ক্যারিয়ার বাঁচানোর জন্যই আইসিএলে গিয়েছিলাম : শাহরিয়ার নাফীস
‘হয় জাতীয় দল থেকে জোরপূর্বক অবসরে যেতে হবে অথবা ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে’, এমন উপলব্ধি থেকেই ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে খেলতে গিয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। ‘প্রয়োজনে পেসারকে দিয়ে ওপেনিং করানো হবে, তবুও শাহরিয়ার নাফীসকে কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না’, এমন কথা কানে এসেছিল তার। ২০০৭ ও ২০০৮- এই দুই বছর তার সঙ্গে যে ‘আচরণ’ করা হয়েছে, সেসবের ওপর ভিত্তি করেই দেশের ক্রিকেট কাঠামো থেকে বের হয়ে অন্য এক জায়গায় গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। আইসিএল ‘নিষিদ্ধঘোষিত’ নয়, বরং ‘অস্বীকৃত’ একটা টুর্নামেন্ট ছিল, নাফীস জানতেন এমনই।
২০০৮ সালে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ১৩ জন বাংলাদেশী ক্রিকেটার খেলতে গিয়েছিলেন আইসিএলে, ঢাকা ওয়ারিয়র্স নামের দলের হয়ে। সে সময় বাশারসহ বেশ কয়েকজন দেশের ক্রিকেট কাঠামো ও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সে বছরের সেপ্টেম্বরে নাফীসসহ ৬ জন ক্রিকেটার দেশীয় ক্রিকেট থেকে অবসরের ইচ্ছা জানিয়েছিলেন বিসিবিকে, মূলত আইসিএল খেলতে যেতেই তারা অবসর নিতে চেয়েছিলেন।
নিজের ফেসবুক পেইজ থেকে প্রচারিত আইসিএল : দ্য আনটোল্ড ট্রুথ নামে এক ভিডিওতে আইসিএল নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক ও সাবেক সহ-অধিনায়ক নাফীস। এর দ্বিতীয় পর্বে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তার সে টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার কারণ।
আইসিএলের অনুষ্ঠানে অলক কাপালি, কপিল দেব, ধীমান ঘোষ ও হাবিবুল বাশারের সঙ্গে শাহরিয়ার নাফীস (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
“একজন ক্রিকেটারের ২০০৫ সালে অভিষেক হলো, ২০০৬ সালে ১ হাজার রান করলো। ওয়ানডেতে, টেস্টে ভাল করলো, এরপর একটি টুর্নামেন্টে ৩-৪টি ম্যাচ খেলার পর যদি আপনি তাকে ছুঁড়ে ফেলতে চান, তাহলে সে কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে, আমি সে উত্তর এখনও খুঁজে পাই না।
“তখন বাংলাদেশ বেশিরভাগ ম্যাচই ওয়ানডে খেলতো, যখনোই সুযোগ পেয়েছি, ভাল খেলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার কোনো খেলাই যেন কারও জন্য যথেষ্ট ছিল না। আপনি একটি সিরিজে সেরা ক্রিকেটার হবেন, এরপরের সিরিজে একটি ম্যাচ খারাপ খেললেই বাদ দেবেন, তখন তার কাছে কী বার্তা যায়, আমি নিশ্চিত ছিলাম না।
“২০০৮ সালে যখন এশিয়া কাপ খেলতে যাই, আমার কানে এমন কথাও এসেছে যে, ‘প্রয়োজনে ফার্স্ট বোলারকে দিয়ে ওপেন করানো হবে, কিন্তু শাহরিয়ার নাফীসকে কোনও সুযোগ দেওয়া হবে না। আমার জাতীয় দলের অবস্থা ছিল এমন।”
২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকেই দলে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন নাফীস। সে বছর শ্রীলঙ্কা সফরে শুরুতে ওয়ানডে থেকে বাদ দেওয়া হলেও পরে যুক্ত করা হয়েছিল তাকে স্কোয়াডের সঙ্গে। প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক স্কোয়াডেও সুযোগ পাননি তিনি। এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে শুধু টেস্ট স্কোয়াডে ছিলেন, পরের বছর দেশের মাটিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের সিরিজে ১০২ গড়ে করেছিলেন ২০৪ রান। এরপর পাকিস্তান সিরিজে ৩ ম্যাচের পর বাদ পড়েন, দেশের মাটিতে ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে অবশ্য সুযোগ পেয়েছিলেন। এ ৪টি ম্যাচে এক অঙ্কের রানের কারণে এশিয়া কাপে সুযোগই পাননি তিনি।
নাফীস তার আইসিএলে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে বলেছেন ২০০৮ সালে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তির কথাও। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এক বছর থেকে চুক্তির মেয়াদ কমিয়ে ছয় মাস করা হয়েছিল তার, যদিও পরবর্তীতে সেটি বাড়ানো হয়েছিল।
