• প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন
  • " />

     

    একটি জয়ের খোঁজে...

    একটি জয়ের খোঁজে...    

    সব থমকে গেছে যেন আপাতত। এ সময়ে প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন সিরিজে আমরা মনে করেছি মাঠে বসে আমাদের দেখা স্মরণীয় ম্যাচের কথা। যেখানে চারপাশে উল্লাস বা স্তব্ধতা যাই থাকুক, ঘোরলাগা মুহুর্তের রেশ ছিল আমাদের। 


    স্কুলে পড়ার বয়সটায় কলোনির বড় মাঠে ক্রিকেট লিগের খেলা চলতো যে কটা দিন, দুপুরের খাবারের সময়টা ছাড়া বাড়িমুখো হওয়া হতো কমই। ব্যস্ততাটা অবশ্য খেলোয়াড় বলে নয়, দর্শক হিসেবে। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার শখটা প্রায় সমবয়সী পুরোনো হলেও পূরণ হতে পেরিয়ে গেছে কলেজের গন্ডি। বছর দশেক আগে ঢাকায় তখন সবে পথঘাট চিনতে শুরু করেছি, বাসা থেকে মিনিট দশেক দূরের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ দেখতে যাওয়ার লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়তো তখন। শৈশব স্মৃতির কোনো দৈনিকের প্রথম পাতায় লাল কালিতে শিরোনাম হওয়া ‘ঢাকা ডার্বি’র উত্তাপ ততোদিনে তেজ হারিয়েছে অনেকটাই, ঘরোয়া ফুটবলের খবর হয়তো খেলার পাতাতেও খুঁজে পড়তে হয়। তবু নীল-হলুদ আর সাদা-কালো গ্যালারিগুলো জাগিয়ে রাখা নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকগোষ্ঠীর হাতে ফুটবলের সুদিন ফেরানোর দায়ভার দিয়ে মিরপুরের বাস ধরি গোলাপ শাহ মাজারের মোড় থেকে।  

    ‘হোম অব ক্রিকেটে’র গ্যালারিতে অভিষেক হয়েছিলো ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সফর চলাকালীন। খুলনায় প্রথম দুটো ওয়ানডে জিতে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ। দারুণ ছন্দে থাকা দলটার খেলা মাঠে গিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো খুব। মিরপুরে পরের তিন ম্যাচের টিকিটের জন্য তেমন বেগ পেতে না হলেও স্টেডিয়ামপাড়ায় পৌঁছে চোখ চড়কগাছ হওয়ারই জোগাড়। বাইরের জনসমুদ্রে হাঁসফাঁস করতে করতে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত পৌঁছনোর পীড়াটুকু আরও এক প্রস্থ বাড়িয়ে দিয়ে সাধের হেডফোনখানা নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরোতে পারলো না। গ্যালারির পথে হাঁটতে হাঁটতে কতোটা ক্ষতি হয়ে গেলো সে হিসেব কষতে থাকা বিরস বদনের সামনে আচমকা সবুজ মাঠখানা উন্মুক্ত হতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। টিভি পর্দার মিরপুর খোলা চোখের ‘ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে’ অন্যরকম এক মুগ্ধতা নিয়ে দৃশ্যমান হয়। তবে ভালোলাগার মুহূর্তটুকু ইস্টার্ন গ্যালারির গগনবিদারী গর্জনের মাঝেও বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে দিচ্ছিলেন না স্যামি-নারাইনরা। কাভারে নিয়মিত বিরতিতে নাঈম-নাসির-মমিনুলের ক্যাচ নিয়ে ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে পোলার্ড হয়তো গ্যালারির উদ্দেশ্যে গাইতে চাইলেন, ‘আওয়াজ করা বারণ’!

