সাদা মানুষ, কালো মানুষ
এসি মিলানে থাকা কালেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন কেভিন প্রিন্স। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে যখন সারা বিশ্ব ফুঁসে উঠেছে তখন নিজের বর্ণবাদকে মোকাবেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলাখুলিভাবে প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে লিখেছেন প্রিন্স। সেই লেখারই অনুবাদ প্রকাশ করা হল প্যাভিলিয়নে।
সবাই এত অবাক হওয়ার ভান কেন করছে এটাই আমি বুঝতে পারছি না। নতুন করে কিছু তো হয় নি। এমনই কি হয়ে আসছে না?
বছর সাতেক আগে আমি মিলানের হয়ে একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলছিলাম। ম্যাচের শুরু থেকেই কালো কোনো প্লেয়ারের পায়ে বল গেলেই গ্যালারির এক কোণা থেকে বানরের আওয়াজ করছিল কিছু দর্শক। আমি বেশ অনেক্ষণ শুনলাম, সহ্য করলাম। তারপর ২৬ মিনিটের মাথায় রেফারিকে ডেকে বললাম, দেখ ওরা যদি আর একবার এমনটা করে আমি মাঠ থেকে নেমে যাব।
রেফারি আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন, আরে চিন্তা করার কিছু নেই। খেলতে থাকো।
এর কিছুক্ষণ পরই আমি বল নিয়ে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আবারো শুনলাম ঐ আওয়াজ। সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, বলটা হাতে তুলে নিলাম। এক লাথিতে বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিয়ে সাইডলাইনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
এমন না যে এই প্রথম আমি বর্ণ বিদ্বেষের মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু এবার আর আমি নিতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল আমার ভেতরে কিছু একটা ভেঙে গিয়েছে। রেফারি দৌড়ে এলেন আমার কাছে, তিনি কিছু বলার আগেই তাকে বাজে একটা গালি দিয়ে আমি বললাম, একদম চুপ! তুমি চাইলেই কিছু করতে পারতে, তোমার সে ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তুমি একটা আঙুলও নাড়াও নি। ওদিকে প্রতিপক্ষের একজনও আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল, আমি তার উদ্দেশ্যেও খেঁকিয়ে উঠলাম, তুমিও চুপ থাকো! খুব মজা নিচ্ছিলে না? ওরা যা করছিল তোমার খুব ভাল লাগছিল, তাই তো? এজন্যই চুপ করে বসে ছিলে?
আমি প্রায় টানেলের কাছাকাছি চলে গিয়েছি তখন, আমাদের ক্যাপ্টেন এম্ব্রোসিনি আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি যা করছ বুঝে শুনে করছো তো প্রিন্স?
১০০ ভাগ, আমি জবাব দিলাম, তারপর ঢুকে গেলাম টানেলে।
আমি জানি আমি যা করেছি তা কেন করেছি। সেটা বেশিরভাগ লোকেই বুঝবে না। ঐ ঘটনার পরে অনেকে এমনটাও বলেছিল যে কেবল ফ্রেন্ডলি ম্যাচ বলেই আমি অ্মন করার সাহস পেয়েছি। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হলে বা পয়েন্ট হারানোর ভয় থাকলে নির্ঘাৎ আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতাম। সত্য বলতে কী, ঐ মুহূর্তে কী ম্যাচ, কী পরিস্থিতি, আমার কী হবে কিচ্ছুই আমার মাথায় কাজ করছিল না। অনেকদিনের জমানো রাগ, ক্ষোভ আমার ভেতরে বিস্ফোরিত হয়েছিল ঐ দিন। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি, নিয়ন্ত্রণ করতে চাইও নি। আমি জানি আমার কথাগুলো সাদা মানুষদের বুঝতে কষ্ট হবে, বিশেষ করে গায়ের রঙ এর কারণে যাদের কখনো অপমান সইতে হয় নি তাদের। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?
