• প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন
  • " />

     

    ১৪৬ টাকা, কলেজ ফাঁকি আর ঢাকা-ফতুল্লার 'দুঃসাহসিক' ভ্রমণ

    ১৪৬ টাকা, কলেজ ফাঁকি আর ঢাকা-ফতুল্লার 'দুঃসাহসিক' ভ্রমণ    

    সব থমকে গেছে যেন আপাতত। এ সময়ে প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন সিরিজে আমরা মনে করেছি মাঠে বসে আমাদের দেখা স্মরণীয় ম্যাচের কথা। যেখানে চারপাশে উল্লাস বা স্তব্ধতা যাই থাকুক, ঘোরলাগা মুহুর্তের রেশ ছিল আমাদের। 


    সেই সময়ের খুব বেশি কোনো স্মৃতি আসলে নেই আমার। তখন এতই ছোট যে আমাকে কাঁধে তুলে নেওয়া যেত। ছোটমামা ক্রিকেট ভালোবাসতেন। সুযোগ পেলেই খেলা দেখতে যেতেন। সে দেশের খেলা হোক, বা ঘরোয়া। বায়নাও ধরা লাগতো না, মাঝেমাঝেই নিজে থেকেই আমাকে নিয়ে যেতেন। মাঠের গেটে আমাকে কাঁধে তুলে চেঁচাতেন “একজন! একজন!” মানে যেহেতু আমি তার ওপর সওয়ার, আমার টিকিট লাগবে না কোনো। 

    খেলার স্মৃতিও বেশি নেই। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যত উত্তেজনা আমার, মাঠে গেলে ততটাই পানি পড়তো সেই উত্তেজনায়। এত মানুষ! মাঠটা এত্ত বড়! কিছুই তো দেখা যায় না। অল্প সময়েই হয়তো আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। খেলা শেষে মামা কোলে নিয়ে ফিরে আসতেন বাসায়। তারপরেও পঁচিশ বছরের তরুণ মামা কয়দিন পরেই আবার হুট করে বাসায় এসে বলতেন, “আপা, রিয়াদকে নিয়ে যাচ্ছি।” আর আমিও লাফাতে থাকতাম - খেলা দেখতে যাওয়ার উত্তেজনায়।

    খেলা কিছুই বুঝতাম না। দেখাই তো যেত না ঠিকমত। কিন্তু মাঠে যাওয়ার নেশার যেই বীজ, সেটি বোনা হয়ে গিয়েছিল হয়তো সেই ছোট্ট বয়সেই।

    এক

    আমাদের ক্লাসটাইমটা একটু অদ্ভুতই। প্রথমে চারটে পিরিয়ড, তারপর ব্রেক। ব্রেকের পর দুটি, যার প্রথমটি আনিস স্যারের। যাকে বলা যায় ভীতিকর ৫০ মিনিট। 

    ব্রেকের পর আমি তাড়াতাড়ি করেই ক্লাসে চলে আসি। এই সপ্তাহে কপালটাই খারাপ, সামনের দিকে সিট আমার। ক্লাসে কিছুই করা যাবে না, ক্লাসের আগে করতে হবে।

    কিন্তু জুলি আসেনি এখনো।

    জুলি আমার পাশে বসে। ডাকি জুলি, কিন্তু তার নাম জুয়েল। আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। স্যার আসার আগেই তাকে আসতে হবে!

    হয়না। জুলি ঢুকতে না ঢুকতেই স্যার এসে পড়েন।
     


    জুলিকে আমার প্রয়োজন, কারন তার একটি মোবাইল আছে। আমার নেই। সেই মোবাইল দিয়ে টেক্সট করলে ফিরতি টেক্সটে খেলার খবর জানা যায়। জুলি বাদে আশেপাশের অন্য কারো এত আগ্রহ নেই খেলা নিয়ে। জুলিরও ছোটমামা ছিল কি না জানি না, কিন্তু তার আছে আগ্রহ, আর আমার তো আছেই। শেষ আপডেট জেনেছিলাম ঘন্টাখানিক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে, খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। এপ্রিলের গরমের মতই অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা রীতিমত আগুন ঝড়াচ্ছে।

    হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, বাইনারি, হেক্সাডেসিমেল। স্যার কি সব বলেই যাচ্ছেন। এর মধ্যেই আমি জুলিকে ফিসফিস করে বলি, “জুলি, খেলার খবরটা একটু দেখবি রে!”

