তারা আটজন: এক ম্যাচে যাদের হ্যাটট্রিক আছে দুইবার
১.
১৭ বছর পার হয়ে গেল, পাকিস্তানে যায় না ভারত। শেষমেশ ১৯৭৮ সালে ভারত জাতীয় দল গেল পাকিস্তানে খেলতে। সে সফরেই প্রথম টেষ্ট পরে একটি সাইড ম্যাচ বা প্র্যাক্টিস ম্যাচ খেলবে ভারত। সেখানে ভারতের প্রতিপক্ষ দল পাকিস্তান ইউনিভার্সিটিজ ও ইয়ুথ মিলিয়ে গড়া। ম্যাচের আগের রাত সবাই জড়ো হয়েছে ডিনার করতে। সেই গেট টুগেদারে ১৯ বছর বয়সী এক ছেলেকে দেখিয়ে পাকিস্তানের সংযুক্ত সে দলের ম্যানেজার পাঞ্জাবীতে কিছু একটা বললেন বিশান সিং বেদীকে। ভাষান্তর করলে যার অর্থ দাঁড়ায় এরকম- এই ছেলেটা আপনাদের কাল নাচাবে। পরে ছেলেটার সঙ্গে বেদীর দেখা হয় বারবার, মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে।
মুলতানের সে পিচে বল এতটাই টার্ন করছিল যে নিয়ন্ত্রণ আনতে বোলাররা চাইছিলেন বলের টার্ন কমাতে। পিচের অমন অবস্থা দেখে ভারতের লেফট আর্ম মিডিয়াম পেসার কারসান গারভি তো ২ ওভার পেস বল করেই শুরু করেছিলেন লেফট আর্ম স্পিন। বামহাতে বল ঘুরানোর কাজটা করতো সে ছেলেটাও। টার্নে বারবার পরাস্ত করে গ্রেট সুনিল গাভাস্কারকে ছেলেটা ৩২ রানে প্যাভিলিয়নেও ফেরায়। বাহাতে করে স্পিন, নাম তাঁর আমিন লাখানি।
একসময় লাখানির বলে মিসটাইমড করে মিড অনে বাহাতি কারসান গারভি, পরের বলে ডানহাতি ভেঙ্কাটারাগাভান মিড অনে দেন ক্যাচ। 'অন অ্যা হ্যাটট্রিক' বলে তাঁর শিকার হন ভারত দলের উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান ভারত রেড্ডি। সুইপ করতে গিয়ে মিসহিট করায় বল উঠে আকাশে, রমিজ রাজা সেদিন মাঠে ছিলেন টুয়েলভথ মেন হিসেবে, শর্ট স্কোয়ার লেগে সে ক্যাচ নেয়ার দায়িত্ব আসে তাঁর উপরেই। রমিজ রাজা ক্যাচ মিস করেন, লাখানির মুখ দিয়ে আপসে বের হয়, ‘উফ’। প্রথম চেষ্টায় মিস করে পরক্ষণেই দ্বিতীয় চেষ্টায় রমিজ তালুবন্দী করতে পারেন। ১৪৯ রানে ভারত হারায় ১০ উইকেট, ৫৮ রান খরচায় সেখানে লাখানির শিকার ৬টি।
বাহাতে করে স্পিন, নাম তাঁর আমিন লাখানি
সেদিন শেষে আবার গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়। সে রাতে বেদি বলেন, “আসলেই, এই ছেলেটাতো আমাদের নাচিয়ে দিল”। ভারত দলের ম্যানেজার ফাতেহ সিং রাও গায়েকোয়াড় আমিন লাখানির বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হয়ে কিছু টাকা উপহার দিলেন। লাখানি ও উইকেটকিপার আশরাফ আলী ৯ম উইকেটে ৭২ রানের পার্টনারশিপ গড়ে ১০৮ রানে ৮ উইকেট হারানো পাকিস্তানকে নিয়ে যান ১৮০ তে। লাখানি যেরাত উপহার পেলেন, সেদিন তিনি অপরাজিত ২৩ রানে। পরের দিনের শুরুতেই এরপর তিনি আউট হয়ে যান কোন রান না যোগ করেই।
মহিন্দর আমারনাথ স্পিনে স্টেপ আউট করে দারুণ খেলতেন। এদিনও ক্রিজ ছেড়ে বের হলেন, কিন্ত লাখানির বলে পরাস্ত হয়ে যেতে হলো মাঠ ছেড়ে প্যাভিলিয়নে। পরের বলেই কিরমানিকে যেতে হয় অমরনাথের যেতে না যেতেই। এরপরে আসেন কাপিল দেব, লাখানি 'অন অ্যা ডাবল হ্যাটট্রিক'। সে বল করার আগে দর্শকেরা এতটাই চিৎকার করছিলেন যেন হ্যাটট্রিক হয়েই গেছে। লাখানি বল করলেন, কাপিল দেবের ব্যাটের কানায় লেগে বল গেল হারুন রশিদের কাছে, প্রথম হ্যাটট্রিক শেষে যার কাছে গিয়ে লাখানি বলেছিলেন ‘হ্যাটট্রিক হয়ে গেছে ভাই’। দ্বিতীয়বার আর নিশ্চয়ই বলতে হয়নি, কারণ তখন যে বিরল এক কান্ড ঘটে গেছে, সেটা ঘটানোর দায়িত্বটা যে ছিল তাঁর হাতেই।
লাখানির মনে কাপিল দেবের সে ক্যাচের পর সন্দেহ হলো সেটা ক্যাচ হলো কি না। কারণ সে সময়ে কিছুটা দুর্বল দলের পক্ষে আম্পায়ারদের সুনজর থাকত। লাখানি গিয়ে তাই আসলাম খোখারকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, এই আউট কি পুরোপুরি সঠিক ছিল?’। আসলাম জবাব দেন, ‘হ্যা, বাচ্চা। তুমি ভয় পাচ্ছ, তোমার এই আউটটা পুরোপুরি সঠিক ছিল।’
কাপিলের ঐ আউটের পর ভারতের প্রয়োজন ছিল মাত্র ২৬ রান, হাতে ছিল ৪ উইকেট। ভেঙ্কাটারাগাভানের ১৮ নট আউটের বদৌলতে ২ উইকেট হারিয়ে পরে যা করতে সক্ষম হয় ভারত জাতীয় দল। ৩৪ ওভারে ৮০ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেন লাখানি।
হ্যাটট্রিক করা ম্যাচের বলটি আছে লাখানির সংগ্রহেই। ম্যাচ শেষে তিনি সেটাতে স্বাক্ষরও নিয়েছিলেন একজন ভারতীয় ক্রিকেটারের, কে সে? তিনি বিশান সিং বেদীই। সে ম্যাচে প্রথম ইনিংসে বেদীর বলে ০ রানে আউট হন লাখানি, পরে বেদীকেও ০ রানে ফেরান লাখানি। দ্বিতীয় ইনিংসে লাখানিকে পারেননা বেদী আউট করতে, ব্যাট করতে নামা লাগেনি বলে লাখানিও পারেননি বেদীকে আউট করতে।
ঐতিহাসিক সে ম্যাচের আগে-পরে বেদি ৬৩ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ২৪৯ উইকেট। লাখানি নামতে পারেননি আন্তর্জাতিক কোন ম্যাচেতেই!
