একদিন কার্ডিফে বিকেলে
হাবিবুল বাশারের বাংলাদেশ ক্যারিয়ারে স্মরণীয় মুহুর্তের অভাব নেই। তবে সেই দিনটা ছিল ‘স্পেশাল’। মোহাম্মদ আশরাফুলের কাছে অন্য কোনও ব্যক্তিগত ইনিংস ‘ফেভারিট’ হলেও সে জয়টার চেয়ে বড় কিছু নেই। আফতাব আহমেদের কাছে মনে হয়, এই তো গতকাল ঘটে গেল অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা। খালেদ মাসুদ নিজের স্মরণশক্তিকে বাজে বললেও মনে করতে পারেন, কতো উইকেটে জিতেছিলেন, কার ছোট ইনিংস গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আতহার আলি খানের মনে পড়ে যায়, শেষ মুহুর্তে কীভাবে ‘আমন্ত্রিত’ কমেন্ট্রি দিয়েছিলেন তিনি।
কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনস পরে ‘স্পেশাল’ হয়েছে আরও, তবে সে দিনকে ধরে রাখার কারণে সে শহর আর মাঠের নামটাও আলাদা একটা জায়গা দাবি করে সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে।
২০০৫ সালের ১৮ জুন দিনটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাছে সবসময়ই ‘স্পেশাল’। যেদিন বাংলাদেশ বার্তা দিয়েছিল, যে দিন পেয়েছিল ‘সম্মান’।
যে দিন বাংলাদেশ টলিয়ে দিয়েছিল ‘ইনভিনসিবল বা অজেয়’ অস্ট্রেলিয়াকে।
****
১৯৯৯ সালের ২০ জুন, বিশ্বকাপ ফাইনালের পর থেকে ২০০৫ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ১৫৬ ওয়ানডে খেলে হেরেছিল ২৯টি। জয়-পরাজয়ের অনুপাত ছিল ৪.১৩৭। দুইয়ে থাকা পাকিস্তানের অনুপাত ছিল ১.৫০৬।
১৮ জুন, ২০০৫-এর আইসিসি র্যাঙ্কিং অনুযায়ী রিকি পন্টিং ছিলেন এক নম্বর ব্যাটসম্যান, গ্লেন ম্যাকগ্রা এক নম্বর বোলার। ব্যাটসম্যানদের র্যাঙ্কিংয়ের সেরা দশে ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, মাইকেল ক্লার্ক। সেরা বিশে ছিলেন ম্যাথু হেইডেন, ড্যামিয়েন মার্টিন। মাইক হাসি র্যাঙ্কিংয়ে আসার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে রান করেননি তখনও। বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে সেরা দশে ছিলেন জেসন গিলেস্পি, একটু বাইরে ছিলেন মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ। ব্রেট লি চোটে পড়ে বাইরে ছিলেন।
সেদিন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে সেরা পারফর্মারের র্যাঙ্কিং ছিল ৬০। বোলারদের মাঝে সবার ওপরে যিনি ছিলেন, র্যাঙ্কিংয়ে তারও আগের অবস্থান ছিল অস্ট্রেলিয়ার ‘মূল স্পিনার’ ব্র্যাড হগের।
“যদি প্র্যাকটিক্যালি চিন্তা করি, ওই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তো আমরা ‘নো-ম্যাচ’, না? এখনকার অনেক দলেরই তাই হবে, তুলনা হবে না ওই দলের সাথে”, সে ম্যাচে বাংলাদেশ অধিনায়ক বাশারের এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার মতো পর্যাপ্ত উপাত্ত হাতে নেই।
অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস প্রায় মাতাল অবস্থায় অনুশীলনে এসেছিলেন, আগের দিনের পার্টিটা একটু বেশিই তীব্র হয়ে গিয়েছিল তার। সে ম্যাচে খেললেন না তিনি। “সত্যি বলতে কী, সাইমন্ডসের ঘটনা আমরা পরে জেনেছি। অস্ট্রেলিয়ার ওই দলে এতো স্টার প্লেয়ার ছিল, সাইমন্ডসের থাকা না থাকা ব্যাপার ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার অমন দল হয়তো কখনো আর হবে না। মাইক হাসি আসত ছয়ে ব্যাটিং করতে। অস্ট্রেলিয়া তো তখন প্রায় ‘ইনভিনসিবল’”, বাশার ব্যাখ্যা করেন, “ওরা তো বলেকয়ে বিশ্বকাপই জিতত তখন।”
অস্ট্রেলিয়া তখন আদতেই ‘ইনভিনসিবল’, অজেয়। বাংলাদেশ সেই ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজে শুধু নাকানিচুবানিই খায়নি, সে সফরে সাসেক্সের কাছেও হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি এলো, ওভালে প্রথম ম্যাচে ১০ উইকেটে হারলো বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া সমারসেটের কাছে অনুশীলন ম্যাচে হারলো, তবে তাতে কী এসে যায়! নেহায়েত প্রস্তুতি তো তাদের জন্য।
বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি এরপর কার্ডিফে। ১৮ জুন, শনিবার।
****
সেদিন সকালে সোফিয়া গার্ডেনসের উইকেট দেখে বাশার বুঝেছিলেন, বোলারদের জন্য সহায়তা আছে। কিন্তু পন্টিং ঠিকই বেছে নিলেন ব্যাটিং। পাইলটের মনে হয়েছিল ‘অস্ট্রেলিয়া ফেঁসে যেতে পারে’। ৬ ওভারের মাঝে একটু ফেঁসে গেল তারা-- নেই গিলক্রিস্ট ও পন্টিং-- প্রথমজন মাশরাফির বলে ব্যাকফুটে, পরেরজন তাপস বৈশ্যর বলে ফ্রন্টফুটে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ।
সকালে উইকেট থেকে পাওয়া সহায়তা আদায় করল বাংলাদেশ।
বৈশ্য আগের ম্যাচে খেলেননি। এ ম্যাচে নিজের প্রথম ওভারে করলেন দুটি নো-বল। নিজের তৃতীয় ওভারে আরও দুটি, ৬ষ্ঠ ও ৭ম ওভারে একটি করে। বৈশ্য সেদিন মোট নো করেছিলেন আটটি।
বাশারকে সেটি মনে করিয়ে দেওয়া হলে তাপসের লম্বা হয়ে যাওয়া পায়ের কারণ বললেন, “যেহেতু বল একটু সুইং করছিল, ‘তাপস ওয়াজ ট্রাইং টু হার্ড’, এ কারণেই নো হচ্ছিল। আমরা চেষ্টা করছিলাম, ওকে বুঝাতে, “এতো কিছু চেষ্টা করিস না, ‘জাস্ট ট্রাই টু বোল ইন ইয়োর লাইন’।”
সকালে উইকেট থেকে পাওয়া সহায়তা আদায় করল বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন-আপ ছিল স্বাভাবিক সময়ের ঢাকার যানজটের মতো লম্বা, আটে নামা হগকে বব উইলিস কমেন্ট্রিতে বলছিলেন ‘জেনুইন অলরাউন্ডার’ হিসেবে। শুরুর সুবিধা আদায় করতে পারলেও তাই চিন্তামুক্ত হতে পারছিলেন না বাশার।
তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলা বৈশ্য ফিরে এসে আরও নো করলেন, তবে ভাঙলেন মার্টিন-ক্লার্কের ১০৮ রানের জুটি। এর আগে হেইডেনকে বোল্ড করেছেন নাজমুল হোসেন। শেষ ১০ ওভারের ৯৩ রানের ঝড়ে অস্ট্রেলিয়া গেল ২৪৯ রান পর্যন্ত।
বাশার একটু আশাহত হলেন, “সত্যি বলতে কী, আমি তাকিয়ে ছিলাম, ২৩০-এর দিকে। কারণ অস্ট্রেলিয়ার বোলিং লাইন-আপটা তো 'হেভি' ছিল-- ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, ক্যাসপ্রোভিচ। আমরা যেরকম শুরু করেছিলাম, একটা সময় কিন্তু মনে হচ্ছিল আমরা ওদেরকে ২২০-২৩০-এর মধ্যে আটকে রাখতে পারব। ভাল একটা সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষ ১০ ওভারে ওরা ৯০ রানের মতো করল। তখন ২৪৯ কিন্তু অনেক রান। পাওয়ারপ্লে ছিল না তো পরের দিকে। তখন এরকম অনেক ম্যাচ খেলেছি, আমরা শুরুটা করতাম ভাল, কিন্তু শেষটা করতে পারতাম না। অন্য দল ম্যাচটা বের করে নিয়ে যেতো আমাদের হাত থেকে।”
অবশ্য তখনকার কোচ ডেভ হোয়াটমোর একটা ‘সংস্কৃতি’ তৈরি করেছেন ততদিনে, হারার আগে না হারার। অন্তত চেষ্টা করে যেতে, “ও বলতো, ‘যেটাই ঘটুক না কেন, তোমরা জয়ের জন্য খেলবে। জেতার চেষ্টা করো। রান যতোই হোক, ৩০০ হোক, তোমরা চেষ্টা করে ১৫০-এর ভেতর অল-আউট হয়ে যাও, কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু চেষ্টা করো’। আমাদের মধ্যে ওই ব্যাপারটা তৈরি হয়েছিল।”
****
বাংলাদেশের চেষ্টার শুরুটা হলো ধীরগতির। ১৬তম ওভারে তুষার ইমরান ফিরলেন ৩৫ বলে ২৪ করে, বাংলাদেশের রান ৫১, ২ উইকেটে।
চারে এলেন আশরাফুল। যিনি ভেবেছিলেন, ওই সফরে সেটিই হতে যাচ্ছে তার শেষ ম্যাচ। এর আগে টেস্ট সিরিজে ৪ ইনিংসে করেছেন ২৩ রান, ওয়ানডেতে প্রথম ম্যাচে গোল্ডেন ডাক।
“এই ম্যাচেও রান-টান করবো না, বাকি ম্যাচগুলিতে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবেই থাকতে হবে আরকি। এরকম মানসিকতা ছিল নামার আগে।”
তবে সে মানসিকতা বদলাতে শুরু করলো তার, “যখন নামলাম, শুরুতে একটা পুল করে চার মারলাম, সুইপ করে মারলাম, কাভার ড্রাইভে মারলাম। এই তিনটা শট মারার পর মনে হলো, যে উইকেটটা ভাল আছে, আজকে একটু চেষ্টা করি। এতদিন রান করতে পারি নাই, আজ একটু দলের জন্য কাভার করে দিই। আর যখন জাভেদ (ওমর বেলিম) ভাই আউট হয়ে গেলেন, (হাবিবুল বাশার) সুমন ভাই আসলেন, যখন ২৪-২৮ হয়ে গেছে, তখন থেকে উপলব্ধি করা শুরু করলাম, এই ম্যাচ জিততে হবে।”
“সুমন ভাই বলছিলেন, ‘তুই শুধু তোর ব্যাটিংটা করতে থাক। আমি আমার দিকটা দেখছি। তো উনি উনার ভূমিকাটা পালন করছিলেন। আর আমি প্রতি ওভারেই একটা করে ‘ক্যালকুলেটিভ রিস্ক’ নিচ্ছিলাম। হাসিকে স্কুপ, ক্লার্ককে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে চার, ম্যাকগ্রারে কাভার দিয়ে চার মারলাম পরপর, ৬০ হয়ে গেল।”