    “স্যার যেভাবে তাকিয়ে আছে! আচ্ছা, দাঁড়া!”

    খেলার স্কোর আর জানা হয় না। মোবাইল বের করা মাত্র স্যার দেখে ফেলেন। যেই সময়ের কথা বলছি, তখন ক্লাসে ফোন আনা আর বোমা আনা প্রায় সমান অপরাধ। ফলাফল, ফোন স্যারের হাতে চলে যায়।

    জুলি বহিষ্কৃত হয় ক্লাস থেকে। 

    দুই

    ২৬ এপ্রিল, ২০০৬। বুধবার।

    ক্লাসে যখন ঢুকছি, ৩-৪ জন বাদে আর কেউই আসেনি তখনো। সিটে ব্যাগটা রেখে গাঙ্গুলি ভবনের বারান্দায় এসে দাঁড়াই।

    আজকে খেলা আছে। ফতুল্লায়। ফতুল্লা আমি চিনি না। কখনো যাইনি। মনটা খারাপ হয়ে যায় আমার। জুলি এখনো ফোন ফেরত পায়নি। আজকে স্কোরও জানা যাবে না।

    রোদ লাগছে মুখে। ঘুরে ক্লাসে এসে ঢুকি। জুলি এসেছে।

    মুহূর্তেই পাগলামি ভর করে আমার উপর। হুট করে, একেবারেই হুট করে। আমি জুলিকে বলি, “জুলি, বাইরে আয়।”

    টানতে টানতে নিজেই নিয়ে আসি তাকে। বারন্দায় এক কোণে নির্জনে এনে বলি “খেলা দেখতে যাবি?”

    “পাগল তুই! পাশাপাশি দুইটা সিট খালি থাকলে…”

    আমারও ভয় লাগে। কথা বাড়াই না আর। কিন্তু জুলি নিজেই বাড়ায়। “কীভাবে যাবি?”

    “জানি না। ফতুল্লায় নাকি ট্রেন যায়”

    “এতদূর যাবি”

    “চল কমলাপুর গিয়ে দেখি কীভাবে কী হয়”

    সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয় না। আর বেশি বাকি নেই আটটা বাজতে, এখনই বের হয়ে যেতে হবে। নটরডেমের এই একটা সুবিধা, আমাদের কোন ইউনিফর্ম নেই। এবং যখন তখন বের হওয়া যায় চাইলেই। তার উপর বিকেলে থাকে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যাই হয়। আমরা কোনো ফাঁক দেখি না আমাদের পরিকল্পনায়। ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকি দুইজন। ব্যাগ নিয়ে বের হয়েই দৌড়াতে থাকি। 

    আমি ছেলে ভালো, এবং বোকা। এবং ভীতুও। স্কুল জীবন, কলেজ জীবন - কখনো ক্লাস ফাঁকি দেইনি। প্রথমবারের মত ক্লাস ফাঁকি দিলাম, এবং ট্রেনে চড়ে এমন এক শহরে যাচ্ছি, যেখানে আগে কখনোই যাইনি। 

    ভয় বাড়ছে, বাড়ছে আনন্দও! আমি মাঠে যাচ্ছি! আমি খেলা দেখতে যাচ্ছি!

    তিন

    “পকেটে কত আছে বের কর তো”

    আমরা বসে আছি কমলাপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে। খুঁজে-টুজে একটা লোকালের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, কিছুক্ষন পরই ছাড়বে।

    আমার প্রতিদিনের বরাদ্দ থাকে ৬০ টাকা, বাসা থেকে দেয়। পকেট থেকে ৪৬ টাকার মতো বের হয়। বাকিটা খরচ হয়ে গিয়েছে।

    জুলি আমার চেয়ে একটু ‘বড়লোক’। ওর পকেট থেকে আসে ১০০ টাকার মত। 

    দুইজনেরটা মিলিয়ে গুনতে থাকি। আমাদের সারাদিনের সম্বল।

    “আচ্ছা, খেলা যে দেখতে যাচ্ছি, টিকেট কই!”

