• প্রীতি ম্যাচ
  • " />

     

    বাফুফের 'আত্মঘাতী' সিদ্ধান্ত স্বস্তির বদলে চাপ বাড়াচ্ছে জেমির ডের

    বাফুফের 'আত্মঘাতী' সিদ্ধান্ত স্বস্তির বদলে চাপ বাড়াচ্ছে জেমির ডের    

    ফুটবলের মাঠে ফেরার ম্যাচ শুধু নয়, পরিসরটা আরও বড়। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক খেলা ফেরারও উপলক্ষ্য। মার্চের পর থেকে কার্যত স্থবির হয়ে পড়া মাঠগুলোতেই প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা চলছিল নেপালের বিপক্ষে দুইটি প্রীতি ম্যাচ দিয়ে। ম্যাচের ফলের চেয়ে বরং এই ‘ফেরাটার’ গুরুত্বই ছিল বেশি। বাংলাদেশ কোচ জেমি ডেও বারবার সেই সুরেই কথা বলেছেন। কিন্তু হিসাব-নিকাশ বদলে গেল প্রথম ম্যাচে মাঠে গড়ানোর কিছুদিন আগেই। বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি আগেভাগেই খেলে ফেলছে কাতার। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সম্মতির পর ফিফার কাছ থেকেও অনুমোদল মিলেছে কাতারের। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ কাতারের বিপক্ষে বাছাইপর্বের বাকি একটি অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশের হাতে থাকবে তিনটি ম্যাচ, সবগুলোই ঘরের মাঠে।   

    নভেম্বরে নেপালের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ দুইটি ছিল বাংলাদেশের জন্য বোনাস। দুই দফায় বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ বাছাইয়ের শেষ ৪ ম্যাচ স্থগিত হওয়ার পর চলতি বছর আর কোনো ম্যাচ খেলারই কথা ছিল না বাংলাদেশের। নেপালের বিপক্ষে দুইটি প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করে ‘সাহসী’ এক পদক্ষেপই নিয়েছিল বাফুফে। কিন্তু এরপর কাতারের বিপক্ষে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্তটা এখন ‘দুঃসাহসী’ মনে হতে পারে বহু কারণে। 

    মার্চের পর থেকে ফুটবলাররা ম্যাচ খেলেননি একটিও। নেপালের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য অনুশীলন শুরু হয়েছে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে। নেপালের সঙ্গে দুই ম্যাচ খেলার পর ডিসেম্বর থেকে ঘরোয়া ফুটবলও শুরু হওয়ার কথা। উলটো অবস্থা কাতারে। ঘরোয়া লিগে এরই মধ্যে সব দল অন্তত ৪টি করে ম্যাচ খেলে ফেলেছে। আন্তজার্তিক ফুটবলেও ফিরেছে কাতার। ঘানার বিপক্ষে গেল অক্টোবরেই প্রীতি ম্যাচ খেলেছে তারা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরে ঘানার কাছে ৫-১ ব্যবধানে সেই ম্যাচ হেরেছে এশিয়ার চ্যাম্পিয়নরা। শুররু ধাক্কা সামাল দিয়ে, ঘরোয়া ফুটবলে ফেরার স্বস্তি কাজে লাগিয়ে এবার বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচটা আগেভাগে খেলে ফেললে লাভটা কাতারেরই বেশি।

     