আমার বয়স যখন নয় তখন পূর্ব জার্মানিতে একটা টুর্নামেন্ট খেলার জন্য বাসে চড়ে আমাদের এলাকার গোটা টিমই গিয়েছিলাম। আমি বড় হয়েছি বার্লিনের এক অস্বচ্ছল পাড়ায়। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, মিশর - সব জায়গার মানুষজনই থাকতো ওখানে। আমরা একসাথে থাকতাম, খেলতাম, মারামারি করতাম। মাঝে মাঝে গালাগালি থেকে খুনোখুনি পর্যন্তও হত, কিন্তু সেগুলো ছিল ব্যক্তিগত ঝগড়া। কার গায়ের রঙ কী, কে কোন দেশ থেকে এসেছে এ নিয়ে আমাদের মাঝে কখনো ঝগড়াঝাঁটি হতো না।
এ কারণেই বর্ণ বিদ্বেষের প্রথম পাঠ হল আমার নয় বছর বয়সে, পূর্ব জার্মানিতে ঐ টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে। বাচ্চারা খেলছিল আর গ্যালারিতে তাদের বাবা-মা, অভিভাবকেরা বসে ছিলেন। আমি মাঠে নেমেই গ্যালারি থেকে বিভিন্ন সুরের চীৎকার শুনছিলাম।
মার, ঐ নিগারটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দে!
এই নিগ্রোর বাচ্চাকে খেলতে নামিয়েছে কে?
আমি পুরোই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ঐ শব্দটা এর আগে আমি দুই একবার হয়তো কোন গানে বা সিনেমাতে শুনেছি। আমার আবছা আবছা একটা ধারণা ছিল যে এটা আমার গায়ের রঙ বিষয়ক কোনো গালি। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কেন ওরা আমাকে গালি দিচ্ছিল। নিজেকে চোরের মত মনে হচ্ছিল, যেন ভুল কোন জায়গায় চলে এসেছি, বিনা অনুমতিতে। কিন্তু জায়গাটাতো আমার বার্লিনের বাসা থেকে মাত্র ছয় ঘন্টার দূরত্বে! একই দেশের একটা শহরে আমাকে সবাই ভালবাসে আর তার পাশের আরেকটা শহরে আমার গায়ের রঙের কারণে আমাকে ঘৃণা করে। এটা কীভাবে সম্ভব? আমার শিশু মন কিছুতেই এই হিসাবটা মেলাতে পারছিল না।
এরকম পরিস্থিতিতে আগে আমার কখনো পড়তে হয় নি, কাজেই কী করতে হবে আমি জানতাম না। বাসে করে বাড়ি ফেরার পথে আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার টিম মেটরাও কাঁদতে শুরু করল। আমরা কেউই বুঝতে পারছিলাম না আমরা কী ভুল করেছি। বাসায় এসে মাকেও কিছু বললাম না। ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, যেন ভুলে গেলেই চলে যাবে। কিন্তু চলে গেল না। এরপর যতবারই পূর্ব জার্মানিতে খেলতে গিয়েছি, একই ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। বরঞ্চ কদর্যতার মাত্রা দিনকে দিন আরো বাড়ছিল।
এই নিগ্রো, গোল করলেই কলা পাবি বুঝেছিস?
এই নিগ্রোর বাচ্চাকে বাক্সে ভরে ওর দেশে পাঠিয়ে দে কেউ!
প্রচন্ড অপমান লাগতো, কিন্তু আমি কিছুই বলতাম না। ১৪ বছর বয়সে একবার আমার ক্লাসের শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, অন্যদের থেকে কি আমাকে ভিন্ন চোখে দেখেন আপনি? তিনি বেশ অবাক হলেন, অবশ্যই না। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন? আমি কিছুই বুঝছিলাম না তখনো তাই প্রশ্ন করলাম, তাহলে পূর্বের ওরা আমার সাথে এমন আচরণ কেন করে? এটা তো আমারও দেশ, আমি একজন জার্মান। আমার মাও জার্মান। ওরা আমাকে কোন দেশে পাঠাতে চায়?
