২৫ পাসের গোল আর ৫৫ সেকেন্ডের মুগ্ধতা
২০০৬ বিশ্বকাপে দারুণ এক গোল করেছিল আর্জেন্টিনা। টানা ২৫ পাসের সাজানো আক্রমণের পর সেই গোলটি এসেছিল এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোর পা থেকে। এমন কিছু অবশ্য দৈবক্রমে ঘটেনি, আর্জেন্টিনার তখনকার কোচ হোসে পেকারম্যানের বহুদিনের সাধনার ফল দেখিয়েছিল তার দল।
প্রথম ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলেন কি দেখে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনার জবাব হবে- কোনো এক খেলোয়াড় অথবা কোনো দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে। ফুটবলের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক যত গভীর হয়েছে, ততো এর নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে ধারণা বেড়েছে। কিন্তু শুরুটা হয়ত দারুণ কোনো মুহুর্ত থেকে। বেশিরভাগ সময় ওই মুহুর্তটার নাম, "গোল"।
বয়স যত বেড়েছে আপনি বুঝে গেছেন একটি শৈল্পিক গোল আসলে শত শত দিনের অনুশীলনের ফল। দলগত গোল হলে তার পেছনের গল্প আরও বড়। একজন কোচের পুরো ক্যারিয়ার স্বার্থক হওয়া মুহুর্ত এসব। পুরো জীবনের কঠোর পরিশ্রমের ফল চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কি হতে পারে?
হোসে পেকারম্যান আর আর্জেন্টিনার ২০০৬ বিশ্বকাপ যাত্রাটা সফল হয়নি। তবে পেকারম্যানকে এমন একটি মুহুর্ত ওই বিশ্বকাপে পেয়েছিলেন, যেটা দিয়ে নিজেকে সফল দাবি করতেই পারেন তিনি। সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে গোলটা করেছিলেন এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো। তিনি শুধু শেষপ্রান্তেই ছিলেন, বাকি কাজটা আসলে ছিল পুরো দলের এক অনবদ্য প্রচেষ্টা।
মার্সেলো বিয়েলসা ২০০৪ কোপা আমেরিকা শেষে দায়িত্ব ছাড়ার পর পেকারম্যানের দ্বারস্থ হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৪ বারের ভেতর ৩ বারই আর্জেন্টিনা অনুর্ধ্ব-২০ দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন পেকারম্যান। তাকে দায়িত্ব দেওয়ার কারণটা ছিল স্পষ্ট। যে তরুণদের নিয়ে পেকারম্যান অবিশ্বাস্য সাফল্য এনে দিয়েছিলেন, তারাই তখন জাতীয় দলের কান্ডারি। হুয়ান পাবলো সোরিন, হুয়ান রমান রিকেলমে, ম্যাক্সি রদ্রিগেজ, হাভিয়ের মাসচেরানো, এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোদের তার চেয়ে ভালো আর কে চেনেন! জাতীয় দলের কোচদের দায়িত্বও তো খানিকটা আলাদা। খেলোয়াড়দের সঙ্গে তারা সময় কাটানোর সুযোগ পান কম। স্বল্প সময়ে সেরাটা বের করে আনতে খেলোয়াড় আর কোচের সমন্বয়টাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দলে।
পেকারম্যানের দল কেমন করতে পারে তার একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা বিশ্ব পেয়ে গিয়েছিল বিশ্বকাপের আগের বছর। এস্তাদিও মনুমেন্টালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে। ব্রাজিলের বিপক্ষে সেদিন চোখ ধাঁধানো এক পারফরম্যান্সে ৩-১ এ গোলে জিতে জার্মানি বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিল আর্জেন্টিনা। রিকেলমে, ক্রেসপো, সাভিওলারা বিশ্বকাপেও গিয়েছিলেন ফর্মের তুঙ্গে থেকে।
