ডেনিস বার্গক্যাম্প : ক্রুইফের হাত ধরে, হাইবুরির সিংহাসনে
সুন্দর একটা গান, একটা গল্প, একটা কবিতার জন্য নাকি বেঁচে থাকে মানুষ। আপনি যদি ডেড পোয়েটস সোসাইটির সদস্য হয়ে থাকেন, আর ফুটবলও যদি হয় নেশার বস্তু- আপনি তাহলে নিশ্চিতভাবেই ডেনিস বার্গক্যাম্পের ভক্ত। বার্গক্যাম্পের আপনার দলের হন্তারক হয়ে থাকলে স্মৃতিগুলো আপনার জন্য সুখকর নয়। তবে বার্গক্যাম্পের জাদুমন্ত্রে মোহিত হয়ে গেলে প্রতিপক্ষ হয়েও আপনি হাততালি দিতে বাধ্য। তিনি তার ঝোলা থেকে এমন গোল বের করে দেখাবেন, যা দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। এমন প্রস্তাব, ইউ সিম্পলি কান্ট রিফিউজ। বার্গক্যাম্পের স্বার্থকতা এখানেই। তিনি ছিলেন ‘দ্য পার্ফেকশনিস্ট’।
নতুন নেদারল্যান্ডসে নতুন প্রজন্ম
বার্গক্যাম্পের এই নিখুঁত হওয়ার গল্পটা এখনকার সময়ের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আমস্টারডামে ঘরের সামনে বল পায়ে শুরু হয়েছিল বার্গক্যাম্পের যাত্রা। কখনও দেয়ালের গায়ে, গাড়ির টায়ারে, ডাস্টবিনে- যেখানে সুযোগ পেতেন বল মারতেন। ফিরতি পাস তার দিকে আসার সময় নজরদারি বাড়ত। বল কতো ডিগ্রিতে ঘুরত, কোন কোণায় বল লেগে কীভাবে সেটা ফেরত আসত, পায়ের কোনদিক দিয়ে বল মারলে অনায়েসেই বল আবার ফেরত পাওয়া যাবে- এসব বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সেই বয়স থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন বার্গক্যাম্প।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে তখন নেদারল্যান্ডসে। বাকি সবকিছুর সঙ্গে ফুটবলেও একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। জন্মেই নেদারল্যান্ডসের যে শিশুরা ‘টোটাল ফুটবল’- এর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন বার্গক্যাম্প ছিলেন সে প্রজন্মের।
“বেশিরভাগ সময় একাই থাকতাম। দেয়ালে বল মেরে দেখতাম বলটা কীভাবে আমার কাছে ফেরত আসে। এই প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতাম। এই ব্যাপারটাই আমার কাছে আনন্দদায়ক ছিল। এরপর অন্যভাবে চেষ্টা করতাম। কখনও ডান পায়ে, এরপর বাম পায়ে, ইনসাইড ফুটে, আউটসাইড ফুটে, কখনও আবার বুটের লেস দিয়ে মারতাম… যতরকম ছন্দ সম্ভব- সবকিছুই চেষ্টা করতাম।
আরেকটু বড় হয়ে ইটে বল মারতাম। কখনও বা ক্রসবারে। বল ঘুরিয়ে মারার চেষ্টা করতাম। ডান পায়ে একবার, বাম পায়ে একবার। এরপর আরও অনেক পরে ম্যাচের কোনো একটা সময় হয়ত আমি দারুণ এক টাচে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি, তখনই চট করে মনে পড়ত। আরে, এই টাচ কই থেকে উদয় হলো তাতো আমি জানি!”
