পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে উড়ছে ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া
নব্বইয়ের শেষ থেকে ক্রিকেট দেখে যে প্রজন্ম বড় হয়েছে, তারা একটা দীর্ঘ সময় জানত না অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোন দল ট্রফি জিততে পারে। আমি নিজে সেই সময়ের দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্যান হওয়া সত্ত্বেও বলতে আপত্তি নেই, ওই অস্ট্রেলিয়া দলের মত পরিপূর্ণ দল আমি কখনো দেখিনি। বিশ্বজয়ী দল হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন ছিল, সব ছিল সেই অস্ট্রেলিয়ার-- এবং সেটাকে এত নৃশংসভাবে প্রয়োগ করেছিল জন বুকানানের দল, যে "চ্যাম্পিয়ন" শব্দটার সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন তারা। টানা তিনটি বিশ্বকাপ, টানা ষোলটি টেস্ট, টানা একুশটি ওডিআই, টানা তেইশটি বিশ্বকাপ ম্যাচ জয়-- এর যে কোন একটি পেলে বর্তে যাবে পৃথিবীর যে কোন দল-- এর সবকটা ছিল পন্টিংদের।
এই সর্বগ্রাসী অস্ট্রেলিয়া দলের একটি অর্জনে ভাগ বসিয়েছে আরেকটি অস্ট্রেলিয়া-- মেগ ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া ২০০৩ এর জানুয়ারি থেকে ২০০৫ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অজেয় ছিল ৫০-ওভার ফরম্যাটে-- ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া ছুঁয়েছে সে রেকর্ড। ২০১৭র অ্যাশেজে শেষবার কোন ওয়ানডে হেরেছিলেন ল্যানিংরা-- তার পর থেকে একুশটা ওয়ানডেতে অপরাজিত তারা। টানা সাতটি ওডিআই সিরিজের প্রত্যেকটাতে তারা ৩-০ তে জিতেছেন-- তিন সাতে একুশের সহজ অঙ্ক শেষ হয়েছে নিউজিল্যান্ডকে ৭ অক্টোবর ২৩২ রানে ধরাশায়ী করে।
ক্রিকেটের অলিগলির খবর যারা রাখেন তাদের কেউ কেউ অবশ্য ল্যানিংদের অস্ট্রেলিয়াকে সর্বকালের সেরা বলতে একটু আপত্তি করতে পারেন-- বেলিন্ডা ক্লার্কের দল যে ১৯৯৭ থেকে ২০০০ এর মধ্যে দুবার এই রেকর্ডের কাছাকাছি গিয়েছিলেন (একবার থামতে হয়েছিল ১৭তে, আরেকবার ১৬তে)। কিন্তু এটা ভুলে গেলে খুব বড় গলতি হবে যে ওসময় অস্ট্রেলিয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার মত দল ছিল কেবল তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড তো এখনও সগৌরবে আছেই, ভারত উঠে এসেছে চমৎকার একগুচ্ছ ক্রিকেটার নিয়ে, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা দলগতভাবে বড় কিছু না জিতলেও দারুণ সব ক্রিকেটার উঠে আসছেন সেসব দেশ থেকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ত একটা টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেই নিলো। নিজেদের দিনে প্রতিপক্ষকে ঘোল খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মেয়েরাও। এদের সবার চোখরাঙ্গানিকে থোড়াই কেয়ার করে কেউ টানা সাতটা ওয়ানডে সিরিজ হোয়াটওয়াশ করলে তাদের সর্বকালের সেরা তকমা দিতে অন্তত আমার আপত্তি নেই।
এই অস্ট্রেলিয়া দলের সবাই বিশ্বের যেকোন দলে খেলার যোগ্যতা রাখেন- এই দলের প্রত্যেকটা উইকেটকে আপনার সমান দাম দিতে হবে, প্রত্যেকটা বোলারকে সমান সাবধানে খেলতে হবে। খেলার যেকোন মুহূর্তে পা হড়কালেন ত আপনি গেলেন, ওই ম্যাচ আপনার মুঠো থেকে নিমেষে বেরিয়ে যাবে। তার সাথে যোগ করুন প্রায় বটমলেস পাইপলাইন-- প্রতি সিরিজেই নতুন নতুন ক্রিকেটার দলের সাথে যোগ দিচ্ছেন। ইনজুরিতে পড়া সিনিয়র খেলোয়াড়দের মিস করার সুযোগ দিচ্ছেন না নতুন আসা ক্রিকেটাররা (নিউজিল্যান্ডের সাথের সিরিজে এলিস পেরি ছিলেন না, সে অভাব বুঝতেই দেন নি অ্যানাবেল সাদারল্যান্ড)। এ সব কিছু আপনি পরিসংখ্যান দেখলেই জানতে পারবেন, খেলা দেখতে হবে না। পরিসংখ্যান আপনাকে যেটা জানাবে না সেটা হল এই দলটার বৈচিত্র্য। এই দলে এলিসা হিলি আর অ্যাশ গার্ডনারের মত স্লগার যেমন আছেন, তেমন আছেন মেগ ল্যানিং বা র্যাচেল হেইনসের মত ক্লাসিকাল ব্যাটার। এলিস পেরি বা তায়িলা ভ্লামিনিকের মত গতিনির্ভর পেস বোলারদের সাথে আছেন মেগান শুটের মত লাইন-লেংথ মাস্টার। বাঁহাতি অর্থোডক্স জেস জোনাসেন আর সোফি মলিনিউকে নিয়মিত সঙ্গ দেন অফি গার্ডনার আর লেগি জর্জিয়া ওয়ারহ্যাম। সিনিয়র নিকোল বোল্টন বা বেথ মুনি ছায়া দেন তরুণ তালিয়া ম্যাকগ্রাদের, পেরি একদিকে নোঙ্গর ফেলে রাখলে আরেকদিকে হিলি টর্নেডো তোলেন, নিকোলা ক্যারির মত সর্বকর্মা অলরাউন্ডাররা স্পেশালিষ্টদের কাজ সহজ করে দেন নিয়মিতই। এত এত বৈচিত্র্য যে দলে, সে দলকে হারাতে হলে স্পেশাল কিছু না করে উপায় নেই-- আর স্পেশাল ত রোজদিন আসে না!
পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে থামতে হয়েছিল ২১ জয়ের পর; ল্যানিংরা ২১ জয়ের পরও এখনও উড়েই চলেছেন। কোথায় গিয়ে থামবেন সেটা সময়ই বলে দেবে। এক-দুটো ম্যাচ হেরেও যদি যান, বাকি সবার ওপর এই ছড়ি ঘোরানো যে নিকট ভবিষ্যতে থামছে না, এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।