• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    ওরা এগারো জন

    ওরা এগারো জন    

    প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সোয়েলেম আফনান-এর লেখা 'ওরা এগারো জন'।

     

    'ওরা এগারো জন'-চাষী নজরুল ইসলামের কালজয়ী চলচ্চিত্র, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রিয় মাতৃভূমির সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এগারো জন বীরের অসীম বীরত্বগাথা। তবে এখানে যে এগারো জনের উল্লেখ থাকবে, তাদের বীরত্বকে চাইলে আপনি চাষী নজরুলের এগারো জনের সাথে একই পাল্লায় মাপতে পারেন। প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগে তাঁদের মত হাজারো এগারো জন লাল সবুজের যে ঝান্ডা উঁচু করে তুলে ধরেছিলেন অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে, এই এগারো জন সেই ঝান্ডার মর্যাদাই বাড়িয়েছেন কিংবা এখনো বাড়িয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত-তবে অস্ত্র হাতে নয়, ব্যাট বলের অনবদ্য লড়াইয়ে। হ্যাঁ, ক্রিকেটের কথাই বলা হচ্ছে এখানে। ২০০০ সালে প্রাপ্তবয়স্কতার সনদ পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের দীর্ঘ পথচলায় ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন ক্ষেত্রেই কালজয়ী অবদান রাখা কিংবা এখনো রেখে চলা খেলোয়াড়দের নিয়ে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই স্বপ্নের একাদশ।

     

    ১/ তামিম ইকবাল- টেস্টে চারটি শতকসহ ৩৬.৫৯ গড়ে প্রায় চার হাজার রান আর ওয়ানডেতে চার শতকসহ ৩০ গড়ে প্রায় পৌনে পাঁচ হাজার রানের মালিক এই মারকুটে ওপেনারের বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশে স্থান পাওয়া নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। প্রায় অর্ধযুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য হিসাবে গড়ে তুলেছেন তামিম। যে ওপেনিং জুটি নিয়ে দীর্ঘদিন ভুগেছে বাংলাদেশ, সেখানেও এনেছেন স্থিতি। ক্যারিয়ারের শেষে নিজেকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন সেটা এখনো ভাগ্যবিধাতার হাতে থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ তাকে বহুদিন মনে রাখবে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে তার উদ্ধত অর্ধশতক কিংবা লর্ডসে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে টেস্ট শতকের পর অনার্স বোর্ডে নাম লেখানোর জন্য তার উদযাপনকে।

     

    ২/ ইমরুল কায়েস- একটি সফল ওপেনিং জুটির জন্য বাংলাদেশ জাতীয় দলে হাহাকার নতুন কিছু নয়, যে হাহাকার করা হয়েছে এই একাদশ নির্বাচন করতে গিয়েও। তবে এত অপ্রাপ্তির মধ্যেও বাংলাদেশ দলকে ওপেনিং জুটিতে সবচেয়ে ভাল সার্ভিস দিয়েছে তামিম-ইমরুল জুটিই। এই জুটির ওয়ানডেতে গড়ে ২৭ রান উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে, বিদেশের মাটিতে এই গড় ৫৩! অন্য কোন ওপেনিং জুটি এর ধারে কাছে নেই। সম্প্রতি তামিমের সাথে এনামুল ও শামসুর জুটি বাঁধলেও সফল জুটি হিসাবে তাদের এখনো অনেক পথ পেরোনো বাকি। ফলে সন্তোষজনক ব্যক্তিগত রেকর্ড না থাকা সত্ত্বেও তামিমের যোগ্য সঙ্গী হিসাবেই একাদশে স্থান পেয়েছেন রাজশাহীর এই বাঁহাতি।

     

