চ্যাম্পিয়নস লিগে গার্দিওলার টানা ব্যর্থতা: 'অতি চালাকের গলায় দড়ি'?
দুইটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার কীর্তি এর মধ্যেই আছে তার। ঘরোয়া কাপও জিতেছেন স্পেন, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে। তারপরও পেপ গার্দিওলাকে যদি ‘চ্যাম্পিয়নস-লিগের জন্য আনফিট’ বলা হয়, তাহলে তার সবচেয়ে গুণমুগ্ধ ভক্তও বোধ হয় আপত্তি করবেন না। নয় বছর আগে বার্সার হয়ে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলেন। এরপর বায়ার্নের হয়ে একের পর এক চেষ্টায় পারেননি, সেমি পর্যন্তই ছিল দৌড়। আর ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালার পর সেমি দূরে থাক, কোয়ার্টারই পার হতে পারেননি এখনো। পর পর টানা তিন মৌসুমে গার্দিওলার দল বিদায় নিল শেষ আট থেকেই। কিন্তু এই টানা ব্যর্থতার কারণটা আসলে কী? লিগে সাফল্য পেলেও টুর্নামেন্টে কেন মুখ থুবড়ে পড়েন গার্দিওলা? কোচ হিসেবে তিনি কি আসলেই ওভাররেটেড?
এসব প্রশ্নগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে এখন, হয়তো গার্দিওলার এজন্য জবাবদিহিতাও করতে হতে পারে। গত তিন মৌসুমে খেলোয়াড় কেনায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ করার পরেও গার্দিওলার দলের সাফল্য চ্যাম্পিয়নস লিগে শুন্য। কাল লিওঁর সঙ্গে যা করলেন, তাতে বোঝা গেল সমস্যাটা আসলে গার্দিওলার সামর্থ্যের নয়, মানসিক।
আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক। গার্দিওলা যে ঘরোয়া লিগে পরীক্ষিত একজন কোচ, সেটা তার নিন্দুকও মানবেন। বার্সার হয়ে না হয় মেসি-জাভিরা ছিলেন, বায়ার্নেও হয়তো লিগে সেরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে পড়তে হয়নি, তবে আর যাই হোক অন্তত ম্যান সিটিকে নিয়ে দুইবার লিগ জেতার জন্য তাকে কিছুটা কৃতিত্ব দিতেই হবে। লম্বা সময় ধরে মৌসুমের পরিকল্পনা কীভাবে করতে হয়, প্রতিপক্ষকে কীভাবে কাটাছেঁড়া করতে হয়, সেটাও জানেন গার্দিওলা। সেজন্য লিভারপুলের মুখের গ্রাস থেকে লিগ ছিনিয়ে নিয়েছিল সিটি দুই বছর আগে। কিন্তু সিটিতে এত টাকা খরচ তো শুধু লিগের জন্য নয়, চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্যও। কিন্তু বড় টুর্নামেন্টের বড় ম্যাচে যেন কৌশলগতভাবে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
কালকের ম্যাচটাই এর প্রমাণ। লিঁও প্রায় মাস পাঁচেক পর প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলতে নেমেছিল এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে। তাদের বিপক্ষে গার্দিওলা শুরু থেকে খেললেন তিনজন সেন্টারব্যাক নিয়ে। দু দিকে উইংব্যাক ক্যান্সেলো আর ওয়াকার। ক্যান্সেলো ভালো করলেও ওয়াকার একদমই মানিয়ে নিতে পারেননি। আর বাড়তি একজন সেন্টারব্যাক খেলানোয় খেলাও স্ট্রেচ করতে পারছিল না সিটি। সেজন্য প্রথমার্ধে কেভিন