সোফিয়া গার্ডেনসের আকৃতিটা একটু আলাদা, সেখানে স্ট্রেইট বাউন্ডারি বেশ ছোট। তবে আশরাফুল সে ইনিংসে বেছে নিয়েছিলেন ‘দীর্ঘতম’ পথটা, লেগসাইডে বিহাইন্ড দ্য স্কয়ারে করেছিলেন ৫১ রান। আশরাফুলের সঙ্গে ব্যাটিং করতে করতেই মনে হয়েছিল বাশারের, এই ম্যাচটা জেতার মতো তাদের।
"এই তিনটা শট মারার পর মনে হলো, যে উইকেটটা ভাল আছে, আজকে একটু চেষ্টা করি।"
“আমাদের যেটা ছিল, আমরা চেষ্টা করি। তারপরও ভাল খেলতে খেলতে হেরে যেতে থাকলে একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে যায়, ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড তো ওটা থাকেই। আমার এবং আশরাফুলের জুটি যখন শুরু হয়েছে, প্রথমে কথা ছিল যে, কিছু না ভেবে শুধু ব্যাটিং করে যাব, ৪০ ওভারের পর দেখা যাবে কী হয়। মাঝে বুঝতে শুরু করেছিলাম, ম্যাচটা জেতা সম্ভব। সাধারণত রান-রেটে আমরা পিছিয়ে পড়ি, কিন্তু ওই ম্যাচে মাঝখানে খেলাটা ভাল ধরতে পেরেছিলাম, (প্রয়োজনীয়) রানরেট ৮-এর ওপরে যাচ্ছিল না। আমরা জানতাম, যদি এটা ৮-এর নিচে রাখতে পারি, ১০-এর নিচে রাখতে পারি, তাহলে আমরা তাড়া করতে পারব। কারণ উইকেটটা পরের দিকে ভাল ছিল। আমাদের পরে আফতাব ছিল, মোহাম্মদ রফিক ছিল। শেষটা হবে তাহলে।”
বাশারের সঙ্গে জুটি ১০০ পেরিয়ে গেল আশরাফুলের, ফিফটি থেকে ৩ রান দূরে বাংলাদেশ অধিনায়ক। শর্ট মিড-উইকেট থেকে সিঙ্গেল চুরি করতে গিয়ে স্ট্রাইক-এন্ডে ডিরেক্ট থ্রো থেকে বাঁচলেন ঠিকই, ছুটে আসা গিলক্রিস্টের থ্রো-তে অন্যপ্রান্তে হলেন রান-আউট।
“তখন আমাদের আরেকটা সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছিল, যে দলই সবার আগে। ব্যক্তিগত অর্জন কিছু না। তখন রানের জন্যই দৌড়াচ্ছিলাম, জানতাম, আর ৩ রান করলে ফিফটি হবে। কিন্তু তখন ভাবনাটা এমন ছিল, ১ রান হলে ১ নিব, ২ হলে ২-ই নিব। যাতে আমরা পিছিয়ে না পড়ি। ফিফটির চিন্তা ছিলই না। দলের মধ্যে আমাদের এটা তৈরি হয়েছিল। ওই অ্যাটিটিউডটা যাতে আমাদের থাকে”, আউট হয়ে বাশার আক্ষেপ করেননি।
শুধু আশরাফুলকে বার্তা দিয়ে এসেছিলেন, “তুই যতক্ষণ পারিস ব্যাটিং কর, বাকিদের মারতে বলিস। তোর চান্স নেওয়ার দরকার নাই আপাতত, বাকিরা নেবে।”
ম্যাকগ্রাকে পুল করে ৯৯-এ গেলেন আশরাফুল। সে ওভারের শেষ বলে লো-ফুলটসে সিঙ্গেল নিয়ে সেঞ্চুরি। ১০৮তম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি।
“অন্যরকম একটা অনুভূতি। সে সময় অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের সাথে ১০০ করা, আর বাংলাদেশের হয়েও দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, ১৯৯৯ সালে (মেহরাব হোসেন) অপি ভাইয়ের পর কেউই তো করতে পারছিল না”, আশরাফুলের অনুভূতিটা অন্যরকম হলেও স্পষ্ট। পিঠে অভিবাদনের চাপড় মেরে গেলেন পন্টিং, আশরাফুল যখন জড়িয়ে ধরেছেন আফতাবকে।
