যে রাতে মেসি প্রমাণ করেছিলেন তিনি একাই একশ
লিওনেল মেসি প্রতিপক্ষকে একাই দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারেন। এ ধারণাটা অবশ্য একদিনে পোক্ত হয়নি। প্রতিপক্ষকে মেসি কতোখানি নৃিশংসভাবে উড়িয়ে দিতে পারেন তার প্রথম আঁচটা টের পেয়েছিল আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল। ন্যু ক্যাম্পে উত্তেজনার সেই রাতে ২২ বছর বয়সী মেসি পেয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম হ্যাটট্রিক। অবশ্য ৩ গোলে থামেননি তিনি, ৪ গোল করে প্রায় একাই বার্সেলোনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে।
২০১০ এর ৬ এপ্রিল। ন্যু ক্যাম্পের সেই রাতে কিছুটা চাপে ছিল বার্সা। এমিরেটেসের প্রথম লেগে ২-২ গোলে ড্র করে ন্যু ক্যাম্পে অনুপ্রেরণা সঙ্গী ছিল আর্সেনালের। দ্বিতীয় লেগেও শুরুতেই হোঁচট। ম্যাচের ১৯ মিনিটে নিকোলাস বেন্টনার গোল করে যখন পুরো স্টেডিয়াম নীরব করে দিলেন তখন কেবল চাপটাই বেড়েছিল বার্সার।
অবশ্য মেসি বোধ হয় এমন পরিস্থিতিই চেয়েছিলেন। নায়ক হওয়ার গল্পে খানিকটা সঙ্কট না থাকলে বীরত্বগাঁথা জমে কী করে? মেসি এমনিতে অবশ্য ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননা। সেদিনও করেননি। তবে মেসি যেদিন বল পায়ে মাঠে বিতোভেনের নাইন্থ সিম্ফোনির ঝঙ্কার তোলেন সেদিন শুরুতেই ‘সতর্কবার্তা’ দিয়ে রাখেন প্রতিপক্ষকে। ন্যু ক্যাম্পের সে রাতেও অঘোষিত ঘোষণাটা দিয়ে রেখেছিলেন মেসি। আর্সেনাল কেবল আঁচ করতে পারেননি। অথবা পারলেও নিরুপায় হয়ে উপভোগ করতেই বাধ্য হয়েছিল।
বেন্টনারের গোলের আগেই দুইবার গোলে শট করে আর্সেনাল গোলরক্ষক ম্যানুয়েল আলমুনিয়াকে চমকে দিয়েছিলেন মেসি। প্রথমবার আলমুনিয়া অবশ্য দারুণ এক সেভে মেসিকে আটকে দিলেন। পরেরবার বক্সের ঠিক বাইরে থেকে মেসি বল মারলেন গোলবারের ঠিক ওপর দিয়ে। বেন্টনার যখন দুই লেগ মিলিয়ে ব্যবধান ৩-২ করেছেন তখন থমথমে অবস্থা ন্যু ক্যাম্পের। ওই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করা মানে গুমোট ভাবটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া, নিজেদের ওপর চাপ বাড়ানো। মেসি ঝুঁকি নিলেন না, জবাব দিতেও সময় নিলেন না। শুরুর ঝলকানিটা সত্যি করতে মেসি সময় নিলেন ২ মিনিট।
ঠিক যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে বারপোস্টের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মেরেছিলেন সেই জায়গায়টাই বেছে নিলেন। বাম পায়ে বুলেট গতির শটে বল পাঠালেন টপ কর্নারে। দুই লেগ মিলিয়ে ৩-৩ তখন স্কোরলাইন।
পেপ গার্দিওলা সেদিন একাদশে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বা প্রথম লেগে জোড়া গোল করা ইব্রাহিমোভিচ- কাউকেই রাখেননি। মেসির সঙ্গে বোয়ান কিরকিচ ও পেদ্রো রদ্রিগেজকে নামিয়ে আক্রমণভাগ সাজিয়েছিলেন বার্সা কোচ। ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় একাদশ বাছাইয়ে চমক এখনকার মতো তখনও দেখাতেন গার্দিওলা। তবে মেসি যখন দলে, তখন যে কোনো ঝুঁকি নিতে তো খুব বেশি ভাবার দরকারও নেই।
মেসি যখন ২১ মিনিটে ম্যাচে আর টাইয়ে সমতা ফিরিয়েছেন এরপর ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরেছে ন্যু ক্যাম্পেও। প্রথম ২১ মিনিট চড়াই-উতরাইয়ে থাকা বার্সা সমর্থকেরা পরের ২১ মিনিটে সবকিছু ভুলে গেছেন নিমিষেই। জাদুমন্ত্রের দিয়ে মুগ্ধ করে আসলে মেসি তখন এক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন। ন্যু ক্যাম্পে তখন প্রকম্পতি হয়েছে, ‘মেসি...মেসি..” রবে।