২.
কেউ অমর হয় শতকের শতক করে, কেউ শতকপ্রায় গড় নিয়ে। কারো অমর হতে লাগে তিনশের বেশি ম্যাচ, আবার কারো লাগে মাত্র আটটি ম্যাচ কিংবা একটি দিন। জিমি ম্যাথিউজেরও অমর হতে লেগেছিল ওই একটি দিনই। ওই দিনে ম্যাথিউজ যা করেছিলেন তা তো শতবছরেও কেউ করতে পারেনি! কি এমন করেছিলেন এই লেগ স্পিনার? ১৯১২ সালের এক দিনে তিনি দুইবার করেছিলেন হ্যাটট্রিক। তাঁর আগে পরে মিলিয়ে আরও আটজনও পেয়েছেন এমন কীর্তির স্বাদ। তবে ম্যাথিউজ তাদের সবার থেকে ভিন্ন, কারণ বাকি সবাই তা করেছিলেন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে 'ডাবল হ্যাটট্রিক' করেছেন একমাত্র ম্যাথিউজই। এবং 'একাই একশ' জিমি ম্যাথিউজ সে হ্যাটট্রিক দুটি নিয়েছেন কারো সাহায্য ছাড়াই!
তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে মাত্র তিনটি দেশ। সেই তিন দেশ- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে অনুষ্টিত হলো ত্রিদেশীয় সিরিজ। তখনও বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলা হতো ক্রিকেটারদের, আর সে কারণেই ইংল্যান্ডে অনুষ্টিত সে ত্রিদেশীয় সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার ছয়জন নিয়মিত সদস্য গেলেন না। তাতেই সুযোগ মিললো থমাস জেমস ম্যাথিউজের। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাই সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করলেন এই লেগি। প্রথম ইনিংসে ৩৫ রান করে অস্ট্রেলিয়ার ৪৪৮ এ রাখলেন অবদান, পরে ২৬৫ রানে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস খতম করলেন টানা তিন বলে একজনকে বোল্ড ও দুজনকে এলবিডব্লিউয়ে শিকার বানিয়ে।
তিন দিনের ম্যাচে দ্বিতীয় দিনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করে ফলো-অন দিয়ে আবার ব্যাটে পাঠাল অস্ট্রেলিয়া। ৭০ রানে দক্ষিণ আফ্রিকার পঞ্চম ব্যাটসম্যান আউট হয়ে ফিরলেন প্যাভিলিয়নে। পরের ওভারে এলেন ম্যাথিউজ, টানা তিন বলে বোল্ড করে, দুটি কট এন্ড বোল্ড করে গড়লেন রেকর্ড, শতবছর ধরে যা এখনও অক্ষত। ম্যাথিউজ দুইবারই হ্যাটট্রিক পুর্ণ করেন টমি ওয়ার্ডকে আউট করে। মুলত উইকেট কিপিংয়ের জন্যই ওয়ার্ডের একাদশে থাকা। প্রথম ইনিংসে ১১ নাম্বারে নেমে, দ্বিতীয় ইনিংসে নয়ে নেমে অভিষেকেই তিনি পেয়েছেন কিং পেয়ারের স্বাদ। এটিই ছিল অভিষেকে কিং পেয়ারের প্রথম ঘটনা।
জিমি ম্যাথিউজ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন ৬৭টি, যার ২৮টিই খেললেন ইংল্যান্ডের ওই সফরে। ১৯১২ সালে অভিষেক হয়ে ৮ টেষ্টে ১৭ গড়ে ১৫৩ রান ও ২৬ গড়ে ১৬ উইকেটে সে বছরই তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ঘটলো ইতি। পরের আট বছরেই অস্ট্রেলিয়া খেলেনি আর কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৫ সালে যোগ দিতে হলো ম্যাথিউজকেও, সেখানে তাকে দেখতে হল তাঁর ছোট ভাইয়ের মৃত্যু। পরে গ্যাস্ট্রিক আলসারের জন্যে ১৯১৭ সালে তাকে ইউরোপ থেকে ফেরত পাঠানো হয় দেশে।
যক্ষ্মা তাঁর পুরো পরিবারকেই গ্রাস করেছে। শ্বাসজনিত রোগে ও যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর স্ত্রী ও নয় সন্তানের পাঁচজনের। এই যক্ষ্মাকে সঙ্গে নিয়েই তিনি খেলে গেছেন বহু বছর। এত দুঃখ-কষ্টে তাঁর পাশে ছিল খেলাধুলা, তিনি বলের খেলা দুটিকে ভালোবাসতেন। ক্রিকেটের পাশাপাশি খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলের ঘরোয়া পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্তরে। খেলোয়াড়ী জীবন শেষে কাজ করেছেন গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবেও। ১৯৪৩ সালে ৫৯ বছর বয়সী জিমি ম্যাথিউজের মৃত্যু ঘটে ভিক্টোরিয়ায় কলফিল্ড মিলিটারি হাসপাতালে। তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কী লেখা আছে? কী আবার! যক্ষ্মা।
৩.
