• " />

     

    একুশ বাইশ

    একুশ বাইশ    

     

    ১.

    বিশ্বকাপের ক্যাম্প শুরু পরশু। বিকেলেই ঢাকা রওনা হবে রাফসান। সকাল থেকেই আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধুদের যাওয়া আসা লেগেই আছে। কতো কতো শুভকামনা। চিলেকোঠায় দাদীর ঘরে যাওয়ার ফুরসতই মিলছে না! দাদীর শরীরটা খারাপ। কতোবার বলা হয়েছে, নিচের কোনো ঘরে এসে থাকতে। কে শোনে কার কথা!

    সবাইকে বিদায় করে যখন চিলেকোঠার ঘরে এলো রাফসান, দাদী ওপাশ ফিরে শুয়ে। টেবিলের ওপর ‘বিখ্যাত’ লাল মলাটের বাঁধাই করা খাতাটা। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাফসান। নির্মাণ স্কুলের প্রথম সেঞ্চুরির পর ক্যামেরাম্যানের কথামতো পোজ দেওয়া ছবি। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রথম ম্যাচের দলীয় ছবি। প্রিমিয়ার লিগের দ্রুততম সেঞ্চুরির পর বুনো উল্লাসের ছবিটা! টেস্টের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের কাছে প্রথম ওই সবুজ রঙের ক্যাপটা হাতে পাওয়া। সব ছবি পেপার থেকে কাটা। কতো যত্ন করে সাদা পাতার ওপর লাগানো সব! মলিন হয়নি এতোটুকু। দাদী হতে দেন নি। সেই দাদী! রেডিওতে কমেন্ট্রি শোনা দেখে ক্রিকেটের প্রেমে পড়া দাদী। 

    দাদীকে ক্রিকেট বুঝিয়েছিলেন বাবা। অথবা বাবার ‘অত্যাচার’-এ ক্রিকেট বুঝেছিলেন দাদী। সতীর্থদের অনেকেরই বাবা-মা ক্রিকেটের চার-ছয়-আউট বোঝেন শুধু! অথচ রাফসান ক্রিকেটই বুঝেছিল দাদীর কাছে। রাফসান মনে মনে হাসে।

    দাদীর পাশে আলতো করে বসে রাফসান। দাদী এপাশ ঘোরেন।

    ‘খেলবি তোর জন্য। আর দেশের নামটার জন্য। আর কে কী বললো, সব ভুলে যা।’

    দাদীর এমন কথা প্রায় সব সফরের আগেই শোনে রাফসান। তবুও অবাক হয়। প্রত্যেকবার কিরকম অদ্ভূত লাগে কথাগুলো শুনতে! হেলে পড়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরে রাফসান। আরেকবার।

     

    ২.

    মায়ের মুখটা কীরকম গোমড়া হয়ে আছে ক'দিন ধরে। কাছে গেলে হাসছেন, কী কী যেনো বোঝাচ্ছেন। তাঁকে ছাড়া থাকতে গেলে কী কী করতে হবে, লম্বা তালিকা পড়ার মতো করে বলে যাচ্ছেন। বিরক্ত লাগছে আমেনার। মাকে ছাড়া কই যাবে, কেন যাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। মায়ের হাসিটাও কেমন শুকনো; উঠোনে শুকোতে দেয়া আমসত্ত্বের মতো! বড় ফুফু এসেছেন বাড়িতে। সব মিলিয়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। বড় ফুফু আসলে অবশ্য উৎসবই হয়। ওদিকে বাবার টিকিটিরও খোঁজ নেই। আসেন, কী যেন কথা বলেন মায়ের সঙ্গে। ঝড়ের বেগে এসে তার চেয়েও বেশী বেগে বেড়িয়ে যান। আমেনাকে একবার কাছেও ডাকেন না!

