সেদিনের এই দিনে : ম্যানচেস্টারে শিরোপা উৎসব, ম্যানচেস্টারে বরো হাহাকার
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই শতাব্দীর সেরা মৌসুম ছিল সেটি। আর ম্যানচেস্টার লাল অংশ তখনও গোণায় ধরার মতো নামও নয়। মাত্র এক যুগ আগের কথা। ম্যানচেস্টার সিটি ইংল্যান্ডেই তখন অখ্যাত এক নাম। আর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ইউনাইটেড স্বপ্নের এক দলের নাম। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, ওয়েইন রুনি, কার্লোস তেভেজ সেই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। মিডফিল্ডে পল স্কলস, মাইকেল ক্যারিকদের সঙ্গে বুড়ো হতে থাকা রায়ান গিগসও কম যান না। ২০০৭-০৮ মৌসুমের শেষদিনটা ম্যানচেস্টারের দুই ক্লাবের শেষ করেছিল দুই মেরুতে থেকে। একদল ম্যানচেস্টারে ফিরেছিল শিরোপা নিয়ে, আরেক দল ফিরেছিল ৮-১ গোলে হেরে।
শিরোপা এলো গিগসের হাত ধরেই
রোনালদো রেকর্ড গড়ার নেশায় নেমেছিলেন সেবার। তিনি যে মুড়ি-মুড়কির মতো গোল দিতে পারেন সেই প্রমাণটা আসলে সেবারই প্রথম পেয়েছিল বিশ্ব। উইগ্যানের মাঠে ইউনাইটেডের শেষ ম্যাচ। চেলসি দুই নম্বরে থেকে তাড়া করছে। শিরোপা নিশ্চিত করতে ইউনাইটেডের দরকার ছিল অন্য ম্যাচে চেলসির সমান ফল। আর ইউনাইটেড জিতলে তো কথাই নেই। হিসাব সহজ।
রোনালদো-রুনি-তেভেজদের সম্বনয় ইউরোপেরই সেরা ছিল সেবার। উইগ্যানের বিপক্ষে না জেতারও কারণ ছিল না। অন্যদিকে চেলসির শুরুটা হয়েছিল ঝড়-ঝঞ্চায়। হোসে মরিনহো বরখাস্ত হলেন শুরুর দিকেই। এরপর আভরাম গ্রান্ট এলেন। খোঁড়াতে থাকা সেই চেলসিকে তিনি শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেলেন শিরোপার খুব কাছেও। এপ্রিলের শেষদিকে ইউনাইটেডকে হারিয়ে শিরোপার লড়াইটা পুরোপুরি জমিয়ে তুলেছিল চেলসি।
উইগ্যানের ম্যাচেও তাই ভয় ছিল ইউনাইটেডের। পুরো মৌসুমের দুর্দান্ত ফর্ম এক ম্যাচের হারে সবকিছু বিলীন করে দিতে পারত। উইগ্যান নিজেদের মাঠে শুরুটাও করল দারুণ। একটি পেনাল্টিও পেতে পারত তারা ম্যাচ শুরুর ২৫ মিনিটের মধ্যেই। অ্যান্টোনিও ভ্যালেন্সিয়ার শট রিও ফার্ডিনান্ডের হাতে বল লাগলেও রেফারি অবশ্য এড়িয়ে গেলেন সেটা।
ভয় যখন জেঁকে বসতে শুরু করেছে তখন পল স্কোলসও ইউনাইটেড সমর্থকদের ভড়কে দিলেন। এমনিতে হুটহাট লাল কার্ড দেখার স্বভাব ছিল স্কোলসের। সেদিন অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলেন। নইলে ম্যাচের আধঘন্টা পেরুনোর আগেই দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে বসতে হত।
৩৩ মিনিটে উইগ্যানের সেই ক্ষোভ আরেকটু বাড়িয়ে দিলেন রোনালদো। মৌসুমের ৪১ তম গোল করে খানিকটা স্বস্তি এনে দিলেন রেড ডেভিল সমর্থকদের। রোনালদোর অবশ্য ওটাই ছিল কাজ, বিপদে পড়লেই ইউনাইটেডকে রক্ষা করতে তিনি।
ওই গোলে রোনালদো একটা রেকর্ডও গড়ে ফেলেছিলেন। ৩৮ ম্যাচের প্রিমিয়ার লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল (৩১) অ্যালান শিয়ারারের রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন তিনি।
