বার্সার 'মেসি-ম্যানেজমেন্ট', রিয়ালের 'ধারাবাহিকতা' ও অ্যাটলেটিকোর ছন্দ: লা লিগার নতুন শুরুতে যত প্রশ্ন
করোনা মহামারীর বিস্তার রোধে ১২ মার্চ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লা লিগার চলতি মৌসুম। সেদিনের প্রায় ৩ মাস পর ১১ জুন সেভিয়া-রিয়াল বেটিসের মাঝে সেভিল ডার্বি দিয়ে আবারও প্রাণ ফিরেছে স্পেনের ফুটবলে। শনিবার মাঠে নামছে বার্সেলোনা, এক দিন পর রিয়াল মাদ্রিদ। পয়েন্টের ব্যবধান মাত্র ২, শেষ ১১ ম্যাচে তাই রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের আশা করাই যায়।
বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ যখন চ্যাম্পিয়নের তকমা নিজেদের করে নিতে মরিয়া, লা লিগার আরেক জায়ান্ট অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের তখন সেরা চারে আসাটাই তখন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে। মৌসুম শুরুর আগে দলবদলের বাজারে লোকের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অ্যাটলেটিকো খেলার মাঠে এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারছে না। তবে দীর্ঘ বিরতির সুযোগে ডিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা মৌসুমের শেষদিকের চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য নিজেদের কতটা প্রস্তুত করে তুলেছেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বার্সেলোনা : টানা তৃতীয় লিগ শিরোপা?
গত দুই মৌসুমে লিগ শিরোপা নিয়ে লা লিগায় খুব একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়নি। তবে এই মৌসুমে চিত্রটা ভিন্ন। আগের দুই মৌসুমে বার্সেলোনার শিরোপা মিশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে না পারলেও এবার সেয়ানে-সেয়ানে লড়ছে রিয়াল মাদ্রিদ। টেবিলের শীর্ষে থেকেও তাই মোটেও স্বস্তিতে নেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনা। ২ পয়েন্টের লিড নিয়ে শীর্ষে থাকা বার্সেলোনার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে মাদ্রিদ। একটু এদিক-সেদিক হলেই শীর্ষস্থান খোয়াতে হবে কাতালান ক্লাবটিকে। আর লিগ স্থগিতের ঠিক আগে ক্লাসিকোতে রিয়ালের কাছে মেসিদের অসহায় আত্মসমর্পণে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, শিরোপার সমীকরণে ভজঘট পাকাতে একটি ম্যাচই যথেষ্ট।
অবশ্য শিরোপা ধরে রাখার মিশনের শেষ স্টেজ শুরুর আগে বার্সেলোনা ম্যানেজার কিকে সেতিয়েনের জন্য বড় সুখবর হয়ে এসেছে লুইস সুয়ারজের ফেরা। হাঁটুর চোটে প্রায় ৫ মাস মাঠের বাইরে থেকে একেবারে সময়মত ফিট হয়ে উঠেছেন এই উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার। মৌসুমের শেষদিকে মেসি-সুয়ারেজ কম্বিনেশনের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে বার্সেলোনার ভাগ্য। । গত ১৫ মৌসুমের মাঝে ১০ টিতেই মেসির দল জিতেছে শিরোপা। এই মৌসুমেও নিজের সেরাটা দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত, গোল করা এবং করানোর দিক দিয়ে লিগের সেরা খেলোয়াড় এখন পর্যন্ত তিনিই।
