ভাল খেলোয়াড়ও ছিলাম। তবে আমার ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল স্কুলের কাপটা। আমার বয়স তখন ১১। সেমিফাইনাল পর্যন্ত পোঁছে গেছিলাম সেবার, খেলা ছিল গেনিতে, একদম আসল স্টেডিয়ামে। আমার এটাও মনে আছে ম্যাচটা ছিল বুধবারে। পুরো ঘটনাটাই আমার জন্য একটা বড় স্মৃতি। এত বড় স্টেডিয়ামে ওটাই আমার প্রথম খেলা। এত বড় মাঠ, এত মানুষ! ভয়েই আমি দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে গোটা ম্যাচে আমি বলে পা লাগিয়েছিলাম কিনা বা দৌড়েছিলাম কিনা আমার খেয়ালই নেই। ম্যাচ শেষে আমার মা মাঠে ঢুকে আমার কান মলে দিয়েছিলেন।
কানমলাটা খারাপ খেলার জন্য নয়, ভয় পাওয়ার জন্য।
মা বললেন, আজকের কথা যেন সারা জীবন মনে থাকে। তুমি হেরে যাও, পড়ে যাও যেটাই হোক না কেন, নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস হারানো যাবে না। পরপর ৬০টা গোলও হয়তো মিস করে গেলে, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এই যে ভয়ের কারণে খেলতে পারলে না এটা যেন আর কখনো না হয়।
মা ঠিক এই কথাগুলিই বলেছিলেন, আমার প্রতিটা শব্দই মনে আছে। কথাগুলো আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে এর পর থেকে কিলিয়ান ফুটবল মাঠে আর কখনো ভয় পায়নি। আমার মা, আমার বাবা, আমার পরিবার, পাড়া আর বন্ধুদের ছাড়া কিলিয়ান এমবাপের কোন অস্তিত্বই নেই।
হয়তো আমি যে জায়গা থেকে উঠে এসেছি সে জায়গার সাথে তোমাদের পরিচয় নেই বলে আমি ঠিক বুঝাতে পারছি না। তাহলে আরেকটা গল্প বলি। আমার বয়স যখন ১১, তখন চেলসির বয়সভিত্তিক দলের সাথে লন্ডনে কিছুদিন ট্রেনিং করার একটা সুযোগ এল আমার কাছে। আমি এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে পুরো ব্যাপারটা আমার পাড়ার বন্ধুদেরকে বলতে আমি ভুলেি গিয়েছিলাম! ট্রেনিং সেরে যখন বাড়ি ফিরে এলাম তখন বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল, কিলিয়ান, গত সপ্তাহে কোথায় ছিলে? খেলতে আসোনি কেন?
আমি বললাম, আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম। চেলসির সাথে ট্রেনিং করতে।
তারা উড়িয়েই দিল, ধুত! অসম্ভব!
আমি আরো জোর নিয়ে বললাম, আরে না আসলেই! আমার দ্রগবার সাথেও দেখা হয়েছে!
তারা তবুও মানতে নারাজ, গুল মারার আর জায়গা পেলে না? দ্রগবা কেন বন্ডির একটা ছেলের সাথে দেখা করবে! আজগুবী কথাবার্তা!
আমার তখন কোন মোবাইল ছিল না। বাবার মোবাইলটা নিয়ে এসে বন্ধুদের আমাদের তোলা ছবিগুলো দেখালাম। তারা শেষ পর্যন্ত আমার কথা বিশ্বাস করল। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল তাদের কারোই হিংসা হয়নি আমার উপর! তারা কেবলই অবাক হয়েছিল। ওদিন বন্ডি ক্লাবের ড্রেসিং রুমে বসে তারা আমাকে যা বলেছিল সেটা আমার সবসময় মনে থাকবে।
তারা বলল, কিলিয়ান, আমাদেরকে নিয়ে যাবে তোমার সাথে?
যেন আমি অন্য কোন গ্রহ থেকে ঘুরে এসেছি।
আমি মুখ কাল করে তাদের জানালাম, কিন্তু ট্রেনিং ক্যাম্পটা তো শেষ। আমি কী করব বল?
তারা তখনো ফোনে আমার ছবিগুলো দেখছিল আর হাসছিল, একজন বলল, আরে কিলিয়ানের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করে নিলেই তো হয়। আমরা তো একই!
আমাদের কাছে এসব অভিজ্ঞতার অর্থটা এমনই, অন্য একটা গ্রহ ঘুরে আসার মতো।
দ্রগবা কেন বন্ডির একটা ছেলের সাথে দেখা করবে! আজগুবী কথাবার্তা!