ডি ব্রুইন নিজেকে সেভাবে খুঁজেই পাননি, আউট অফ পজিশন হয়ে ঘুরেছেন। লিঁওকে একটু বেশিই সমীহ করে ফেলেছিলেন গার্দিওলা, শুরু থেকেই ‘রিঅ্যাক্টভ অ্যাপ্রোচে’ গিয়ে তাই খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন দলকে। প্রথমার্ধে সেখানেই মার খেয়ে গেছে সিটি, লিঁওকে চেপে ধরার বদলে উলটো গেছে পিছিয়ে। সেভাবে কোনো আক্রমণও করতে পারেনি, সেই দায়টা গার্দিওলার।
দ্বিতীয়ার্ধে এসে নিজের ভুলটা একটু শুধরে নিয়েছেন গার্দিওলা। ফার্নান্দিনহোকে উঠিয়ে নামিয়েছেন মাহরেজকে, সিটির খেলা একটু স্ট্রেচ হয়েছে। এরপরেই দুর্দান্ত একটা আক্রমণ থেকে গোল করে সমতা ফিরিয়েছেন ডি ব্রুইন। গার্দিওলার দলের ফ্রি-ফ্লোয়িং ফুটবল দেখা গেছে এরপর কিছুটা। কিন্তু রক্ষণের ভুলে আর ম্যাচে ফেরা হয়নি। হাই লাইন খেলতে গিয়ে লাপোর্তরা নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। শেষ দিকে সিল্ভাদের নামিয়েও তাই কাজ হয়নি সিটির, স্টার্লিংয়ের মিসের জন্য মাশুল দিতে হয়েছে তাদের।
অথচ ৪-৩-৩ ফর্মেশনে শুরু থেকে খেললেও হয়তো লিঁও এত সুযোগ পেত না। রিয়াল মাদ্রিদের সাথে একাদশটা ঠিক ছিল গার্দিওলার, ডি ব্রুইন পুরো ম্যাচেই ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু তিন ডিফেন্ডার নামিয়ে কাল এলোমেলো করে ফেললেন সবকিছু। এমনকি ৮২ মিনিট পর্যন্ত আর কোনো বদলিই করেননি গার্দিওলা, একটু বেশিই আস্থা রেখে ফেলেছিলেন খেলোয়াড়দের ওপর।
সমস্যা হচ্ছে এরকম ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত বছর টটেনহামের বিপক্ষেও প্রথম লেগে রক্ষণাত্মক খেলে হেরেছিলেন, দ্বিতীয়ার্ধে ৪-৩ গোলে জিতেও তাই পুষিয়ে দিতে পারেননি হারটা। এর আগে লিভারপুলের সাথে মিডফিল্ড প্যাক করার পরীক্ষা করতে গিয়ে খেসারত দিয়েছিলেন হেরে। আবার বায়ার্নের হয়ে যখন ছিলেন, সুয়ারেজদের ম্যান-টু-ম্যান মার্ক করতে গিয়েও সেটার মাশুল দিয়েছিলেন, আর রিয়ালের সাথে খেলতে গিয়েছিলেন অলআউট। এমন নয় যে গার্দিওলা জানতেন না তিনি কী করছেন। ট্যাকটিক্যালি তাকে কমজোরি ভাবার কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ আসলে কেন যেন একটু বেশিই চিন্তা করেন। দলের সহজাত ফর্মেশন ও পরীক্ষিত একাদশের ওপর ভরসা না রেখে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যান। বেঞ্চ সবসময়ই শক্তিশালী পেয়েছেন বলে হয়তো সেই সুযোগ থাকেও। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে সেটা গার্দিওলার কাছে বুমেরাং হয়েই ফিরে এসেছে সবসময়।
কাল ম্যাচ শেষে গার্দিওলা বলেছেন, একদিন না একদিন চ্যাম্পিয়নস লিগের গেরো কাটাবেনই। সেটা হবে কিনা বলে দেবে সময়, তবে আপাতত কোচ হিসেবে গার্দিওলার সুনামটা বড় প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। তার বড় কারণ অবশ্যই গার্দিওলার অতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা।