অ্যান্টিগায় যেদিন অসীমতক পাড়ি দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ
অ্যান্টিগার এই মাঠ দেখেছে ব্রায়ান লারার দুই বিখ্যাত ইনিংস- ৩৭৫ ও ৪০০*। ২০০৪ সালে লারার ৪০০ রানের পর টেস্ট ক্রিকেট দেখেছে আরও ১২টি ট্রিপল সেঞ্চুরি, যাদের মধ্যে সর্বোচ্চ মাহেলা জয়াবর্ধনের ৩৭৪। তিনিই সবচেয়ে কাছে গিয়েছিলেন, তবে কয়েকটি ইনিংস তেমন কাছাকাছি না গেলেও যে সম্ভাবনা জাগায়নি লারার রেকর্ড ভাঙার, তা নয়। তবে সেটি ভাঙেনি। ১৬ বছর ধরে শীর্ষে লারা।
লারার ৪০০*-এর বছরখানেক আগে অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড দেখেছিল আরেকটি রেকর্ড। ট্রিপল পেরিয়েও কোনও ব্যাটসম্যানকে দৃঢ় দেখালে যেমন লারার রেকর্ডের কথা আসে, এই রেকর্ড আসে আরও বেশি ঘুরেফিরে। ৪১৮ বা এর বেশি রানের রেকর্ড হলেই আসে অ্যান্টিগায় লারার দলের সেই রানতাড়া। যেবার অস্ট্রেলিয়াকে ‘হোয়াইটওয়াশের’ স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ৪১৮ রান তাড়া করে। যেবার অসীমতক পাড়ি দিয়ে তারা গড়েছিল ইতিহাস।
স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া তখন বিশ্বের সেরা দল, শেন ওয়ার্ন ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে নিষিদ্ধ থাকলেও গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলদের বোলিং আক্রমণও ‘সেরা’। প্রথম ৩ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা, গায়ানা-ত্রিনিদাদ-বার্বাডোজ ঘুরে অ্যান্টিগায় এসেছিল অস্ট্রেলিয়া প্রতিপক্ষকে আরেকবার শূন্যহাতে বিদায়ের আশায়।
জেরোমি লসনের তোপে প্রথম ইনিংসে ২৪০ রানে গুটিয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অ্যাডভান্টেজ নিতে দেয়নি, স্বাগতিকরাও অল-আউট হয়েছিল সমানসংখ্যক রানেই। দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাথু হেইডেন ও জাস্টিন ল্যাঙ্গারের জোড়া সেঞ্চুরি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে লক্ষ্য দিল ৪১৮ রানের। ইতিহাসে এতো রান তাড়া করে জেতেনি কোনও দল। শেষ ৪০০-এর বেশি তাড়া করে কোনও দল জিতেছিল ২৭ বছর আগে-- পোর্ট অফ স্পেনে সেবার ভারতের কাছে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ক্রিস গেইল ও ডেভন স্মিথের ওপেনিং জুটি ৪৭ রানে দিন শেষ করলো, তবে পরদিন সকালে সে জুটি ভাঙতে সময় লাগলো না। প্রথম আধাঘন্টার মাঝে, আগেরদিনের সঙ্গে আর ৩ রান যোগ করে ফিরলেন গেইল-স্মিথ। ব্রায়ান লারা এলেন, ট্রেডমার্ক শট খেলা শুরু করলেন। তবে ওপাশে ড্যারেন গঙ্গা অসহায় হয়ে পড়োলেন গ্লেন ম্যাকগ্রার ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কারে।