টেস্টের তথা ক্রিকেটের প্রথম বলটা করেছিলেন আলফ্রেড শ, ইনিংসে প্রথম ৫ উইকেটের রেকর্ডটাও তাঁর। আলফ্রেড শো প্রথম যখন মিডিয়াম পেস বল করে একই ম্যাচে দুইবার হ্যাটট্রিক করেন তখন তাঁর বয়স কত ছিল জানেন? ৪২ বছর। এর দুবছর আগেই শ খেলে ফেলেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। তবে এর আগে-পরে মিলিয়ে ৩৩ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন ৪০৪টি, যাতে ১২.১২ গড় ও ১.৪৪ ইকোনমিতে তাঁর শিকার ২০২৭টি উইকেট! ফার্স্ট ক্লাসে দুই হাজারের বেশি উইকেট নেয়া ৩৩ জনের মধ্যে একমাত্র শয়ের ইকোনমিই দুয়ের নিচে, ইকোনমির মতো তাঁর গড়ও সবচে কম। তবে ৭ টেস্টের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এর প্রায় দ্বিগুণ গড়ে তাঁর শিকার ১২টি উইকেট। এর মাঝে ৪টি টেষ্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেন তিনি, যাতে জয় পাননি একটিতেও, ড্র করেছেন দুটিতে।
ঘরের ১৩তম সন্তান হিসেবে ট্রেন্ট নদীর পারে অবস্থিত বার্টন জয়েস গ্রামে জন্ম আলফ্রেড শয়ের। ভাইবোনদের মাঝে দুই ভাই খেলতেন ক্রিকেট। ১৮৪২ সালে জন্মের দশ বছর পর তাঁর মা মারা গেলে স্কুল ছেড়ে দেন তিনি, শুরু করেন কাজ, পান পাখি তাড়ানোর কাজ। পরে আরেক কাজ শুরু করেন, যে কাজ শেষে সময় পেতেন একটু প্রিয় ক্রিকেট খেলার, শিখেও ফেলেন বোলিং।
তাঁর দুই ভাই উইলিয়াম ও আর্থার খেলতেন ক্রিকেট। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে গ্র্যান্থাম ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতেন আর্থার। একবার আর্থারের বাতরোগে দেখা দিল, গ্র্যান্থামে তাকে দেখতে গেলেন আলফ্রেড শ। বিশ বছর বয়সী শয়ের তখনও ক্রিকেট খেলে জীবিকা নির্বাহের কোনই ধারণা ছিল না। গ্র্যান্থাম ক্লাবে এক ভদ্রলোক নেট ব্যাট করবেন, শকে বললেন বোলিং করতে। ভদ্রলোক তাঁর বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়ে বললেন, 'তুমি তো আর্থারের থেকে ভালো বল করো'। তাঁর ভাই, আর্থার সে সিজনেই রোগ সেরে উঠতে পারলেন না, তাঁর জায়গায় খেললেন আলফ্রেড শ। এরপর আর্থার ভালো হলেন, তখন তাঁর জায়গাটা আলফ্রেড শয়ের। আর্থারকে গ্র্যান্থাম ক্লাব ছাড়তে হলো, 'বোলারদের সম্রাট' হওয়ার পথে যাত্রা শুরু হলো আলফ্রেড শ'য়ের।
ক্যারিয়ারের শেষদিকে একটু মেদ বেড়ে গিয়েছিলো শয়ের
২০ বছরের সে ছেলের বয়স এখন ৪২। গ্র্যান্থাম থেকে নটিংশ্যামহায়ার অধিনায়ক, মাঝখানে কেটে গেছে ২২টি বছর। সে সময়ে আলফ্রেড শ ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ৮ আন্তর্জাতিক টেস্টের একটি বাদে সব খেললেন। ১৮৭১ থেকে ১৮৮০, এই দশ সিজনের দুটি বাদে সবটিতেই শিকার করেছেন ১০০টির বেশি উইকেট। আগের সিজনে কাউন্টিতে তাঁর নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নটিংশ্যামহায়ার খেলতে নেমেছে গ্লাস্টারশায়ারের সাথে, টসে জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন আলফ্রেড শ।
টানা দুই বলে দুই উইকেট, বোলার অন অ্যা হ্যাটট্রিক। পুরো ম্যাচে এভাবে আলফ্রেড শ হ্যাটট্রিকের সুযোগ তৈরি করেছেন পাঁচবার, যার মধ্যে দুবার তিনি হয়েছেন সফল। ৪ বলে হতো তখন ওভার। আলফ্রেড শ বোলিংয়ে কোনও পরিবর্তন আনেননি, অ্যাটওয়েলকে অপর প্রান্তে বোলিং সঙ্গী বানিয়ে ৮১.৩ ওভার বল করে গ্লাস্টারশায়ারকে অলআউট করেছেন ৪৯ রানে। ৪১ ওভারে ২৯ রানে শয়ের শিকার ৮টি, যার মধ্যে তিনটি তাঁর টানা তিন বলে।
উইলফ্রেড ফ্লাওয়ারসের ফিফটিতে ১০৫ রানে অলআউট হয়ে বোলিংয়ে আবারও আলফ্রেড শ কোনও পরিবর্তন আনেননি, পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েনি। দুজনে মিলে খেল খতম করেছেন ৭৫.২ ওভারে। প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয়বার দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যাটওয়েলের শিকার ওয়ালটার গিলবার্ট। ওয়ালটার গিলবার্ট, গ্রেট ডব্লিউ জি গ্রেসের ভাতিজা, পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালে ড্রেসিং রুমে টিমমেটের জিনিষ চুরির অপরাধে অপরাধী হয়ে যাকে দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে কানাডায়।
১৬ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পরই ১৭ রানে টানা তিন বলে তিনজনকে প্যাভিলিয়নে ফেরান আলফ্রেড শ, এবং হয়ে যান পৃথিবীর প্রথম 'ডাবল হ্যাটট্রিকিয়ান'। এরপর আরও তিনটি মিলে মোট ছয়টি উইকেট তিনি নেন সে ইনিংসে। ৬৩ রানে অলআউট হয়ে গ্লাস্টারশায়ার মাত্র ৮ রানের লক্ষ্য দেয় শয়ের নটিংহ্যামশায়ারকে। ২ ওভারেই সে লক্ষ্য তাড়া করে ট্রেন্ট ব্রিজে তিনদিনের ম্যাচ দুদিনেই জিতে যায় আলফ্রেড শয়ের দল। তাঁর দল ১৮৮৪ সালের সে মৌসুমসহ পরের দু মৌসুম মিলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টানা চারবার।
চিনতে পেরেছেন? ডানদিক থেকে দ্বিতীয়, বসে আছেন আলফ্রেড শ
অবসরের পর পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চির আলফ্রেড শ আম্পায়ার হয়েছেন, করিয়েছেন কোচিং। ৫২ বছর বয়সে এরপর অবসর ভেঙ্গে ১৮৯৪ সালে আবারও ফিরেন কাউন্টি ক্রিকেটে। সেবার খেলেছিলেন সাসেক্সের হয়ে, ৫২ বছরের আলফ্রেড শ ৪২২ ওভার বোলিং করে মাত্র ৫১৬ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৪১টি উইকেট।
পরের বছরের ঘটনা। শীতে কাপছেন রঞ্জিতসিনহজি, এমনই যে হাত পকেটে ঢুকিয়ে পা দিয়ে ফিল্ডিং করছিলেন। ম্যাচটা ছিল নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে, আলফ্রেড শয়ের সাবেক এই দল প্রথম ইনিংসে করে ৭২৬ রান। সে ম্যাচেই আলফ্রেড শ বোলিং করেছিলেন ১০০.১ ওভার, তখন ওভার হয় পাঁচটি বলে। এর দুই ম্যাচ পর আবার অবসরে চলে যান ডানহাতি এ বোলার।
৪.
ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার বাড়িতে থাকছেন প্রায় দু-আড়াই বছর ধরে। কিছুদিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকার পর জোরজবস্তি করেই বাড়িতে ফিরেছেন ভদ্রলোক। বাড়ির মালিক সেই ভদ্রমহিলা গেলেন তাকে দেখতে তাঁর ঘরে, গিয়ে দেখতে পেলেন বিছানায় শোয়া এক লাশ, ডানহাতে তাঁর বাদামী পিস্তল, যে ডানহাতে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৭১৫৪৯ বল ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে লর্ডসের প্যাভিলিয়ন পার করেছেন সে ডানহাতেই পিস্তলের ট্রিগার চেপে তিনি হয়েছেন লাশ। লাশ হওয়ার আগে তাঁর নাম, জস, খ্যাতি সবই ছিল, লাশ হওয়ার পরেও। লাশ হওয়ার আগে যে তিনি যা করে গেছেন তাঁর জন্য আজও তাকে স্মরণ করতে হয়। তিনি আলবার্ট এডউইন ট্রট।
১৮৯৫ সালের অস্ট্রেলিয়ান সামার, খোলা মাঠে তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। অ্যাডিলেডে অভিষেক হলো আলবার্ট এডউইন ট্রটের। লেট অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে দুই ইনিংসে অপরাজিত থেকে করলেন ৩২ ও ৭৮ রান। বোলিংয়ে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩ ওভার সুযোগ পাওয়ায় কিছু করে দেখাতে পারলেন না, দ্বিতীয় ইনিংসে গড়লেন অভিষেকে ইনিংস সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড, ৪৩ রান দিয়ে ৮ উইকেট। সিরিজের পরের দুই ম্যাচ শেষে ১০২.৫০ গড় ও ২১.৩৩ বোলিং গড়ে ৯ উইকেটে শেষ হলো ট্রটের অস্ট্রেলিয়ান ক্যারিয়ার। এরপর আর কখনও নিজ মাতৃভুমির হয়ে লড়লেন না এই অলরাউন্ডার, প্রতিভাবান কিন্ত হতভাগা অলরাউন্ডার।
ট্রটের স্বপীল অভিষেক শেষে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক বলেছিলেন, ট্রট অস্ট্রেলিয়ার সেরা ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন হতে যাচ্ছেন এবং এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া থেকে বের হওয়া সেরা ক্রিকেটারদের একজন। ইংলিশ কাপ্তান অ্যান্ড্রু স্টুডডার্ট আরও বলেছিলেন, ট্রটের মতো ক্রিকেটারদের সর্বদাই স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আছে তারা(ইংল্যান্ড)। ট্রট ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন ঠিকই, তা ভিন্ন পথের পথিক হয়ে। ট্রটের অভিষেক সিরিজের পর ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে অস্ট্রেলিয়া দল যে জাহাজে গিয়েছে, সেখানে ছিলেন ট্রটও। তবে আলবার্টো ট্রট অস্ট্রেলিয়া দলের সদস্য ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ যাত্রী, নতুন জীবনের সন্ধানে যে ছেড়ে যাচ্ছে প্রাণের জন্মভুমিকে।
অস্ট্রেলিয়া ২-১ ব্যবধানে সে সিরিজ হারলো, আলবার্ট ট্রট সেসময়ে মিডলসেক্সের সাথে চুক্তি করলেন। মিডলসেক্সের অধিনায়ক আর কেউ নন, অ্যান্ড্রু স্টুডডার্ট। সে সফরে অজিদের দলপতি ছিলেন আলবার্ট ট্রটের ভাই হ্যারি ট্রট। এরপর থেকেই তারা দুজন দুই পথের দিশারী। দুই ভাইয়ের একবার দেখা হল অক্সফোর্ড স্ট্রিটে। হ্যারি আলবার্টকে বললেন, 'হ্যালো, তরুণ ভিক্ষুক'। উত্তরে আলবার্ট ট্রট হ্যালোর বেশি আর কিছু বললেন না।
বছর দুয়েক পর আলবার্ট ট্রট মিডলসেক্সের হয়ে কাউন্টি খেলা শুরু করলেন। দারুণ পারফর্মেন্সে ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পেয়ে চারটি টেস্ট খেলতে পারলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ৪ ইনিংসে মাত্র ২৩ রান করতে পারলেও বল হাতে দুই ম্যাচে নিলেন ১৭ উইকেট। এরপর আর ইংল্যান্ডের হয়ে নামতে পারলেন না মাঠে, দুই দেশের হয়ে খেলে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থামলো ১৪.৯৬ গড়ে ২৬ উইকেট ও ৩৮ গড়ে ২২৮ রানে। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ধাপট দেখালেন স্বমহিমায়। ১৮৯৯ সালে কাউন্টিতে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এক সিজনে ১০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবলের রেকর্ড গড়ে পরের সিজনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন।
সেসময়ে অস্ট্রেলিয়া এলো ইংল্যান্ডে। এমসিসির (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) হয়ে স্বদেশের বিপক্ষে লড়তে নামলেন আলবার্ট ট্রট। বোলার এলেন ট্রটের সামনে, ট্রট তাঁর করা বলটি পাঠালেন লর্ডসের বাইরে, আকাশে উড়তে দেখে বলটাকে ট্রটের মনে হচ্ছিল যেন 'আকাশে একটি মটর'। বোলার মন্টি নোবেল, ১৮৯৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে ট্রটের দলে না থাকার কারণ যাকে মনে করেন তিনি। ট্রটের সে অতিমানবীয় শটে বল লর্ডসের প্যাভিলিয়নের উপরে বাউন্স করে গিয়ে পড়ে স্টেডিয়ামের বাইরের এক গার্ডেনে। 'হোম অব ক্রিকেট' খ্যাত এই লর্ডসে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে দুশতাধিক ম্যাচ ও কত সহস্র ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ হয়েছে, খেলেছেন কত সহস্র খেলোয়াড়। কেউ পারেননি লর্ডসের বাইরে বল পাঠাতে, ট্রট যেভাবে পেরেছেন!
আলবার্টো ট্রট চরিত্রটাকে মানুষ ভালোবাসতো, ইংল্যান্ডের জাতীয় হিরোদের পর্যায়ে তখন তিনি। তবে তাকে নাকি অতিরিক্ত মুল্য দেওয়া হচ্ছে, এমনই এক মন্তব্য করে বসলেন প্রতিপক্ষ এক ক্রিকেটার। সেই ক্রিকেটার এক ম্যাচে ব্যাটে যাওয়ার আগে একটি নোট পেলেন এবং তিনি আউট হওয়ার পরেই তা খুলতে পারবেন। সে ম্যাচে ট্রটের মুখোমুখি হলেন সেই ক্রিকেটার- প্রথম বল গিয়ে লাগলো তাঁর পেটে, দ্বিতীয়টি তিনি ব্যাটে লাগাতে পারলেন না, তৃতীয় বলে উড়ে গেল তাঁর স্ট্যাম্প। আউট হওয়ার পর তিনি নোটটি খুললেন। যেটিতে লেখা ছিল, 'ট্রট পাঁচ পাউন্ড পাবে, যদি সে প্রথম বলে তোমার পেটে মারে, দ্বিতীয়টি এমনভাবে করে যাতে তুমি ব্যাটে বল লাগাতে পারো না, এবং প্রথম ওভারেই তোমার স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দেয়। সে কি ভালো বোলার?'
