না-ই বা এলো শিরোপা...
সোজা চলে যাওয়া রাস্তা, তার দুপাশে আপাত-ব্যস্ত দোকানপাট। একটু এগুলেই নদী পড়বে। শহরের পট রাস্তা পেরুলেই শেষ; পাখির কলতান, দিগন্ত-বিস্তৃত ধানখেত, ফাঁক দিয়ে সারবাঁধা খেজুর অথবা নারকেল গাছ; বাংলাদেশের রূপ সব মফস্বলেই তো এমন। নড়াইল তার ব্যতিক্রম কিভাবে হবে, যেমনি ব্যতিক্রম নয় ৫৫০ কিলো দূরে রাঁচি শহরটাও। নদীর বদলে সেখানে হয়তো রেলপথ আছে, সবুজের বদলে সেখানে হয়তো ধূসরতা বেশি; কিন্তু মফস্বলের পট আর জীবনের অঙ্কনে তাতে খুব বেশি পার্থক্য তো আসে না! মফস্বলগুলোই মনে হয় নেতা তৈরির কারিগর, একটু হিসেব করে দেখুন- দুনিয়ার বেশিরভাগ সফল নেতৃত্বের পিছনে এমন সবুজ নয়তো ধূসর চিত্রই আপনার চোখে পড়বে।
মাশরাফি এবং ধোনির ক্যারিয়ারের তুলনা হয়তো চলে না, কিন্তু দুজনের শৈশব তো এই সদৃশ দুটি শহরেই কেটেছে। দুজনের সেই দিনগুলোর তুলনা করে দেখুন, প্রখর আত্মসম্মানবোধ আর তীব্র আত্মবিশ্বাসযুক্ত একটি ছবিই আপনার সামনে ফুটে উঠবে। কেউই শৈশবে ক্রিকেটার হতে চাননি, কেউই ভাবেননি দেশকে নেতৃত্ব দেবেন সামনে থেকে। বাইকের নেশায় দুজনেই বুঁদ; যেমনি উদ্বেলিত থাকেন দেশপ্রেমের নেশায়; এবং আশ্চর্যজনকভাবে দুজনেই ক্রিকেটে দেশপ্রেমের কিছু খুঁজে পান না! চাইলে এমন অনেক মিলই আপনি খুঁজে পেতে পারেন, পার্থক্যও হয়তো পাওয়া সম্ভব; কিন্তু মূলসুরটা মেপে দেখুন; তাতে ফারাক সামান্যই! নেতা আসলেই জন্ম নেয়না, নেতা তৈরি হয় পারিপার্শ্বিকতা থেকে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ক্ষমতা থেকে!
আজ বাংলাদেশ-ভারতের এশিয়া কাপ ম্যাচ নিয়ে লেখাটা একদিক থেকে তাই অর্থহীন। আপামর জনসাধারণ যতই উদ্বেলিত থাকুক, রোমাঞ্চিত ক্রিকেটপ্রেমী যতই সব কাজ বাদ দিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখুন, কৌশিক-মাহির কাছে এটা শুধুই আরেকটা ম্যাচ; মাঠে হয়তো সবকিছুই তারা করবেন জেতার জন্যে, কিন্তু মাঠের বাইরে তার কোন রেশই আর আনতে দেবেন না। অবশ্য ধোনি নাই পারেন আনতে দিতে, ভারতের সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক তিনি; সব ফরম্যাটে দলকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের চূড়ায়। জিতেছেন সব ধরনের ট্রফি, টেস্ট ক্রিকেটে দলকে নিয়ে গেছেন এক নম্বরে। এই এশিয়া কাপ হয়তো ধোনির সাফল্যের মুকুটে কেবল একটি অতিরিক্ত পালক যুক্ত করতে পারে, কিন্তু মাশরাফির বেলায়? জীবনে এর আগে মাত্র দু'টি ফাইনাল খেলেছেন, বলা বাহুল্য বাংলাদেশও খেলেছেই মাত্র এই দু'টি। হেরেছেনও দু'টিতেই, কাপ নিয়ে উচ্ছ্বাস করার সৌভাগ্য তো আগে কখনো হয়নি। মাশরাফি তবুও নির্লিপ্ত থাকবেন, জিতলে হয়তো সবার আগে তিনিই জোড়াতালি দেয়া হাঁটুটা নিয়ে দৌঁড়াবেন, ঝাঁপিয়ে পড়বেন কোন সতীর্থের কোলে; হারলে তিনিই আবার টুপিখোলা সম্মান জানাবেন প্রতিপক্ষকে, পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিবেন সতীর্থকে! এই মাশরাফি এজন্যেই অনন্য, অনবদ্য; তাঁকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা করাও তাই একটা স্পর্ধার পর্যায়ে পড়ে!
ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যানে এই ম্যাচকে বাঁধা আসলে মূল্যহীন। সবদিক থেকে ভারত বহুগুণে এগিয়ে। এক রোহিত শর্মারই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তিনটি সেঞ্চুরি আছে, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অমানবিক ৫০ এর উপর ব্যাটিং গড় নিয়ে একজন বিরাট কোহলি এই দলেই খেলেন। যুবরাজ সিং এর মত পোড় খাওয়া যোদ্ধা আছেন, ধোনি নিজে তো আছেনই। চিরকাল দুয়োরাণীর মত উপেক্ষিত ভারতীয় পেস বোলিংও এখন দুর্দান্ত; বুমরা,হার্দিক পান্ডিয়ার মত নতুন রক্তের সাথে নেহরার বুড়ো হাড়ের ভেলকি; সাথে অশ্বিনের জাদুকরী স্পিন। এই ভারতের কোনো দুর্বলতাই আসলে নেই। সাথে নেই বাংলাদেশের জেতার সু্যোগটাও!
তবুও একটা কিন্তু থেকেই যায়! ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের ঐ ম্যাচটাতেও তো বাংলাদেশের জেতার কোনো সু্যোগ ছিলনা, তামিম-সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা তখনও আজকের মত মহীরূহ হননি; শচীন-গাঙ্গুলি-দ্রাবিড়-শেবাগদের নিয়ে গড়া ভারতীয় দলকে এই তরুণেরাই তো তবু হারিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন হারিয়েছিলেন এশিয়া কাপের ম্যাচটায় ২০১২ সালে, গত বছরের ২-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জেতার স্মৃতিটা তো এখনো টাটকাই থাকার কথা! ক্রিকেটীয় ভবিষ্যদ্বাণীর ফুলঝুরি তাই এখন আর বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে খাটে না। আজকে মিরপুরে কি হবে সেটাও তাই বলা যায় না!
ক্রীড়া সাংবাদিকতার সকল নীতিকে উপেক্ষা করেও তাই আজ বলার দিন - বাংলাদেশ জিতুক, মাশরাফি তাঁর দৃপ্ত হাতে উঁচিয়ে তুলুক এশিয়া কাপের ট্রফিটা। আজ স্বপ্নটা বড় বেশি বাঁধনহারা, আজ মন সব যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে। ২০০৭ বিশ্বকাপের ঐ ম্যাচের পর ভারতের বিরুদ্ধে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে খেলা ২১টি ম্যাচের মাত্র ৩টিতে জয় থাকুক, ছয়টি টি-টোয়েন্টির সবগুলোতে পরাজয়ের তিলক থাকে থাকুক - আজকে তবু মন চাইবে বাংলাদেশের শিরোপা দেখতে, মিরপুরের সবুজ ঘাসে ক্রিকেটারদের বিজয়োল্লাস অবলোকন করতে!
আশার ফানুস আর না উড়াই। আজ আসলে ফাইনাল হারলেও ক্ষতি নেই, মাশরাফি কি আর তাতে হারবেন? ট্রফির নিরিখেই কি আর সব অধিনায়কের বিচার হয়? বাংলাদেশ আজকে হারলেও তাই মাশরাফি হারবেন না, মাশরাফিরা হারতে জানেনও না। পা হারানোর ভয় নিয়েও যিনি দেশের জন্যে দাপিয়ে বেড়ান, একজন জাতীয় নেতা হয়েও যিনি নেতার প্রাপ্য সম্মানটুকু নিতেও কুন্ঠাবোধ করেন, একটি এশিয়া কাপ পরাজয়ে তাঁর আর কি আসবে যাবে?
ধোনির হাতে শিরোপা উঠলে উঠুক, আসল চ্যাম্পিয়ন আজ বাংলাদেশই থাকবে!