বাবা অপরাজিত ও আইপিএলে অভাগাদের গল্প
২০১৬ সাল। নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন এখন আর বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট নেই। তামিল নাডু ক্রিকেট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট তিনি। ফিক্সিং কেলেঙ্কারীতে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে শ্রীনিবাসনের মালিকানাধীন চেন্নাই সুপার কিংস। আইপিএলের আদলে তাই তামিলনাডু প্রিমিয়ার লীগ শুরু করলেন শ্রীনিবাসন। চেন্নাইবাসীর 'থালা ধোনি' এসে সে টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করলেন।
সে লীগেরই এক ম্যাচে ১৬৬ রান তাড়া করতে ব্যাটিংয়ে নামল বাবা অপরাজিতের দল ভিবি কানছি ওয়ারিয়র্স। ৬৩ বলে ১১৮ রান করে অপরাজিত থেকেই মাঠ ছাড়লেন অপরাজিত। কিংবদন্তী প্রয়াত ডিন জোন্স রীতিমতো উচ্ছসিত, "ভারতীয় নির্বাচকেরা, আইপিএল স্কাউটেরা, এই ছেলেটার দিকে নজর দাও। সে তোমাদের পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত। এবিডি ভিলিয়ার্স এমন ইনিংস দেখলে খুশি হতেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমার দেখা সেরা ইনিংসগুলির মধ্যে একটি।"
ডিন জোন্স প্রয়াত হয়েছেন কদিন আগে। বাবা অপরাজিত রয়ে গেছেন। আইপিএল রয়ে গেছে। যেখানের সাইড বেঞ্চে এখনও অপরাজিত রয়ে গেছেন বাবা অপরাজিত।
****
৮ জুলাই, ১৯৯৪। ডাক্তার আরএন বাবার ঘরে এলেন যমজ দুই ভাই বাবা অপরাজিত ও বাবা ইন্দ্রজিত। ৪ বছরে দুজনে শুরু করেন ক্রিকেট খেলা।
তামিল নাডুর বয়সভিত্তিক দলে একইসাথে খেলতে থাকেন দুই ভাই। মাত্র ৯ বছর বয়সে রাজ্যের অনুর্ধ্ব-১৩ দলেও সুযোগ পেয়ে যান তারা। দীনেশ কার্তিক, মুরালী বিজয়, আভিনাব মুখুন্দের তামিল নাডু দলে ১৭ বছর বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়ে যায় বাবা অপরাজিতের। কিছুদিন পর অস্ট্রেলিয়া অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের জন্য স্কোয়াড ঘোষণা করা হলে সেখানে ডাক পান শুধুই বাবা অপরাজিত।
প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারলো ভারত। পাপুয়া নিউ গিনি ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের পরের দুই ম্যাচে জিতে এরপর নিশ্চিত করে কোয়ার্টার ফাইনাল। প্রথম তিন ম্যাচে মাত্র ৪৩ রান করে পরের তিন ম্যাচে অপরাজিত করলেন ১২৮ রান। ৬ ম্যাচে ৫ উইকেট ও ১৭১ রান নিয়ে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার দৌড়ে থাকলেও শেষমেশ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক উইলিয়াম বসিস্তো পান সে পুরস্কার।
কোয়ার্টাল ফাইনালে বাবর আজমের ফিফটিতে ভারতকে ১৩৭ রানের লক্ষ্য দেয় পাকিস্তান। ৮ রানে ৩ উইকেট হারানোর পরেও শেষে বাবা অপরাজিতের ৫১ রানের সুবাদে ১ উইকেটের জয় পায় ভারত। বাবর আজমকে ৫০ রানে ফেরানোর পাশাপাশি ৪টি ক্যাচ নেন অপরাজিত। নিউজিল্যান্ডকে ২১০ রানের বড় লক্ষ্য দিতে তিনে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৪ রান করে সেমিফাইনালেও অবদান রাখেন বাবা অপরাজিত। বোলিংয়ে ১০ ওভারে ২৯ রান দিয়ে নেন ১ উইকেট। ৯ রানে জিতে ভারত ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়ার। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ বাবা অপরাজিত ফাইনালে ১০ ওভারে ৩১ রান দিয়ে ১ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি করেন ৩৩ রান। তবে সেঞ্চুরিয়ান উন্মুক্ত চাঁদের জন্য ফাইনালে পাওয়া হয়নি হ্যাটট্রিক ম্যাচসেরার পুরস্কার।
****
মাঠে ১৩ জন খেলোয়াড় ও দুজন আম্পায়ার। মাঠের পাশেই বসা রয়েছেন অপরাজিত। মাঝে মধ্যে ভেতর থেকে ডাক এলেই তবে তিনি ভেতরে যেতে পারেন। নয়তো বাইরে বসেই কাটাতে হয় বেশিরভাগ সময়। পাচঁটি বছর পার হয়ে গেলো, অপরাজিত খেলতে পারলেননা একটি ম্যাচও। অথচ শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মতো!
অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ব্যাটে বলে দুর্দান্ত ছিলেন বাবা অপরাজিত। চেন্নাইয়ের ছেলেকে চেন্নাই সুপার কিংস তাই দলে নিলো ২০১৩ সালে। মাইক হাসি, এমএস ধোনি, যাদের দেখে বড় হয়েছেন, সেই তাদের সাথে ১৮ বছরের অপরাজিত একই ড্রেসিং রুমে। মাঠে না খেললেও সে বছর তাই অপরাজিতের জন্য রোমাঞ্চকর। তবু এদের সাথে খেলা তো অবশ্যই আরও বেশি রোমাঞ্চের!
ভালো হয়েও অনেক সময় ভালোদের ভীড়ে অনেকে হারিয়ে যায়। মুরালী বিজয়, সুব্রামানিয়াম বাদরিনাথ, সুরেশ রায়না, রবিন্দ্র জাদেজাদের ভীড়ে পুরো মৌসুম একাদশে জায়গা হয়নি বাবা অপরাজিতের। ১৮ ম্যাচের ১২টিতেই সে মৌসুমে জয় পেল চেন্নাই। রানার্সআপ চেন্নাইয়ে ফাফ ডু প্লেসিস, বাবা অপরাজিত, বিজয় শঙ্কর সহ ১০ জন খেলতে পারলেন না কোনও ম্যাচ। এদিক দিয়ে দুর্ভাগা হলেও অন্য এক দিক বিবেচনায় তারা ঠিকই ভাগ্যবান- সে বছরের ফিক্সিং কেলেঙ্কারীতেই পরে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয় চেন্নাই সুপার কিংস। প্রথম বছরে অভিজ্ঞতাটুকুই তাই অপরাজিতের প্রাপ্তি। অভিজ্ঞতা যে এক বিশাল সম্বল।
****
টপ অর্ডারে খেলার পাশাপাশি মাঝে মাঝে বল ঘোরান বাবা অপরাজিত। চেন্নাইয়ের টপ অর্ডারের ভালোরা খুব খারাপ করেনি বলে ২০১৪ সালও বেঞ্চে পার করতে হল অপরাজিতকে।
সেবার ১৪ ম্যাচে ৯ জয় নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় হয়ে প্লে-অফ নিশ্চিত করলো চেন্নাই। এলিমিনেটর জিতে এরপর কোয়ালিফায়ারে হেরে বিদায় নিল।আগেরবার বেঞ্চে বসে থাকা বিজয়শংকর সুযোগ পেলেন, কিন্তু পেলেন না অপরাজিত।
পরের বছর দুই অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান ও এন্ড্রু টাইও যোগ দিলেন দলে। আইপিএলের ৮ম সে আসরে ফাইনালে আবার মুম্বাইয়ের কাছে হারল চেন্নাই। ২৫ জনের চেন্নাই স্কোয়াডে ১৪ জন খেললেন কমপক্ষে একটি ম্যাচ। সে ১৪ জনের ভেতরে জায়গা হলো না অপরাজিতের।
নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চেন্নাইয়ে ছিলেন বাবা অপরাজিত। তার বাবা ডাক্তার আরএন বাবা সেসময়ে ছিলেন ভারত জাতীয় দলের মিডিয়া ম্যানেজার। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে ভারত দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেসময়কার ভারতীয় অধিনায়কের মিডিয়ার সাথে তেমন সখ্য ছিল না, মিডিয়াও হয়তো ধোনি্র ওপর ঠিক প্রসন্ন নয়। কিন্ত এর জন্য ধোনি আরএন বাবার প্রশংসাই করেন। ধোনীর মতে, মিডিয়া খুশি হলে তুমি ভালো মিডিয়া ম্যানেজার না।