পেকারম্যানের আলাদা একটি দর্শন ছিল। প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডে নিজেদের পায়ে বল রেখে খেলতে বলতেন পেকারম্যান। এই রিকেলমে, সাভিওলারা ১৮ বছর বয়সে এই দর্শনের হাতেখড়ি পেয়েছিলেন পেকারম্যানের কাছে। পরিণত বয়সে এসে একই দায়িত্ব পড়ল আবার তাদের কাঁধে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আইভোরি কোস্টের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় দিয়ে শুরু আর্জেন্টিনার। ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোল ছাপ রেখে গিয়েছিল পরিচ্ছন্ন আর্জেন্টিনার।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় আপনি দ্রুত দ্বিতীয় গোল পেতে চাইবেন। ৩৮ মিনিটে হাভিয়ের মাসচেরানো যখন আইভরি কোস্টের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়েছেন, তখন কাউন্টার অ্যাটাকটাই অনুমিত ছিল। কিন্তু পেকারম্যানের দর্শন এক্ষেত্রে আলাদা। টিকিটিকার উত্থানের আগে আর্জেন্টিনার ওই দলটাকে তিনি ধীর-স্থির ফুটবলে উজ্জীবিত করেছিলেন। মাসচেরানো বল পাওয়ার পর সরাসরি আক্রমণে না গিয়ে আর্জেন্টিনা খেলল আরও ৭টি পাস। অষ্টম পাসটি ছিল রিকেলমের। তার ডিফেন্সচেরা পাস ধরে সাভিওলা ব্যবধান দ্বিগুণ করেছিলেন দারুণ এক ফিনিশে।
রিকেলমের খেলার ধরন নিয়ে অবশ্য আর্জেন্টিনায় সমালোচনা ছিল। তার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল না কখনই। কিন্তু বেশি সৃজনশীল হতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই খাপছাড়া ফুটবল খেলতেন রিকেলমে। ট্র্যাক ব্যাক করতেন না, বল হারালে প্রেস করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করতেন না। ‘ছন্নছাড়া রিকেলেমে’ বেশ কয়েকবারই ভুগিয়েছেন দলকে। চড়া মাসুলও দিতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। পেকারম্যান যেহেতু রিকেলমের আচার-আচরণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন তাই আর তাকে বদলাতে চাননি তিনি। তার ঠিক পেছনে মাসচেরানো বা ক্যাম্বিয়াসোকে খেলিয়ে (কখনও কখনও দুইজনকেই একসঙ্গে নামিয়ে) দুর্যোগ সামাল দিতেন পেকারম্যান। আর রিকেলমে তাতে মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করে বেড়াতেন মাঠজুড়ে।
এইসব পরিকল্পনার কার্যকর হলে ফুটবল কতোখানি লাবণ্য ছড়ায় সেটিই দেখেছিল গেলসেরকারখেন। সার্বিয়ার বিপক্ষে এক গোলে এগিয়ে তখন আর্জেন্টিনা। ঘড়ির কাটা আধ ঘন্টা ছুঁই ছুঁই। এবার ম্যাক্সি রদ্রিগেজ নিজ অর্ধে সার্বিয়া মন্টেনেগ্রোর কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। প্রথম পাসটা পেয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল হাইঞ্জা। এরপর আবার রদ্রিগেজ। মাঠের মাঝখানে মাসচেরানো-রিকেলমে ঘুরে বল আবার সেন্টারব্যাক রবার্তো আয়ালার কাছে। সোরিন আরেকবার যখন বল পেলেন, ততোক্ষণে বাম প্রান্তে অনেক দূর উঠে গেছেন তিনি। বক্সের ভেতর ছিলেন সাভিওলা-ক্রেসপো। চাইলে ক্রস করতে পারতেন। ক্রস না করে আবার পাস বাড়ালেন। সোরিন তৃতীয় দফায় বল পেয়েও ক্রস না করে সামনে পাস বাড়ালেন সাভিওলার উদ্দেশ্যে। রিকেলমে ততোক্ষণে অ্যাটাকিং থার্ডের হাফস্পেসে। আলতো টাচে বল তুলে দিলেন সাভিওলাকে, সেখান থেকে বক্সের ঠিক বাইরে থেকে ক্যাম্বিয়াসো। সার্বিয়ার রক্ষণ ততোক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আর আর্জেন্টিনাকে বহুদিন ধরে অনুসরণ করছেন যারা, তারা বুঝে গেছেন এটা পেকারম্যানের দুর্দান্ত সেই চাল। দারুণ কিছু হতে চলেছে।