আমার শিক্ষক বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে গোটা দুনিয়াতেই এমন অনেক বোকা আর খারাপ মানুষ আছে, এদেরকে পাত্তা দিতে নেই। আমার চোখে পানি চলে এসেছিল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। খুব দ্রুতই আমার এই বিহবলতা সন্দেহে রূপ নিল, তাহলে কি আমার মাঝেই সমস্যা আছে? নিশ্চয়ই সমস্যাটা আমারই, নয়তো খামাখা কিছু অপরিচিত লোক আমাকে ঘৃণা করবে কেন? এবং আমার মনে হয় জার্মানির সকল অশ্বেতাঙ্গদের মাঝেই এই কমপ্লেক্সটা তৈরী হয় ছোটবেলাতেই। এ কারণে বড় হওয়ার পর কেউ তার দিকে তাকালেই সে মনে করে, কী হে আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছ কেন? কোন সমস্যা? আমাকে পছন্দ হচ্ছে না? দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমাকে!
স্বাভাবিকভাবেই দিনকে দিন আমি আরো আক্রমণাত্মক আর মারমুখি হয়ে উঠতে থাকলাম। ক্রমাগতই খেলাতে লাল কার্ড দেখতাম। আমার গরম মেজাজকে সবাই ভয় পাওয়া শুরু করল। তবে এর মাঝেও সবচেয়ে খারাপ দিক কোনটা জানেন? কেউ একটা বারের জন্যও আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেনি। সবাই জানতো আমি/আমরা কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বর্ণ বিদ্বেষের ব্যাপারটাও সবাই জানতো - এবং সবাই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল। এমনই যেন হওয়ার কথা! আমার বাবা মা চুপ থাকতেন, স্কুলে টিচাররা সান্ত্বনা দিতেন, রেফারিরা বলতেন খেলা চালিয়ে যেতে। কোচরা বলতেন, আরে বাদ দাও! আমি বাদ দিয়েছিলাম। সকল রাগ আর ক্ষোভ জমা করে রাখতাম আমার শরীরে, মনে। বাকিদের মতই ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।
কিন্তু ২০১৩ সালের জানুয়ারির ঐ ম্যাচে গ্যালারি থেকে বানরের আওয়াজ শোনার পর আমার ভেতরের কোন একটা কলকব্জা অচল হয়ে গিয়েছিল। যুগের পর যুগ ধরে বাঁধ দিয়ে রাখা সকল অভিমান, ক্ষোভ আর রাগ ফেটে বেরিয়ে এসেছিল ঐ দিন। আমি সারাজীবন কষ্ট করে, অপমান সয়ে তারপর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল ক্লাবগুলোর একটিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছি। আর এখনো সেই ছেলেবেলার মত আমার এসব সহ্য করতে হবে? অগ্রাহ্য করে খেলা চালিয়ে যেতে হবে? না! আর নয়! আমার ভেতরে কিছু একটা ভেঙে গিয়েছিল। কোন কিছুরই আর পরোয়া করছিলাম না তখন, কী পরিণতি হবে, আমার ক্যারিয়ারের কী হবে কিছুই মাথায় আসে নি। সব চুলোয় যাক! আর আমি এসব সহ্য করব না!
তুমিও চুপ থাকো! খুব মজা নিচ্ছিলে না? ওরা যা করছিল তোমার খুব ভাল লাগছিল, তাই তো? এজন্যই চুপ করে বসে ছিলে?
আমি যখন মাঠ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, গ্যালারি থেকে অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে তালি দিয়ে আমাকে সমর্থন জানাচ্ছিল। আর তারপর সবচেয়ে ভাল ব্যাপারটা ঘটলো, আমার টিম মেটরাও একে একে আমার সাথে মাঠ ছাড়তে লাগলো। শুধু কালোরা নয়, সবাই! এখনো গোটা ব্যাপারটা চিন্তা করলেই আমার শিহরণ হয়। ড্রেসিং রুমে গিয়েই আমি বুট, জার্সি খুলে নিলাম, যাতে সবাই বুঝতে পারে আমি আর ফিরে যাচ্ছি না মাঠে। এর মাঝে রেফারি ড্রেসিং রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি খেলবে? এম্ব্রোসিনি উঁঠে দাঁড়িয়ে রেফারির চোখে চোখ রেখে জবাব দিল, প্রিন্স যদি মাঠে না নামে, আর কেউ নামবে না।
পুরো ঘটনাটা দাবানলের মত গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেল। সংবাদমাধ্যমগুলোর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। ঘানা, চীন, ব্রাজিল থেকে পর্যন্ত আমার কাছে টেক্সট আর ফোনকল আসছিল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর রিও ফার্দিনান্ডের মত খেলোয়াড়রা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাতারাতি আমি বর্ণ বিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের পতাকাবাহী দূত হয়ে গেলাম। তবে এখানে একটা মজার বিষয় ছিল, এত কিছু ঘটছিল একজন কালো খেলোয়াড় প্রতিবাদ করে মাঠ ছেড়েছে এজন্য নয়। বরঞ্চ সাদা খেলোয়াড়রাও ঐ কালো খেলোয়াড়ের সাথে সাথে মাঠে ছেড়েছে বলেই। এই ছোট্ট একটা পরিবর্তনই গোটা দুনিয়াকে পালটে দিল। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও।
মিথ্যা বলবো না, তখন আমি আসলেই ভেবেছিলাম আমরা ঠিক পথে এগোচ্ছি, আমরা দুনিয়াতে একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারবো। আমি আসলেই এমনটা বিশ্বাস করতাম তখন। ফিফার হেডকোয়ার্টারে আমাকে ডেকে নিলেন সেপ ব্ল্যাটার, জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এখন কী করা উচিত? মার্চে ফিফার প্রথম এন্টি রেসিজম টাস্ক ফোর্স গঠন করা হল, আমি সেখানে যোগ দিলাম ফিফার আমন্ত্রণে। সব চমৎকার ভাবে এগোচ্ছিল।
আমি অন্য খেলোয়াড়দের মতই খেলতাম, ট্রেনিং করতাম। আবার টাস্ক ফোর্সের সাথেও নিয়মিত বসতাম - কী করা যায়, কী ক্যাম্পেইন করা উচিত, নতুন কী নিয়ম বা শাস্তির প্রনয়ন করা যায় এসব নিয়ে মতামত দিতাম। আমি ব্ল্যাটারকে বললাম গ্যালারির দিকে তাক করে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন রাখতে। এতে করে কেউ বর্ণবাদী কিছু বললে বা করলেই সাথে সাথে তাকে লাথি মেরে বের করে দেওয়া যাবে। আমি ব্ল্যাটারকে বললাম, এভাবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি কাজ হয় তাহলে আপনি হিরো বনে যাবেন, আর কাজ না হলেও লোকে আপনাকে বাহবা দিবে যে অন্তত আপনি চেষ্টা করেছেন। এরপরেও টাস্ক ফোর্সের বেশ কিছু মিটিং হল, বেশ কিছু ই-মেইল চালাচালিও হল। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে টের পেতে থাকলাম, কাজের কাজ আসলে কিছুই হচ্ছে না। বরঞ্চ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমার অবস্থানের কারণে আমাকেই সবাই টার্গেট করা শুরু করল। আরো বেশি করে বর্ণবাদী গালি শুনতে লাগলাম গ্যালারি থেকে। তারা হয়ত আশা করছিল আমি আবারো ক্ষেপে গিয়ে মাঠ ছাড়বো, সেটা দেখে তারা মজা নেবে। আমি তখন টাস্ক ফোর্সের সদস্য, আমার মাথা গরম করলে চলবে কেন? আমি নিয়মমাফিক রেফারিকে গিয়ে অভিযোগ জানাতাম, রেফারি কর্তৃপক্ষকে জানাতো আর স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ মাইকে দর্শকদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী জারি করত। ঘোষণার পর হয়তো মিনিট খানে্ক দর্শকেরা চুপ থাকতো, এর পর আবারো দ্বিগুণ উদ্যমে গালাগালি চালিয়ে যেত। এভাবেই চলছিল। মাসখানেক পর সংবাদ মাধ্যমগুলোও আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, তারা বর্ণবাদ বিষয়ক রিপোর্ট করা বন্ধ করে দিল। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আমার কাছে এল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। ফিফা থেকে আমাকে একটা ই-মেইল করা হয়েছিল, যার লেখাগুলো আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। ই-মেইলটার সারমর্ম ছিল, অভিনন্দন! টাস্ক ফোর্স সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছে! এভাবেই একটা ই-মেইল দিয়ে তারা টাস্ক ফোর্সটা বন্ধ করে দিল।
আমার মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে গিয়েছিল। এটা কী মশকরা? কী দায়িত্ব পালন করেছে তারা? কী অর্জন করেছে? বর্ণবাদী মন্তব্যের জন্য ক্লাবকে ৩০ হাজার ইউরো জরিমানা আর বর্ণবাদী দর্শককে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া? এটাই? এটা কী ফাজলামো? ৩০ হাজার ইউরো একটা ক্লাবের কাছে ফুটো কড়ির চেয়েও কম দামী। আর যে ফ্যানকে বের করে দেওয়া হল সে পরের সপ্তাহেই আবার ম্যাচ দেখতে ফিরে আসতে পারবে। এটাই শাস্তি?
আমি ক্রমেই বুঝতে পারলাম ফিফা ঐ টাস্ক ফোর্সটা বানিয়েছিল পাবলিকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য, যাতে সবাই মনে করে ফিফা কিছু করছে। আমি এখন আর পরিণতির ভয় পাই না, আমি আসলেই মনে করি ফিফা বর্ণবাদের ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও চিন্তিত নয়। নয়তো কেন তারা এ বিষয়ে আর কিছু করছে না এর কোন সদুত্তর তাদের বা আমার কাছে নেই। হয়তো মাঠে বর্ণবাদ ঠেকানোর থেকে ভিএআর কীভাবে কাজ করছে সেটা জানাটাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এত এত টাকা ফিফার, সব টাকা তারা খরচ করছে আরো উন্নত ক্যামেরা, গোল লাইন প্রযুক্তির পেছনে। কিন্তু বর্ণবাদ ঠেকানো? উঁহু, ওটা হচ্ছে না হে। বর্ণবাদ ঠেকালে কি আরো মানুষ খেলা দেখবে? তাদের পকেটে আরো টাকা আসবে? না, আসবে না। তাই তারা পরোয়াও করে না।
আমি ক্রমেই বুঝতে পারলাম ফিফা ঐ টাস্ক ফোর্সটা বানিয়েছিল পাবলিকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য, যাতে সবাই মনে করে ফিফা কিছু করছে
ফিফা ২০১৩ সালে টাস্ক ফোর্স বানিয়েছিল বর্ণবাদ ঠেকাতে, আজ থেকে সাত বছর আগে। অথচ সাত বছর পরে এসেও ঠিক একই সমস্যাগুলো নিয়েই আমরা কথা বলছি। কোন পরিবর্তনই হয় নি। বরঞ্চ বর্ণবাদের সমস্যা আরো গভীর হয়েছে এই সময়ে।
বর্ণবাদের কথা উঠলেই আমেরিকার নাম চলে আসে যেন ইউরোপে বর্ণবাদের সমস্যা নেই। হ্যাঁ, এখানে হয়তো গায়ের রঙের কারণে কাউকে মেরে ফেলা হয় না, কিন্তু আমাদের ঘাড়েও পাড়া দেওয়া হয়, আমাদের টুঁটিও চেপে ধরা হয়। কিন্তু প্রকাশ্যে নয়, আড়ালে আবডালে। এতদিন থাকার পর আমি রাস্তায় বের হলেই টের পাই। মানুষ যেভাবে আমাদের দিকে তাকায়, ফুটপাথ থেকে নেমে যায়। আমি গাড়িতে বসে তাদের দৃষ্টি থেকেই যেন তাদের মনের কথাগুলো শুনতে পারি - একটা কালো লোক এমন একটা গাড়ি পেল কীভাবে? নির্ঘাৎ মাদক ব্যবসা করে বা র্যাপার! বা দুটোই!