ট্রটের সুসময় বেশিদিন টিকলো না, মদ-জুয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসা বাড়তে থাকলো, ফর্মের গ্রাফ তাই নিচের দিকে যেতেই থাকলো। এদিকে স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটতে থাকলো পাশাপাশি। ১৯০৭ সালে সমারসেটের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল তাঁর বেনিফিট ম্যাচ, অর্থাৎ ম্যাচের গেট মানি বা টিকেটের টাকাটা যেত তাঁর পকেটে। কিন্ত তিনি নিজের কপালে যেন নিজেই কুড়াল মারলেন, এক ইনিংসেই দুবার হ্যাটট্রিক নিয়ে খেলা শেষ করে দিলেন আগেভাগেই। ২৬৪ রানের লক্ষ্যে সমারসেট যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই টানা চার বলে চারজনকে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে ম্যাচটা নিজেদের করে নিলেন আলবার্ট ট্রট। ৭৭ রানে চারজনকে ফেরানোর পর শেষ তিন সমারসেট ব্যাটারকে টানা তিন বলে ফিরিয়ে ১৬৬ রানের জয়ে প্রথম বোলার হিসেবে এক ইনিংসে ডাবল হ্যাটট্রিকের রেকর্ডও গড়লেন বৈচিত্রময় এই বোলার। তবে আলফ্রেড শ তা জানতে পারলেন না। পৃথিবীর একমাত্র ডাবল হ্যাটট্রিকিয়ান তিনি- তা জেনেই সেদিনের মাস চারেক আগে মারা যান ডাবল হ্যাটট্রিক ক্লাবের প্রথম সদস্য।
স্বাস্থ্যের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতে হতে এমন অবস্থা যে হাসপাতালে ভর্তি আলবার্ট ট্রট, কিন্তু আপনজন কেউই নেই তাঁর পাশে। দুই সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী আগেই চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। ক্রিকেট ছেড়ে আম্পায়ারিং শুরু করেছিলেন, কিন্ত স্বাস্থ্য তাঁর সহায় ছিল না। তিনিও এমন স্বাস্থ্যকে সঙ্গী বানিয়ে জীবন পার করতে চাইলেন না, বাড়িতে এসে ৪১ বছর বয়সী ট্রট নিজেই ট্রিগার চাপলেন নিজের মাথায়।
সিনেমা শেষ, দ্যা এন্ড। ট্রটের জীবন নিয়ে কি আপনি বানাতে চান না সিনেমা?
৫.
ছোটবেলায় ক্রিকেটে চার্লস ওয়ারিংটন লিওনার্ড পার্কারের তেমন আগ্রহ ছিল না, গলফেই পড়ে ছিল তাঁর মন। আঠারো বছর বয়সের পরেই মজেন ক্রিকেটের প্রেমে। এরপর সে প্রেমের স্থায়ীত্ত্ব ছিল তাঁর মৃত্যু অবধি। ক্রিকেট ভালোবাসতেন বলেই পার্কার সারাজীবন পার করেছেন ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেই। ক্রিকেট খেললেই যে তা জাতীয় দলের হয়ে খেলতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই! চার্লস পার্কার মাত্র একবারই খেলেছেন জাতীয় দলে। তবু ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পদচারণ বারবার তাকে ক্রিকেট ইতিহাস থেকে বের করিয়ে আনে।
পার্কারের ক্রিকেট চর্চার ব্যাপ্তি প্রায় তিন বছর, এরপর গ্রেট ডব্লিউ জি গ্রেসের সুপারিশে গ্লাস্টারশায়ারে পেলেন তিনি জায়গা। ১৯০৩ সালে যোগ দিয়ে পরের চারবছরে খেললেন মাত্র দুটি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ। মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত অনেকটা নিশ্চুপ ছিলেন, পরের তুলনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এলে বন্ধ হলো ক্রিকেট, ক্রিকেট ফিরলে পার্কারও ফিরলেন নতুন রুপে। আগে করতেন বাহাতে পেস, যুদ্ধের পরে শুরু করলেন স্পিন। ১৯১৪ এর আগে পেসে তিনি উইকেট নিয়েছিলেন ৪৬৭টি। এরপর ১৯২০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত প্রতি সিজনেই নিয়েছেন একশের বেশি উইকেট।
পার্কারের বেনিফিট ম্যাচে দর্শকদেরই হলো বেনিফিট। পার্কার টানা পাচ বলে উড়ালেন পাঁচজনের স্ট্যাম্প, এমন দৃশ্য আপনার চোখের সামনে ঘটলে আপনি লাভবান না? দুঃখের বিষয়, পার্কারের দ্বিতীয় বলটি ছিল নো বল, তাই পাঁচ বলে পাঁচ উইকেটের অবিস্মরণীয় রেকর্ড গড়া হয়নি পার্কারের। তবে ১৯২২ সালে সেদিন প্রথম হ্যাটট্রিকের স্বাদ পেয়েছিলেন তিনি। দুবছর পর ১৯২৪ মৌসুমে তিনি ইতিহাসে প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে নিয়েছিলেন এক মৌসুমেই তিন তিনটি হ্যাটট্রিক।
সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারে তাঁর হ্যাটট্রিক আছে ছয়টি, যা ফার্স্ট ক্লাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মাঝে দুটি আবার তিনি করেছেন এক ম্যাচেই, তা ওই ১৯২৪ সালেই। মিডলসেক্সের বিপক্ষে সে ম্যাচে মাত্র ৩১ রানে অলআউট হয়ে আবার গ্লাস্টারশায়ার তাদের অলআউট করেছিল ৭৪ রানে। সেখানে সাত শিকার পার্কারের। ওয়ালি হ্যামন্ডের অপরাজিত ১৭৪ রানের ইনিংসে ২৫২ রানের লক্ষ্য দিতে সক্ষম হয় এরপর তারা। ১৯০ রানে সবকটি উইকেট হারায় মিডলসেক্স, পার্কারের সাত শিকারে সেখানেও আছে টানা তিন বলে তিনজনকে ফেরানোর দৃশ্য।
ফার্স্ট ক্লাস ইতিহাসে পার্কারের চেয়ে বেশি উইকেট আছে আর মাত্র দুজনের। উইলফ্রেড রোডস ও টিক ফ্রিম্যানের পেছনে আছেন পার্কার ৩২৭৮ উইকেট নিয়ে। যার মধ্যে মাত্র দুটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯২১ সালে এক ইনিংসে বল করে তা নিয়েছিলেন পার্কার। এরপরে আর কখনো জাতীয় দলে তাঁর সুযোগ না পাওয়ার পেছনের কারিগর বলে পার্কার যাকে মনে করেন তিনি পেহলাম ওয়ার্নার। ক্রিকেটের সব জায়গাতেই ছিল তার বিচরণ। সফল ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পর ম্যানেজার, নির্বাচক, সংঘটকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন 'দ্যা ক্রিকেটার' এর প্রতিষ্টাতা ইংল্যান্ডকে ১০ টেষ্টে নেতৃত্ব দেয়া ওয়ার্নারই। ক্রিকেটে অবদানের জন্য পরে 'নাইট' খেতাবও পেয়েছেন, নামের পাশে লেগেছে স্যার।
স্যার পেহলাম ওয়ার্নারকে একদিন প্রায় ঘুষি মারতেই চলেছিলেন চার্লস পার্কার। খেলা ছেড়ে ওয়ার্নার যখন ইংল্যান্ডের নির্বাচক, পার্কার তখন খেলোয়াড়। ১৯২৬ সালে অ্যাশেজের প্রথম দুই টেষ্ট ড্র করলো ইংল্যান্ড, পরের টেষ্টে পিচ হলো পার্কারের উপযোগী, স্টিকি উইকেট। পার্কার তাহলে খেলছেন অবশেষে, বারোজনের স্কোয়াডে থাকলেন তিনি, আগেরদিন পর্যন্ত তাকে একাদশেই দেখছেন সবাই। পরের দিন ইংল্যান্ড নামলো তাকে ছাড়াই। সেসময় নির্বাচক প্যানেলের সদস্য ছিলেন ওয়ার্নারও।