    পরদিন সকাল সকাল মা তুলে দিলেন তাকে। পড়তেও বসতে হলো না! অদ্ভূত সব ব্যাপার স্যাপার। ছোট খালাকে দেখে ক্ষণিকের জন্য ভুতুড়ে পরিস্থিতির কথা ভুলে গেল আমেনা। শুধু ছোট খালা না, মামারাও এসেছেন। বিপত্তিটা হলো মা নিজের হাতে তাকে গোসলখানায় নিয়ে যাওয়ার পর। কটকটে হলদে রঙের একটা শাড়ি মায়ের হাতে। নুরজাহানের কথা মনে পড়লো আমেনার। ক'দিন আগে তার গায়ে-হলুদ ছিল, মুখে আর হাতে হলুদ মাখার আগে এরকম একটা হলুদ শাড়ি পরে হলুদ পরী সেজেছিল সে। কিন্তু তারপরই তো তার বিয়ে হয়ে গেল, চলে যাওয়ার আগে আমেনাকে জড়িয়ে ধরে কী কান্নাটাই না কাঁদলো নুরজাহান! তবে কী! বুকটা ধক করে উঠলো আমেনার! শাড়িটা কেন পরতে হবে, মাকে এ কথাটাও জিজ্ঞাসা করা হলো না আর!

     

    ৩.

    ৮৩ বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি প্রতিবাদ করে প্রতিনিয়ত। তবুও আমেনা বেগমের ক্রিকেট দেখার হার কমে না। রাফসানের ম্যাচ না দেখে অশীতিপর বৃদ্ধা হয়ে শুয়ে আছেন, ভাবলেই যেন জীবনটা বেরিয়ে যায় তাঁর!

    চিলেকোঠার এ ঘরে একটা টেলিভিশন আছে। রাফসানই এনে দিয়েছে। ছোট নাতি আফনানের সঙ্গে এখানেই খেলা দেখেন আমেনা বেগম।

    নীচের তলায় পাড়া-প্রতিবেশীদের ভীড় থাকে। আজ তা আরও বেড়েছে। চার বছর আগের কথা মনে পড়ে আমেনা বেগমের। আফনানের বয়স তখন আট। রাফসানও ছিল সেদিন। তখনও তো জাতীয় দলে ডাক পায়নি সে। কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের হারের পর আফনানের সে কী কান্না! রাফসান শুধু ছুটে কোথায় যেন বেড়িয়ে গিয়েছিল!

    অথচ তাদের কতো আয়োজন ছিল! জমায়েতটা মিছিলে রূপ নিলো না কেবল। ঢাক-ঢোলগুলো পড়ে রইলো, নিথর হয়ে!

    আর চার বছর পর, আমেনা বেগমের পাশে শুধুই আফনান। রাফসান তো সেই কোন সুদূরে, কত সমুদ্র দূরে। গায়ে লাল-সবুজের জার্সি তার। চোখে সানগ্লাস। ট্রাউজারসের পেছন দিকে গোঁজা সাদা একটা রুমাল। আমেনা সেলাই করে দিয়েছিলেন, সেই কবে! এখনও প্রতি ম্যাচে রাফসানের সঙ্গী থাকে রুমালটা! 

    চার বছর আগের দুঃখটা ভোলা শুরু করেছে বাংলাদেশ। স্বপ্নের দোড়গোড়ায় আজ কড়া নাড়ছে তা!

    তবুও আমেনা বেগমের একটু অস্বস্তি হয়। সেই কতোকাল, হিসেব করে বললে প্রায় ৬৭ বছর আগের ওই দিনটার মতো অস্বস্তি! একটা শূন্যতা জাঁকিয়ে বসে, ম্যাচ গড়ানোর সাথে সাথে! পাশের স্টেশন থেকে ছুটে যাওয়া ট্রেনের শেষ হুইসেলগুলো সে শুন্যতাকে যেন বাড়িয়ে দেয়!

     

    ৪.

    রায়হান আজ চলে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। আমেনার অস্বস্তি লাগছে। বরাবরের মতো। আবার সেদিন সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। যেদিন বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল। ছেড়ে আসতে হয়েছিল সেই পরিচিত উঠোন, বাড়ির পাশের ছোট্ট পুকুর, আদরের লালী কুকুরটাকে। বউ হয়ে এসে উঠেছিল এই চিলেকোঠায়। ছাদের ওপাশে খোপের কবুতরগুলোকে আপন করে নিয়েছিল আমেনা। সব ওই রায়হানের বদৌলতে। রায়হান চলে গেলে আবার কি সব অচেনা হয়ে যাবে? সেই সন্ধ্যার মতো? শঙ্কাটা ঘিরে ধরে আবার। আগে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো। এখন শুধু অস্বস্তি হয়। এমনিতেই ক’দিন ধরে ভাষার দাবিতে চলতে থাকা আন্দোলনের কী কী কথা যেনো বললো এবার রায়হান। আমেনার শুনে কেমনতর যেনো ঠেকে, নিজের ভাষাতে কথা বলতে আন্দোলনের কী আছে!