****
অপরাজিত যে তিন বছর পার করেন চেন্নাইয়ে সে সময় অধিনায়ক ও কোচ ছিলেন মাহেন্দ্র সিং ধোনি এবং স্টিফেন ফ্লেমিং। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ হল চেন্নাই ও রাজস্থান। ২০১৬ সালের আইপিএলে বাবা অপরাজিত আবার পড়লেন ধোনির দলে। রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টসে, এবারও কোচ স্টিফেন ফ্লেমিং।
দল পাল্টালেও ভাগ্য পাল্টালো না অপরাজিতের। ধোনির দলে অপরাজিতের জায়গা হলো না সে আসরেও। রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টস পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থেকে শেষ করলো লীগ। পরের বছর রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টস হয়ে যায় রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্ট। নাম বদলের সঙ্গে বদলি এলো অধিনায়কত্বে, দলপতি হলেন স্টিভেন স্মিথ। কোচ থাকলেন ফ্লেমিংই। এত বদলে পুনের ভাগ্য বদলালেও বদলায়নি অপরাজিতের ভাগ্য। ২০১৬ সালে পয়েন্ট টেবিলে ৭ম স্থানে লীগ শেষ করা পুনে ২০১৭ সালে হলো রানার্সআপ। ফাইনালে হেরে গেল মুম্বাইয়ের কাছে। তারকায় ভরা পুনেতে অপরাজিত সে বছরও খেলতে পারলেন না কোনও ম্যাচ।
****
২০১৩ সালে মুম্বাইয়ের হয়ে প্রথম শ্রেণীতে অভিষেক হয় সিদ্দেশ লেডের। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ২০১৫ সালে তাকে কিনে নেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। এরপর অভিষেকের আগে বেঞ্চ গরম করেন ৪ বছর। বল দুই দিকেই সুইং করাতে পারেন তিনি। ফার্স্ট ক্লাসে ১০০টির বেশি উইকেট শিকার করে ফেলেছেন। ২০১৩ সালে সান্দিপ ওয়ারিয়েরকে প্রথমে বেঙ্গালুরু কিনে নেয়। কেরেলার এই পেসার কোহলির দলে তিন বছরে একটি ম্যাচও খেলতে পারেননি। তবে শেষ পর্যন্ত খেলার সুযোগ হয়েছে দুজনের। ২০১৯ সালে আইপিএলে মুম্বাইয়ের হয়ে অভিষেক হয় লেডের , আর সান্দীপের কলকাতার হয়ে।
২০০৯ সালে সিএম গৌতমকে কিনে সেই সিজন পরেই তাকে ছেড়ে দেয় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। ২০১১ সালে এ উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানকে আবার কিনে বেঙ্গালুরু। দুই সিজন বসিয়ে রেখে আবার বেঙ্গালুরু ছেড়ে দেয় কর্নাটকের এই ক্রিকেটারকে। তবে অপরাজিতের মতো ভাগ্য খারাপ হয়নি। অবশেষে ২০১৩ সালে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে আইপিএল ক্যারিয়ার শুরু করে ১৩ ম্যাচে ১১৬.৭ স্ট্রাইক রেটে ১৬৯ রান করে সে বছরই ডেয়ারডভিলসেই শেষ হয় তারঁ ক্যারিয়ার। কর্নাটক প্রিমিয়ার লীগে ফিক্সিং করে ২০১৯ সালে এরেষ্ট হয়ে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারই এখন ফিনিশড।
