• সিরি আ
  • " />

     

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি: এই মৌসুমের চমক আটালান্টার 'সিক্রেট ফর্মুলা'

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি: এই মৌসুমের চমক আটালান্টার 'সিক্রেট ফর্মুলা'    

    দীর্ঘ বিরতি দিয়ে মাঠে ফিরেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফুটবল। শেষ আটের লড়াইয়ের অন্যসব ম্যাচের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ থাকবে ইতালিয়ান ক্লাব আটালান্টা বি.সি. বনাম পিএসজি এর মধ্যে ম্যাচও। আপনি যদি ফুটবলের নিয়মিত দর্শক না হয়ে থাকেন তাহলে ভাবতে পারেন পিএসজি এই ম্যাচ সহজেই জিতে সেমিতে পা রাখবে। কিন্তু যখন জানতে পারবেন আটালান্টা সিরি এ ১৯-২০ মৌসুমে তৃতীয় স্থান অধিকারী দল এবং এই সিজনে সিরি এ তে সর্বোচ্চ ৯৮ টি গোল করেছে তখন একটু নড়েচড়ে বসারই কথা। সাথে পরিসংখ্যান একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলে যখন দেখবেন এই সিজনে আটালান্টা বিসির পজেশন ৫৫.৪%, শটস পার গেম ১৮.৭, যা সিরি এ এর মধ্যে সর্বোচ্চ এবং ভ্যালেন্সিয়া কে আগের রাউন্ডে দুই লেগ মিলিয়ে ৮-৪ এ উড়িয়ে এসেছে, তখন নেইমার বাহিনীকে একচ্ছত্র ফেভারিট মানতে কষ্ট হওয়ারই কথা। জিয়ান পিয়েরো গ্যাসপিরিনি এর অধীনে আটালান্টা খেলছে চোখ ধাঁধানো ফুটবল। বড় কোনো তারকা না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ইউরোপের শেষ চারের পথে আছে তা জানতে একটু দলের ট্যাকটিকস বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।​

     

    ফর্মেশনঃ

    আটালান্টা বি.সি. খুব সম্ভবত এই মুহুর্তে সিরি এ এর সবচেয়ে ট্যাকটিক্যালি কমপ্লেক্স সাইড। সাদা চোখে দলটি মূলত ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে খেলে থাকে। তিন সেন্টার ব্যাক রাফায়েল তোলোই, পালোমিনো এবং জিমসিতি, উইং ব্যাকে রবিন গোসেন্স এবং হ্যান্স হাতোবার, সেন্টার মিডে ডি রুন, ফ্রয়লার এবং পাসালিচ এর যেকোনো দুইজন, প্লেমেকার হিসেবে পাপু গোমেজ এবং দুই ফরোয়ার্ড হিসেবে জাপাতা এবং ইলিসিচ, প্রয়োজনে সাব হিসাবে মুরিয়েল। আর গোলকীপার হিসাবে আছেন গোলিনি। বল পজেশনে থাকলে দুই উইং ব্যাক ওভারল্যাপ করেন। ফলে আক্রমনে উঠার সময় মূলত দলের ফর্মেশন ৩-২-৫ হয়ে যায়।


     আটালান্টার ফর্মেশন

       তবে আটালান্টার এই দলে বৈশিষ্টই হচ্ছে ট্রানজিশনাল প্লে। কাজেই ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী পাপু গোমেজ লেফটে শিফট করে দলকে ৩-৪-৩ তে খেলতে দেখা যায়। দুই উইংব্যাক এর ক্রমাগত ওভারল্যাপ, দুই ফরোয়ার্ডের ক্রমাগত মুভমেন্ট, সেন্টার ব্যাক আর সেন্টার মিডদের ফরোয়ার্ড রান এবং ফাঁকা জায়গা পূরনে পজিশনাল রোটেশন এর কারণে বিপক্ষের ডিফেন্স প্লেয়ারই ধন্দে পরে মার্কিং করতে গিয়ে।


     ৩-৪-৩ তে শিফট করলো দল

    আবার ডিফেন্স করার সময় ৫-৪-১ ফর্মেশনে চলে আসে গ্যাসপিরিনির দল। ডিফেন্স লাইনের সামনে মিডফিল্ডের একটা সারি শিল্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে এত এটাকিং খেলেও লিগে ৪৮ গোল খেয়েছে আটালান্টা। জুভেন্টাস, দুই মিলান এবং লাৎসিওই এর চেয়ে কম গোল হজম করেছে লিগে।