“এর অর্থ হচ্ছে, আপনি তার ওপর ভরসা করতে পারছেন না, মানে খারাপ খেললে বাদ দিয়ে দেবেন। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা হয়েছিল-- কে করেছিল বলতে পারব না-- আমি ভাল খেলা ও প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম-- হয় আমি জাতীয় দল থেকে নিজে থেকে সরে যাব, অথবা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার ওখানেই থেমে যাবে।”
২০০৮ সালে আইসিএলে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের শেষ সফর, অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নাফীস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পড়াশুনা শেষ করতে চান, আন্তর্জাতিক সূচির কারণে শেষ দেড় বছরে সেটি পারছেন না, তিনি বলেছিলেন এমন।
“২০০৫ এবং ২০০৬ সালে ভাল খেলার পরের দুই বছর আমার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল, সেটা আমাকে তখনও ব্যথিত করেছিল, সবসময় করে, ভবিষ্যতেও করবে”, এভাবে নিজের আক্ষেপ জানিয়েছেন নাফীস। সে সময় তাকে তার “পূর্ববর্তী হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ, মোহাম্মদ রফিকসহ কয়েকজন ক্রিকেটার-- যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্তম্ভ ছিলেন”, তাদের মতো তাকেও সরিয়ে দেওয়া হবে বলে শঙ্কা ছিল তার।
“আমি তো আমার ক্যারিয়ার ‘স্যাক্রিফাইস’ করতে পারি না। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, একটা ক্রিকেটারের প্রতিটা মুভমেন্ট কেউ এভাবে অনুসরণ করতো না, এমন বহুল-চর্চিত ব্যাপার ছিল না। ফলে সবার কাছে একটা ভুল বার্তা যেতো, যে ও নিশ্চয়ই পারছে না, এ কারণে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
২০১৩ সালে মিনহাজুল আবেদিন ও হাবিবুল বাশারের সঙ্গে জাতীয় দলের অনুশীলনে নাফীস। বাশার পরে হয়েছেন জাতীয় দলের নির্বাচক।
“আমার তাই এমন একটা ক্ষেত্র প্রয়োজন ছিল, যেখানে আমি ভাল খেললে ম্যানেজমেন্ট, ভক্ত, সংবাদমাধ্যম সবাইকে দেখতে পারবে, ‘যে, না, শাহরিয়ার নাফীস ভাল খেলছে। আমরা যাতে আবার তাকে ঠিকঠাক সুযোগ দেই।”
“আগেও বলেছি, প্রথমে আমাকে আইসিএলের কথা (মোহাম্মদ) আশরাফুল বলেছিল, তখন আমি ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তবে ২০০৮ সালের এশিয়া কাপ থেকে ফিরে আসার পর যখন প্রস্তাব পাই, তখন কিন্তু শক্তভাবে এটা ভেবে দেখার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।”
আইসিএলে যাওয়া ক্রিকেটারদের পরে নিষিদ্ধ করেছিল বিসিবি। ২০০৮ সালের সে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় মৌসুমে ৮ ম্যাচে ৩৪.১৪ গড় ও ১১৪ স্ট্রাইক রেটে ২৩৯ রান করেছিলেন নাফীস। এরপর মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার কারণে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আইসিএলের আরেকটি টুর্নামেন্ট- আইসিএল টোয়েন্টিজ ওয়ার্ল্ড সিরিজ। এরপর সে টুর্নামেন্ট হয়নি আর।
“আমি চেয়েছিলাম, এই সিস্টেমের বাইরে গিয়ে এমন একটা জায়গায় খেলতে, যেখানকার মান ভাল, এবং ভাল খেললে সবাই স্বীকৃতি দেবে। এবং আমি এখনও বিশ্বাস করি, তখন তো করতামই, যে আমি আইসিএলে গিয়েছিলাম, ভাল খেলেছিলাম বলেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই ফিরেছিলাম। এরপর জাতীয় দলে কতোখানি সুযোগ পেলাম, কী করলাম, কী হতে পারতো, সেসব অন্য বিতর্ক, সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। তবে আমি ক্যারিয়ার বাঁচানোর জন্যই আইসিএলে গিয়েছিলাম।”
নাফীস পরে আইসিএলের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছিলেন, এরপর আরও ৯টি টেস্টের সঙ্গে জাতীয় দলের হয়ে ১৫টি ওয়ানডে খেলেছিলেন এই বাঁহাতি। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে টেস্টই হয়ে আছে জাতীয় দলের হয়ে তার শেষ ম্যাচ।
আইসিএলে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের মাঝে নাফীস ছাড়াও এরপর জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন আফতাব আহমেদ, অলক কাপালি, ফরহাদ রেজা ও মোশাররফ রুবেল।