পুর্ব অভিজ্ঞতার কারণেই ওয়ার্নারের মতো এত বড় ক্রীড়া ব্যাক্তিত্বের প্রতি ক্ষোভ ছিল পার্কারের। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে দুবার ওয়ার্নারকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো গ্লাস্টারশায়ারের অনুষ্টানে। সেখানে এসে তিনি সবারই প্রশংসা করলেন, চার্লস পার্কারকে বাদ দিয়ে! ১৯২৬ সালে গ্লাষ্টারশায়ারের বার্ষিক সে অনুষ্টানে আগের মৌসুমে এসেক্সের বিপক্ষে ১৭ উইকেট নেয়ার জন্য পার্কারকে পুরষ্কৃতও করা হয়। 'প্রায় ঘুষি' মারার ঘটনাটা ঘটে পরেরবারের বার্ষিক অনুষ্টানে ১৯২৯ সালে, চার্লস পার্কার কিন্ত ঘুষি মারেননি। ঝেড়েই তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ওয়ার্নার বেচে ছিলেন ৮৯ বছর পর্যন্ত, ১৯৬৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্পাদনা করেছেন 'দ্যা ক্রিকেটার'। চার্লস পার্কার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন, পরে কোচিং করিয়েছেন। ওয়ার্নারের প্রায় সাড়ে তিন বছর আগেই তাকে যেতে হয়েছে দুনিয়া ছেড়ে, ক্রিকেটের মায়া ছেড়ে।
৬.
কুড়ি বছর বয়সী ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে বল হাতে। তাঁর সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে মরিস লেল্যান্ড, ফার্স্ট ক্লাসে যার রান তেত্রিশ হাজারেরও বেশি। ছেলেটা বল করল, বেল উপচে গিয়ে পড়লো মাটিতে। ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকে ছেলেটার অভিষেক শিকার হলেন ইংল্যান্ডের হয়ে ৪১ টেষ্ট খেলা মরিস লেল্যান্ড। ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন, মন খারাপ করে সরাসরি রওয়ানা দিবেন প্যাভিলিয়নের দিকে। চিরাগত এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়, ব্যতিক্রম কিছু হলেই তবে! রোল্যান্ড অলিভার জেনকিনসও এমন কিছু করেছিলেন, লেল্যান্ড তাই আউট হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন, আর সেসময়ে বিস্মিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলেন ছেলেটার দিকে। এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস শেষে তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো, 'খুব ভালো বল করেছ, বাচ্চা'।
দশ বছর পর সে বাচ্চা আর বাচ্চা নেই। হয়তো অভিষিক্ত সেসময়ে ছিলেন লেল্যান্ডের বয়স কিংবা ক্যারিয়ারের তুলনায়। এখন ওরচেস্টারশায়ার তাঁর উপর ভরসা রাখে, আশা করে। সারের বিপক্ষে খেলতে নামলেন রোনাল্ড জনকিনস। মাত্র ৯ রানে ডানহাতি জনকিনসকে ফিরতে হলো এলেক বেডসারের বলে জন পার্কারের হাতে ক্যাচ দিয়ে। এরপর সারের দলীয় রান যখন ১৭৫, তখন টানা দুই বলে ফেরালেন এ দুজনকে। জন পার্কার ও এলেক বেডসারের পরে জনকিনসের হ্যাটট্রিক রুখতে এলেন স্টুয়ার্ট সারির্জ। ১৯৪৯ সালের সে মৌসুমের আগের মৌসুমেও এরকম পরিস্থিতির সামনে পড়েছিলেন সারির্জ। তখনও পারেননি, এবারও পারলেন না।
জনকিনসের দুটি হ্যাটট্রিকেই সারির্জের আগের শিকার ছিলেন বেডসার দুই ভাই। ১৯৪৮ সালে এরিক বেডসার, আর পরেরটায় এলেক বেডসার। রোলি জনকিনস তাঁর ডাবল হ্যাটট্রিকও পুরণ করেছিলেন এলেক বেডসারকে ফিরিয়েই। দ্বিতীয় ইনিংসে জনকিনসকে ১১ রানে এলেক বেডসার আউট করেছিলেন আর্থার ম্যাকবাইন্টারের ক্যাচ বানিয়ে। পরে সে ম্যাচে জনকিনস দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করে রেকর্ড বুকে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য করেছেন তাদের দুজনকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়েই।
ম্যাচটা ওরচেস্টারশায়ারই জিতেছিলো, ১০৯ রানে। জনকিনসের এমন মনোমুগ্ধকর পারফর্ম্যান্সের পরে ওরচেস্টারশায়ার হারে কি করে! প্রথম ইনিংস শেষে ৩৮ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে জেনকিনসের দল ২৫৪ রান করে সারের সামনে ছুড়ে দেয় ২১৭ রানের লক্ষ্য। একটা সময় এমন ছিল- ম্যাচটা কার পক্ষে ঠিক বলা সম্ভব হচ্ছিল না। সারের স্কোরবোর্ডে তখন ৯০ রান হয়ে গেছে, তাতে তারা হারিয়েছে ৪ উইকেট। এরপর ১০৭ রানে পঞ্চম উইকেট হারানোর পর সারে তাদের শেষ পাঁচ উইকেট হারিয়েছিলো স্কোরবোর্ডে কোন রান না যোগ করেই। সেখানে পরপর তিন বলে তিনজনকে আউট করে ম্যাচটা নিজেদের করে নিয়েছিলেন জেনকিনস। প্রথম ইনিংসে ছয় শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর শিকার পাঁচটি।
ইনজুরি হানা দিয়েছিল ১৯৫৩ সালে, জনকিনসকে তাই প্রায় অর্ধেক মৌসুম কাটাতে হয়েছিলো বসে থেকেই। এরপর ইনজুরি গেছে, আবার ফিরেছে, তিনি লড়েছেন, মাঠে ফিরেছেন। এভাবে করতে করতে শেষমেশ তাঁর সঙ্গে আর চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়নি ওরচেস্টারশায়ার। ১৯৫৮ সালে ইতি ঘটে রোনাল্ড জেনকিনসের কাউন্টি ক্রিকেটের। এরপরও তিনি ক্রিকেটের মমতা ছেড়ে দূরে সরে যাননি, আরও পনেরো বছর খেলে গেছেন জেলা লীগ ও নানাবিধ স্থানে। বয়সের সঙ্গে না পেরে একটা সময় থামতেই হয়, জেনকিনসকেও খেলা ছাড়তে হয়েছিলো একেবারে। তবু তাঁর শরীর ছাড়লেও মন তো আর ছাড়তে পারেনি! মাঠে আম্পায়ারগিরি করার সময়ে নাকি দুদলের বোলারদেরই টিপস দিতে থাকতেন যৌবনে লেগ স্পিন করা বোলার রোনাল্ড অলিভার জেনকিনস।
জেনকিনস ইনজুরির সঙ্গে লড়ে খেলে গেছেন বহুদিন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার সাধ্য তো কারোরই নেই! ৭৬ বছর বয়সী জেনকিনসের মৃত্যু ঘটেছিল ১৯৯৫ সনে। মরণের আগে যিনি ইংল্যান্ডের হয়ে ৯ ম্যাচে খেলে ১৮ গড়ে ১৯৮ রান ও ৩২ উইকেট নিয়েছিলেন প্রায় ৩৪ গড়ে। ফার্স্ট ক্লাসে যার ১৩০৯ উইকেটের সাথে আছে দশ হাজারের বেশি রানও।
৭.
