• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    অদ্ভুত বছর এক ২০২০, কতটুকু শান্তি দিল ক্রিকেট?

    অদ্ভুত বছর এক ২০২০, কতটুকু শান্তি দিল ক্রিকেট?    


    এমিনেম তার নতুন গান বের করেছেন। 

    ৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড, এক হাজারের বেশি শব্দ। এবং তার গান অবশ্যই কোভিড-১৯ নিয়ে। ২০২০ সালটা এমনই। যদি মনুষ্য জাতি এই কোভিড-১৯ পার করে যায়, তাহলে অদ্ভুত, বীভৎস, মানুষ-কতো-অসহায়, মহামারি-- এসব পেরিয়ে দেখবেন, এ সালটা আদতে ঐতিহাসিক। এমিনেমের মতো কেউ এটিকে নিয়ে গান করবেন, এরই মাঝে কেউ করে না থাকলে এ বছর নিয়ে সিনেমা হবে, ওয়েব সিরিজ আসবে, ডকুমেন্টারি আসবে। সেসবের ‘বিনোদন-মূল্য’ থাকবে, আপনার সময়ের একটা অংশ কাটবে সেসব নিয়ে। সেই আপনি ২০২০ দেখে থাকলে হয়তো স্মৃতিচারণ করবেন। 

    এবং তার আগে, এই ২০২০ পেরুনো সময়ে বা পেরিয়ে গিয়ে হয়তো ভাববেন, ক্রিকেট এই অদ্ভুত-ঐতিহাসিক সময়ে আপনাকে কতোটা স্বস্তি বা শান্তি দিল।

    **** 

    আকবর আলির হাই (বেশি হাই) ব্যাকলিফট তার ব্যাটিংয়ের একটা ভিজিটিং কার্ড হতে পারে। মার্চের সেই দুপুরগড়ানো সময়ে আকবর যখন গাজী গ্রুপ ক্রিকেটারসের হয়ে নামলেন প্রিমিয়ার লিগে, তখনও তার সেই ব্যাকলিফটে যেন বিশ্বকাপের গন্ধ লেগে আছে। 

    প্রায় মাসখানেকের চেষ্টায় তার একটা প্রোফাইল দাঁড় করানোর শেষ ধাপ বলা যায় সেই ম্যাচটা, প্রায় বছরখানেক পর লিস্ট ‘এ’ খেলতে নামা আকবরের ‘জুনিয়র’ থেকে ‘সিনিয়র’ ক্রিকেটের এই রূপান্তরটার একটা ‘টাচ’ রাখা যায় যদি। সে ম্যাচে উইকেটকিপিং করা আকবর শেষ পর্যন্ত গাজী গ্রুপকে জেতাতে পারেননি, যদিও মাহাদি (অথবা মেহেদি বা মাহেদি) হাসানের সঙ্গে তার জুটিটা আশা জোগালেও রান-আউট হয়ে ফিরেছেন তিনি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেটি ছিল প্রথম রাউন্ড। 

    ম্যাচশেষে প্রেসবক্স ছেড়ে মাঠে যাওয়া-- ঘরোয়া লিগে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন সাধারণত সেখানেই হয়। তবে সেই সংবাদ-সম্মেলন ছাপিয়ে তখন প্রিমিয়ার লিগ স্থগিত হওয়ার আভাস, পরে যেটি নিশ্চিত হলো মূলত ক্রিকেটারদের কথাতেই। 

    আকবর তার আরেকটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচের অপেক্ষায় আছেন এখনও, প্রিমিয়ার লিগও শুরু হওয়ার অনিশ্চিত অপেক্ষায়। ঘরোয়া লিগের ম্যাচশেষে প্রেসবক্স ছেড়ে মাঠে প্রবেশের সেই অলিখিত নিয়মটা বদলে গেছে। বদলে গেছে অনেক কিছুই। 

    ****

    কোভিড-১৯। এরপর স্থগিত। স্থগিত। স্থগিত। এই স্থগিত ব্যাপারটা একসময় যেন চলে গেল হিসাবের বাইরে। জীবনটাই যখন থমকে গেল, খেলার হিসাব রেখে আর কী হবে! 

    ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল আসতে যখন সময় লাগছিল, টুইটারে একটা কৌতুক ঘুরছিল-- এখন তারা বুঝবেন, টেস্ট ক্রিকেটটা কী। যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রেসিডেন্ট পেল, ক্রিকেট বুঝল কিনা কে জানে। তবে তাদের জীবনে ক্রিকেটের এই সুদূরতম ‘প্রভাব’টা বোধহয় সেই টুইট পর্যন্তই (সেখানে মেজর লিগ ক্রিকেট শুরু হচ্ছে, অনেকের আশা, এতে ক্রিকেট-বিপ্লব ঘটবে সেখানে। তবে এখনও সেটি ঠিক আলোচ্য নয়)। 