ব্যাপারটা এমন কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থার গভীরে বর্ণবাদের মূল প্রোথিত করা আছে। যে শ্বেতাঙ্গরা আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা করে তারা এই ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন চায় না। তারা কেনই বা চাইবে? তারা সবাই ভালই আছে, ৩০০ বছর আগে দাস প্রথার সময়ে তারা যেমন ভাল ছিল এখনো তেমনই ভালো আছে।
আরেকটা গল্প বলি। গত বছরের আগস্টে আমার প্রাক্তন ক্লাব শালকের চেয়ারম্যান ক্লেমেন্স টোনিয়েস প্রকাশ্যে একটা অবিশ্বাস্যরকমের বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য ট্যাক্সের পরিমাণ না বাড়িয়ে জার্মানি সরকারের উচিত আফ্রিকাতে আরো পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা। যাতে আফ্রিকানরা গাছ কাটা বন্ধ করে অন্ধকারে বাচ্চা পয়দা করা শুরু করে।
আমি পুরোই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। লোকটা কী বলছে এসেব? তার দলেই আফ্রিকান খেলোয়াড়রা আছে! আমি দাবি জানালাম, একে লাথি দিয়ে বের করে দেওয়া হোক। মিডিয়া বলল, হ্যাঁ খুব খারাপ হয়েছে ব্যাপারটা। ক্লাব বলল, আমরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু জানেন এর পর কী হল? ক্লেমেন্সকে তিন মাসের সাসপেনশান দেওয়া হল। তিন মাস ক্লাবের টাকায় ছুটি কাটিয়ে সে আবার অফিসে ফিরে এল। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এখন এমন, বর্ণবাদ এত গভীরে চলে গিয়েছে যে আমরা এ ধরনের ব্যাপারকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করেছি। কিন্তু সত্যি কথা হল যারা আমাদের সমাজ চালাচ্ছে তাদের তুলনায় আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি, আমাদের ক্ষমতা বেশি, আমাদের গলার জোর বড়। তারা সারা দুনিয়ার সাথে এসব করে পার পেয়ে যাবে? অসম্ভব!
সেদিন ইন্সটাগ্রামে একটা ভিডিও দেখছিলাম, একজন কলেজ শিক্ষক তার ছাত্রদের ক্লাস নিচ্ছেন। বললেন, কালোদের সাথে যেমন আচরণ করা হয় তেমনটা তোমাদের সঙ্গেও করা হোক- যারা যারা চাও হাত তোলো। কেউ হাত তোলেনি। সংক্ষেপে বললে এটাই বর্ণবাদ। যেখানে সবাই জানে কী হচ্ছে কিন্তু কেউ কোন টুঁ শব্দটিও করে না, এগিয়ে আসে না, প্রতিবাদ করে না। যতবারই আমি নিজে গ্যালারি থেকে বর্ণবাদী গালি শুনেছি আমি জানি আশেপাশেই এমন মানুষ আছে যারা জানে যে এটা অনুচিত। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করে নি। তাদের ভাবনা যেন, আরে এটা এমন কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে। না, ঠিক হবে না। যারা দুনিয়ার খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন আমরা কেমন সময় পার করছি।
আমি এই লেখাটা লিখছি তার পেছনে অনেক কারণ আছে, আমার ভেতরে রাগ আর ক্ষোভ আবারো গুমরে উঠছে। জর্জ ফ্লয়েডের ভিডিওটা দেখে আমি কেঁদেছি, ভিডিওটা আমার পাঁচবার দেখতে হয়েছে আসলে কী হচ্ছে বোঝার জন্য। আপনি জর্জের কন্ঠ্য শুনলেই বুঝতে পারবেন, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না… মা, বাঁচাও। জীবনের সবচেয়ে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের মনে পড়ে ঈশ্বর আর মাকে। জর্জ জানতেন তিনি মারা যাচ্ছেন, এজন্যই মাকে ডেকেছিলেন।
আপনারা হয়ত জর্জের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারবেন না, কিন্তু আমি পারি। আমি আমার সন্তানের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করি, আমি কীভাবে এটা ওকে ব্যাখ্যা করব? কীভাবে ওকে বলব যে এই লোকটা মারা গিয়েছে তার গায়ের রঙের কারণে?