চেলসির ঐ ট্রেনিংয়ের পর থেকে বন্ডির বাইরের বড় কোন ক্লাবে যাওয়ার জন্য আমি বাবা মার কাছে পীড়া-পীড়ি করতে লাগলাম। আমার তখনো বুঝার বয়স হয় নি, আমার বাবা মা চাইতেন আমি যেন অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই বড় হই, সাধারণ জীবনযাপন করি। এখন আমি বুঝি, বন্ডিতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাই আমার জন্য সেরা ছিল। একাডেমির চার দেয়ালের মাঝে ফার্মের মুরগির মত বড় হলে জীবনের অনেক শিক্ষাই আমার নেওয়া হতো না।
আমার বাবা প্রায় ১০ বছর আমার কোচ ছিলেন। এমনকি ক্লেয়ারফতেঁইনের বিখ্যাত অ্যাকাডেমিতে আমার ট্রেনিং শুরু হওয়ার সময়কালেও তিনি ছিলেন আমার গুরু। ক্লেয়ারফতেঁইনের ফুটবল একাডেমি দুনিয়ার সেরা একাডেমিগুলোর একটা। তবে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরলেই বাবার অধীনে সেমি প্রোফেশনাল বন্ডি ফুটবল ক্লাবের হয়ে মাঠে নেমে যেতাম। আর সেখানে বাবা আমার ঐ উঁচু জাতের অ্যাকাডেমি শিক্ষাকে পাত্তাই দিতেন না।
সপ্তাহ শেষে বাসার ফিরতাম আমি আমার অ্যাকাডেমি কোচের কন্ঠস্বর মাথায় করে। তিনি বার বার আমাদের উইক ফুট নিয়ে কাজ করতে বলতেন। ক্লেয়ারফতেঁইনের পুরো ব্যাপারটাই ছিল আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, নতুন নতুন জিনিস শেখানো। আর বন্ডিতে ছিল বাস্তবিকতা, সেমিপ্রো লিগে টিকে থাকবার লড়াই। খেলতে হত কেবলই জেতার জন্য, স্কিল দেখানোর জন্য নয়।
একবার এমন একটা ছুটিতে আমি বন্ডির হয়ে খেলছিলাম। উইং দিয়ে দৌড়ে ডান পায়ে বলটা নিলাম। আশেপাশে কেউ নেই, এই সুযোগ! মনে পড়ে গেল আমার একাডেমি কোচের কথা, কিলিয়ান, তোমার বাম পায়ের ওপর আরো কাজ করতে হবে।
আমি বাম পা দিয়ে একটা লম্বা পাস বাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পুরোই ভজঘট পাকিয়ে ফেললাম। প্রতিপক্ষ বলের দখল নিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে চলে গেল। বাবা পারলে তখন মাঠে এসে আমাকে দু’ঘা লাগিয়ে যান!
আমার কানে এখনো বাবার ঐ চিৎকার ভাসে।
‘কিলিয়ান, এটা তোমার ক্লেয়ারফতেঁইনের স্কিল দেখানোর জায়গা না। এখানে আমাদের লিগ জিততে হবে। সারা সপ্তাহ যখন ক্লেয়ারফতেঁইনের সুন্দর মাঠে খেলবে তখন এসব চেষ্টা করবে। এটা বন্ডি, আমাদের বাস্তবতা এত সহজ না!’
আমি এ শিক্ষা এখনো মাথায় নিয়ে চলি। বড় অ্যাকাডেমির ছাত্র হয়ে আমি আকাশে উড়ছিলাম, বাবা আমাকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন।
আরেকবার, আমার ১৪তম জন্মদিনের ঠিক আগে আমার জন্য একটা বিশাল চমক অপেক্ষা করছিল। আমার বাবাকে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ফোন দিয়ে জানানো হল যে তারা চাচ্ছেন এ ছুটিতে যেন আমি স্পেনে গিয়ে তাদের সাথে ট্রেনিং করি। সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল যখন তারা বাবাকে জানাল, জিদান আপনার ছেলের সাথে দেখা করতে চান। জিদান তখন মাদ্রিদের স্পোর্টিং ডিরেক্টর। আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, পারলে তখনি আমি ব্যাগ গুছানো শুরু করব এমন একটা অবস্থা!