    কাতার কেন নির্ধারিত সময়ের বাইরে গিয়ে আগেই ম্যাচটা আয়োজন করে ফেলল তা স্পষ্ট। আগামী বছর জুনে কোপা আমেরিকায় অংশ নেওয়ার কথা কাতারের। আর করোনা পরস্থিতি আরও খারাপ না বাছাইপর্বের বাকি ম্যাচগুলো সম্পন্ন করতে অন্তত পক্ষে জুন পর্যন্ত সময় লেগে যেত।  নির্ধারিত সময়ের বাইরেই বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ আয়োজন করতে চেয়েছে কাতার। তাদের বাকি ৩ ম্যাচের দুইটি হোম ম্যাচ। একটিতে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ, আরেকটি আফগানিস্তান। আফগানিস্তান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কাতার যোগাযোগ করেছে কি না সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত কাতার আগে ম্যাচ খেলার প্রস্তাবটা দিয়েছিল বাংলাদেশকেই। অন্তত একটি ম্যাচ আগে খেলা হয়ে গেলে কোপা আমেরিকার আগে প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা কম তাদের। বাছাইপর্বের শেষ দুইটি ম্যাচ মার্চের পরবর্তী উইন্ডোতেই সেরে ফেলার কথা কথা কাতারের।  

    কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের তুলনা চলে না। যোজন যোজন এগিয়ে থাকা সেই কাতারকে প্রথম লেগের ম্যাচে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ প্রায় আটকে দিয়েছিল। যদিও ২-০ গোলে হারতে হয়েছিল সেবার জেমি ডের দলকে। সেই প্রেরণা কাতারের বিপক্ষে হয়ত কাজেই দেবে বাংলাদেশের। কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন এতো শক্তিশালী তাদের বিপক্ষে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুবিধাগুলোও আদায় করে নেওয়ার কাজটা করতে পারল কই বাফুফে? বাংলাদেশ কেন কাতারের প্রস্তাবে রাজি হলো সেটাও অস্পষ্ট।

    সবকিছু বিপক্ষে থাকলেও 'সাহসী হয়ে মাঠে নামার' কথা বলছেন ন্যাশনাল টিমস কমিটির চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদ, “খেলাটা অবশ্যই মার্চে ভালো হত। জুনে খেললে হয়ত আরও ভালো হত। যখনই খেলি, খেলতে তো হবেই। এরপর আরও ৩টি ম্যাচ বাকি থাকতে বাছাইপর্বের জন্য। এখন খেলি আর ৩ মাস পর খেলি, খেলতে তো হবেই। কেবল মাত্র ফলাফলের কথা চিন্তা করে বসে থাকলে হবে না। আরেকটু সাহস করে মাঠে নেমে পড়তে হবে।” 

    এই সাহসটুকু এখনই দেখানোর কতোখানি প্রয়োজন ছিল সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একে তো ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রতিপক্ষ ১৩০ ধাপ এগিয়ে থাকা কাতার, তার ওপর গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী দলও তারা- এমন ম্যাচ বাংলাদেশ খেলতে যাচ্ছে কার্যন অন্ধকারে থেকে। আট মাস বিরতির পর ফুটবলাররা কেমন করবেন তা কেউ জানেন না, অনুমান করারও উপায় নেই। ফিটনেসের ঘাটতিই একমাত্র মাথাব্যথা নয়। প্রস্তুতির ঘাটতি স্পষ্টই। কাতারের মতো দলের বিপক্ষে ২০ দিনের নোটিশে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত তো সবকিছুই এলোমেলো করে দেওয়ার কথা। নেপালের বিপক্ষে যে ম্যাচ দুইটিতে চাপমুক্ত থেকে ফুটবলে ফেরার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার কথা ছিল, সেগুলোই এখন হয়ে যাচ্ছে বড় পরীক্ষার প্রস্তুতির অংশ।

    এএফসি এখনও বাছাইপর্বের বাকি ম্যাচগুলোর জন্য ফিক্সচার ঘোষণা করেনি। কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সুযোগ বুঝে নিজেদের ভালোটাই আদায় করে নিয়েছে 'অসময়ে' ম্যাচ আয়োজন করতে চেয়ে। তাতে বাংলাদেশ একরকম ‘বলির পাঠা’। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ মত দিয়ে রেখেছে আগেভাগেই ম্যাচ খেলে ফেলার পক্ষে।  

    কাতারের বিপক্ষে সম্ভাব্য ম্যাচ নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে কোচ জেমি ডেকেও। বাংলাদেশ অক্টোবরে অনুশীলন শুরু করলেও দেশে ফিরে কাজে যোগ দিতে নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে কোচকে। এর আগে খেলোয়াড়রা ফিটনেস পরীক্ষা দিয়েছেন। ম্যাচের এক সপ্তাহ আগেও ফিটনেস শঙ্কা কাটেনি বাংলাদেশের। খেলোয়াড় থেকে কোচ- সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন সেটা। আট মাস বিরতির পর খেলোয়াড়দের ফিটনেস ঘাটতি অবাক করা কোনো ঘটনাও অবশ্য নয়। 

    এর মাঝে বাংলাদেশের ৩৬ জনের স্কোয়াড কাটছাট হয়েছে। মাসুক মিয়া জনি, মতিন মিয়াকে বসুন্ধরা কিংস জাতীয় দলের অনুশীলনে যোগ দিতে দেয়নি। মামুনুল ইসলাম, তারিক কাজী এর মাঝে চোটের কারণে ছিটকে গেছেন। ডিফেন্ডার টুটুল হোসেন বাদশাও অসুস্থ্যতার কারণে অনুশীলন করছেন না। কাতার ম্যাচেও এই খেলোয়াড়দের দলে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই জেমির। 

    নেপাল ম্যাচের জন্য জেমি ডের ঘোষণা করা স্কোয়াডে নতুন মুখ ছিল অনেক। নতুনদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ভালো সুযোগও ছিল। কিন্তু সম্ভাব্য কাতার ম্যাচ সামনে রেখে এখন পরিকল্পনা বদলাতে হচ্ছে তাকেও, “এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য কঠিন। কাতারের সঙ্গে ম্যাচটা সামনে থাকলে নেপালের বিপক্ষে আমাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেরা ১৬ জন খেলোয়াড়কেই খেলাতে হবে। যদিও আমার ইচ্ছা ছিল নেপালের বিপক্ষে স্কোয়াডের সবাইকে সুযোগ করে দেওয়া।” - প্যাভিলিয়নকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কোচ। 

    যদিও কোচ আশা করছেন ৬ সপ্তাহ সময়ে দলের ফিটনেস পুনরুদ্ধার করতে পারবেন তিনি। কাজী নাবিলও আশ্বাস দিচ্ছেন, কাতার গিয়ে দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকবে বাংলাদেশের। কিন্তু আট মাস বিরতির পর দুইটি প্রীতি ম্যাচ আর দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচ কি আসলেই প্রস্তুত করতে পারবে বাংলাদেশকে? তাও আবার কাতারের মতো দলের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য? জেমি ডেও সেখানে নিরুপায়, ফেডারেশন চাইলে দল প্রস্তুত করবেন তিনি, “ফেডারেশন যদি কাতারের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে সম্মতি দেয় তাহলে ৬ সপ্তাহের ভেতর আমি দল প্রস্তুত করে ফেলব। খেলোয়াড়রা লিগে খেলার পর ম্যাচটা খেলার সুযোগ পেলে অবশ্যই আরও বেশি ফিট থাকত, আগের চেয়েও শক্তিশালী হত, কিন্তু এই সময়ে আমাদের সেরাটাই দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। জনি প্রায় দুই বছর আগে সবশেষ খেলেছে, তারিকেরও অভিষেক হয়নি। তবে মতিনকে পেলে অবশ্যই ভালো হত।”  

    ফুটবলে ফিরে তাই বাংলাদেশ কোচের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার উপক্রম নেই। নেপালের সঙ্গে এই দুই ম্যাচ তার জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। এতোদিন দুইটি প্রীতি ম্যাচের জন্য পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন। হুট করে এখন সব আকর্ষণ কেড়ে নেবে আগামী মাসে কাতারের বিপক্ষে ম্যাচটি। স্বস্তির বদলে কেবল চাপটাই বাড়ল তাতে বাংলাদেশের দলের ওপর।