    সিরিজ নিশ্চিত করার ম্যাচে আগের দুদিনের বাংলাদেশ দল নিজেদের হারিয়ে খুঁজে ফিরেছিলো। মাহমুদুল্লাহ-মুশফিকদের ব্যাটে দলের সংগ্রহটা শেষ অব্দি ভদ্রস্থ হলেও জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। তবে উদযাপনের যতোটুকু উপলক্ষ্যই এসেছিলো, গলা ভেঙ্গে বাড়ি ফিরতে কার্পণ্য করি নি। ওহ বলা হয় নি, ওপরে বর্ণিত ঢাকা ডার্বির ম্যাচটিতে আবাহনীকেও গলা ফাটানো সমর্থনে হারিয়ে এসেছিলাম। 

    ক্যারিবিয়রা পরের ম্যাচেও ৭৫ রানের বড় জয়ে সিরিজে ২-২ সমতা ফেরালে গ্যালারি ছাড়তে ছাড়তে একরকম কাগজে-কলমেই ‘অপয়া’র খাতায় নাম লেখাই। সে রাতে ১০ নম্বরের গোলচত্বর থেকে বাসে চেপে ভিক্টোরিয়া পার্কে নামতে নামতে ফোনে-মেসেজে বন্ধু-নিকটজনদের অনুনয়-বিনয় থেকে শুরু করে হুমকি-ধামকি সবই পাওয়া হয়ে গেলো, সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে যেনো কোনোভাবেই মাঠে না যাই। 

     


    আরেকবার হারতে হবে?/ক্রিকইনফো


    ওসবে দমবার পাত্র ছিলাম না তখনও। এক সপ্তাহ বাদে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল শুরু। তাতেও আমার থোড়াই কেয়ার বুঝেই হয়তো ওপরওয়ালা নিজেই দায়িত্ব নিলেন। ‘ডিসাইডার’ ম্যাচের আগের দিন জন্ডিসে কাবু হয়ে শয্যাশায়ী হলাম। ‘চাপমুক্ত’ হলো বাংলাদেশ দলও, দুই উইকেটে সিরিজ জয়ের পাশাপাশি নিশ্চিত করলো গ্যালারিতে আমার উপস্থিতি প্রিয় দলের জন্য মোটেও প্রীতিকর নয়। 

    কিন্তু এ অপবাদ নিয়ে তো নির্লিপ্ত বসে থাকা যায় না। দুনিয়ার যে একটামাত্র দলকে কোনো শর্ত ছাড়াই সমর্থন করি তাঁদের জন্য মাঠে অলক্ষুণে হয়ে থাকাটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। বন্ধু-প্রিয়জনদের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে তাই আমি মাঠে যাওয়া অব্যাহত রাখার পণ করলাম, গ্যালারিতে বসে জয় না দেখে হাল ছাড়ছি না। কিন্তু বিধি বাম, দেশের মাঠে পরের এক বছর খেলাই নেই কোনো! বছর ঘুরে আসা নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাইয়ের সিরিজে একটা টিকিটের জন্য মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় ভোর ছ’টা থেকে দুপুর দুটো অব্দি লাইনে দাঁড়িয়েও ফিরতে হয়েছিলো খালি হাতে, পুলিশের লাঠিপেটায় টিকিটপ্রত্যাশী জনতার ভিড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়ে। ক্রিকেটের সুদিন শুরু হতে না হতেই কালোবাজারি ব্যবসার ‘কর্পোরেট’ রূপটাও সেদিন দেখা হয়ে গিয়েছিলো কিছুটা।

    টিকিট সহজলভ্য হতে হতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সেও মন্দা দশা ফিরে এলো। কিংবা হয়তো আমি আবার মাঠে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে সেটা ফিরিয়ে আনলাম। শ্রীলংকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে সবক’টি হেরে শুরু হওয়া ২০১৪ সালে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ঘরে-বাইরে টানা ২৩ ম্যাচে জয়ের মুখ দেখে নি ‘টাইগার’রা, মাঝে দেশের মাটিতে হওয়া টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তান আর নেপালের বিপক্ষে দুটো জয় ছাড়া। 

    ‘জিততে ভুলে যাওয়া’ বাংলাদেশ দলের সামনে পরবর্তী প্রতিপক্ষ তখন জিম্বাবুয়ে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের পুরোনো পরীক্ষিত বন্ধু। তবে ঘরের মাঠের তিন জাতি সিরিজে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকাকে ‘আপসেট’ করে আসা দলটা সেবার খুব সহজে শিকার হওয়ার বার্তা নিয়ে আসে নি। 

