২০২০ ফুটবল: করোনাভাইরাস ও ম্যারাডোনাকে হারানোর বছর
২০২০ সাল ফুটবলকে কী দিল সেটার হিসেব খুব একটা কঠিন নয়। তবে ২০২০ ফুটবল থেকে কে নিয়ে গেল সেটার হিসেব করা সম্ভব নয়। এক ডিয়েগো ম্যারাডোনার শুন্যতাই তো পূরণ হবে না কখনো। আর করোনা ভাইরাসের থাবা বিশ্বের আর সবকিছুর মতো এই বছর ফুটবলকেও করে দিয়েছে এলোমেলো। তবে জীবন থেমে থাকে না, থেমে থাকেনি ফুটবলও। মাঠে তাই খেলা গড়িয়েছে, অদ্ভুত এক দর্শকহীনতার মধ্যে কেটেছে গোটা বছর।
বছরের শুরুতে অবশ্য কেউ ভাবেনি এমন কিছু হবে। ঠিকঠাক মতোই চলছিল সবকিছু। ব্যস্ত ক্লাব ফুটবলের মধ্যে চলছিল ইউরো আর কোপার প্রস্তুতি। তবে মার্চে করোনা ভাইরাস মহামারী হওয়ার পরেই বদলে যায় সবকিছু। প্রায় একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল, মেসি-রোনালদোরা সবাই হয়ে পড়েন গৃহ-অন্তরীণ। এত বছরের ক্যারিয়ারে যা হয়নি এই বছর সেই অভিজ্ঞতাই হয়েছে তাদের। অনিশ্চিত একটা সময়ের মুখোমুখি হয়েছে ফুটবল, আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ক্লাবগুলো। দলবদলের বাজারও তাই এবার ছিল নিস্তেজ, আক্রার বাজারে খুব সাড়া জাগানো কোনো দলবদল হয়নি। মে তে বুন্দেসলিগা দিয়ে ফিরতে শুরু করেছে ইউরোপিয়ান ফুটবল, তবে স্পেন-ইংল্যান্ড-ইতালিতে মাঠ গড়াতে গড়াতে হয়ে গেছে জুন।
এরপর আর দম ফেলার ফুরসত ছিল না। ঘরোয়া লিগ-চ্যাম্পিয়নস লিগের সব চাপ এসে পড়েছে এক সঙ্গে। ইংল্যান্ডে লিভারপুলের হাতে শিরোপাটা এক রকম উঠেই ছিল, করোনা ভাইরাস শুধু পিছিয়ে দিয়েছিল অপেক্ষাটা। সেটা সাঙ্গ হয়েছে দীর্ঘ ৩০ বছর পর, ইয়ুর্গেন ক্লপের দল বাকিদের চেয়ে যোজন এগিয়ে থেকে করেছে ট্রফিজয়ের উল্লাস।
স্পেনে অবস্থা তেমন ছিল না। করোনার আগে বার্সা একটু হলেও এগিয়ে ছিল, কিন্তু আবার খেলা শুরুর পর খেই হারিয়ে ফেলেছে। পেছন থেকে এসে জিনেদিন জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ টপকে গেছে তাদের। আরেকবার জিদানের কোচিং ক্যারিশমা দেখা গেছে, প্রশ্ন উঠেছে কোচ জিদান বড় না খেলোয়াড় জিদান? বার্সার জন্য বছরটা গেছে ভুলে যাওয়ার মতো। ঘরোয়া লিগে যেমন-তেমন, চ্যাম্পিয়নস লিগে এই বছরটা কখনোই মনে রাখতে চাইবে না বার্সা। বায়ার্নের কাছে আট গোল হজমের পর সরে গেছেন কোচ কিকে সেতিয়েন। তবে বছরের সবচেয়ে বড় নাটকটা ফুটবলে হয়েছে মাঠের বাইরেই। লিওনেল মেসি মৌসুমের শেষে এসে হুট করেই জানিয়েছেন, ক্লাব ছাড়ছেন তিনি। সেই ব্যুরোফ্যাক্স নিয়ে এরপর শুরু হলো আরেকটা সোপ অপেরা। অনেক রটনার পর শেষ পর্যন্ত মেসি আবেগাপ্লুত একটা সাক্ষাৎকারে জানালেন, বার্সাতেই থেকে যাচ্ছেন তিনি।
