সেদিনের এই দিনে : রবিউলের গোলে ফুটবলে ঈদের আনন্দ
বৈশ্বিক মহামারীর ছোবল পৃথিবীকে গ্রাস না করলে এখন পুরোদমে ব্যস্ত থাকত বাংলাদেশের ফুটবল। ঘরোয়া লিগ বন্ধ হয়ে গেছে, খেলোয়াড়রাও তাই দিন কাটাচ্ছেন অনিশ্চয়তাও। অথচ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও এখন হয়ত বাংলাদেশকে থাকতে হত নির্বাসনে। দেশের ফুটবল আরেকবার নির্বাসনে যাওয়া, না যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবিউল হাসানের একটি গোল। গত বছর বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের প্রাক বাছাইয়ে লাওসের মাঠে রবিউলের গোলটা এক অর্থে বাংলাদেশকে দিয়েছিল নতুন প্রাণ।
ভিয়েনতিয়েনে ম্যাচের ৭২ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের নিচু শটে গোল করেছিলেন রবিউল। ওই গোলই ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে দিয়েছিল। ঘরের মাঠে লাওসের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে এরপর বাংলাদেশ উঠেছিল বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে। আন্তর্জাতিক ম্যাচের ফিক্সচার নিয়েও তাই আর ভাবতে হয়নি বাংলাদেশকে। আফগানিস্তান, ভারত, কাতার, ওমানের সঙ্গে একের পর এক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ গত বছর পেয়েছে নতুন সঞ্জীবনী শক্তিও।
লাওসকে সেই ম্যাচে হারাতে না পারলে পরের দুই বছর আন্তজার্তিক ম্যাচের জন্য তীর্থের কাক হয়ে ঘুরত বাংলাদেশকে। রবিউলের গোলটার মাহাত্ম্য তাই একটু বেশিই। লাওসের মুখোমুখি হওয়ার আগে বাংলাদেশ সবশেষ খেলেছিল কম্বোডিয়ার মাঠে। সে ম্যাচেও রবিউলের গোলই পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। আর বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রায় আড়াই বছর পর প্রথম অ্যাওয়ে জয়।
বক্সের বাইরে থেকে করা শটে গোল বাংলাদেশ শেষ কবে দেখেছে? জবাব খুঁজতে আপনাকে করতে হবে বিস্তর ঘাটাঘাটি। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, এক বছর পেরিয়ে গেলেও ৯ ম্যাচ খেলে আর বক্সের বাইরে থেকে কোনো গোল পাওয়া হয়নি বাংলাদেশের। প্রাক-বাছাইয়ে লাওসের বিপক্ষে একাদশে ছিলেন না রবিউল, একাদশে যে জায়গা হবে সেটা জানতেন ম্যাচের আগেরদিনও। তবে কোচ জেমি ডের একটা টোটকা প্রেরণা বাড়িয়েছিল রবিউলের।
লাওসের সঙ্গে ম্যাচের আগেরদিন ছিল ঈদ। রবিউল নাকি ঈদের নামাজের পর আবার নফল নামাজ পড়ে দোয়া করেছিলেন যেন ম্যাচে প্রভাব রাখতে পারেন। সেই প্রভাব যে ম্যাচের ভাগ্যই গড়ে দেবে সেটা অবশ্য নিজেও ভাবেননি রবিউল, “আগের ম্যাচেই গোল করেছিলাম, তাই আমাকে বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটা বোধ হয় কোচের জন্য কঠিনই ছিল। কোচ আমাকে ডেকে বলেছিলেন, একাদশে না থাকলেও যেন হতাশ না হই। বেঞ্চে বসে যেন প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজতে থাকি। তখনই খেয়াল করেছিলাম ওদের গোলরক্ষক লাইন ছেড়ে অনেকটাই এগিয়ে খেলছে।”
“মিডফিল্ডে থেকে বল উড়ে আসার পরই ভেবেছিলাম এটাই সুযোগ। আমি বাম পায়ের খেলোয়াড়। বল রিসিভ করে বাম প্রান্তে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি জানতাম গোলে শট করলে একটা কিছু হতে পারে। ইনসাইডে ঢোকার চেষ্টা করলাম তাই, ওদের রাইটব্যাককে ডজ দিয়ে সরাসরি গোলেই শট করলাম, গোলও পেয়ে গেলাম। আমি ভাগ্যবান ওই গোলেই পরে আমরা প্রাক-বাছাই পার হলাম।”- নিজের গোলের বিশ্লেষণ করেছেন রবিউল নিজেই।
কোচ জেমি ডে বাংলাদেশের দায়িত্বে আছেন দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই সময়ে কাতার, ভারতের বিপক্ষে স্মরণীয় কিছু ম্যাচ খেলেছে তার দল। ওই ম্যাচগুলোর সঙ্গে একই কাতারে লাওস ম্যাচটাও রাখেন তিনি। আর বক্সের বাইরে থেকে গোল পেয়ে সেদিন জেমি নিজেও কিছুটা চমকেই গিয়েছিলেন, “এই ম্যাচের আগে আমরা খেলোয়াড়দের বক্সের বাইরে থেকে শট করতে উদ্বুদ্ধ করছিলাম। যদিও মাঠে নামানোর আগে আমি ওকে বলেছিলাম যাতে আক্রমণের সঙ্গে রক্ষণেও যথেষ্ট মনোযোগ দেয়। এরপর ওর চমৎকার ফিনিশটাই পার্থক্য গড়ে দিল। সত্যি বলতে অ্যাওয়ে ম্যাচ জেতার পরই আমরা বুঝেছিলাম ঘরের মাঠে আমাদের হয়ত ওরা আর হারাতে পারবে না।”
ফিরতি লেগে লাওস আর বাংলাদেশকে হারাতে পারেনি। এর মাস দেড়েক পর রবউলও হয়েছেন মৌসুমের সেরা উদীয়মান ফুটবলার। কিন্তু যে ধারায় তরতর করে উঠছিলেন সেটা একরকম থমকেই গেছে। বদলি হিসেবে নিয়মিত মাঠে নামলেও একাদশে জায়গাটা পোক্ত করা হয়নি তার। ক্লাব বদলে বসুন্ধরা কিংসে যোগ দিলেও সেখানেও হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য। রবিউলের এখনের লড়াইটা তাই নিজেকে ফিরে পাওয়ার। কিন্তু রবিউল বলছেন তার আত্মবিশ্বাসে মরচে পড়েনি এতটুকুও, “ওই এক গোল আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। এখন আক্রমণভাগে বল পেলে গোলে শট করতে দ্বিধা হয় না আগের মতো। আমি জানি ক্লাবেও হয়ত আশানুরুপ সুযোগ মেলেনি। তবে এটুকু আত্মবিশ্বাস আছে ফুটবল আবার ফিরলে আমি আগের ফর্মেই ফিরতে পারব।”
ফুটবল ফেরার লড়াই শুরু করে দিয়েছে। এএফসিও বাছাইপর্বের ম্যাচের জন্য নতুন দিন-তারিখ প্রস্তাব করেছে। যার গোলে ভাগ্য ফিরেছিল বাংলাদেশের, তারই এখন ফেরার লড়াই।