তবে মেসিকে ফিট রাখাটাই সেতিয়েনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দলীয় অনুশীলন শুরুর পরই পেশীর চোটে পড়েন মেসি। তবে চোট খুব একটা বড় না হওয়ায় কয়েকদিন এককভাবে অনুশীলন করেই ম্যাচ খেলার মতো ফিটনেস ফিরে পেয়েছেন মেসি। তবে যেহেতু লা লিগা ১৯ জুলাইয়ের মাঝে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে লিগ কর্তৃপক্ষ, সেহেতু সপ্তাহে দুটি করে ম্যাচ খেলতে হতে পারে প্রতিটি দলকে। সেক্ষেত্রে মেসির গেম টাইম ঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করাটা বড় একটি চ্যালেঞ্জ বার্সেলোনার টিম ম্যানেজমেন্টের জন্য।
এদিকে শিরোপা জয়ের মিশনে সফল হতে হলে এই মৌসুমে অ্যাওয়ে ফর্মের বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে বার্সেলোনাকে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১১ ম্যাচে পয়েন্ট হারিয়েছে মেসিরা। আর লা লিগায় শনিবার তাদের প্রথম ম্যাচটিও মায়োর্কার বিপক্ষে অ্যাওয়ে। তাই ফেরার ম্যাচে একটু সাবধানী হতে হবে কাতালান ক্লাবটিকে। আর বাকি ১১ ম্যাচের মাঝে সেভিয়া এবং ভিয়ারিয়ালের মাঠে গিয়ে খেলতে হবে বার্সেলোনাকে। আর ন্যু ক্যাম্পেও অ্যাথলেটিক বিলবাও এবং অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচ রয়েছে তাদের, সঙ্গে এস্পানিওলের বিপক্ষে বার্সেলোনা ডার্বিও রয়েছে। আর তাই এতো কম সময়ে এতোগুলো ম্যাচ খেলে শিরোপা নিজেদের নাম করা মোটেও সহজ হবে না সেতিয়েনের দলের।
তবে পয়েন্ট ছাড়াও আরও একটি দিক দিয়ে রিয়ালের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে বার্সেলোনা, সেটি হচ্ছে খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা। মেসি, পিকে, বুস্কেটস, টার স্টেগেনদের ভালোই জানা আছে, কীভাবে শেষ মুহূর্তের খেল দেখিয়ে শিরোপা করতলগত করতে হয়। শেষ পর্যন্ত এই অস্ত্রটিই কার্যকরী প্রমাণ হতে পারে কাতালান ক্লাবটির জন্য।
রিয়াল মাদ্রিদ : ধারাবাহিক হওয়াটাই মূল চ্যালেঞ্জ
খেলার দিক দিয়ে এই মৌসুমে বার্সেলোনার চেয়ে বেশি নজর কেড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। মাঠের বাইরের বিভিন্ন জটিলতা, ম্যানেজার পরিবর্তনসহ বেশকিছু বিষয় বার্সার মাঠের খেলায় প্রভাব ফেললেও রিয়ালকে সেই ধরনের সমস্যা খুব একটা ভোগায়নি। বরং লস ব্লাঙ্কোসদের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে চরম অধারাবাহিকতা। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণটি দেখা গেছে লিগ স্থগিতের ঠিক আগের দুই খেলায়। এল ক্লাসিকোতে দাপট দেখিয়ে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষস্থান নিজেদের করে নিয়েছিল জিদানের দল। কিন্তু পরের ম্যাচেই বেটিসের মাঠ শুন্য হাতে ফিরে আবার শীর্ষস্থান তুলে দিয়েছিল বার্সার হাতে।
শিরোপা জিততে তাই মৌসুমের শেষ ১১ ম্যাচে ধারাবাহিক হওয়াটা জরুরী রিয়ালের জন্য। আর ধারাবাহিকভাবে ফল নিজেদের পক্ষে আনতে পুরো ফিট স্কোয়াড নিয়ে মৌসুমের শেষভাগে মাঠে নামছেন জিদান। চোটের কারণে এই মৌসুমে আর খেলার সম্ভাবনা না থাকলেও করোনার বিরতিতে মৌসুমের দৈর্ঘ্য বাড়ায় সময়মত স্কোয়াডে ফিরে এসেছেন মার্কো আসেনসিও।
ফিবুলার ইনজুরি কাটিয়ে ইডেন হ্যাজার্ডও এখন পুরোপুরি ফিট। ভালদেবেবাসে এক ট্রেনিং ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছেন বলেও শোনা গেছে। চোটজর্জর মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১০ ম্যাচ খেলে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি এই বেলজিয়ান, তবে মৌসুমের শেষটাকে নিজের করে নিতে মুখিয়েই থাকবেন। এই মৌসুমে গোলমুখে মাদ্রিদকেও কিছুটা নড়বড়ে মনে হয়েছে। করিম বেনজেমা একাই যেখানে লিগে এখন পর্যন্ত ১৪ গোল করেছেন, সেখানে দলের অন্য সব ফরোয়ার্ডরা মিলে করেছেন মোটে ১২ গোল। হ্যাজার্ড এবং আসেনসিও-র দিরে আসাটা তাই বেশ স্বস্তি দেবে জিদানকে।