ডেনিস বার্গক্যাম্প
(স্টিলনেস অ্যান্ড স্পিড)
স্বর্গীয় আশীর্বাদ
মাঠে-ঘাটে-এখানে-সেখানে দৌড়-ঝাপ করতে করতেই নজরে এসে গিয়েছিলেন আয়াক্স স্কাউটদের। সেই প্রস্তাব ফেরানোর কোনো কারণও ছিল না। বার্গক্যাম্প ফুটবলই খেলতে চেয়েছিলেন। নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে বড় ক্লাবে অনুশীলনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন? ১১ বছর বয়সে আয়াক্সের একাডেমিতে যোগ দিয়ে ক্লাসের ‘নায়ক’ বনে গিয়েছিলেন তখন। অবশ্য বার্গক্যাম্প আসরের মধ্যমণি হতে চাইতেন না, হৈ-হুল্লোড়ও তার খুব একটা পছন্দ না। বাকি জীবনেও সে চরিত্র আর বদলায়নি বার্গক্যাম্পের।
বার্গক্যাম্পের ক্যারিয়ার শুরুর গল্পটাও ‘নিখুঁত’। আয়াক্সে বার্গক্যাম্পের অভিষেক হয়েছিল ইয়োহান ক্রুইফের হাতে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বার্গক্যাম্পের ভাষায় সেটি ছিল, “স্বর্গ থেকে পাওয়া আশীর্বাদ”। বাকি কোচরা যখন ফলের ওপর জোর দিতেন, ক্রুইফ তখন তার আদর্শের ব্যাপারে পরিস্কার। বাকিরা রক্ষণে জোর বাড়ায়, ক্রুইফ বার্গক্যাম্পদের আক্রমণে আরও স্বাধীন হতে বলেন। সাংবাদিকদের সমালোচনার তীর বাড়ে, ক্রুইফ সেসব তোয়াক্কা না করে বলেন খেলার ছন্দ হতে হবে আরও সুন্দর। ওইটুকু স্বাধীনতা পেয়ে বার্গক্যাম্প তার সৃজনশীলতার ডাল-পালা মেলে ধরলেন আয়াক্সে। এর্ডিভিসি, ইউয়েফা কাপ, কাপ উইনার্স কাপ জিতে বার্গক্যাম্প নেদারল্যান্ডস ছাড়লেন প্রথমবারের মতো।
সপ্তাহের সেরা বার্গক্যাম্প
স্বাধীনচেতা স্বভাবটা অবশ্য আরেকটু হলেই বার্গক্যাম্পের ক্যারিয়ারটা আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলতে পারত। আয়াক্সে ৯ বছর কাটানোর পর ইউরোপের নামী-দামী ক্লাবগুলোর নজর ততোদিনে পড়ে গেছে তার ওপর। ইতালি তখন বিশ্বসেরাদের পূন্যভূমি। প্রস্তাব ছিল এসি মিলানের কাছ থেকেও। ফন বাস্তেন, রুগ গুলিতরাও ছিলেন তখন মিলানে। রোসোনেরিদের দলে নাম লেখানো মানে প্রতি মৌসুমে শিরোপা ছোঁয়া একরকম নিশ্চিত। কিন্তু মিলানে গিয়ে বদলাবেনটা কী বার্গক্যাম্প? মিলানকেই ঠিকানা হিসেবে বেছেন নিলেন, তবে মিলানের নীল অংশকে। এসি মিলানের বদলে যোগ দিলেন ইন্টার মিলানে।
তবে সে আশা নিয়ে ইন্টারে যোগ দিলেন সেটাও সফল হলো না। কাতানাচ্চিওর মার মার কাট কাট রক্ষণাত্মক ফুটবলে বার্গক্যাম্প খাপ খাওয়াতে পারলেন না মোটেই। ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে, একটা সময় নিয়মিত ফ্লপের তালিকায় নাম লেখানোর শুরু। পরে ইতালির এক পত্রিকা সাপ্তাহিক ফ্লপ খেলোয়াড়ের শিরোনামটাই বদলে দিল। “সপ্তাহের সেরা বার্গক্যাম্প”- শিরোনামে সিরি আর ফ্লপ খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণাও শুরু হলো এরপর।
বার্গক্যাম্প সহজেই বুঝে গিয়েছিলেন ইতালি তার জায়গা নয়। ড্র-য়ের জন্য খেলতে নারাজ তিনি। কিন্তু ইন্টারও তাদের কৌশল বদলাবে না। বার্গক্যাম্প ততোদিনে নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের নিয়মিত ফুটবলার। দুই বছরে খানিকটা আড়ালে চলে গেলেও, তার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল না।
আর্সেনালের বার্গক্যাম্প, বার্গক্যাম্পের আর্সেনাল
