• " />

     

    হাত ছাড়াই ২২ গজ জয়!

    হাত ছাড়াই ২২ গজ জয়!    

    কাশ্মীর ভ্যালির আলাদা একটা খ্যাতি আছে বিখ্যাত কাশ্মীর উইলো ব্যাটের কারখানা হিসেবে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলীয় গ্রামটির ছেলেপুলেদের তাই ব্যাট-বলের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে বেশ অল্প বয়সেই। ক্রিকেট খেলাটিতে সিদ্ধহস্ত হতেও সময় লাগে না খুব একটা। কিন্তু যদি বলা হয় কার্যত হাতের এই খেলাটি হাতের ব্যবহার ছাড়াই দিব্যি খেলে যাচ্ছে কেউ? বলা হচ্ছে কাশ্মীর রাজ্যের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আমির হোসেনের কথা।  শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কাশ্মীর ভ্যালির এই তরুণ ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং সবই ‘অনায়াসে’ করে যাচ্ছেন দুটো হাত ছাড়াই!

     

     

    কাশ্মীর ভ্যালির অন্তর্গত ঝেলুম নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা গ্রাম ওয়াঘামার বাসিন্দা বশির আহমেদ ও রাজা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে আমির দ্বিতীয়। যেমনটা শুরুতেই বলা হয়েছে, সে এলাকার ছেলেরা ঠিকমতো হাঁটতে শেখার আগেই ব্যাট ধরতে শেখে। আর ক্রিকেট পাগল ভারতে ক্রিকেটার হয়ে দেশ-দুনিয়া মাতানোর স্বপ্নটা তো পাওয়া জাতীয়তা সূত্রেই। আমিরের ক্ষেত্রেও কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি। কিন্তু সেই ক্রিকেটের নেশাই শৈশব না পেরোতে আমিরের জীবনে নিয়ে আসে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। উইলো কাঠ কাটার এক কলের পাশে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত চলন্ত করাতের নীচে চলে যায় ছোট্ট ছেলেটার দুটো হাতই।

     

    পরের ক’টা বছর আমির ও তার পরিবার পার করে ভয়াবহ দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে। সুস্থ হতে তাকে হাসপাতালের বিছানায় কাটাতে হয় পুরো তিনটি বছর। প্রিয় ছেলের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে নিজের প্রায় সব সম্বলই বিক্রি করে দেন বাবা বশির।

     

    সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর শুরু হয় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে স্বাভাবিক জীবনে মানিয়ে নেয়ার এক নতুন সংগ্রাম। বর্ণনাতীত কষ্টকর সে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আমিরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হন তার দাদী। একটু একটু করে আমির নিষ্ঠুরভাবে বদলে যাওয়া বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করে। হাতবিহীন শরীরে প্রাত্যহিক কাজকর্মগুলো সারতে শেখে মূলত পায়ের ব্যবহারে।

     

    ধীরে ধীরে আমির পা দুটোকেই তৈরি করে নেয় হাতের বিকল্প হিসেবে। একটা সময় গিয়ে গ্লাসভর্তি পানি মুখ পর্যন্ত তুলে আনা থেকে শুরু করে মাথার চুল আঁচড়ানোর কাজটাও পায়ের মাধ্যমেই করতে থাকে সে, “দু’বছরের মতো লেগেছে সব কাজ আবার নিজে নিজে করা শিখতে। এখন আমি কারও সাহায্য ছাড়াই ওগুলো অনায়াসে করে ফেলতে পারি।”

     

    পায়ের আঙ্গুল দিয়েই আমির এখন কলম চেপে ধরে লিখতে পারেন, “প্রথম প্রথম লিখতে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু কোনো উপায় তো ছিল না। এই ভেবে মনে জোর এনেছিলাম যে এই প্রতিবন্ধকতা জয় করতেই হবে।”

     

    ওই দুর্ঘটনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পড়াশুনার পাটটাও একসময় আমির চুকিয়ে ফেলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে উৎরে যান সাফল্যের সাথে। ও হ্যাঁ, হাঁসদের পানিতে ভেসে বেড়ানোর কৌশলটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে স্রেফ পায়ের ব্যবহারে সাঁতারটাও শিখে নেন তিনি!

     

    অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার এমন সংগ্রামের মাঝেও ক্রিকেটের প্রতি আমিরের ভালোবাসাটুকু কমে নি। পরিবর্তিত জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার পরপরই ফের শুরু হয় শৈশবের স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটা। বলা বাহুল্য, এখানেও তাঁকে মানিয়ে নিতে কম ঝক্কি পোহাতে হয় নি। একটা সময় গিয়ে আমির গলা আর কাঁধের মাঝে ব্যাট ধরার অদ্ভুত এক কৌশল রপ্ত করে নেন। তারচেয়েও চমকপ্রদ এক কৌশলে শুরু করেন লেগ স্পিন বোলিংও! ডান পায়ের পাতার ফাঁকে বলটা আটকে বেশ গতির সাথেই ‘সুইং’ করে বলটা ছুঁড়ে দেন ব্যাটসম্যানের দিকে।

     

    ব্যাটিং-বোলিংটা যখন হাত ছাড়াই করতে পারছেন তখন ফিল্ডিংটা যে আরও নস্যি বানিয়ে নিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। পা দিয়ে বল ঠেকানোর পাশাপাশি ক্যাচও ধরেন আমির।

     

    সব বিভাগে অবিশ্বাস্য এই পারফরম্যান্স দেখিয়ে আমির ২০১৩ সালে জায়গা করে নেন রাজ্য প্রতিবন্ধী দলে, দ্রুতই পেয়ে যান নেতৃত্বও। আন্তঃরাজ্য ক্রিকেট খেলে ফেরা আমিরের চোখ এখন আন্তর্জাতিক আঙিনায়, প্রতিনিধিত্ব করতে চান গোটা দেশের। আমির প্রেরণা মানেন শচিন টেন্ডুলকারকে...তিনি নিজেও কি কারও কারও চোখে প্রতিবন্ধকতা জয়ের প্রেরণা হয়ে উঠছেন না?