    ৩/ মোহাম্মদ আশরাফুল- পাঠক ব্যাপারটাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুর্ভাগ্যও বলতে পারেন, প্রাপ্তিও বলতে পারেন, তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আশরাফুল একজনই। আশরাফুলের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন নিয়ে হয়ত একটি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলা যাবে, তবে শত আলোচনা সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় নাম থাকবে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান অসামান্য প্রতিভাধর এই ব্যাটসম্যানের। পরিসংখ্যান উল্লেখের প্রয়োজন নেই, নিজের নামের জোরেই বাংলাদেশের স্বপ্নের একাদশে স্থান পেয়েছেন এই ডানহাতি।

     

    ৪/ হাবিবুল বাশার- তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই সময়টার প্রতিনিধিত্ব করেন যে সময়টায় বাংলাদেশ দলকে হারতে হয়েছিল টানা ৬৪টি ওয়ানডে, যে সময়টায় টেস্ট ম্যাচকে তিনদিনের বেশি টেনে নিয়ে যাওয়াকে ধরা হত উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ওই দুর্দশার সময়টাতেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ভরসার স্থানটি ছিল এই ব্যাটসম্যানের উইলোবাজি। স্টাইলিশ এই ব্যাটসম্যানের ঝুলিতে রয়েছে তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরিসহ ২৪টি হাফ সেঞ্চুরি, ১৪টি ওয়ানডে হাফ সেঞ্চুরি, তাঁর ডাকনামই ছিল মিস্টার ফিফটি, বহুবার আউট হয়েছেন সত্তরের ঘরে। তাঁর অবদানের মর্যাদা রাখতেই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশের ব্যাটিং লাইন আপের চতুর্থ স্থানটি দেয়া হল তাকে।

     

    ৫/ মুশফিকুর রহিম- বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক, দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ। উইকেটকিপার হিসাবে ফর্মটা ওঠানামা করলেও মিডল অর্ডারে তাঁর ব্যাটিংয়ের বিকল্প এই মূহুর্তে বাংলাদেশের হাতে নেই। নেতৃত্বদানের অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই “লিটল মাস্টার” দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার হিসেবেও পরিচিত, সেই সাথে নেটে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যাটও করেন এই ডানহাতি। এসব যোগ্যতার বলেই সাকিব আল হাসানের পর দলের অধিনায়কত্বের ব্যাটন এসেছে তাঁর হাতে। আরো সুখের কথা, অধিনায়কত্ব লাভের পর নিজের ব্যাটিং পারফরম্যান্স আর দলের সাফল্য-দু’টো গ্রাফই উর্ধ্বমুখী।

     

    ৬/ সাকিব আল হাসান- এই মূহুর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মানদন্ড নির্ণায়ক কোন খেলোয়াড় থাকলে সেটা নিঃসন্দেহে সাকিব আল হাসান। আপামর জনতার হৃদয়জোয়ারি ভালবাসায় সাকিব খেতাব পেয়েছেন “বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ”। আর সেই নামের মর্যাদা রাখতেই কিনা টেস্ট, ওয়ানডে, টিটোয়েন্টি-তিন ফরম্যাটেই নিজেকে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আর সেই স্বীকৃতির পুরষ্কার হিসেবে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে ইতিমধ্যে খেলে ফেলেছেন আইপিএল, ইংলিশ কাউন্টি, সিপিএল, এসএলপিএল, বিগ ব্যাশের মত বিশ্বের সমস্ত শীর্ষস্থানীয় ঘরোয়া লিগে। বোলিং-ব্যাটিং দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য এই বাঁহাতি নিজেকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের শীর্ষতম উচ্চতায়, এখন তাঁর সামনে বাকি শুধু সেই পাল্লাটাকে আরো উঁচুতে নেয়া।

     