    তবু মিরপুরে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে অতিথিদের ২৪০ রানে গুটিয়ে দিয়ে আশা জাগান সাকিবরা। জবাবে দ্বিতীয় দিনের শেষে বাংলাদেশও ২৫৪ রানে অলআউট হলে চতুর্থ দিনের টিকিট কাটার প্ল্যান করি। কিন্তু তৃতীয় দিনের সকালেই জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংস ১১৪ রানে শেষ হলে প্ল্যান বদলাতে হয়। ক্লাস কামাই দিয়ে বন্ধু তুষারকে সঙ্গে করে স্টেডিয়ামে পৌঁছতে পৌঁছতে ১০১ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের কোনও রান না করতে ৩ উইকেট নেই। সেদিন অবশ্য প্রতিজ্ঞা করেই গিয়েছিলাম, আজ হেরে ফিরলে এ জীবনে আর মাঠমুখো হচ্ছি না। 

    সোমবারের সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়লে দর্শকের সংখ্যাও বাড়ে গ্যালারিতে। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের উল্টোরথ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাও। চতুর্থ উইকেটে মাহমুদুল্লাহর সাথে মহামূল্য ৪৬ রান যোগ করে সাকিব ফিরে যাওয়ার পর মাহমুদুল্লাহও ফেরেন দলের ৬২ রানের মাথায়। ৪ উইকেট হাতে নিয়ে বাকি ৩৯ রানের পথটা তখন মনে হচ্ছিলো ‘টেল এন্ডার’দের নিয়ে কার্যত মুশফিকের ‘একা’র লড়াই। কিন্তু চিগুম্বুরাকে চমৎকার এক কাভার ড্রাইভে চার রানের জন্য সীমানাছাড়া করে গ্যালারি জাগিয়ে তুলেছিলেন দশ ব্যাটিং গড়ের শাহাদাতই। দু’ ওভার বাদে পানিয়াঙ্গারাকে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে গর্জনে ফেরা গ্যালারির অভিবাদনের জবাবও দিয়েছিলেন ব্যাট উঁচিয়ে। পরের স্লোয়ার বলটা আবারও মেরে খেলতে গিয়ে স্লিপে টেইলরের ক্যাচ হয়ে যখন ফিরছেন, জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ১৯ রান, হাতে ৩ উইকেট। 

    মুশফিকের সঙ্গী হয়ে নয় নম্বরে এলেন তাইজুল, সেদিন সকালে ৮ উইকেট নিয়ে জিম্বাবুয়ের ইনিংস ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন একরকম একাই। হয়তো দূরতম কল্পনাতেও ভাবেন নি এমন অভাবনীয় বোলিংয়ের পর তাঁকে ব্যাট হাতেও নামতে হবে তাকে। পাঁচ ইনিংসের ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ১৯ রান এই টেস্টেরই প্রথম ইনিংসে, ব্যাটসম্যান তাইজুলে তাই ভরসা পাচ্ছিলাম না খুব। তাইজুলই চার মেরে ম্যাচ জেতাবে- তুষারের এমন ভবিষ্যৎবাণী আমার হারের শংকা কতোটা কমিয়েছিলো মনে নেই, তবে সেটা সত্যি করে চিগুম্বুরার শর্ট বল পুল করে স্কয়ার লেগ দিয়ে সীমানা ছাড়িয়ে জয় নিশ্চিত করে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তাইজুলই।

    মিরপুর গর্জেছিলো বহুকাল বাদে পাওয়া জয়ের উল্লাসে, আমি হাঁফ ছেড়েছিলাম দুই বছরের ফাঁড়া কাটিয়ে, নিজের গায়ে এঁটে যাওয়া ওই তকমাটা সরিয়ে। 
     

    মহিবুল্লাহ ত্বকী প্যাভিলিয়নের সাবেক সহ-সম্পাদক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অবার্নে পিএইচডি গবেষক 

     

    এ সিরিজের অন্যান্য লেখা

    ১৪৬ টাকা, কলেজ ফাঁকি আর ঢাকা-ফতুল্লার 'দুঃসাহসিক' ভ্রমণ

    'ফ্রম সুবর্ণ এক্সপ্রেস টু এমএ আজিজ স্টেডিয়াম'

    'আপন' গ্যালারি, না দেখা ক্রিকেট আর রিচার্ড স্টোকস হওয়ার বাসনা

    বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা, রুবেল... এবং একটি টার্নিং পয়েন্ট