    ‘স্পোর্টস’ বা ‘খেলাধুলা’র ব্যাপারটা জীবনের সঙ্গে কীভাবে সংশ্লিষ্ট, বা মানুষ সেটি কেন ভালবাসে, এ ব্যাপারে হয়তো বিস্তর গবেষণা করা যায়। তবে মোটামুটি যে তত্ত্বটা-- খেলাধুলা এমন একটা ডাইমেনশন তৈরি করে, যেখানে জীবনের একটা ‘অল্টারনেট ইউনিভার্স’ তৈরি হয়। ‘ফুটবল জীবনের চেয়ে বড়’, ‘ক্রিকেট জীবনের প্রতিচ্ছবি’-- এ কথাগুলো আসে তখনই। 

    জীবনের এই অস্থির সময়ে তাই আলাদা একটা জীবন প্রয়োজন ছিল ক্রিকেটে। তবে সে অপেক্ষা কাটল না শীঘ্রই।

    **** 

    তামিম ইকবাল মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলেন। দাঁড়াতে হলো তাকে। আম্পায়ার আর রকিবুল হাসানের সঙ্গে ক্রিজের একটু পাশে দাঁড়িয়েই হাসিমুখে পোজ দিলেন ছবির জন্য। তামিম ইতিহাস গড়েছেন, প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। ১৩ বছর পর ট্রিপল সেঞ্চুরির তালিকায় সঙ্গী পেয়েছেন রকিবুল, তারই বন্ধু তামিম ছাড়িয়ে গেছেন তাকেও। 

    তামিম কদিন পর দেশ-বিদেশের বন্ধু-সতীর্থ-সিনিয়রদের নিয়ে আড্ডা শুরু করলেন ভার্চুয়ালি। জুম-গুগল মিট-স্ট্রিমইয়ার্ড নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, লাইভ-শো হচ্ছে ভার্চুয়ালি। তামিম বনে গেলেন ‘হোস্ট’। অস্থির সময়ে একটু খুশি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি।

    মাশরাফি বিন মুর্তজা ওয়ানডে অধিনায়কত্বকে বিদায় বলার পর নতুন অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়েছিল তামিমকে, তবে সে দায়িত্ব এখনও পালন করা হয়নি তার। মার্চের পর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলেনি বাংলাদেশ, কোভিড-১৯ আসার পর আইসিসির পূর্ণ সদস্যের মাঝে আর এমন হয়েছে শুধু আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেই। 

    হবে-কবে-হবে-হচ্ছে-তো?-এর জটিল সমীকরণ পেরিয়ে স্থগিত হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কা সফর, বিসিবি সেটি ভোলার চেষ্টা করেছে প্রেসিডেন্টস কাপ দিয়ে। বিপিএলের বদলে আয়োজন করেছে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ, ঘরোয়া ক্রিকেটে যা একটি নতুন মাত্রা যোগ করা উচিৎ। 

    নতুন বছরের শুরুতেই আসার কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজের। যে সফরে আসছেন না ১০ জন সিনিয়র ক্রিকেটার, তাদের ওয়ানডে স্কোয়াডের অধিনায়ক শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২০১৮ সালে। ওয়ানডে সিরিজে তামিম নামবেন, আরেকজন ‘নতুন’ অধিনায়কের সঙ্গে। তবে এসব বলছে, তামিম মানুষকে বিনোদনের জন্য শো হোস্ট শীঘ্রই না করলেও ২০২০-এর কাঁধে এসে বসা কোভিড-১৯-এর রেশটা কাটছে না শীঘ্রই!

    **** 

    ২০১০-১১ অ্যাশেজ, শেষ টেস্ট, সিডনি। শেষদিন এসসিজিতে অস্ট্রেলিয়ার উইকেটের পর ক্যামেরা যেদিকে যায়, সেই ফ্রেম দেখলে মনে হবে, মাঠভর্তি দর্শক। আদতে তা নয়, মাঠের যতখানি ভর্তি, তার চেয়ে বেশি খালি। তবে ভর্তি যে অংশটুকু, সেখানকার প্রায় সবাই ইংলিশ-- পতাকা, পোশাক-আশাক দেখলেই টের পাওয়া যায় তা। ২৪ বছর পর নিজেদের মাটিতে অ্যাশেজ হারিয়ে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া, তাদের কেউ তাই আসার প্রয়োজন বোধ করেননি ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ জয়ের সাক্ষী হতে। 

    শুধু অস্ট্রেলিয়ায় সেই দিনটা নয়, ইংল্যান্ড যে দেশেই খেলতে যায় না কেন, সংখ্যায় স্বাগতিক দর্শকদের সঙ্গে বেশ একটা পাল্লা দেন তাদের সমর্থকরা (উপমহাদেশে ইংলিশরা জেতে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়তো একটা প্রতিযোগিতা হয়, তবে সেটাও পরিস্থিতি অনুযায়ী)। 

    সেই ইংল্যান্ডে ঘরোয়া গ্রীষ্মের প্রথম টেস্ট। অথচ কেউ নেই গ্যালারিতে। কেমার রোচের রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে করা বলটা ব্লক করলেন ররি বার্নস, বল গেল গালিতে। অন্য সময় হলে বেশ একটা করতালির শব্দ পাওয়া যেত, গ্রীষ্মের প্রথম ডেলিভারি বলে কথা। অথচ এদিন শুধুই বাতাসের শোঁ শোঁ। কোভিড-১৯ কেড়ে নিয়েছে দর্শকদের প্রবেশাধিকার। 