প্রশ্ন ছিল বার্গক্যাম্প কি আসলেই মানিয়ে নিতে পারবেন? ১৯৯৫ তে যখন আর্সেনাল দলবদলের নতুন রেকর্ড গড়ে বার্গক্যাম্পকে দলে ভেড়ালো তখনও একই প্রশ্ন। ইতালিতে পারেননি, ইংল্যান্ডের শরীর নির্ভর ফুটবলে কেন পারবেন বার্গক্যাম্প? আর্সেনাল সমর্থকদের অবশ্য বিশ্বাসটা ছিল। বার্গক্যাম্পের ১০ নম্বর জার্সি গানার সমর্থকেরা গায়ে চাপালেন চুক্তির পরদিন থেকেই। কেউ কেউ আবার বার্গক্যাম্পের নামের বদলে লিখলেন ‘গড’।
ইশ্বর হাইবুরির উচ্চাসনে বসতে খানিকটা সময় নিলেন। তবে প্রথম মৌসুমটা শেষ করলেন দারুণভাবে। ইউরোপে বাছাই করতে মৌসুমের শেষ ম্যাচে আর্সেনালের দরকার ছিল জয়। বোল্টনের বিপক্ষে সে ম্যাচে একমাত্র গোলটি করলেন বার্গক্যাম্পই। সেই গোলও নিখুঁত। সেটাও চোখ ধাঁধানো। ওই এক গোলে গল্পটা লেখা হলো সাফল্যের।
আর্সেনাল অবশ্য তখনও ‘বোরিং আর্সেনাল’। ইংল্যান্ডে আসার আগে আর্সেনালের এই নাম সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না বার্গক্যাম্পের। প্রথম মৌসুমে সাফল্য ধরা দিলেও ‘বদনাম’ ঘোচানো গেল না। ঘুচল আর্সেনাল ওয়েঙ্গারের আগমনে। ওয়েঙ্গার ফুটবল দুনিয়ায় তখন নতুন নাম। তবে তিনি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলান- এটুকু জানা ছিল সবার।
পেশাদার ফুটবল ক্লাব, পেশাদার ফুটবলার- এই শব্দগুলো শোনা যায় হরহামেশা। অর্থের গভীরতা আঁচ করা যায় না তাতে। বার্গক্যাম্পের নিজের কথায়, আর্সেনালে যোগ দিয়ে তিনি অবাকই হয়েছিলেন। খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে অনুশীলনে পূর্ণ মনোযোগ আর ঘাম ঝরানোর ব্যাপারটি নাকি ছিলই না আর্সেনালে। ওই অপূর্ণতাটা ওয়েঙ্গারের হাত ধরে ঘোচার পর এবার হাইবুরির ইশ্বর হওয়ার পথে যাত্রা শুরু বার্গক্যাম্পের।
ওয়েঙ্গারের দ্বিতীয় মৌসুমে আর্সেনাল জিতল লিগ আর এফএ কাপ ডাবল। ওয়েঙ্গারের অধীনে নিজের পছন্দের ‘সেকেন্ড স্ট্রাইকার’ পজিশনটা বাগাতে পেরেছিলেন বার্গক্যাম্প। ইন্টারে বার্গক্যাম্পের দুর্দশার বড় কারণ ছিল এই পজিশনটা না পাওয়া। উইঙ্গার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও দুর্দান্ত ফিনিশ আর বলের ওপর অসাধারণ দক্ষতার কারণে মূলত ফরোয়ার্ড লাইনে এসেছিলেন বার্গক্যাম্প। মূল স্ট্রাইকারের পেছনে থেকে গোল করা আর করানোতে এক কথায় ছিলেন ওস্তাদ। ওয়েঙ্গারের অধীনে বোরিং আর্সেনালের ইন্টারেস্টিং আর্সেনাল হওয়ার পেছনেও বড় অবদান ছিল এক বার্গক্যাম্পের।
এর পর আর্সেনালের ১০ বছরের ক্যারিয়ারে বার্গক্যাম্প প্রিমিয়ার লিগ জিতেছেন আরও দুইবার। এর ভেতর একবার তো সেই বিখ্যাত ইনভিনসিবল মৌসুম। ৪২৩ ম্যাচে ১২০ গোল করে বুটজোড়া তুলে রেখেছিলেন এমিরেটসে। ওই মাঠে অবশ্য বার্গক্যাম্পের খেলার সুযোগ হয়েছিল একবারই। সেটাও বিদায়ী ম্যাচে। আগের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে আর্সেনাল হেরে না গেলে বার্গক্যাম্পের বিদায়টা হতে পারত আরও রাজসিক। হাইবুরির সেই সোনালী দিন এখনও আর ফেরত আসেনি এমিরেটেসে, তবে বার্গক্যাম্পের জায়গা আর্সেনাল সমর্থকদের হৃদয়ে জায়গা পেয়েছে আজীবনের জন্য। এমিরেটসের সামনে তার মূর্তিটাই তার প্রমাণ।
“ডেনিস পার্ফেকশনিস্ট। ও অনুশীলনের শেষদিকেও একটা পাস অবহেলা করত না। একটা বল ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, বা পাস ঠিক মতো বাড়াতে না পারলে সে হতাশ হয়ে যেত।”
-আর্সেনাল ওয়েঙ্গার
এমন যদি হত আমি পাখির মতো...