এক গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে গেলেও ভয় পিছু ছাড়ছিল না। উইগ্যান বারবার ম্যাচে ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল। তুমুল বৃষ্টিতে জেজেবি স্টেডিয়ামে মঞ্চ প্রস্তুত হয়ে ছিল রোমাঞ্চকর এক নাটকের। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের দুই বদলি এরপর মঞ্চটা করে নিলেন নিজেদের। ওয়েইন হারগ্রিভস নেমে রক্ষণে আরেকটু শক্তি বাড়ালেন। আর রায়ান গিগস নেমে করলেন আরেক গোল। অন্য ম্যাচে চেলসি স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ১-০ গোলে এগিয়েও ছিল ততোক্ষণ পর্যন্ত। গিগসের গোলে শিরোপা হারানো নিশ্চিত হয়ে যাওয়াতেই কী না শেষ মুহুর্তে বোল্টনের কাছে গোল খেয়ে ড্র করল চেলসি! শেষ পর্যন্ত তাই গোলব্যবধানে শিরোপা জিততে হয়নি ইউনাইটেডকে। দুই পয়েন্টে এগিয়ে থেকেই ১৭ তম লিগ শিরোপাটা নিশ্চিত হয়েছিল স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের দলের। আর সেবার রোণালদো-রুনিরা মৌসুম শেষ করেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে। ফাইনালেও সেই চেলসিকেই আরেকবার শিরোপাবঞ্চিত করেছিল রেড ডেভিলরা।
উইগ্যানের তখনকার ম্যানেজার ছিলেন সাবেক ইউনাইটেড খেলোয়াড় স্টিভ ব্রুস। ম্যাচ শেষে বেজায় চটেছিলেন তিনি রেফারিং নিয়ে। অবশ্য সেসব এই ‘অন দিস ডে’- বাদে আর কেউ ঘাটতেও যাবে না কোনোদিন!
ম্যান সিটি ১-৮ মিডলসবরো
থাকসিন সিনাওয়াত্রা সেবার মালিকানা কিনে নিয়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির। লক্ষ্য সিটিকে প্রিমিয়ার লিগের সেরা ৫ ক্লাবের একটি বানানো। সেই পরিকল্পনা নির্মমভাবে নিহত হলো মৌসুমের শেষদিনেই। নতুন মৌসুমের শুরুর দিকে এরপর আবু ধাবি গ্রুপের কাছে মালিকানা বিক্রি, সিটিতে শুরু নতুন দিনের মিছিল। এর আগের গল্পটা সিটি সমর্থকেরা মনে করতেও চাইবেন না। সম্ভবত কেউ মনেও রাখেনি।
সিটি শুরুতেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল অধিনায়ক রিচার্ড ডানের এক লাল কার্ডে। টুনসায় সানলিকে ফাউল করে ম্যাচে ১৫ মিনিটেই মাঠ ছেড়েছিলেন ডান। সেখান থেকে পাওয়া পেনাল্টিতে প্রথমবার এগিয়ে যায় মিডলসবরো। এরপর ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার আলফোন্সো আলভেজ করে বসেন এক হ্যাটট্রিক। প্রথমার্ধ ব্যবধানটা কমই ছিল, ৩-০। পরের অর্ধে অসহায় সিটির ওপর দিয়ে একরকম বুলডোজার চালিয়ে পিষে দিয়েছেল মিডলসবরো।
জেরেমি আলিয়াদিয়ের, স্টুয়ার্ট ডাউনিংদের সবাই স্কোরশিটে নাম লিখিয়েছিলেন এক এক করে। মিডলসবরোর সেই দলে ছিলেন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার হুলিও আর্কা। তিনিও পুরো ক্যারিয়ারেই গোল করেছেন হাতে গোণা কয়েকবার। বাকিদের মতো গোলউৎসবে যোগ দিয়েছিলেন তিনিও। সিটির এলানো যখন ৮৭ মিনিটে এক গোল শোধ দিয়েছিলেন তখনও থামেনি মিডলসবরোর মেশিন। ৯০ মিনিটে আরেক গোল খেয়ে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে সভেন গোরান এরিকসনের দল মাঠ ছেড়েছিল রিভারসাইডের ভ্রমণ করা সিটি সমর্থকদের দুয়ো শুনে।
মিডলসবরোর সেই দলের ডাগআউটে ছিলেন এখনকার ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। ওই মৌসুমের পর সাউথগেট প্রশংসিত হয়েছিলেন, আর সাবেক ইংল্যান্ড কোচ এরিকসন ইংলিশ ফুটবল থেকে পুরোপুরিই হয়ে গিয়েছিলেন ‘সাবেক’। আর সিটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের হার হয়ে থেকে গেছে এই ম্যাচ।