উইকেটকিপিংয়ে ফিরতে ফিরতে গিলক্রিস্ট হাততালি দিচ্ছিলেন। ড্রেসিংরুমের বারান্দায় দুহাত তুলে বাশার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, সবাই হাততালিতে ব্যস্ত। বাশারের পেছনে হোয়াটমোর, খালি গায়ে। হয়তো শিষ্যদের উত্তেজনায় গরমটা বেশি লেগে গেছে তার।
ঠিক পরের বলেই গিলেস্পিকে তুলে মারতে গিয়ে ধরা পড়লেন আশরাফুল। ১০১ বল, ১০০ রান, ১১ চার। যে চারের প্রতিটিই হয়তো এখনও মনে আছে তার। আফতাবের সঙ্গে ম্যাচ শেষ করে আসতে চেয়েছিলেন, পারলেন না।
তবে ছুটে এসে গিলক্রিস্ট অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন তাকে।
****
আফতাব আগের ম্যাচে ফিফটি করেছিলেন। এ ম্যাচে যখন নামেন, শেষ ৬ ওভারে প্রয়োজন ৪৭।
আশরাফুল যখন আউট হন, আফতাবের রান ৭ বলে ৯। রফিক নামলেন, নিজের মুখোমুখি প্রথম বলেই মারলেন চার। আফতাবও যোগ দিলেন। পরের ওভারে রফিক আরেকটি চার মারলেন ম্যাকগ্রাকে, তবে শেষ দুই বলে বাউন্সারের জবাব দিতে পারলেন না কোনও।
গিলেস্পির শেষ ওভারে দরকার ৭।
বাশারের চিন্তা তখনও যায়নি, “ওই সময় অনেক ম্যাচ এমন হেরেছি, বড় দলগুলির সাথে। ওরা অভিজ্ঞ ছিল তো আমাদের চেয়ে বেশি, দেখা গেছে শেষে এসে বের করে নিয়ে যেতো ওরা। ভাল খেলে শেষটা করতে পারিনি। আর অস্ট্রেলিয়ার ওই দলের সিগনেচারই তো এমন ছিল, ১ বল বাকি থাকতেও খেলা ছাড়তো না।”
হারার পর অস্ট্রেলিয়ানদের চেহারা।
আফতাবও চিন্তামুক্ত নন তখন, “শেষ ওভারের আগেও মনে হচ্ছিল, একটু এদিক-ওদিক হলে ম্যাচটা ওদের হাতে চলে যাবে। হয়তো অন্য দল হলে এমন ভাবতাম না, ওই অস্ট্রেলিয়া বলেই ভেবেছিলাম। যদি প্রথম ২-৩টা ডট করে ফেলে, তাহলে কঠিন হয়ে যাবে ব্যাপারটা। আসলে ওরা এমন একটা কঠিন দল, সুযোগ দেওয়া হলে ছাড়বে না। তো আমাকে যা করতে হবে, ১-২ বলের মাঝেই করতে হবে।”
প্রথম বলের আগেই ফিল্ড-সেটিংয়ে বার্তা পেয়েছিলেন অবশ্য তিনি, “আমি দেখলাম মিড-উইকেটটা বাইরে আছে, পেস বলে সাধারণত মিডউইকেট খুব কম বাইরে থাকে। স্কয়ার লেগ এদিকে ছিল। থার্ডম্যান, ফাইন লেগ ওপরে ছিল, তখন বুঝেছিলাম যে স্লোয়ার আসার একটা ভাল সম্ভাবনা আছে। এ কারণে অফস্টাম্পের বাইরে আগেই রুম করে নিয়েছিলাম।”
গিলেস্পি স্লোয়ার করলেন। আফতাবের টাইমিংটা ‘ভাল’ হলো, মিড-উইকেট দিয়ে ছয়। গিলেস্পি হেডব্যান্ড চুয়ে পড়া ঘাম মুছতে ব্যস্ত। পন্টিংয়ের চোখেমুখে অন্ধকারাচ্ছান্ন ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমের বারান্দায় উল্লাস।
মাসুদের ভাষায়, 'আফতাব ধুম করে মিডউইকেট না লং-অন দিয়ে ছয় মেরে দিল'।
****
স্কাইয়ের কমেন্ট্রিতে ডেভিড লয়েড ও ড্যারেন লেম্যান। সে সময় ‘অন-এয়ার’ ছিলেন না আতহার আলি খান। কমেন্ট্রি বক্সের পেছন দিকে এর আগেই অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে তার, উত্তেজনায় পায়চারি করছেন শুধু।