ক্রেসপোর দারুণ ব্যাকহিল গিয়ে পৌঁছাল গোল থেকে ঠিক ১২ গজ দূরে থাকা ক্যাম্বিয়াসোর পায়ে। যিনি ক্রেসপোকে ২৪ তম পাস দিয়ে ফিরতি পাসের আশায় বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন। এরপর বাম পায়ের শটে ক্যাম্বিয়াসো যে গোল করলেন সেটা ঢুকে গেল ইতিহাসে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল তো বটেই, পাসের হিসেবে সেরাদের সেরা হয়ে গেল সেই গোল।
ক্যাম্বিয়াসো অবশ্য নিজেকে ভাগ্যবানই ভাবতে পারেন। ওই ম্যাচে একাদশেই ছিলেন না তিনি। লুচো গঞ্জালেজ ১৬ মিনিটে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়ার পর মাঠে নেমেছিলেন তিনি। এমন চিত্রকর্মে তুলির শেষ আঁচড়টা তার জন্যই বোধ হয় জমা ছিল। পুরো ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের হয়ে মোট ৫ গোল করেছেন ক্যাম্বিয়াসো। গোল দেওয়ার জন্য তাকে আলাদা করে মনে রাখার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই এক গোলেই অমর হয়ে গেছেন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার।
ওই গোলের বিল্ডআপে সবচেয়ে বেশি পাসও ক্যাম্বিয়াসোই দিয়েছিলেন। অংশগ্রহণ ছিল সবার। এগারো জনের ভেতর বাদ পড়েছিলেন কেবল গোলরক্ষক কার্লোস আবদেনজিয়েরি ও ডিফেন্ডার নিকোলাস বুরদিসো। আর সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিলেন রিকেলমে। গোলের কিলার পাসটা এসেছিল তার পা থেকেই, ২৫ পাসের ভেতর মোট ৪টিই তার।
গোলের পর অবশ্য ক্যাম্বিয়াসো ঘোরের ভেতর ছিলেন। সতীর্থরা গোল উদযাপনের সময় যা বলাবলি করছিল তাই শুনে তখন বুঝতে পেরেছিলেন দুর্দান্ত এক শিল্প রচনা হয়ে গেছে মাঠে, "আমাদের কোচ পেকারম্যান আমাদের এভাবেই খেলতে বলতেন। পরিচ্ছন্নভাবে বল পাস করতে বলতেন। আপনি গোলটি আরেকবার দেখলে বুঝতে পারবেন, এতে সবকিছু আছে। ধৈর্য্য, ছন্দ, ছন্দ পরিবর্তন, চমক- সবকিছু।"
আর্জেন্টিনার গল্পটা সেবারও মধুর হয়নি। ওই বিশ্বকাপ শেষে পেকারম্যানের একটি সিদ্ধান্ত আর্জেন্টিনার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়ের জন্য সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছিল। জার্মানির বিপক্ষে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ম্যাচের ৮০ মিনিটে রিকেলমেকে উঠিয়ে ক্যাম্বিয়াসোকে নামিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা কোচ। পুরো ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করা আর্জেন্টিনা এরপরই খেই হারিয়েছিল। বলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গোল হজম করে শেষে গিয়ে টাইব্রেকারে বিদায়। ওই বদলিটা পেকারম্যান কেন করিয়েছেন সেটা এক রহস্যই থেকে গেছে।
ফুটবলারদের অনুশীলনে বারবার করে কিছু ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। সেগুল অনেকটা ব্যবহারিক ক্লাসের মতো। দুর্দান্ত দলগত গোল কিভাবে দিতে হয় সেই ক্লাসে নিশ্চিতভাবে এই ম্যাচের ফুটেজ দেখানো হয় বারবার করে। ক্যাম্বিয়াসোর ২৬ পাসের গোলটি শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছে গবেষণার বস্তু। সময় যত যায় ততোই কদর বাড়ে। যার পাস থেকে এই গোল সেই ক্রেসপোর কাছে এটা, 'দ্যা বিউটিফুল গোল'। যে সব কারণে খেলাটা 'দ্য বিউটিফুল গেম' তার বড় একটা অনুষঙ্গও তো জাদুঘরে যত্ন করে তুলে রাখার মতো এমন সব ৫৫ সেকেন্ডের মুহুর্ত।