জর্জের মেয়ে বলেছে, বাবা দুনিয়াটা পালটে দিয়েছেন। আমার খুব ভাল লেগেছে কথাটা, কারণ আমার মনে হয় সে ঠিক বলেছে। এই আন্দোলন আর বিক্ষোভ আমাদের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আরো আরো মানুষ বুঝতে পারছে আমাদের কেমন বোধ হয়। তারা বুঝতে পারবে আমরা যুদ্ধ চাই না, সবাই যা পাচ্ছে আমরা কেবল সেটুকুই চাই। আমার ভাই সেদিন বার্লিনের একটা বিক্ষোভ সমাবেশের ছবি আমাকে পাঠালো। সেখানে সব ধরনের মানুষ আছে - মেক্সিকান, আরব, তার্কিশ, কালো সাদা - সবাই। সব জায়গাতেই এমন হচ্ছে, শুধু বার্লিনেই নয়।
আমার ভয়টা অন্য জায়গায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, এখন হয়তো সবাই বিষয়টা বুঝতে পারছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পর কী হবে? আমরা কী আবারও সব ভুলে যাব? আমার ভয় হল জুলাই আগস্টের দিকেই হয়ত কমে আসবে বিক্ষোভের তীব্রতা। মিডিয়া এখান থেকে নজর সরিয়ে অন্য ইস্যুতে মন দেবে। আবার সব আগের জায়গাতেই ফিরে যাবে, ভুলে যাবে সবাই। ঠিক যেমন আমার সাথে হয়েছিল ২০১৩- তে। এজন্যই আমার এ লেখাটা লেখা, যেন আমরা ভুলে না যাই, যেন আমরা এই আন্দোলনকে মরতে না দেই। আর সেজন্য আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে সাদা মানুষদের।
একটা কালো লোক এমন একটা গাড়ি পেল কীভাবে? নির্ঘাৎ মাদক ব্যবসা করে বা র্যাপার! বা দুটোই!
বর্তমানে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে, কিন্তু কেবল আমরা একা কিছু করতে পারব না। সাদা মানুষেরা রাষ্ট্র আর সমাজ চালায়, বর্ণবাদকে পরাজিত করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে তাদেরকেই। তারা যদি এই আন্দোলনে আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ায় আমাদের কোন আশা নেই। আমরা তাদেরকে পাশে চাই, আমরা তাদের থেকে শুনতে চাই যে তাঁরা জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ, আমরা তাদের থেকে শুনতে চাই যে তারা কালো মানুষদের দুঃখটা বুঝতে পেরেছে। গোটা দুনিয়া যদি এই আন্দোলনে শামিল না হয় তাহলে পরিবর্তন কখনোই সম্ভব নয়। আমি অন্তত আমার প্রতিবাদ থামাচ্ছি না। আমি বার্লিন থেকে শুরু করব, তারপর জার্মানি, গোটা ইউরোপ, আমেরিকা - সারা বিশ্বে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেব। এই আন্দোলনের কারণে যদি আমার স্পন্সরেরা বা আমার ক্লাব আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, তবে তাই হোক! এ ধরনের লোকেদের সাথে সম্পর্ক রাখারও কোন মানে হয় না। আমি এই আন্দোলনে মাঠে নামবো, দরকার হলে নিজের সব অর্থকড়ি বিলিয়ে দেব। আমি চাই জর্জ ফ্লয়েড দিবস পালন করতে যেখানে সমাজে কালোদের অর্জন আর বঞ্চনার ইতিহাস সবাই জানবে। আমি চাই বার্লিনে একটা কনসার্ট হবে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার শিরোনামে। আমি গান লিখছি সেজন্য। অনেকে আমাকে বলছে এখনই করে ফেলতে। না এখন সময় হয়নি। এসব আমরা করব জুলাইতে, যখন সবাই ভুলে যেতে শুরু করবে এই আন্দোলনের কথা, আমি আবার মনে করিয়ে দেব। তবে আমার একার পক্ষে এই আন্দোলন থেকে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়, আমার পাশে সবাইকে দরকার, বিশেষ করে যাদের দরকার তাদেরকেই আহবান জানিয়ে শেষ করব আমার লেখা।