শীঘ্রই লারা চড়াও হলেন, বিশেষ করে ম্যাকগিলের ওপর। টানা দুই ছয়ে পূর্ণ করলেন ফিফটি, একটি তো গেল মাঠের বাইরেই। ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে এক্সট্রা কাভার দিয়ে চার। তবে দ্বৈরথটা শেষ পর্যন্ত জিতলেন ম্যাকগিল, বেরিয়ে এসে খেলতে গিয়ে বলের লাইন মিস করে লারা হলেন বোল্ড। ‘যা হবার হবে, আক্রমণ করে যাও’-- লারার নীতি কাজে দিল না দীর্ঘ পরিসরে।
শিবনারাইন চন্দরপল অবশ্য আক্রমণাত্মকই থাকলেন। সিরিজের প্রথম টেস্ট চন্দরপল সেঞ্চুরি করেছিলেন মাত্র ৬৯ বলে। ৯ চারে ফিফটি করলেন এদিন, ৭৩ বলে। তবে সেসব মিলিয়ে গেল। অ্যান্টিগা হয়ে উঠলো ম্যাকগ্রার ক্যারিয়ারের অন্যতম বাজে দিন। সারওয়ানের সঙ্গে যে বেশ ভাল একটা বিবাদেই জড়িয়ে পড়লেন তিনি।
কথা চালাচালি, বল নিয়ে ছুঁড়ে দেওয়ার হুমকি চলছিল। তবে এক ওভার শেষে সেটিই রূপ নিল চরমে। রাগে ফুঁসতে থাকা ম্যাকগ্রা ঠিক সারওয়ানের মুখের ওপর গিয়ে কিছু বলছেন, মোটামুটি বিখ্যাত ছবি সেটি। তাদের আলোচনাটাও বিখ্যাত।
রিপোর্ট অনুযায়ী, দুজনের আলোচনা ছিল এমন-- ম্যাকগ্রা সারওয়ানকে গিয়ে বলেছিলেন, “লারার *** চুষতে কেমন লাগে?” জবাবে সারওয়ান যেটি বলেছিলেন, ম্যাকগ্রাকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করেছিল সেটিই-- “তোমার স্ত্রীকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো।” অবশ্য সারওয়ান হয়তো জানতেন না, ম্যাকগ্রার স্ত্রী জেনের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে ততদিনে।
তবে স্টিভ ওয়াহর এই অস্ট্রলিয়ার এই রূপটাও ছিল-- পরাজয় কাছাকাছি আসলে তারা আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠতেন, হয়ে উঠতেন এমন আক্রমণাত্মক। হাত দিয়ে গোলা ছুড়তে না পারলে কী হবে, মুখই তো আছে! অ্যান্টিগাও ততক্ষণে উত্তপ্ত হয়ে গেছে, একবার তো সীমানা থেকে সরিয়েও আনা হলো ম্যাকগ্রাকে ফিল্ডিংয়ে।
ম্যাকগ্রার মুখ দিয়ে কী বেরুচ্ছে, অনুমান করাটা কঠিন নয় নিশ্চয়ই!
সারওয়ান অবশ্য টললেন না। ম্যাকগ্রার বাউন্সার সামলালেন, লিকে সামলালেন, করলেন সেঞ্চুরি। বুনো উল্লাসে মাতলেন, কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ানও এসে জানিয়ে গেলেন অভিনন্দন-- হয়তো আগের ঘটনা একটু ছাইচাপা দিতে চাইলেন তারা।
ধৈর্য্য খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখা হলো না সারওয়ানের। লির বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে টপ-এজড হয়ে ফিরলেন, লি নিজের বলে ক্যাচ ধরলে ছুটলেন ম্যাকগ্রার দিকে, গিয়ে তুলে ধরলেন তাকে। হয়তো ম্যাকগ্রা সারওয়ানকে সেট-আপের বুদ্ধি দিয়েছিলেন, অথবা আগের ঘটনার কারণে ম্যাকগ্রার প্রতি এটি ছিল লির ‘উপহার’!