কিন্তু ব্যাপারটা আসলে অতটা সহজও ছিল না। ঐ বয়সেই আমার নাম ডাক ছড়ানো শুরু করেছিল, মাঠে নিয়মিত বিভিন্ন দলের স্কাউটরা আসতেন আমার খেলা দেখতে। আমার বয়স তখন মাত্র ১৩, এসব কীভাবে সামলাতে হয় সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা আমার ছিল না। আমার বাবা মা-ই সবসময়ে আমাকে এসব ব্যাপার থেকে আগলে রেখেছেন।
কিন্তু ঐ সপ্তাহেই ছিল আমার জন্মদিন। আমি জানতাম না, আমাকে চমক দেওয়ার জন্য বাবা আগে থেকেই কথাবার্তা বলে আমার স্পেনে যাওয়ার সমস্ত কাজ সেরে রেখেছেন।
এর থেকে ভাল জন্মদিনের উপহার আর কী হতে পারে!
হয়তো তোমাদের বিশ্বাস হবে না, কিন্তু এই ট্রিপের কথা আমরা কাউকেই জানাইনি। এমনকি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদেরও না। আমার খালি তখন ভয়, যদি কোন গড়বড় হয়ে যায়? আমি আমার পাড়ার লোকদের হতাশ করতে চাই নি।
দেখোতো ব্যাপারটা। এই এভ্রুর একটা ছেলে আর বন্ডির একটা ছেলে বিশ্বকাপ খেলতে মাঠে নামছে। বিশ্বাস হয়?
আমার সারাজীবন মনে থাকবে, এয়ারপোর্ট থেকে আমরা সরাসরি মাদ্রিদের ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছে দেখলাম জিজু আমার জন্য পার্কিং লটে অপেক্ষা করছেন। জিজুর গাড়িটাও ছিল ব্যাপক! প্রাথমিক কুশলবিনিময় শেষে তিনি আমার বাবা মাকে বললেন তিনিই আমাকে ড্রাইভ করে মাঠে নিয়ে যাবেন। তিনি তার গাড়ির সামনের দরজা খুলে হাসিমুখে আমাকে বললেন, উঠে পড় জলদি।
আমার তখন হতভম্ব অবস্থা, আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি জুতা খুলে উঠব?
হাহাহা! জানি না কেন বোকার মত ঐ প্রশ্ন করেছিলাম। জিজু আমার কাছে ঈশ্বরের মত ছিলেন, হয়তো সেজন্যই।
জিজুও হেসে ফেললেন, আরে নাঃ! উঠে পড়।
জিজুর পাশে গাড়িতে বসে কেবল আমার মনে হচ্ছিল, বন্ডির ছেলে আমি কিলিয়ান এমবাপে বসে আছি জিনেদিন জিদানের পাশে । এটা কি সত্যি নাকি আমি এখনো প্লেনেই ঘুমাচ্ছি?
মাঝে মাঝে বাস্তব জীবনও স্বপ্নের মতই মনে হয়। ঠিক যেমনটা হয়েছিল রাশিয়া বিশ্বকাপের সময়।
বিশ্বকাপের সব স্মৃতির মাঝে যেটা আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সেটা হল, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের আগে টানেলে দাঁড়িয়ে থাকা। তখন হুট করেই গোটা ব্যাপারটা আমি উপলদ্ধি করলাম, আমি কে, আমি কোথায় আছি। আমি পেছনে উসমান ডেম্বেলের দিকে তাকালাম, সেও হাসছে আর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। আমার মতোই।
আমি তাকে বললাম, দেখোতো ব্যাপারটা। এই এভ্রুর একটা ছেলে আর বন্ডির একটা ছেলে বিশ্বকাপ খেলতে মাঠে নামছে। বিশ্বাস হয়?
সে বলল, না ম্যান। বিশ্বাস হচ্ছে না।
মাঠে নামার পর টের পেলাম সাড়ে ৬ কোটি মানুষ আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে। জাতীয় সঙ্গীত যখন বাজানো হচ্ছিল, আমি কোনমতে চোখের পানি সংবরণ করেছি।
বিষয়টা আমার কাছে খুবই মজার। এই আমরা, যারা বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছি তাদের প্রায় সবাই ফ্রান্সের শহরতলির অলিগলি থেকে উঠে আসা। এমন সব মহল্লা থেকে আমরা এসেছি যেখানে রাস্তায় নামলেই চার পাঁচ ধরনের ভাষা শোনা যায়। রাস্তায় হ্যান্ডশেক করতে হয় ১ জন না, ১৫ জনের সাথে।
বন্ডির বাচ্চারা শোন,
ইল-দ্য-ফ্রান্সের বাচ্চারা শোন,
প্যারিসের শহরতলির বাচ্চারা শোন,
আমরাই ফ্রান্স, তোমরা সবাই ফ্রান্স।
আমরা সবাই পাগল স্বপ্নবাজ ছেলেমেয়ে। এবং আমাদের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার, স্বপ্ন দেখতে টাকা লাগে না। স্বপ্ন দেখা যায় বিনামূল্যে।
তোমাদেরই,
কিলিয়ান এমবাপে