    টিকেট সমস্যা না, মাঠে গেলে পাওয়া যাবে আমি নিশ্চিত। কিন্তু টিকিট কাটতে কত লাগতে পারে, ঘুণাক্ষরেও আইডিয়া নেই আমার। কীভাবে যাব কীভাবে ফিরবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

    “চল, আগে গিয়ে দেখি”

    লোকাল ট্রেনে টিকেট লাগে না। আসলে লাগে, কিন্তু আমাদের মত ‘গরীবদের’ লাগে না। এত্ত ভীড়! পা ঝি ঝি ধরলে পা টা যদি উঠিয়েছেন একটু সরিয়ে রাখতে, ব্যস, আপনি শেষ। ওই পা রাখার আর জায়গা পাবেন না।

    এপ্রিলের গরম। এক ভদ্রলোক মুরগী নিয়ে উঠেছেন, মাথায় মুরগীর ডালা নিয়ে আমার পাশেই দাঁড়ানো। মুরগীগুলো আমার মাথার দিকেই খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। 

    “জুলি, আর কতক্ষন লাগবে রে?”

    জুলির অবস্থাও আমার মতই। উত্তর দেয় না সে। উত্তর দেয় পাশের মুরগীওয়ালাই। ফতুল্লা আরো এক ঘন্টা।

    এক ঘন্টা পর যখন ট্রেন থেকে নামছি, দুইজনের কাুকেই চেনা যাচ্ছে না। দরদর করে ঘামছি। ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ, কিন্তু পয়সা বাঁচিয়ে চলতে হবে।


    যখন মামা নিয়ে যেতেন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে, ২০০২ সালে/রিয়াদ আহমেদ


    স্টেডিয়াম অনেক দূর। ১৫ টাকার বিনিময়ে এক রিকশা নেয়া হয়। রিকশা থেকে নামি স্টেডিয়ামের গেটেই। খেলা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাংলাদেশ বোলিংয়ে। অস্ট্রেলিয়ানর তিনটি উইকেট ফেলেও দিয়েছেন মাশরাফি। প্রতিটি লফটেড শটে স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে ভেসে আসে হুল্লোড়ের শব্দ, একেকটা বিটে যেন বিশ্বজয় হয় দর্শকদের। বাইরেও এক আনন্দঘন পরিবেশ! মাথায় লাল সবুজ হ্যাট লাগিয়ে পতাকা বিক্রি করছে কেউ, কেউ আবার গালে হাতে লাল সবুজ এঁকে দিতে চাইছে।

    আমাদের টিকেটের কাছে যেতে হয় না। টিকেটই আমাদের কাছে আসে। “ছোটভাই, টিকেট লাগবো? দুইটা ১০০ টাকা”। জুলি দামদর করে, ৭০ টাকায় রফা হয়। 

    এই টিকেট দুটি আমাদের। আমরা মাঠে ঢুকতে পারবো, আমরা খেলা দেখতে পারবো। আমাদের আনন্দ দেখে কে! এবার কাঁধে ইংরেজির মোটা বই এর ওজন গায়েই লাগে না, এক দৌড়ে মাঠে!

    ঠিক সেই মুহূর্তেই আনিস স্যার আমাদের বেঞ্চের তৃতীয় সদস্য মুনকে জিজ্ঞাসা করছেন, “পাপি দুইটা একসাথে অ্যাবসেন্ট? কী ব্যাপার? কোথায় গিয়েছে?”

    চার

    খেলার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। 

    মাঠে ঢুকে আর উইকেটের দেখা পাই না আমরা। ক্রিজ জুড়ে মনের আনন্দে খেলে যাচ্ছেন মাইকেল ক্লার্ক আর অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। জুটিটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!

    কারো বলেই কাজ হচ্ছে না। বাঁহাতি মোহাম্মদ রফিক বা আব্দুর রাজ্জাক। আমরা হতাশ হয়ে অস্ট্রেলিয়ানদের জুটি বড় হতে দেখতে থাকি। 

    গ্যালারিতে কাঠফাটা গরম। আমরা একটা ছায়া খুঁজে নিয়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মাঝেমাঝে “বাংলাদেশ - বাংলাদেশ” স্লোগান উঠে। গলা ফাটিয়ে চেঁচাই। গলা শুকায়। পেটে চো চো ক্ষুধা। দুজনের কেউই এ নিয়ে কিছু বলি না অন্যজনকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। সাইমন্ডস ছয় হাঁকাতে গিয়ে ক্যাচ উঠিয়েছে যেন। আমরা বিকট শব্দে উত্তেজনা প্রকাশ করি। হয় না। বল মাটিতে নেমে আসে।

    “জুলি, গলা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে রে!”