তাদের পরিবারে খুব আপন গলফ। মা গলফ ইউনিয়নের মহিলা কমিটির প্রধান, দুই ছেলেও গলফ খেলেন জাতীয় পর্যায়ে। তাদের পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া আরেক সদস্যও খেলাটা খেলতেন একটা সময়। আজ তাদের খুশির দিন, জন্মদিন বলে কথা! দিনটা ১৯৯৪ সালের পরের যেকোন ১৬ অক্টোবর। হয়তো সেদিন নন্দিতা বসে বসে কাদছেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে। দুই ভাই জানে কেন কাদছেন তাদের মা। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে এরকম অনুষ্টানেরই পরিকল্পনা করছিলেন নন্দিতা, কিন্ত জন্মদিনের কয়েকদিন আগেই তাঁর স্বামীর মৃত্যুতে সব ভেস্তে গেল। চোখের জল মুছতে মুছতে স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে বহুবছর পরেও হয়তো দুই ছেলেকে তিনি শোনান সে স্বামীর গল্প, তাদের বাবার গল্প। প্রবির রাও ও রাহুল রাওকে শোনান জগিন্দর সিং রাওয়ের বীরত্বের গল্প। গল্পটা যুদ্ধের ময়দানের, খেলার ময়দানের! হয়তো সে গল্প শেষ হতে না হতেই দুই ভাই তাদের চোখের কোণে কয়েক ফোটা জলও আবিস্কার করে ফেলে।
চেহারা থেকে তখনও কিশোর বয়সের ছাপ উঠে যায়নি। দেশের জন্য লড়তে সে এসেছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে। ব্রিটিশদের হাত থেকে প্রাণের ভুমি মুক্ত হওয়া সে দেখেছে। স্বাধীনতার আট বছর পর সে ছেলেটি, ১৭ বছর বয়সী জগিন্দার সিং রাও যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। নামটা আসলে রাও জগিন্দর সিং, সেনাবাহিনীতে যোগদানের সময়ে ভুলবশত তাঁর নাম পাল্টে হয়ে যায় জগিন্দর সিং রাও। এ নামেই তাঁর পরিচয়, ইতিহাসে তিনি ঢুকে গেছেন এ নামেই।
ব্রিটিশদের বিদায় নিতে হলেও ক্রিকেটে দিওয়ানা করে রেখে গেছে তারা বহুজনকে। জগিন্দর সিংও তাদের মধ্যে একজন। তবে তিনি শুধু ক্রিকেটেই পাগল ছিলেন না, ভালোবাসতেন গলফ নামের খেলাটাকেও। খেলাধুলায় তো আর রুটি-রুজি চলে না! অন্তত তখন হয়তো চলত না খুব! তবু সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েও জগিন্দর সিং তাঁর অন্য ভালোবাসা থেকে দূরে সরে গেলেন না। খেলাধুলা চালিয়ে গেলেন নিয়মিত। আটবছর পর রঞ্জি ট্রফিতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সার্ভিসেস নামের দলে তাঁর নাম এল প্রথম।
২৪ তারিখে হলো তাঁর অভিষেক। অভিষেকেই জগিন্দর সিংয়ের ফাইফার! সেদিন জাম্মু কাশ্মির গুটিয়ে গেল মাত্র ৪৭ রানে। ২৪ রানে ডানহাতে মিডিয়াম পেস বল করে জগিন্দর সিং নিলেন ৬ উইকেট, সেখানে পরপর তিনজনকে ফেরালেন তিন বলেই। এরপর সার্ভিসেস ১ উইকেট হারিয়ে ১৯৬ করে ডিক্লেয়ার করে জাম্মু কাশ্মিরকে ৮১ রানে অলআউট করে ম্যাচ জিতে নিল ইনিংস ও ৬৮ রানে। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও ১৩ ওভার বল করলেন জগিন্দর সিং, তবে দ্বিতীয়বার নিতে পারলেন মাত্র ২টি উইকেট।
দুদিনে সে ম্যাচ শেষ হওয়ার দুদিন পর সার্ভিসেস নামলো নর্থান পাঞ্জাবের সঙ্গে খেলতে। দুর্দান্ত অভিষেকের পর জগিন্দর সিংয়ের দ্বিতীয় টেষ্টের শুরু তেমন ভালো হলো না। ৫ ওভার বল করে থাকলেন উইকেটশুন্য। এরপর প্রথম দিনের সে পারফর্মেন্স যেন পুষিয়ে দিলেন দ্বিতীয় দিনে সাতটি উইকেট নিয়ে। প্রথম ইনিংসে নর্থান পাঞ্জাবের অলআউট ১০৮ রানের পর ১৩২ রানের দ্বিতীয় ইনিংসে জগিন্দর সিং করলেন 'ডাবল হ্যাটট্রিক'। এক ইনিংসে এরকম দুবার হ্যাটট্রিক পৃথিবীর বুকে আর একমাত্র আলবার্ট এডউইন ট্রটই করেছেন। স্বপ্নীল অভিষেক, প্রথম হ্যাটট্রিক অভিষেকেই, এরপর ডাবল হ্যাটট্রিক। জগিন্দর সিং রাওয়ের জীবনে এসবকিছু ঘটলো ১৯৬৩ সালের নভেম্বরের এক সপ্তাহের মধ্যেই।
এক মৌসুমে তিন হ্যাটট্রিক নেয়া প্রথম ব্যাক্তি চার্লস পার্কার। আরও দুজনের মাঝে একজন জগিন্দর সিং রাও। চার্লস পার্কারও গলফ ভালোবাসতেন, এরপর ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে গলফ ছেড়ে বাকি জীবন কাটিয়েছেন ক্রিকেটের সাথে। কিন্ত জগিন্দর সিং রাও বাধ্য হয়ে ক্রিকেট ছেড়ে গলফে ফিরে গেছেন। ১৯৮৪ সালে প্যারিসে ও ১৯৯২ সালে ইসলামাবাদে গলফে লড়েছেন ভারতের হয়ে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে যুদ্ধেও লড়েছেন মেজর জেনারেল জগিন্দর সিং রাও।
জগিন্দর সিং রাও নামটা বলতে আপনার কাছে কি বুঝায়? প্রশ্নের উত্তরে বিশেন সিং বেদী বলেছিলেন 'ডাবল হ্যাটট্রিক'। সে ডাবল হ্যাটট্রিক যে পুর্ণ হয়েছিলো ১৭ বছর বয়সী বেদীকে দিয়েই। এর বছর পনেরো পরে ১৭ বছর বয়সী আমিন লাখানির ডাবল হ্যাটট্রিকও দেখেছিলেন ক্যারিয়ারে প্রায় শেষ লগ্নে পৌছা বেদী। মাত্র আট ডাবল হ্যাটট্রিকের দুটিরই স্বাক্ষী হিসেবে বিশেন সিং বেদী অবশ্যই স্বগৌরবে গল্প করতে পারেন।
জগিন্দর সিং মানেই হ্যাটট্রিকের গল্প। তাঁর ক্রিকেটের গল্পটা হয়তো সাজানো যেত আরও নানান উপাদানে। ইনজুরি আর তা হতে দিল কই! নিজের প্রথম মৌসুমে পাচ ম্যাচ খেলার পরেই সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের সময় তাঁর পায়ের গোড়ালিতে ইনজুরি হয়। ব্যস, ইতি ঘটে তাঁর ক্রিকেট জীবনের। তবু পাঁচ ম্যাচে ২১ উইকেটের ওই ছোট্ট ক্যারিয়ারের কারণে আজও যে তাকে মনে করতে হয়!