চ্যাম্পিয়নস লিগও এবার বদলে গেছে অনেকখানি। করোনা ভাইরাস দুই লেগের লড়াইটা নামিয়ে এনেছে নকআউটে, সেখানে চমক দেখিয়েছে আটালান্টা-লিও-লাইপজিগের মতো আন্ডারডগরা। ফাইনালটা অবশ্য হয়েছে দুই ফেবারিট বায়ার্ন আর পিএসজির মধ্যে, তাতে শেষ হাসি হান্সি ফ্লিকের বায়ার্নের।
সর্বজয়ী বায়ার্নের এমন একটা বছরে ব্যালন ডি অরের যোগ্য দাবিদার ছিলেন রবার্ট লেভানডফস্কি। কিন্তু কপালটা খারাপ তার, করোনার জন্য এই বছরের ব্যালন ডি অরই গেছে বাতিল হয়ে। অবশ্য সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে ফিফা দ্য বেস্ট আর ইউয়েফা বর্ষসেরা পুরস্কার জিতেছেন, তবে ব্যালন ডি অরের আক্ষেপ হয়তো পুরোপুরি ঘোঁচেনি।
দেশের ফুটবলের জগতটাও কেটেছে অনেকটা নিরুত্তাপ। বছরের শুরুতে বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপের পর করোনা ভাইরাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ঘরোয়া ফুটবল। অবশেষে সেই অক্টোবরে এসে নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল শুরু হয়েছে, পরে কাতারের বিপক্ষে খেলেছে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ। ফেডারেশন কাপ দিয়ে বছরের শেষে ঘরোয়া ফুটবলের শুরুটাও স্বস্তি হয়ে এসেছে এই বছর।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে মহারথীদের প্রয়াণই এই বছরকে নাড়া দিয়ে গেছে। করোনা ভাইরাসের সময় চলে গেছেন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি লরেঞ্জো সাঞ্জ, ইংল্যান্ডের নরম্যান হান্টার। আরেক ইংলিশ কিংবদন্তি নবি স্টাইলসও চলে গেছেন এরপর। একের পর এক শোকের ধাক্কাটা এসেছে নভেম্বরে। কদিনের ব্যবধানে চলে গেছেন আর্জেন্টিনার ২০১৪ বিশ্বকাপের কচ আলেহান্দ্রো সাবেয়া, ২০০২ বিশ্বকাপের সেনেগালের অন্যতম নায়ক পাপা বুবে দিওপ। হুট করেই পৃথিবীকে বিদায় বলেছেন ৮২ বিশ্বকাপের ইতালির সোনালী ছেলে পাওলো রসি, গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট জেতার বিরল তিন কীর্তিমানের একজন। বছর শেষে চলে গেছেন লিভারপুলের সাবেক ম্যানেজার জেরার্ড হুলিয়েরও। তবে শেষ পর্যন্ত ২০২০ মানে ম্যারাডোনাকে হারানোর বছর। ৬০ বছর বয়সে তার অকালপ্রয়াণ কাঁদিয়ে গেছে ফুটবলের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের আরও অগুণিত মানুষকে। আর কারও বিদায়ে কেঁদে এভাবে আকুল হয়নি বুয়েনস এইরেস থেকে ঢাকা, রোজারিও থেকে নেপলস।
২০২০ সাল তাই চলে যাচ্ছে ফুটবলের জন্য অপূরণীয় শুন্যতা রেখেই।