    “চল, টয়লেটে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসি।”

    টয়লেট ভরতি পানি। ট্যাপে না, মেঝেতে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। তীব্র গন্ধে নাড়ি উলটে আসে আমার। চোখে একটু আঁধার সয়ে এলে দেখি মেঝেতে বিছানো ইট। ওগুলোর উপর পা রেখে যেতে হবে একটা ভাঙ্গা ট্যাপের কাছে, যেখান থেকে অবিরত পানি পড়ছে।

    মুখ ধুতে ধুতেই শুনি স্টেডিয়াম জুড়ে গগন বিদারী আওয়াজ। সকলের প্রিয় রফিক অবশেষে ক্লার্ককে ফিরিয়েছেন।  আমি এই উইকেটটিও দেখতে পেলাম না!

    তাড়াহুড়া করে ফিরতে গিয়ে ইট থেকে পিছলে যায় পা। গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ডুবে যায়। ঘৃনায় রি-রি করে উঠে শরীর। 

    বের হয়ে দেখি মাইক হাসি নামছেন। কী ভাবছেন, জায়ান্ট স্ক্রিনে রিপ্লে তো দেখাই যায়? যখনের কথা বলছি, মাঠে কোন জায়ান্ট স্ক্রিন দূরে থাক, শেডও ছিল না। হসপিটালিটি বক্স ছিল শামিয়ানা দেয়া, প্লাস্টিকের আরএফএল চেয়ার বসানো। উইকেট যাওয়ার আনন্দে ওই চেয়ারগুলোই মাথায় নিয়ে নাচছেন কতিপয় যুবক।

    আর যায় না উইকেট। একদম শেষ বলে রাজ্জাক ফেরান হাসিকে। অন্যপ্রান্তে সাইমন্ডস থাকেন অপরাজিত। ৫০ ওভারে স্কোর ২৫০, ৫ উইকেটে। আমরা খুশি, কারন পর্বতসম স্কোর দেখতে হলো না। মাশরাফিকে বড্ড আপন লাগে আমাদের। মনের কোনে কোথায় যেন বিশ্বাস লাগে, আমরা আজকে জিতবো। ২৫০ চেজ করে গত বছরই না জিতে গেলাম! আজও পারবো।

    “রিয়াদ, চল খাই কিছু। আর তো থাকা যাচ্ছে না”

    আমরা বের হয়ে আসি। টিকেটের ছোট একটা টুকরো আমাদের হাতে দিয়ে বাকিটুকু রেখে দেয় গেটে। এই টুকরো দিয়ে আমরা এই একবারই বের হতে পারবো। বাচ্চারা ঘিরে ধরে আমাদের। এই টুকরো টিকিট বিক্রি করবো কিনা! তাদেরকে বাঁচিয়ে সাবধানে পাশ কেটে একটা দোকানে যাই আমরা। পানি কিনি আগে এক বোতল। ২০ টাকা চলে যায়। আর কি খাওয়া যায় চিন্তা করতে থাকি।

    পকেটে খুব বেশি নেই। 


    এক পেটিসওয়ালাকে পাওয়া যায়। আমরা পেটিস কিনি একটা। ৫ টাকা রাখে। হাতেই ভাগ করে খেয়ে নেই দুইজন। পেটের কোনাটাও ভরে না কারোরই। “জুলি, আরেকটা নিবি?”

    একবার ভেবে সায় দিয়ে দেয় জুলি। “হু, চাচা, আরেকটা দেন।”

    ভাগ করতে গিয়ে আমি বলি, “চাচা, ছুরিটা একটু দেন, এর আগেরটা সমান হয় নাই।” পেটিসের ডালায় রেখে ছুরি দিয়ে পেটিস কাটি।

    পেটিস দুই টুকরা হয়ে পড়ে যায় দুই দিকে। অতি দুঃখেও হাসি পায় আমাদের। কপালে না থাকলে কীইবা আর করার থাকে।