১৩০ রান প্রয়োজন থাকতে ৫ম উইকেট হারালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরের বলে লি আবারও শর্ট করলেন, এবার ছেড়ে দিতে গিয়ে বলের লাইনে আটকে গেলেন রিডলি জেকবস। আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ডের আউটের সিদ্ধান্ত অ্যান্টিগায় ঝড় তুললো। জেকবসের কনুইয়ে লেগেছিল বলটা, অস্ট্রেলিয়ানদের জোরালো আবেদনে আঙুল তুলেছিলেন শেফার্ড। তবে রিপ্লে দেখিয়েছিল আসল ঘটনা, যেটি মাঠে দেখতে পেরেছিলেন দর্শকরাও।
খানিক বাদেই মাঠে ছুটে আসা শুরু করলো বোতল, বন্ধ থাকল খেলা। ওয়াহরা গিয়ে হাত লাগালেন বোতল সরাতে! প্রযুক্তি থাকতেও কেন ব্যবহার করা হচ্ছে না, সে প্রশ্ন উঠে গেল আরেকবার। তবে লি হ্যাটট্রিকের সামনে, তার সামনে ওমারি ব্যাঙ্কস।
ব্যাঙ্কস লিওয়ার্ড দ্বীপ থেকে উঠে এসেছেন, সে অঞ্চলের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার তিনি। আগের টেস্টেই অভিষেক হয়েছে। ৩ উইকেট নিয়েছিলেন ম্যাচে, তবে ৪১ ওভারে গুণেছিলেন ২০৬ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সবচেয়ে খরুচে অভিষেকের রেকর্ড সঙ্গী হয়েছিল তার।
ব্যাঙ্কস হ্যাটট্রিক হতে দিলেন না। ব্যাঙ্কস পরদিন হবেন ইতিহাসের অংশ।
২ রানে ক্যাচ তুললেন ব্যাঙ্কস, স্লিপে সেই লোপ্পাটি ফেললেন মার্টিন লাভ। লাভ ক্যারিয়ারে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন ৫টি টেস্ট, ৪৬ গড়টা মোটেই খারাপ কিছু নয়, এমনকি শেষ যে টেস্ট খেলেছেন সেটিতেও আছে সেঞ্চুরি। তবে রিকি পন্টিংদের যুগে সুযোগ করে নিতে পারেননি তিনি, সে টেস্টেও লাভ এসেছিলেন সিরিজসেরা পন্টিংয়ের জায়গাতেই। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে ‘সুখ্যাতি’ ছিল লাভের, তবে ব্যাঙ্কসের সে ক্যাচের আগেও সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল তার।
চন্দরপল আক্রমণ চালিয়ে গেলেন। শেষবেলায় পেলেন সেঞ্চুরি, ল্যান্ডমার্কে পৌঁছানোর পর পিচে চুমু খেলেন, গ্যালারিতে তখন উল্লসিত তার স্ত্রী। সেন্ট জনসের নাটকীয় দিন শেষ হলো, চন্দরপল ১০৩ রানে অপরাজিত, সঙ্গী ব্যাঙ্কসের রান ২৩, ইতিহাস থেকে ৪৭ রানে দূরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পরদিন সকালে লির বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে কট-বিহাইন্ড চন্দরপল, জয় থেকে তখনও ৪৬ রান দূরে তারা। ব্যাঙ্কসের সঙ্গে যোগ দিলেন ভ্যাসবার্ট ড্রেকস। ম্যাকগিলের ওপর চড়াও হলেন, জীবন পেলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে গেলেন ৪০০-এর ওপারে, টেস্ট ইতিহাসে ১৩তম বার কোনও দল রানতাড়ায় পৌঁছাল এ মাইলফলকে।
১০ রান দূরে থাকতে এলবিডব্লিউর আবেদন থেকে বাঁচলেন ড্রেকস, এবারও আম্পায়ার শেফার্ড। এবার আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের উলটো প্রান্তে অস্ট্রেলিয়া। কার্যত তাদের শেষ সুযোগ ছিল সেটিই। ড্রেকস একটু পর ম্যাকগিলকে কাট করে চার মারলেন, অ্যান্টিগাকে ভাসালেন উল্লাসে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গড়লো ইতিহাস।
এখনও ৪০০ বা এমন কোনও লক্ষ্য থাকলে আসে যে ইতিহাসের গল্প।