    আমেনার অস্বস্তি বা ফোঁপা কান্না রায়হানকে আটকাতে পারে না। রায়হানকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ট্রেনটা বাড়ির ধারের স্টেশনে যখন শেষ হুইসেলটা বাজায়, আমেনার কানে তা কেমন শেল হয়ে বিঁধে। ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দটা মিলিয়ে যায়। পড়ে থাকে চিলেকোঠা, খোলা ছাদ আর ছাদের কোণের কবুতরের খোপ। আর থাকে এক অদ্ভূত রকমের শূন্যতা। আমেনা ভাবে, গত চারমাস ধরে যাকে বয়ে নিয়ে চলেছে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে, সে বেরিয়ে আসলে বোধহয় শূন্যতার হাহাকারটা কমিয়ে দিতে পারবে।

    আমেনা দিন গোনে। রায়হানের বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হওয়ার। নিজের অস্তিত্বকে দেখার।

     

    সেদিনের কথাটা এখনও মনে পড়ে আমেনা বেগমের। মনে পড়ে রায়হানের বন্ধুর সেই মুখটাও। গায়ে হলুদের আগে-পরে শুকনো থাকা মায়ের মুখের চেয়েও শুকনো ছিল রায়হানের সেই বন্ধুর মুখ! আমেনার বুকটা আবার ধক করে উঠেছিল। ছুটিতে ফেরার কথা ছিল রায়হানের। আমেনার অস্তিত্ব তখন বাইরে আসার দিন গুণছে। তিনি স্বপ্ন বুনছেন। রায়হানের ঠিক করে দেওয়া নামে ডাকছেন মনে মনে। রাফসান-আফনানের বাবা পৃথিবীতে এলেন। কিন্তু নিজের দেয়া নামে ডাকার জন্য ছিলেন না রায়হান!

    তাঁর বন্ধুর দেওয়া খবরেই যে ভেঙ্গে পড়েছিল আমেনা বেগমের স্বপ্নের পৃথিবীটা! রায়হানের একটা চিঠি এসেছিল পরে। আগের পাঠানো, গন্ডগোলের সময়ে পৌঁছেছে সময়ের পরে। শেষ লাইনটা মনে পড়ে তাঁর।

    'গ্রীষ্মে তো ফিরছিই। চিলেকোঠা, কবুতরের খোপ আর এক চিলতে ছাদে থাকবো আমরা তিনজন! আমাদের বাংলা ভাষাতেই তোমাকে মা ডাকবে আমাদের সন্তান।'

     

    ৫.

    নীচ থেকে ছুটে আসে আফনান। হাতে একটা ট্যাবলেট পিসি। আমেনা বেগমকেও একটা দিয়েছিল রাফসান, সেটা তিনি শুধু সাজিয়েই রেখেছেন! আফনান ট্যাবটা আমেনা বেগমের সামনে এসে ধরে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করেন তিনি। বরাবরের মতো প্রতিবাদ জানায় চোখজোড়া। ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্ক্রিনে বড় হরফের বাংলা লেখাগুলো এক ধাক্কায় তাঁকে নিয়ে যায় সেই দিনটিতে। ওই লেখাগুলোর পাশেই যেন ভেসে ওঠে রায়হানের মুখের আদলটা।

    মধ্যরাতে শেষ ট্রেনটা ছেড়ে যাচ্ছে তখন। শেষ হুইসেলটা আজও যেন চেষ্টা করে গেল, আমেনা বেগমের বুকে একটা হাহাকারের রেশ জাগিয়ে দিতে! তবে স্টেশনের ওপাশের জমায়েত, যা মিছিলে রূপ নেওয়ার অপেক্ষায়, হতে দিলো না তা।