“আই ওয়াজ ড্যাম নার্ভাস, কখন জিতবে, কখন হবে, বুকের মধ্যে ধুকধুক শুরু হয়ে গিয়েছিল। যখন ২৪৯ রানে অস্ট্রেলিয়া আটকে গেল, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল, সেই মুহুর্তটা আজকেই দেখব কিনা, জন্মের পর থেকে যেটা দেখিনি-- অস্ট্রেলিয়াকে হারাচ্ছে বাংলাদেশ।”
সে সিরিজে লেম্যান বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন আতহারের। সিরিজজুড়ে বিভিন্ন ভেন্যুতে তার সঙ্গে এক গাড়িতে করেই যেতেন তিনি।
আফতাবের সেই ছয়ের পর লেম্যান আর ‘বাম্বল’, দুজনই মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়েছিলেন আতহারের দিকে।
“ওয়াট্টা শট, ভিক্টোরি শট দিয়ার, ফ্রম আফতাব আহমেদ। ব্রিলিয়ান্ট... টেক দ্যাট, অস্ট্রেলিয়া!” আতহার বাংলাদেশ ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ছয়টা বর্ণনা করলেন।
“বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কিন্তু মুখ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, “টেক দ্যাট, অস্ট্রেলিয়া”। সঙ্গে সঙ্গেই লেম্যান বলছিল, “উই আর টেকিং ইট”। অবশ্যই ওয়ান অফ দ্য গ্লোরিয়াস মোমেন্ট ইন দ্য হিস্টোরি অফ বাংলাদেশ।”
পরের বলে সিঙ্গেলের শটটা ঠিক যুতসই হয়নি আফতাবের। তবে তার আগেই বাশারের চিন্তা চলে গেছে। গিলক্রিস্টের ডিরেক্ট থ্রো-এর চেষ্টা ব্যর্থ এবার। রফিক বা আফতাবের চিৎকার স্টাম্পমাইকে ধরা পড়ছে। আশরাফুলের ভাষায়, ‘ইতিহাস হয়ে গেল’। এর চেয়ে বেশি কিছু ভাষায় প্রকাশ করার মতো শক্তি নেই তার।
বাশারের দল টলিয়ে দিল ‘ইনভিনসিবল’কে।
বাংলাদেশ যেদিন বার্তা দিয়েছিল...
সে জয়ের কিছুদিন পর সিডনিতে আইসিসির অধিনায়কদের এক মিটিংয়ে গেছেন বাশার। আর কাউকে তেমন করে ডাকা না হলেও মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর উদযাপন কেমন করেছিলেন সেটা বর্ণনা করতে। বাশারদের সেই জয়ের রেশ থেকে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন।
বাশাররা সেদিন ড্রেসিংরুমে ‘বুনো উদযাপন’ করেছিলেন। আশরাফুলের মতে, আকাশে উড়ছিলেন তারা, সেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। এরপর হোটেলে ফিরে অনেক্ষণ ধরে আড্ডা মেরেছিলেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা লিমোজিনে চড়িয়ে ডিনারে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের।
যে হোয়াটমোর জিতলে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে না করতেন, তিনিও সেদিন বাধা দেননি। হইচই, গানবাজনা চলেছিল। বাশার ফোনকল পাওয়া শুরু করেছিলেন ইংলিশ মিডিয়া থেকেও, ‘অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর থিওরি জানতে চেয়ে’!