    ৭/ নাসির হোসেন- ক্রিকেট সমালোচকদের বহুদিনের অভিযোগ বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের নাকি টেম্পারামেন্টের অভাব। তবে নাসির হোসেনের ব্যাটিং দেখে থাকলে সেই সমালোচকেরা নিশ্চয়ই তাঁদের দাবি বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। চাপের মুখে বরাবরই চওড়া তাঁর উইলো, সেই সাথে নাজুক অবস্থা থেকে ম্যাচ টেনে বের করে আনার অসাধারণ ক্ষমতা দেখিয়েছেন নাসির, পেয়ে গেছেন “মি. কনসিসটেন্ট” খেতাব। আর তাঁর এই খেতাবকে শক্ত সমর্থন দিচ্ছে টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই চল্লিশোর্ধ গড়। পয়েন্টে অতিমানবীয় ফিল্ডিং আর বল হাতে প্রয়োজনের সময় ব্রেক থ্রু এনে দেয়ায় পারদর্শী ইস্পাতদৃঢ়  স্নায়ুর অধিকারী এই ডানহাতি সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ওয়ানডে একাদশে স্থান করে নিয়েছেন ।

     

    ৮/ মাশরাফি মর্তুজা- বাংলাদেশ ক্রিকেটে গতির ঝড় তোলা প্রথম পেসার। বাংলাদেশ দলের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে দোর্দন্ড প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অঙ্গনের নবজাতক বাংলাদেশের করুণ পরিণতি নিয়ে যখন ক্রিকেট বিশ্ব শঙ্কিত, তখন বাংলাদেশ দলের হয়ে বল হাতে গতির ঝড় তুলে বিশ্ব মিডিয়ার নজর কাড়েন মাশরাফি। দুই টেস্টেই ইনিংসে হারলেও মাশরাফির উজ্জীবিত পারফরম্যান্স দেখে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া তাঁকে আখ্যায়িত করে “নড়াইল এক্সপ্রেস” হিসেবে। সদ্যই ত্রিশের কোঠায় পা রাখা এই ডানহাতি মিডিয়াম পেসার পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই যুঝেছেন ইনজুরির সাথে। ইনজুরির কাছে বলি দিয়েছেন অধিনায়কত্ব। তবে বল হাতে বাংলাদেশের প্রথম স্পেলটা সামাল দিতে এখনো যে কোন অধিনায়ক নির্দ্বিধায় ভরসা রাখেন মাশরাফির উপর। বাংলাদেশের স্বপ্নের একাদশের অষ্টম স্থানটি তাই মাশরাফির।

     

    ৯/ মোহাম্মদ রফিক- টেস্ট এবং ওয়ানডেতে ১০০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়া প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিক। ওয়ানডেতে ১২৫ উইকেটের মালিক এই অফস্পিনার ক্যারিয়ারে ওভারপ্রতি খরচ করেছেন ৪ রান, উইকেট নিয়েছেন প্রতি ৫০ বলে। বয়স বাধা হয়ে না দাঁড়ালে তাঁর ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান আরো সমৃদ্ধ হত বলেই বিশ্বাস বোদ্ধাদের। একাদশে তাই স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসাবে স্থান করে নিয়েছেন বাঁহাতি মোহাম্মদ রফিক।

     

    ১০/ আব্দুর রাজ্জাক- বরাবরই স্পিননির্ভর বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপের অন্যতম ভরসা আব্দুর রাজ্জাক। টেস্ট দলে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করতে না পারলেও ওয়ানডে দলের অপরিহার্য সদস্য এই বাঁহাতি অর্থোডক্স অফস্পিনার। ওয়ানডেতে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে পেয়েছেন দুই শতাধিক উইকেট, এর মধ্যে ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন চারবার, চার উইকেট পাঁচবার। এই একাদশের আরেক স্পেশালিস্ট স্পিনার তাই আব্দুর রাজ্জাক।

     

    ১১/ রুবেল হোসেন- গ্রামীনফোন পেসার হান্ট প্রোগ্রামের আবিষ্কার এই পেসারের বোলিং পরিসংখ্যান বলার মত কিছু নয়। তবে নতুন বলে ক্রমাগত ১৪০ কিমি/ঘন্টায় বল করে যাওয়া এবং পুরনো বলে রিভার্স সুইং করানোর ক্ষমতা ব্রেক থ্রু এনে দিতে বিশেষ কার্যকরী। তাই স্বপ্নের একাদশের দ্বিতীয় স্পেশালিস্ট পেসার হিসাবে জায়গা পেয়েছেন রুবেল।