আটালান্টার শক্তি বেরগামো, পিএসজির চাওয়া শুধুই সেমিফাইনাল
কবে, কখন
পিএসজি-আটালান্টা
লিসবন
চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোয়ার্টার ফাইনাল
১৩ আগস্ট, রাত ১.০০
আটালান্টা কোচ জিয়ান পিয়েরো গ্যাস্পারিনি ড্রেসিংরুমে একটা পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে একদল নেকড়ের ছবি। সামনের সারিতে কিছু নেকড়ে, মাঝের সারিতে আরও বেশি। একেবারে পেছনে একটি মাত্র নেকড়ে। তার দর্শন অনুযায়ী, কিছু হলে প্রথমে আক্রমণে যাবে প্রথম সারির নেকড়ে। দ্বিতীয় সারি সবচেয়ে শক্তিশালী, তারা সাহস যোগাবে। আর একেবারে পেছনের একাকী নেকড়ে থাকবে রক্ষিত। গ্যাস্পারিনি মনে করেন, নেতাকে সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। পেছন থেকেও কলকাঠি নাড়তে পারেন তিনি। এই দর্শন গিলে খাওয়ানোর জন্য বেরগামোর স্টেডিয়ামে পোস্টারটা সেঁটেছিলেন গ্যাস্পারিনি।
এই বেরগামো ইতালির ছোট শহর। লোকে বলে মিলান যাওয়া আসার পথে বাঁধে। এর আলাদা কোনো স্বকীয়তা নেই। ছোট শহরে অল্প লোকের বাস। এই শহর মাস কয়েক আগে অন্ধকারে ডুবে ছিল। লকডাউনের সময় ইতালির অলিতে-গলিতে গানবাজনার ভিডিও হয়ত দেখেছেন আপনি। এই ইতালি সেই ইতালি না। শুনশান নীরব শহরে সেনাবাহিনীর সারি সারি গাড়ির শবযাত্রা দেখেছেন? বেরগামো সেই শহর। আটালান্টা সেই শহরের গর্ব। গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগে বাছাই করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল তারা। গ্রুপ পর্বে বাদ পড়তে পড়তে পড়তে শেষের নাটকে নক আউট পর্বের টিকেট। দ্বিতীয় রাউন্ডে ভ্যালেন্সিয়াও কাত তাদের কাছে। স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে তাই আটালান্টা। ফেব্রুয়ারির ওই আনন্দ বেরগামোতে মিলিয়ে গিয়েছিল এর কিছুদিন পরই।
জুন নাগাদ ফুটবল ফেরার সঙ্গে প্রাণ ফিরেছে বেরগামোতেও। আটালান্টা আবার সিরি আ-তে তৃতীয় হয়েছে। সিরি আর ২০ ক্লাবের ভেতর বাজেটের দিক দিয়ে তাদের ওপরে আছে আরও ১৩ ক্লাব। জুভেন্টাসের বাজেটের এক অষ্টমাংশ তাদের বাজেট। পিএসজির নেইমারের পুরো বছরের বেতনের সমান পুরো ক্লাবের খেলোয়াড়দের বেতন। বেরগামোতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলতে পারেনি আটালান্টা এবার, কারণ তাদের স্টেডিয়াম সেকেলে, ইউয়েফার অনুমতি মেলেনি। আটালান্টা হোম ম্যাচ খেলেছে সান সিরোতে। এসি মিলান, ইন্টার মিলান চেয়ে চেয়ে দেখেছে সেসব। কিন্তু আটলান্টার গল্পকে রূপকথা বললে নির্ঘাত অপমান করা হয়।
আটালান্টার উন্নতি কঠোর পরিশ্রম আর মেধার ফল। তিনি স্বীকার করতে চাইবেন না, তবে পোস্টারের দলের পেছনের নেকড়েটা আসলে হুবহু মিলে যায় জিয়ান পিয়েরো গ্যাস্পারিনির সঙ্গে। তার ছোঁয়ায় নেকড়ের দলেই পরিণত হয়েছে আটালান্টা। হুট হাঁট যেখান সেখান থেকে প্রেস করে আপনাকে ধন্ধে ফেলে দেবে আটালান্টা, আপনার রক্ষণে ৭ জন, ৮ জন নিয়ে উঠে যাবে আক্রমণে। আপনি তাদের থামাতে পারবেন না। এই মৌসুমেও ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোল করা দল আটালান্টা। তাদের ৯৮ গোলের চেয়ে বেশি আছে কেবল বায়ার্ন মিউনিখের ১০০ আর, ম্যান সিটির ১০২।
পিএসজি কোচ থমাস তুখল এসব জানেন। ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে সেসব অকোপটে নিজেও স্বীকার করে নিলেন, “আটালান্টার সঙ্গে খেলা কঠিন। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই ম্যাচ শুধু ট্যাকটিক্যালি নির্ধারণ হবে না, মানসিকতাও বড় ভূমিকা রাখবে।” আটালান্টার বিপক্ষে পিএসজিই ফেভারিট। দুই লেগের ম্যাচ হলেও হয়ত তাই হত। যদিও গ্যাস্পারিনি বলছেন, দুই লেগের ম্যাচ হলে আটালান্টার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যেত আরও।