অপরাজিতের মতো বেঞ্চে সময় কাটানো নিয়তি হয়ে গিয়েছিল কুলদীপ যাদবেরও। ভারত জাতীয় দলের নিয়মিত এবং অন্যতম সদস্য তিনি। বাঁহাতি স্পিনার কুলদীপও তিন সিজন কাটিয়েছেন বেঞ্চে। কপাল মন্দ তারও, ভালোদের ভালো করার কারণে ভালো হয়েও পাননি একাদশে জায়গা। ২০১২ সালে কুলদীপ যাদবকে কিনে এক সিজন পরেই তাকে ছেড়ে দেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। পরের সিজনে অবিক্রিত থাকার পর ২০১৪ সালে এই চায়নাম্যানকে দলে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স। সেখানে ব্রাড হগ, সুনীল নারিন, পিয়ুস চাওলাদের মতো স্পিনারদের উপস্থিতির কারণে দুই সিজন বেঞ্চে কাটিয়ে ২০১৬ সালেই অবশেষে অভিষেক হয় তারঁ।
শেল্ডন জ্যাকসনের আইপিএল যাত্রাও অনেকটাই কুলদীপের মতো। ২০১৩ সালে ব্যাঙ্গালুরু তাকে দলে নিয়ে কোন ম্যাচ না খেলিয়েই ছেড়ে দেয়। এরপর ২০১৫ সালে কলকাতা তাকে কিনে এবং দুই সিজন বসিয়ে রাখে। ২০১৭ সালে ৪ ম্যাচে ১২২.৫৮ স্ট্রাইক রেটে ৩৮ রান করার পরে আর কখনও পাননি কোনও দল। কুলদীপের সাথে এ উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানের পার্থক্যের জায়গাটা এখানেই- পারফরম্যান্সে। কুলদীপ প্রথমবার ২০১৬ সালে সুযোগ পেয়েই ৩ ম্যাচে নিয়ে নেন ৬ উইকেট। সেই থেকে এখনও তিনি কলকাতায় আছেন।
সিদ্ধেশ লেড, সান্দীপ ওয়ারিয়ের, কুলদীপ যাদব, সিএম গৌতম, শেল্ডন জ্যাকসন- তিন বা তার বেশি সিজন বেঞ্চে কাটানো এদের সবারই অভিষেক হয়ে গেছে আইপিএলে। ৫ সিজন বেঞ্চে কাটানো বাবা অপরাজিত রয়ে গেছেন অনাভিষিক্ত।
সাইড বেঞ্চে এতদিন ধরে 'নট আউট' থাকা অপরাজিত সাইড বেঞ্চ থেকে 'আউট' হয়ে মাঠে 'ইন' হতে চাইবেন। ভারত দলের সঙ্গে থাকার কারণে ২০১২ সালে ছেলের বিশ্বকাপ ফাইনাল মাঠে গিয়ে দেখা মিস করেছিলেন অপরাজিতের পিতা ডাক্তার আরএন বাবা। আইপিএলে ছেলের খেলা মাঠে গিয়ে দেখার সুযোগ নিশ্চয়ই মিস করতে চাইবেন না বাবা! অপরাজিতের জমজ ভাই বাবা ইন্দ্রজিতও এখন ভাইয়ের ছায়া থেকে চাইছেন বেরিয়ে আসতে। আইপিএলে অবশ্য এখনো খেলার সুযোগ হয়নি তার।
অপরাজিত কি সাইড বেঞ্চ থেকে আউট হয়ে মাঠে ইন করে সে সুযোগটা করে দিতে পারবেন বাবাকে? তার আগেই কি ইন্দ্রাজিত সাইড বেঞ্চে 'ডাক' মেরে তা করে ফেলবেন? আইপিএলের অপেক্ষা কি কখনোই শেষ হবে না অপরাজিতের?