বার্গক্যাম্পের গল্প এই অংশ ছাড়া অপূর্ণ। আর্সেনালের ১০ বছরে বার্গক্যাম্পের খেলা ম্যাচ সংখ্যা দেখে অবশ্য খানিকটা খটকা লাগারই কথা। উড়াল দিতে জানলে আরও কতোগুলো ম্যাচ খেলতে পারতেন বার্গক্যাম্প? অথবা এই দুশ্চিন্তায় মাথা ঘামাতে না হলে আরও কতো শত চোখ ধাঁধানো গোলের জন্ম দিতে পারতেন এই ডাচ?
বার্গক্যাম্পের ‘এয়ার ফোবিয়া’ মোটামুটি বিখ্যাত এক আলোচ্য বস্তু। নিজের মুখে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না বার্গক্যাম্পের। ইতালিতে খেলার সময় থেকেই শুরু ‘মানসিক’ সমস্যাটার। বেশিরভাগ অ্যাওয়ে ম্যাচেই ছোট উড়োজাহাজে করে এক শহর থেক অন্য শহরে পাড়ি জমাতে হত। ভয়টা ঢুকেছিল ওরকম এক যাত্রাতেই। এরপর ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপে এক সাংবাদিকের নিছক মজায় ভয়টা পরিণত হয়েছিল ‘ফোবিয়াতে’। নেদারল্যান্ডস দলের সঙ্গে এক ম্যাচ শেষে অন্য ম্যাচের জন্য যাত্রা করছিলেন বার্গক্যাম্প। এক সাংবাদিক মজা করে বোমার ভয় দেখাতেই আকস্মিকতায় নুয়ে পড়েন তিনি। এর সঙ্গে ইতালির ওই যাত্রাগুলোর প্রভাব তো ছিলই।
এরও আগে সুরিনামে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেদারল্যান্ডস যুব দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় নিহত হয়েছিলেন। এদের অনেকের সঙ্গেই বা বিপক্ষে খেলেছিলেন বার্গক্যাম্প। ‘এয়ারফোবিয়ার’ পেছনে থাকতে পারে তার প্রচ্ছন্ন প্রভাবও। তবে বার্গক্যাম্প তার অটোবায়োগ্রাফি স্টিলনেস অ্যান্ড স্পিডে অবশ্য ইতালির দিনিগুলোকেই তার ফোবিয়ার কারণ হিসেবে দুষছেন।
বার্গক্যাম্প কখনই আর বিমান যাত্রায় স্বাভাবিক হতে পারেননি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাওয়ে ম্যাচগুলোতে ড্রাইভ করে বা ট্রেনে চেপে ভ্রমণ করতেন। এই এক ফোবিয়ায় ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার অনেকগুলো ম্যাচও খেলতেই যাননি। আর জাতীয় দলের ডাক পড়লে ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরতেন ড্রাইভ করেই।
৬ ফুট ২ ইঞ্চির ফরোয়ার্ডের এরিয়াল অ্যাবিলিটিতে দুর্দান্তই ছিলেন পায়ের মতোই। এই ফোবিয়ার কারণেই তার নাম হয়ে গিয়েছিল নন ফ্লাইং ডাচম্যান।
“এই ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। আগের রাত (যাত্রার) থেকে আমার ভীতি কাজ করতে থাকে। এমনও অনেক হয়েছে অনুশীলনের সময় হয়ত আকাশের দিকে তাকিয়েছে- অমনি অজানা এক ভয় গ্রাস করে বসল। আর অনুশীলনেও মন উঠে যেত এরপর।”
-ডেনিস বার্গক্যাম্প
লং বল প্লেইড টুওয়ার্ডস বার্গক্যাম্প…
“আপনি চাইলেও পারফেক্ট গেম খেলতে পারবেন না”- পারফেকশনিস্ট বার্গক্যাম্পের নিজের কথা। তবে আরেকটা লেজুড় আছে- পারফেক্ট হওয়ার চেষ্টা থামানো যাবে না। পার্ফেকশনিস্টদের এই এক ঝামেলা। তারা তৃপ্ত হন না কিছুতেই। প্রতিদিন, প্রতিবার আগের চেয়ে ভালো কিছু করে যেতে হবে। আত্মার তৃপ্তির কাছে শিরোপা টিরোপা ধোপে টেকে না তাদের।