     

     

     


     ৫-৪-১ ফর্মেশনে ডিফেন্স

    রম্বয়ডাল পাসিং লেইন এবং উইং ও হাফস্পেস ওভারলোডঃ

       ট্রায়াঙ্গুলার পাসিং লেইনের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। যার কাছে বল থাকবে সে যেন পাস দেওয়ার জন্যে সবসময় দুইটি অপশন পায় তাই প্লেয়ার পজিশনিং এর মাধ্যমে ট্রায়াংগেল তৈরি করে রাখে দলগুলো। গ্যাসপিরিনি আরেকজনকে যুক্ত করে রম্বয়ডাল কিংবা ডায়মন্ড শেইপের পাসিং লেইন তৈরি করেন। ফলে একজন প্লেয়ার এর কাছে দুইটির পরিবর্তে তিনটি পাসিং অপশন থাকে। একজন সেন্টারব্যাক, উইংব্যাক, সেন্টার মিড এবং ফরোয়ার্ড এর সমন্বয়ে সাধারণত এই শেইপের লেইন তৈরি হয়।


    আটালান্টার ডায়মন্ড পাসিং লেইন

    এরকম রম্বয়ডাল কিংবা ডায়মন্ড পাসিং লেইন আবার একটি নয়, দুই পাশে দুইটি থাকে। ফলে উইং এবং হাফ স্পেসে ওভারলোড তৈরি হয়। এর ফলে সেন্টারে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয় তার সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে থাকেন পাপু গোমেজ। তাছাড়া একপাশে ওভারলোড তৈরি হলে অপর পাশে যে স্পেস তৈরি হয় তার সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে কাটব্যাক করে ঢোকা উইংব্যাক কিংবা অপর ফরোয়ার্ড কালবিলম্ব করেন না। হাফ স্পেস ওভারলোড করে সেন্টারে স্পেস ক্রিয়েট করার ব্যাপারটা পরিচিত লাগছে কি? পচেত্তিনোর টটেনহাম এর খেলা লক্ষ্য করলে লাগারই কথা।

     

    দুই পাশে দুইটি ডায়মন্ড শেইপ

     

    আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ডায়মন্ডের নিচ থেকে যখন বল সামনে বাড়ানো হচ্ছে তখন পাপু গোমেজ গিয়ে নতুন একটা ডায়মন্ড শেপ তৈরি করছে। ফলে এটাকিং থার্ডে গিয়েও সবসময়ই তিনটা পাসিং অপশন খোলা থাকছে।

     ফরোয়ার্ড পাসিং এর সময় গোমেজের মুভমেন্ট


     গোমেজ এর কারণে নতুন ডায়মন্ড তৈরি হল

     

    পজিশনাল ইন্টারচেঞ্জ ও রোটেশনাল ফুটবলঃ

    আর্জেন্টাইন কোচ রিকার্ডো লা ভোলপে এর কথা মনে আছে? ২০০২-০৬ পর্যন্ত মেক্সিকো জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ভারী গুম্ফযুক্ত এই ভদ্রলোকের খেলার ধরণ, “সালিদা লাভোলপিয়ানা” ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলো যার প্রশংসা খোদ পেপ গার্দিওলা করেছেন। সালিদা লাভোলপিয়ানার একটি বিশেষত্ব ছিল পজিশনাল রোটেশন। গ্যাসপিরিনির ট্যাকটিকসেও এই পজিশনাল ইন্টারচেঞ্জ এর চমকপ্রদ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ডায়মন্ডের মাঝের চারজন মূলত নিজেদের মধ্যে রোটেট করে খেলতে থাকেন এবং অনেক সময় ডিকয় রান ক্রিয়েট করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে তার জোন থেকে সরিয়ে আনেন। ফলে সৃষ্টি হওয়া ফাঁকা জায়গার সুবিধা নেন অন্য কেউ। পজিশনাল ইন্টারচেঞ্জের কারণে সেন্টারব্যাক উইং ব্যাকের পজিশনে, উইংব্যাক ফরোয়ার্ডের জায়গায়, ফরোয়ার্ড নেমে সেন্টার মিডের জায়গায় এবং সেন্টার মিড ডিফেন্সের ফাঁকা জায়গা পূরণ করেন।