কী হতে পারত, কী হতে পারত না- সেসব প্রশ্ন এখন অবান্তর। এক লেগের চ্যাম্পিয়নস লিগই এখন বিবেচ্য। পিএসজির ইতিহাস বদলের এটাই সময়। আটালান্টার ওপর প্রত্যাশা পূরণের চাপ নেই, আছে স্বপ্ন। থমাস তুখলের ওপর বরখাস্তের খড়্গ ঝোলে সবসময়। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে পিএসজি এর আগে উঠেছে একবার, ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পর টানা তিনবার দ্বিতীয় রাউন্ডের নাটকীয় ব্যর্থতার পর এবার প্যারিসিয়ানরা আবার উঠেছে শেষ আটে। সেমিফাইনালে উঠতে না পারলে মৌসুমটা বৃথাই যাবে।
মার্চের পর থেকে মাত্র দুইটি আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলেছে পিএসজি। স্থগিত লিগের চ্যাম্পিয়ন তারাই হয়েছে। ঘরোয়া আরও দুইটি শিরোপা জুলাইয়ের শেষে এসে দুই ম্যাচ খেলেই জিতেছে পিএসজি। এরপর আসল জায়গায় এসে পা হড়কালে সমূহ বিপদ ধেয়ে আসবে পিএসজির দিকে।
আটালান্টা খেলার ভেতরই ছিল। গত দুই মাসেও তারা খেলেছে একই ধারায়। ইতালির বড় ক্লাবগুলোকে নিয়মিত ঘাবড়ে দেওয়ার অভ্যাস আছে তাদের। পিএসজি সেই ‘বদঅভ্যাসের’ শিকার হতে চাইবে না। তুখলের কথাই তাই ঠিক, ম্যাচের অনেকটাই মানসিকতার খেলাও।
মানসিক দিক দিয়ে পিএসজি এগিয়ে গেছে খানিকটা কিলিয়ান এমবাপে ফেরার পর। চোটের কারণে একটা সময় ভাবা হচ্ছিল এই ম্যাচ মিস করবেন তিনি। ম্যাচের আগে তুখল নিশ্চয়তা দিয়ে দিয়েছেন এমবাপের থাকার ব্যাপারে, “নাটকীয় কিছু না হলে এমবাপে দলেই থাকবে।”
গোল করা অবশ্য পিএসজিরও সমস্যা না। নেইমারও এবার ফিট আছেন। ২০১৪-১৫ মৌসুম থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগের নক আউট পর্বে নেইমারের ১৪ গোলের চেয়ে বেশি গোল আছে কেবল তিনজনের। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি ও রবার্ট লেভানডফস্কির। অবধারিতভাবেই সব আলো থাকবে নেইমারের ওপর। মাউরো ইকার্দিও গোল করতে পটু। এমবাপে পুরো ম্যাচ না খেললেও তাই যথেষ্ট গোলাবারুদ আছে তুখলের হাতে। বাড়তি তাড়নাও আছে পিএসজির। অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা ক্লাব ছাড়বেন চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষেই। শিরোপা জিতে বিদায় নিতে পারলে ক্লাব অধিনায়কের বিদায়টাও হবে আড়ম্বরে।
আটালান্টার লক্ষ্য অবশ্য বেরগামোতে হাসি ফোটানো। গ্যাস্পারিনি বলেছেন, শহরের সবার মুখে হাসি ফোটানোর একটা দায়িত্ব প্রচ্ছন্নভাবেই এসে গেছে তার দলের ওপর, "আমাদের শহরকে আমাদেরই প্রতিনিধিত্ব করতে হবে সেরা উপায়ে। নতুন করে শুরু করার সামর্থ্য যোগাতে হবে। আমি আগেও বলেছি, মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব।"
বেরগামো অপেক্ষা করছে ফুটবলের শক্তির দেখতে। বেরগামো হাসলে জৌলুসের প্যারিসে শুরু হবে আবার কুরুক্ষেত্রে। প্যারিসিয়ানদের আগুন নিয়েই খেলতে হবে আটালান্টার সঙ্গে।
দলের খবর
এমবাপের একাদশে থাকার সুযোগ কম। পাবলো সারাবিয়া তার জায়গায় খেলবেন। আনহেল ডি মিয়ারিয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে খেলবেন না এই ম্যাচে। মার্কো ভেরাত্তিও চোট থেকে সেরে উঠতে পারেনিনি। নেই এডিনসন কাভানিও। আটালান্টার জোসেপ ইলিচিচেরও খেলার সম্ভাবনা নেই এই ম্যাচে। ইতালিয়ান ক্লাবটির সাফল্যে বড় ভূমিকা স্লোভেনিয়ান ফরোয়ার্ডের। পুরো মৌসুমে মোট ২১ গোল করেছেন তিনি, এর ভেতর চ্যাম্পিয়নস লিগেই আছে তার ৫ গোল। তাকে ছাড়া আলেহান্দ্রো গোমেজ, দুভান জাপাতাদের আক্রমণ কতোখানি কার্যকরী হবে সেটা নিয়েও আছে সংশয়।
সম্ভাব্য একাদশ
পিএসজি
নাভাস, কেহরের, সিলভা, কিমপেম্বে, বের্নাট, মার্কিনিয়োস, হেরেরা, গায়া, সারাবিয়া, নেইমার, ইকার্দি
আটালান্টা
স্পোর্তিয়েলো, তোলোই, ক্লাদারা, দিমিৎসি, হাতেবোর, ডে রন, ফ্রিউলার, গোসেন্স, মালিনোভস্কি, গোমেজ, জাপাতা
প্রেডিকশন
ম্যাচে গোলের অভাব হবে না। তবে খেলোয়াড়দের মান পার্থক্য গড়ে দিতে পারে ম্যাচে। দিনশেষে অঘটন ঘটার সম্ভাবনাও কম। পিএসজিই প্রথমবারের মতো উঠে যাবে সেমিফাইনালে।
আটালান্টা ২-৩ পিএসজি