সেই বার্গক্যাম্পের কাছেও কয়েক সেকেন্ড একদম পারফেক্ট। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে করা তার গোলটি। নিজেদের অর্ধ থেকে পাঠানো বলটি আর্জেন্টিনার বক্সের ঠিক ভেতরে ঢুকে বার্গক্যাম্প রিসিভ করেছিলেন এক পায়ে। এরপর এক ঝটকায় ইনসাইড ফুটে রবার্তো আয়ালাকে ছিটকে ফেলে পরের টাচে টো কিকে হাফভলিতে বল জালে। ম্যাচের শেষ সময়ের ওই গোলে বিদায়ঘন্টা বেজেছিল আর্জেন্টিনার। বার্গক্যাম্পের ওই গোলটি হয়ে গেছে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা। ওই গোলের বর্ণনা আপনি যতভাবেই লিখুন বা বলুন না কেন, দুই চোখে না দেখলে (বারবার) তৃপ্তি হবে না।
অমন গোল করলে খেলোয়াড়রা ওই রিপ্লে দেখেন আরও চৌদ্দবার। বার্গক্যাম্প নাকি আর কখনই দ্বিতীয়বার দেখেননি সেই গোল, “হ্যাঁ, ওই কয়েক সেকেন্ড আমার কাছে নিখুঁত। কিন্তু ওটা আর দেখার প্রয়োজন হয়নি। কারণ আমার মাথায় আছে সবকিছু। কীভাবে পাস রিসিভ করলাম, এরপর কী করলাম সবকিছু তো আমি জানি। আমার দেখার দরকার হয় না”। ফুটবলে ‘ম্যাড সায়েন্টিস্ট’ নামে কোনো উপাধি থাকলে নিশ্চিতভাবেই তার দাবিদার হতেন এই ভদ্রলোক।
বার্গক্যাম্প ক্যারিয়ারে ‘সহজের’ চেয়ে কঠিন’ গোলই করেছেন বেশি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে গোলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো যোগ্য দাবিদারও আছে। নিউক্যাসেলের বিপক্ষে লিগের ম্যাচে করেছিলেন আরও একটি পাগলাটে গোল। এক পায়ে বল ঘুরিয়ে, দারুণ আরেক টার্ন নিয়ে আবার ওই বলের নিয়ন্ত্রণে গিয়ে গোল করে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে। বিল্ডিংয়ের দেয়ালে বল মারতে মারতে ডান, বাম-দুই পায়েই সমান জাদু ছিল বার্গক্যাম্পের। আর আয়াক্সের একাডেমিতে খেলায় ছিল গোলরক্ষক, ডিফেন্ডারসহ- সব পজিশনে খেলার অভিজ্ঞতা। ওসব পরে ডিফেন্ডারদের বোকা বানাতে সাহায্য করেছে বলেই নিজের অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছেন তিনি। পায়ের চেয়ে আসলে মাথাটাই বেশি কাজে লাগাতেন বার্গক্যাম্প!
প্র্যাকটিস….প্রাকটিস…. প্রাকটিস
প্র্যাকটিস মেইক্স আ পার্ফেক্ট প্যারাগ্রাফে আপনি কোনোদিন বার্গক্যাম্পের কথা লেখেননি। এই লেখা পড়ে স্কুলপড়ুয়া কেউ ‘অকাজটা’ করে বসার ফন্দি আঁটলে আগে থেকেই সাবধান হয়ে যান। আপনার শিক্ষকের বার্গক্যাম্পকে চেনার সম্ভাবনা কমই। সেক্ষেত্রে আলাদা করে ডাক পড়তে পারে আপনার। বার্গক্যাম্পকে আসলে চেনেন অল্প লোকেই। নেতৃত্বগুণ তেমন ছিলই না বলতে গেলে, ফুটবলের বাইরেও এটা-অটা করেও শিরোনাম হওয়ার অভ্যাস ছিল না, খুব বেশি রাগও ঝাড়তেন না ফুটবলারদের মতো। মোট কথা ফুটবলার বললে যে চারিত্রিক গুণ-দোষ আপনার মাথায় খেলে যায়, তার কিছুই ছিল না বার্গক্যাম্পের। ছিল শুধু বিচক্ষণতা আর নিখুঁত হওয়ার নেশা। দেয়ালে বল মেরে শুরু। এরপর একাডেমির মাঠে, সেখান থেকে ক্রুইফের ছাতার তলে, মিলানের দুর্যোগে, আর হাইবুরির ঈশ্বরের আসনে- বার্গক্যাম্প যেভাবেই যেখানে যতবার যতভাবে বদলেছেন, বার্গক্যাম্প একটা জিনিস সঙ্গে রেখেছেন। আরও ‘সুন্দর’ কিছুর বাসনা। যে সুন্দরের সংজ্ঞা তিনি নিজেও টানতে পারেন না। নিজের চোখে নিখুঁত না হলেও, তার খেলা যারা দেখেছেন তাদের চোখে নিখুঁতের প্রতিশব্দ হয়ে আছেন বার্গক্যাম্প।