আমার খেলোয়াড় ভাই ও বোনেরা, তোমরা কোথায়? বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইকনেরা আজ কোথায়? কলিন ক্যাপার্নিক, লেব্রন জেমস, মেগান র্যাপিনোর মত কিছু হাতেগোণা অ্যাথলেট শুরু থেকেই এই আন্দোলনের পক্ষে কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু বাকি খেলোয়াড়, ক্লাব, ফেডারেশনগুলো কি করছে? তরুণ মার্কাস র্যাশফোর্ড কী আমাদের দেখায়নি যে আমাদের এই প্ল্যাটফর্মের ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা কতটা ভাল করতে পারি? এখন ভয় পাওয়ার সময় না বন্ধুরা, এখন এগিয়ে আসার সময়। আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্র ৮ মিলিয়ন ফলোয়ার, যাদের সবাইকেই আমি নিয়মিত কিছু জানানোর চেষ্টা করি। তোমাদের যাদের মিলিয়ন-বিলিয়ন অনুসারী তাদের এখনই চেহারা দেখানোর সময়। বিলবোর্ডে, পারফিউমের বোতল বা বুটের জন্য আমরা চেহারা দেখিয়েছি, এবার আসো আমরা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের জন্য কিছু করি। কালোদের সংগ্রামের ইতিহাস নিজেরা জানি, ফলোয়ারদের জানাই। নিজের প্রিয় কালো অ্যাথলেটদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু বলি। সমর্থন দেই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকে।
আমার সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা, এই আন্দোলনকে মরে যেতে দেবেন না। আমি জানি, জনগণের কাছে লেব্রন জেমসের শুটিং, হ্যামিল্টনের শিরোপা বা মেসি-রোনালদোর খবরের কাটতি অনেক বেশি। কিন্তু এই আন্দোলন এসব থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আপনাদের দায়িত্ব এই আন্দোলনকে ঠিকমত কাভার করা। প্রতিদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায়, ওয়েবসাইটের সবচেয়ে উপরে আমাদের আন্দোলনের খবর রাখুন। মানুষকে ভুলে যেতে দেবেন না। আমাদের মত আরো মানুষের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করুন, হয়ত আমাদের কথা শুনে এতদিন যারা চুপ ছিল তারা সাহস পাবে, এগিয়ে আসবে। আপনাদের দায়িত্ব ভুলে যাবেন না, আমাদের ভুলে যাবেন না।
আমার সাদা ভাই ও বোনেরা, তোমরাই পারো দুনিয়াতে পরিবর্তন আনতে। তোমাদেরকে এই মুহূর্তে আমাদের পাশে দরকার। অনেকেই বলবে “অল লাইভস ম্যাটার!” অবশ্যই, অবশ্যই সকল জীবনেরই গুরুত্ব আছে। কিন্তু আজ এই আমাদের, কালোদের ঘর পুড়ছে। তোমাদের ঘর অক্ষত। আমাদের বাড়ির আগুন নেভাতে এগিয়ে এসো। সকল ভয়, সন্দেহ কাটিয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়াও। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য লোকে কি বলছে পাত্তা দিও না। ভয় পেও না, চুপ থেকো না। তোমাদের বিপদে আমরা সবসময় তোমাদের পাশে থেকেছি, থাকব। আজ আমাদের এই ক্রান্তিকালে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াও।