    খেলা শুরু হয়ে যায় ততক্ষণে। আমরা আবার মাঠে ফিরে আসি। আশার প্রদীপ নিভে যেতে সময় লাগে না। এপ্রিলের গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে আগুন ঝড়াতে শুরু করেন ব্রেট লি, মিশেল জনসনরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের দুই ওপেনার প্যাভিলিয়নে। একটু পর ফিরে যান তুষার ইমরানও।

    গ্যালারি জুড়ে স্তব্ধতা। জাভেদ ওমর একপ্রান্ত আগলে রাখার চেষ্টা করতে থাকেন। বলের পর বল ছাড়তে থাকেন তিনি। অস্থির হয়ে উঠে গ্যালারি। অসন্তোষের সুর বাড়তে থাকে পারদে। একসময় তা রুপান্তরিত হয় গালিগালাজে। তার মাঝেও চার মেরে দেন জাভেদ ওমর। এক সেকেন্ড আগে গালি দেয়া মানুষটাই লাফিয়ে চেঁচিয়ে হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন। ততক্ষণে হাবিবুল বাশারও একটু সামলে নিচ্ছেন। রান বাড়ে, বাড়ে গরম। বাড়ে আমাদের ক্লান্তি। বাড়ে ক্ষুধা।

    আনন্দকাল স্থায়ী হয় না বেশিক্ষন। গালির সমুদ্র পাড়ি দিতে দিতে ফিরে যান জাভেদ ওমর। পরক্ষনেই সেটি উল্লাসের সাগর। পাইলট নেমেছেন।

    উল্লাস বাড়ে, বাড়ে বিশ্বাস। তারপরও আস্কিং রেট বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে না রানের গতি। চেষ্টা করেন হাবিবুল বাশার, চেষ্টা করেন পাইলট। হয় না। একসময় দুইজনই ফিরে যান। রফিকের উপর ভরসা ছিল, প্রথম বলেই শেষ সেটি। মাশরাফি কিছুক্ষন বিনোদন দেন দর্শকদের। তবু কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্রমাগত আসা যাওয়ার মিছিলে কখন যেন ইনিংসটাই শেষ হয়ে যায়। মাঠ খালি হতে শুরু করে তারও কিছুক্ষন আগে থেকেই। 

    বিকেলের কমে আসা গরমে হঠাৎ করেই কোত্থেকে ভয় এসে জাঁকিয়ে ধরে। দেরি করে ফেললাম না তো? বাসায় ধরা খাবো না তো? আনিস স্যার?

    বাড়ির পথে পা বাড়াই। আবার রিকশায় করে স্টেশন। বিনা টিকেটে ঢাকাগামী ট্রেনযাত্রা। গরম। ভীড়। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। ক্লান্তিতে দাঁড়াতে পারছি না। ম্যাচ হেরেছি বড় ব্যবধানে। ক্লান্তি মাখা কন্ঠে আমি জুলিকে জিগেশ করি ও ঠিকমত দাঁড়াতে পেরেছে কিনা। জুলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। ক্লান্তি ছাপিয়ে আমাদের চোখে লেগে থাকে তৃপ্তি। চোখে লেগে থাকে আনন্দ।

    চোখে লেগে থাকে হাবিবুল বাশারের ৭০ রান। পাইলটের ৩৬। জাভেদ ওমরের ৩৪।

     

    পুনশ্চঃ সেদিনের পর মাঠে যাওয়ার নেশাটা ধরে বসে পাকাপোক্তভাবে। খুব শীঘ্রই আবিষ্কার করি যে মাঠে খেলা দেখতে গেলে বাসা থেকে আমাকে নিষেধও করে না। মাঠে যেতে যেতেই পরিচয় হয় আরো কিছু খেলাপাগল ছেলেদের সাথে, যাদের সাথে 'দৌড়া বাঘ আইল' ব্যানারে খেলা দেখে যাচ্ছি এখনো। 

    কলেজ জীবন শেষে জুলির সাথে আর তেমন যোগাযোগ থাকেনি। তবে পথ চলতে চলতে দেখা হয়েছিল কয়েকদিন আগে। মুখভর্তি দাড়ি সমৃদ্ধ জুলিকে চিনেছিলাম জুলির হাসিটা দিয়েই। 


    রিয়াদ আহমেদ প্যাভিলিয়নের অপারেশনস ম্যানেজার