তার মতে, কার্ডিফ একটা বার্তা দিয়েছিল, “বাংলাদেশ এসে গেছে। এরপর বাংলাদেশের ‘স্ট্যাটাস’টাই বদলে গেল। এর আগেও সবাই মনে করতো, আমরা ভাল দল, নিজেদের দিনে যে কাউকে হারাতে পারি। তবে এরপর থেকে আমাদের বিপক্ষে ওদের গেমপ্ল্যানটা বদলে গিয়েছিল মনে হয়।”
“সেই ম্যাচে আমরা ভাল খেলেছিলাম আসলে। সবকিছুই আমাদের পক্ষে গিয়েছিল”, বাশার বলেন।
আতহারের মতে, সেদিন একটা আলো এসেছিল। যে আলো দেখিয়েছিল, বাংলাদেশও পারে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিতে। যে আলোর রেখা ধরে এগুলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এমন পারফর্ম করছে। এমন বড় জয় পাচ্ছে।
****
ম্যাচ শেষে সবাই যখন স্টাম্প নিতে ছুটছিল, নিজে একটা তুলে রেখেছিলেন গিলক্রিস্ট। পরে ড্রেসিংরুমে এসে দিয়ে গিয়েছিলেন আশরাফুলকে। ১৮ জুন তারিখটা আশরাফুল ভুলতে পারেন না, তার খেলা শটগুলির মতো।
আফতাবের মনে হয়, এই তো গতকালের ঘটনা। ড্রেসিংরুমে কী করছেন, হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হচ্ছেন। সবকিছু চোখের সামনে ভাসে তার। কীভাবে এতোটা সময় পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারেন না।
বাংলাদেশ জিতেছে, কিন্তু তিনি কোনও ক্যাচ নেননি, স্টাম্পিং করেননি, ব্যাটিংয়েও নামতে হয়নি-- এমন আর একটি ওয়ানডে খেলেছেন মাসুদ। সেদিন 'শুধু বল থামিয়েছিলেন' তিনি। তবে জেতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি সেদিন।
'কার্ডিফ, ২০০৫' বললে বাশারের সবার আগে মনে পড়ে, “হারার পর অস্ট্রেলিয়ানদের চেহারা। আর পুরো ম্যাচটাই। প্রথম বল থেকেই। মাশরাফির উইকেট পাওয়া। ওই প্রথম স্পেলটা। মাঝে রফিকও অনেক ভাল বোলিং করেছিল। তবে শুরুর দিকের ওই বোলিং-ই অস্ট্রেলিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ওরা চিন্তাই করতে পারেনি। মাশরাফি ওয়াজ টু গুড। তাপসও করেছে ভাল। নাজমুলও অনেক ভাল বোলিং করেছিল, তাকে আমরা ওভারলুক করে যাই। আর অবশ্যই আমাদের জুটিটা মনে পড়ে (আশরাফুলের সঙ্গে)।”
সোফিয়া গার্ডেনসের চেহারাটা অবশ্য সেই ২০০৫ সালের মতো নেই। গ্ল্যামারগানের হোমভেন্যু নিজেদের প্রথম টেস্ট আয়োজন করে ফেলেছে ২০০৯ সালে। ২০১৭ সালে সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ কার্ডিফকে আরও ‘আপন’ করে তুলেছেন বাংলাদেশ দলের কাছে।
২০১৯ বিশ্বকাপে নির্বাচক হিসেবে গিয়েছিলেন বাশার, গিয়েছিলেন কার্ডিফেও।
“স্টেডিয়ামের কাঠামোটা বদলে গেছে। অন্যরকম একটু এখন। আগের মতো মনে হয়নি। তবে অবশ্যই, কার্ডিফ শহরটা তো ভোলার নয়। কিছু স্মৃতি সবসময়ই থেকে যায়। অন্যভাবে থেকে যায়।”