৮.
ইতিহাসে মিচেল স্টার্কের নামের পাশে বহু রেকর্ড সজ্জিত আছে। রেকর্ড ভাঙ্গা গড়ার খেলায় এসবও নিশ্চয়ই ভাঙ্গবে। স্টার্কের রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন, বসাবেন অন্যরা। তবে স্টার্ক এখনও আধুনিক ক্রিকেটের কারো সঙ্গ খুজে পাননি একটি রেকর্ডে। সেটি ডাবল হ্যাটট্রিকের রেকর্ডে। চার দশক আগের ক্রিকেটকে কি আধুনিক বলা যায়? স্টার্কের পুর্বে শেষ ডাবল হ্যাটট্রিকটি করেছিলেন আমিন লাখানি, তা ১৯৭৮ সালে। ডাবল হ্যাটট্রিক পেলে কেমন লাগে, তা বুঝেছিলেন লাখানির আগেও আরও ছয়জন। এরপর ২০১৭ সালে এসে বিরল এ অনুভুতির সঙ্গে পরিচিতি ঘটে মিচেল স্টার্কের।
অস্ট্রেলিয়ার বোলিং অ্যাটাকটা সামলানোর দায়িত্ব ন্যস্ত হয় তাদের উপরই, ঘরোয়া ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলসেরও। জস হ্যাজলউড, প্যাট কামিন্স, নাথান লায়ন শুরুটা করেছেন, খতম করেছেন স্টার্ক- সিডনিতে সে ম্যাচের দুই ইনিংসের চিত্রই প্রায় একইরকম। বাহাতি স্টার্ক ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার দুই ইনিংসেরই সমাপ্তি টেনেছেন তিনজনকে টানা তিন বলে ফিরিয়ে। প্রথম হ্যাটট্রিকের তিন ভুক্তভোগীরা যদি দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকেও থাকতেন তবে অনন্য সুন্দর এক রেকর্ডই হতো। তিনজনকে দিয়ে দুইটা হ্যাটট্রিক এক ম্যাচেই! বিরল রেকর্ডের মাঝে বিরল আরেক রেকর্ড। তা হয়নি সাইমন ম্যাকিনের সৌজন্যে কিংবা ভাগ্যের!
প্রথম ইনিংসে জেসন বেহরেন্ডরফের পরের বলে ডেভিড মুডি। দ্বিতীয় ইনিংসেও হ্যাটট্রিকের প্রথম শিকার তারা দুজন। প্রথম হ্যাটট্রিকের শেষ শিকার ছিলেন সাইমন ম্যাকিন। দ্বিতীয়টাতেও তিনি ছিলেন ক্রিজে, কিন্ত ভাগ্য ভালো হ্যাটট্রিক বলটা খেলতে হয়নি তাকে। ওভারের শেষ দুই বলে দুজনকে ফিরিয়ে যখন ইতিহাস গড়তে পরের ওভারে স্টার্ক বোলিংয়ে তখন নন-স্ট্রাইক প্রান্তে সাইমন ম্যাকিন। নন-স্ট্রাইক প্রান্তে দাড়িয়েই তিনি দেখেছেন ঐতিহাসিক মুহুর্ত। স্টার্কের বলে জনাথন ওয়েলসের ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে যাওয়া বল স্মিথের ক্যাচ নেওয়াতে গড়া ইতিহাস। দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে স্টার্ক ঢুকলেন 'ডাবল হ্যাটট্রিক' ক্লাবে। পুরো ম্যাচে দুই হ্যাটট্রিকের ছয়টি উইকেট বাদে স্টার্কের একমাত্র উইকেটটিও ওই জোনাথন ওয়েলসের। ড্রয়ের দিকে ঝুকতে থাকা সে ম্যাচটা জিতিয়ে ম্যান অব দ্যা ম্যাচও হয়েছেন মিচেল স্টার্ক।
স্টার্কের ওই ডাবল হ্যাটট্রিকের বাস্তব দৃশ্যটা মুলত চারজনকে ঘিরেই। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আছেন স্টিভেন স্মিথ ও পিটার নেভিল। নায়ক স্টার্ক একবার বেহরেন্ডরফকে খতম করেছেন স্টাম্প গুড়িয়ে, আরেকবার সাহায্য নিয়েছেন উইকেটের পেছনে থাকা পিটার নেভিলের। প্রথমবার ডেভিড মুডিকে স্টার্ক প্যাভিলিয়নে পাঠিয়েছেন এলবিডব্লিউ করে, দ্বিতীয়বার বোল্ড করে। প্রথম হ্যাটট্রিক পুরণ করেছেন সাইমন ম্যাকিনের স্টাম্প উড়িয়ে, এরপর ইতিহাসে ঢুকেছেন স্মিথের সাহায্য নিয়ে জোনাথন ওয়েলসকে ফিরিয়ে। কখনো কখনো পার্শ্বচরিত্রই যে হয়ে উঠে দৃশ্যের প্রাণ! স্মিথের হাত থেকে যদি ওই ক্যাচটা ফসকে যেত, তাহলে কি সে ঐতিহাসিক দৃশ্যের সৃষ্টি হতো? হয়তো হতো, আক্ষেপের। আক্ষেপের ইতিহাস কয়জনই-বা আর মনে রাখে!