     

    আটালান্টার আক্রমণের আরেকটা বৈশিষ্ট হচ্ছে ডিফেন্ডারদের উপরে উঠার স্বাধীনতা আছে। যেমন জিমসিতি উপরে উঠার ফলে ফ্রয়লার তার জায়গা নিচ্ছে এবং গোসেন্স ওভারল্যাপ করে উঠে যাচ্ছে অনেক। ফলে আক্রমণে ফ্লুইডিটি আসছে অনেক। তাছাড়া একপাশে উইংব্যাক ও একজন সেন্টারব্যাকের কারণে যে ওভারলোড তৈরি হচ্ছে তা অপর পাশে স্পেস তৈরিতে সাহায্য করছে। এবং সেই ফাঁকা জায়গার সুবিধা নিতে পাপু, ইলিসিচ, জাপাতারা সর্বদাই প্রস্তুত।

     


     জিমসিতি আক্রমণে উঠে ওভারলোড তৈরিতে সাহায্য করছেন

     

    পজিশনাল চেঞ্জ এর মাধ্যমে স্পেস ক্রিয়েটের আরেকটি পদ্ধতি হল যেকোনো একজন ফরোয়ার্ড (সাধারণত ইলিসিচ) ওয়াইড এরিয়া তে কিংবা মিডে সরে গিয়ে তাকে মার্ক করা ডিফেন্ডারকে তার জায়গা থেকে সরিয়ে দেওয়া। এতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে যে গ্যাপ সৃষ্টি হয় তার সুবিধা নেওয়ার জন্যে সেন্টার মিড কিংবা উইংব্যাক রা তো আছেনই। সেক্ষেত্রে উইংব্যাক ইনসাইড কাট করে কিংবা সেন্টার মিড ফরোয়ার্ড রান এর মাধ্যমে পাপু গোমেজের বাড়ানো থ্রু বল থেকে গোলের সুযোগ তৈরি করে থাকেন।

     

     ইলিসিচের ডানে শিফটের কারনে ক্রিয়েট হওয়া স্পেস

    ইলিসিচের নিচে নামার কারনে ক্রিয়েট হওয়া স্পেস

    এরকম দ্রুত রোটেশনাল ও মুহুর্মুহু পজিশনাল ইন্টারচেঞ্জের ফুটবল খেলার জন্যে প্রয়োজন প্রচন্ড পরিশ্রমী ও ট্যাকটিক্যালি ট্যালেন্টেড কিছু মিডফিল্ডার। ফ্রয়লার, ডি রুন, পাসালিচ, পাপু গোমেজরা গ্যাসপিরিনির জন্যে সে দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করছেন বলা যায়।

     

    এক্স ফ্যাক্টরঃ পাপু গোমেজ

    যদিও দলের প্রত্যেকের সমান অবদান ছাড়া এরকম পজিশনাল ফুটবল খেলা সম্ভব নয়, তারপরেও আটালান্টার এই দলের প্রাণ বলা যায় নাম্বার টেন পাপু গোমেজকে। দলের আক্রমণভাগ ও মাঝমাঠকে আংটার মত একাই জুড়ে রাখেন বলা যায়। প্রায় লুপ্ত হতে বসা ত্রেকার্তিস্তা রোল মানুষের মনে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। দলের মধ্যে একমাত্র পাপুই সাধারণত জোন ১৪ এ বিচরণ করেন। দুই পাশে ওভারলোডের কারণে তৈরি গ্যাপের সুবিধা নেওয়া এবং ফরোয়ার্ড পাসিং এর সময় নতুন ডায়মন্ড তৈরির কথা তো ইতোমধ্যে বলাই হয়েছে। তার আরেকটি কাজ হল হাফ স্পেসে ঢুকে ডায়মন্ডের জায়গায় পেন্টাগন ক্রিয়েট করে আরো একটি পাসিং অপশন বাড়ানো এবং দ্রুতগতিতে মাঠের এক পাশ থেকে অন্য পাশে বল যোগান দেওয়া। এই দলে একমাত্র পাপু গোমেজকেই ডিফেন্সের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ফ্রি রোলে খেলার অনুমতি দেওয়া আছে। তার মূল কাজ হল ফাঁকা জায়গা খুজে বের করে নিজে অথবা বল সেদিকে পাস করে সেই স্পেসের সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়া। গোমেজের নিজের ভাষ্যমতে, মাঠে সবচেয়ে ফাঁকা জায়গায় থাকে রেফারী। কাজেই তাকে রেফারেন্স ধরেই খালি স্পেস খুঁজে পাওয়া সম্ভব। নিজের কাজে আলেসান্দ্রো পাপু গোমেজ যে অত্যন্ত সফল তা বুঝা যায়, এই সিজনে সিরি এ এর সর্বোচ্চ ১৬টি এসিস্ট তার মাধ্যমেই এসেছে। দলের দুই ফরোয়ার্ডের সাথে পাপু গোমেজের বোঝাপড়াও চমৎকার। প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে নিজেদের মধ্যে প্রচুর পাস আদান-প্রদান করে থাকেন। মৌসুমে লিগের ৯৮ টির মধ্যে ৬৭ টি গোলই এসেছে ওপেন প্লে থেকে  যা দলের সদস্যদের মধ্যে ভালো রসায়নের পরিচয়ই বহন করে।