    তবে রোচের বলটা বার্নসের ব্যাটে লেগে যে শব্দ করলো, সেটি অনাকাঙ্খিত দীর্ঘ বিলম্বের পর স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকা যাত্রীর কানে ট্রেনের হুইসেলের শব্দের মতো, যাতে কাটে একটা অস্বস্তিকর দীর্ঘ নিস্তব্ধতা।   


    সেই গ্রীষ্মে জেমস অ্যান্ডারসন হলেন টেস্টে ৬০০ উইকেট নেওয়া প্রথম পেসার, এই বয়সে এসেও যিনি টেকসই, চলনসই, প্রাসঙ্গিক। স্টুয়ার্ট ব্রড আনলেন তাকে ঘিরে উদযাপনের উপলক্ষ্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া—ইংল্যান্ড নিজেদের ঘরোয়া-গ্রীষ্ম পূরণ করলো, হোক না দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে। 

    আইপিএলের সুর বাজলো, ভারত ছেড়ে আরব আমিরাতে অভিবাসন গেঁড়ে। দর্শকের কৃত্রিম-- মাঝে মাঝেই অস্বস্তিকর--আওয়াজ পেরিয়ে, নাটকীয় বেশ কয়েকটি দিন বা রাহুল তেওয়াতিয়ার গল্পের মাতাল হাওয়া বয়ে গেল। মেয়েদের আইপিএলে বাংলাদেশ মাতল সালমা খাতুনে। 

    এর আগেই ইন্সটাগ্রামে বিদায় বললেন এমএস ধোনি, বললেন সুরেশ রায়না। ২০২০-এ বিদায় বললেন এল্টন চিগুম্বুরা, উমর গুল, মোহাম্মদ আমিররাও। এভারটন উইকস থামলেন, রামচাঁদ গোয়ালা গেলেন, ডিন জোনস হুট করেই অনুসরণ করলেন তাকে। এরপর জন এডরিচ, রবিন জ্যাকম্যানরা। 

    বছরের শেষদিকে আদতেই দর্শক ফিরল অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ফাওয়াদ আলম ১১ বছরের লিম্বো থেকে ফিরলেন, বছরের সবার শেষে শেষ হওয়া ম্যাচটা দেখালো, যাই ঘটুক না কেন, আমরা টেস্ট ক্রিকেটকে ভালবাসি। 

    অ্যাডিলেডের ৩৬-পেরিয়ে আজিঙ্কা রাহানের ভারত মেলবোর্নে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত দিল-- হয়তো এভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে মানুষ, আরেকবার বেঁচে থাকার লড়াইটা প্রবল করবে তারা। খেলাধুলা যে জীবনের আরেকটা মাত্রা তৈরি করে-- জীবনের ‘অল্টারনেট ইউনিভার্স’। যেখানে ক্রিকেট জীবনের একটা প্রজেকশন।

    **** 

    গত ডিসেম্বরে খবর এসেছিল, এফটিপির ২০২৩-৩১ সাইকেলে বাধ্যতামূলক চারদিনের কিছু টেস্ট আয়োজনের কথা ভাবছে আইসিসি, ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে ‘বাড়তি’ জায়গা বের করতে। 

    ২০২০ সালে সব মিলিয়ে টেস্ট হয়েছে ২২টি, ১৯৭৬ সালের পর যা সবচেয়ে কম। ওয়ানডে হয়েছে ৪৪টি, ১৯৯১ সালের পর যা সবচেয়ে কম। ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের বছর টেস্ট হয়েছিল ৩৯টি, ওয়ানডে হয়েছিল ১৫০টি। ‘অপ্রতুল’ ম্যাচসংখ্যার কারণে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট পদ্ধতি বদলে ফেলেছে আইসিসি।

    হয়তো পরের সাইকেলে ঠিকই চারদিনের টেস্ট করবে আইসিসি। হবে বাড়তি ম্যাচ। আইপিএলের মতো অন্য কোনও টুর্নামেন্টও পাবে আলাদা ‘উইন্ডো’। 

    তবে এমিনেম যেমন তার গানে বলেন, ‘২০/২০ হচ্ছে সাইড মিররে বুদ্ধির উদয় ঘটতে দেখার মতো’। ২০২০ ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। সাইড মিররে তাকালে কোভিড-১৯, মহামারি, পজিটিভ, নেগেটিভ, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারেরর সঙ্গে ক্রিকেটে দেখা যাবে স্থগিত, বাতিল, বায়ো-সিকিউরড বলয়ে ঘেরা নতুন এক জগত। 

    ২০২০-এর এই অস্থির সময়ে, অদ্ভুত-ঐতিহাসিক-অস্বাভাবিক বছরেও হয়তো অজস্র ক্লান্ত প্রাণে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল ক্রিকেট, জীবনের প্রতিটা ‘স্বাভাবিক’ বছর বা সময়েও যেমন করে।