৩৭ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের আগে প্রায় একই ভঙ্গিতে আরেকবার সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন মেসি। বক্সের ভেতর ডান পাশে ঢুকে, ডান পায়ে কাছের পোস্টে বল মেরেছিলেন। সেবার বল লাগল সাইডনেটে। পরেরবার যখন একই জায়গায় বল নিয়ে গেলেন, আর ভুল করলেন না। ডান পায়ে কাছের পোস্টেই বল জড়ালেন, টাইয়ের ফল বার্সেলোনা ৪, আর্সেনাল ৩।
এরপরের গল্পে ধারাভাষ্যকার অ্যান্ডি গ্রেকে আনা যাক। ভদ্রলোকের জীবনে এমনিতেই আফসোস করার মতো অনেককিছুই ঘটেছে। তবে সেদিন তার দেওয়া ধারাভাষ্য আরেকবার শুনলে নিজেই লজ্জায় পড়ে যেতে পারেন। অবশ্য মন্দ কিছু বলেননি তিনি, শুধু আঁচ করতে ভুল করেছিলেন মেসির মাহাত্ম্যটা।
মিডফিল্ডে নিজেদের অর্ধ থেকে সতীর্থের হেডে বাড়ানো বল মেসি পেয়ে গিয়েছিলেন ফাঁকায়। সামনে ৫০ গজের মতো দূরত্ব, আছেন শুধু এক আর্সেনাল গোলরক্ষক আলমুনিয়া। অফসাইড ফাঁদ ফাঁকি দিয়ে মেসি এগিয়ে গেলেন তার দিকে। এর পর দুর্দান্ত এক চিপে এগিয়ে আসা আলমুনিয়ার মাথার ওপর দিয়ে সেই বল ঠেলে দিলেন জালে। ৪২ মিনিটে হয়ে গেল হ্যাটট্রিক। মেসির ইউরোপে প্রথম হ্যাটট্রিক।
ওই গোলের পর অ্যান্ডি গ্রে বলেছিলেন, “মেসির মতো মানুষের জন্যও এ ধরনের পারফরম্যান্স বিরাট এক ব্যাপার।” তখন পর্যন্ত অবশ্য সে কথায় যুক্তিই ছিল। তবে এরপর তো এসব একরকম নিয়মই বানিয়ে ফেলেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মেসিরা। তাদের সঙ্গে যে অন্যদের তুলনা হয় না- সে অবস্থানে যাওয়ার আগে এই দুইজনও যে বাকিদের মতো ‘সাধারণ’ ফুটবলারই ছিলেন তার একটা ‘রিমাইন্ডার’ মাত্র।
আর্সেন ওয়েঙ্গার সেদিন বার্সার বিপক্ষে ৪ জন ফরাসিভাষী ডিফেন্ডার নামিয়েছিলেন। থমাস ভারমালেনরা তখনও ফর্মের তুঙ্গে। ভাষা এক হলেই তো আর সমন্বয়ের ভাষা মেলে না। আগের ম্যাচের গোলদাতা আর্সেনাল অধিনায়ক সেস্ক ফাব্রিগাসও নেই দলে। মিডফিল্ডে আবু দিয়াবি ও থমাস রসিস্কির কথা ছিল মেসিকে পাহারায় রাখার। রসিস্কি তখন ঈদের চাঁদ, এই ভালো থাকেন, এই মন্দ। ফিট হয়ে বহুদিন পর পর হুট-হাট এক ম্যাচ খেলেন। এই দুইজন তো বটেই, মেসি ওই ৪ ডিফেন্ডারকেও বাকি সময়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘নাচিয়েছেন’।
আর আলমুনিয়ার ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল ৮৮ মিনিটে। কাছের পোস্টে একবার মেসিকে আটকে দিলেও, ফিরতি বল দুই পায়ের তার ফাঁক দিয়ে জালে পাঠিয়ে মেসি করেছিলেন চূড়ান্ত ‘অপমান’। বিষম খেয়ে শুরু করা রাতে বার্সা সমর্থকরা বাড়ি ফিরেছিলেন তৃপ্তির ঢেকুর তুলে।
সেবার অবশ্য চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে ইন্টার মিলানের কাছে বিখ্যাত এক হারে আর শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি বার্সা। তবে মেসি একাই যে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন, সে ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ন্যু ক্যাম্পের সে রাতেই। এর পর এখন পর্যন্ত আরও ৭টি হ্যাটট্রিক করেছেন মেসি। চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর সঙ্গে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ ৮টি হ্যাটট্রিক এখন তারও। সবকিছুর শুরু দশ বছর আগের সে রাত থেকেই।