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সংস্কার কাজ চলতে থাকায় মৌসুমের বাকি অংশ ৬ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ভালদেবেবাস ট্রেনিং গ্রাউন্ডে খেলবে রিয়াল মাদ্রিদ। জুলাইয়ের দিকে লা লিগা স্বল্প পরিসরে হলেও দর্শকদের মাঠে প্রবেশের অনুমতি দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের ধারণা ন্যু ক্যাম্পে যদি ৩০ হাজার দর্শক প্রবেশের অনুমতি দেয় লিগ কর্তৃপক্ষ, সেক্ষেত্রে মাত্র ৬ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ভালদেবেবাসে খেলা মাদ্রিদ কৌশলগতভাবে কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে।
আর বার্সেলোনার চেয়ে এখন মাদ্রিদ ২ পয়েন্টের ব্যবধানে পিছিয়ে থাকলেও হেড-টু-হেডে কিন্তু এগিয়ে রয়েছে তারা। তাই দুই দলই যদি সমান পয়েন্টে লিগ শেষ করে সেক্ষেত্রে শিরোপা উঠবে লস ব্লাঙ্কোসদের হাতেই।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ : সেরা চারে থাকতে পারবে তো?
মৌসুমে শুরুর আগে দলবদলেই এবার চমকে দিয়েছিল অ্যাটলেটিকো। ১২৬ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে তরুণ পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড জোয়াও ফেলিক্সকে দলে টেনে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল দলটি। ম্যানেজার সিমিওনে আগেই বলেছিলেন, এই মৌসুমে অ্যাটলেটিকো ‘জনগণের ক্লাবে’র চেয়েও বড় কিছু হবে। নতুন স্টেডিয়াম, দলবদলের বাজারে নতুন চেহারার সঙ্গে খেলার ধরনেও বদল আসবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। ক্লাবের ফুটবলীয় দর্শন হবে আরও ‘উদার’, এমনটাই কথা ছিল।
তবে আদতে তা হল কই! আক্রমণে তো টালমাটাল অবস্থা চলছেই, উল্টো গর্বের জায়গা রক্ষণেও চিড় ধরেছে। পয়েন্ট টেবিলের প্রথমভাগে থাকা দশ দলের মাঝে তাদের চেয়ে কম গোল করেছে শুধু ১০ নম্বরে থাকা বিলবাও। আর এখন পর্যন্ত ২১ টি গোল হজম করেছে অ্যাটলেটিকো, রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে দুটি বেশি। বর্তমানে টেবিলের ছয়ে থাকা অ্যাটলেটিকোর সেরা চারে যেতে তাই এখনও অনেক কাজ করতে হবে। তবে পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেই অ্যাটলেটিকো ঘুরে দাড়ায় এমনটা বিশ্বাস করেন অধিনায়ক কোকে, “চারিদিকে অদ্ভুত পরিস্থিতি। আর অ্যাটলেটিকো এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকে, এই বছরটা আমাদের হতে পারে।”
নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণসহ বেশ কয়েকটি কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই অ্যাটলেটিকো। লিগ স্থগিতের আগেই আর্থিক তারল্য কমে আসছিল ক্লাবে। করোনার ফলে যেটি শুধু খারাপের দিকেই গেছে। খেলোয়াড় এবং স্টাফরা এরই মধ্যে ৭০ ভাগ বেতন কম নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এমন অবস্থায় ইউরোপিয়ান ফুটবলের ওপর নির্ভর করেই পরিকল্পনা সাজাচ্ছে ক্লাবটি। আর যদি এই মৌসুমে সেরা চারে জায়গা না হয় এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবল হাতছাড়া হহয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বেশ বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে ক্লাবটিকে।