    অতঃপর হাই প্রেসিং এবং ডিফেন্সঃ

    যদিও চোখ ধাঁধানো আক্রমণভাগ দিয়েই গ্যাসপিরিনির আটালান্টা বেশী নজর কেড়েছে, তবে তাদের ডিফেন্সকেও অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। আধুনিক ফুটবলের সফল অন্য দলগুলোর মতই গ্যাসপিরিনি হাই প্রেসিং করাতে ভালোবাসেন। প্রতিপক্ষের পায়ে বল যাওয়া মাত্রই সবচেয়ে কাছের ফুটবলার গিয়ে প্রেস করেন। কাছাকাছি থাকা অন্য কেউ  এর মত প্রতিপক্ষের সাথে এঁটে পাসিং অপশন বন্ধ করে দেন। এরকম হাই প্রেসের কারণে প্রতিপক্ষ হামেশাই লং ক্লিয়ারেন্স করতে বাধ্য হয় এবং পজেশন পুনরায় আটালান্টার কাছে ফেরত আসে। এর সাথে ডিফেন্সকে খেলান হাই লাইনে। বল ছাড়া দুই উইংব্যাক নিচে নেমে আসেন। সব মিলিয়ে সিরি এ তে পঞ্চম সর্বনিম্ন গোল খাওয়ার পরিসংখ্যান বলে, ডিফেন্স এর কাজেও আটালান্টা খারাপ করছে না।

     

    গ্যাসপিরিনির এই ডায়মন্ড শেইপ এবং পজিশনাল ইন্টারচেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল প্লেয়ারদের মধ্যে একইসাথে হরাইজন্টাল এবং ভার্টিক্যাল রোটেশন সম্ভব। তাছাড়া এতে উইং ও হাফ স্পেসে ওভারলোড তৈরি হচ্ছে যার ফলে সেন্টারে ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে, সেটপিসের সময় জাপাতা তার গতি ও উচ্চতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন। সব মিলিয়ে গ্যাসপিরিনি চমৎকার ট্যাকটিকসের এর মাধ্যমে তার সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন। এর ফলাফল আমরা দেখছি সিরি এ তে তৃতীয় স্থান কিংবা এখনো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টিকে থাকা। আটালান্টা শেষ পর্যন্ত কতদূর যেতে পারবে কিংবা গ্যাসপিরিনি ভবিষ্যতে অন্য কোনো ক্লাবে গিয়ে নতুন কোনো চমক দেখান কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।

     

     

    কৃতজ্ঞতাঃ

    1. https://www.youtube.com/watch?v=KPmUmeEI3Qo
    2. https://www.youtube.com/watch?v=LZfwMbOaL8w
    3. https://themastermindsite.com/2020/03/31/gian-piero-gasperini-atalanta-tactical-analysis/
    4. https://totalfootballanalysis.com/team-analysis/atalanta-201920-using-rotations-scout-report-tactical-analysis-tactics
    5. https://www.thefalse9.com/2019/06/atalanta-formation-tactics-gasperini.html
    6. https://www.whoscored.com/Teams/300/Statistics/Italy-Atalanta