বেঞ্জামিন পাভার্ড : স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে আরও উঁচুতে
রাশিয়া বিশ্বকাপ। কাজান, ৩০ জুন ২০১৮। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর লিওনেল মেসি ও তারঁ দল আর্জেন্টিনা, মুখোমুখি ফ্রান্সের। ৫৭ মিনিট। ২-১ এ পিছিয়ে ফ্রান্স। মাঠের বা পাশে বাড়ানো বলের জন্য দৌড় দিলেন লুকাস হার্নান্দেজ। মার্কাদো পারলেন না তাকে আটকাতে, হার্নান্দেজ ক্রস করলেন। নিকোলাস অতামেন্দি হেড দিয়ে আর নিকোলাস টালিয়াফিকো ব্যাকহিল ফ্লিকে ঠেকানোর চেস্টায় ব্যর্থ। বল ঘুর্ণি খেয়ে গেল বেঞ্জামিন পাভার্ডের কাছে। পাভার্ড বল শুন্যে থাকতেই ডি বক্সের বাইরে থেকে মারলেন ভলি। খানিক বাদেই যা পরিণত হবে ঐতিহাসিক ভলিতে। বল স্লাইস করে ঢুকে গেল টপ কর্নারে। শুন্যে বল মেরে পাভার্ডও যেন খুশিতে ভাসলেন শুন্যে। ৪-৩ এ ম্যাচ জিতে তখন ফ্রেঞ্চদের হৃদয়ের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে বেঞ্জামিন পাভার্ড, ইতিহাস গড়া সেই ভলির খাতিরেই। আনন্দে আত্মহারা ফ্রেঞ্চরা মুহুর্তেই পাভার্ডের জন্য গানও বানিয়ে ফেললেন।
বেঞ্জামিন পাভার্ড, বেঞ্জামিন পাভার্ড
আই ডোন্ট থিঙ্ক ইউ নো হিম
হি কেইম ফ্রম নাও হোয়ার
ওয়ান হেল অফ অ্যা শট
উই হেভ গট বেঞ্জামিন পাভার্ড
****
বাবা ছিলেন ফুটবলার, খেলেছেন ফ্রান্সের তৃতীয় বিভাগ লিগে। বাবা ফ্রেডেরিক পাভার্ডের নেশায় ধরেছিলো ছেলেকেও। বেঞ্জামিন পাভার্ড ফুটবল শুরু করলেন নিজ শহর ইউএস জেমন্টের হয়েই। এভাবেই চলছিলো পাভার্ডের, ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত খেললেন জেমন্টের হয়ে। কিন্ত পাভার্ডের স্বপ্ন পুরণের জন্য দরকার উপযুক্ত কারখানা, যেখানে তিনি নিজেকে গড়ে তুলবেন। বাড়ি থেকে অনেকখানি দূরে খোজ পাওয়া গেল ফুটবলার তৈরির এমনই এক কারখানার। লিগ ওয়ানের দল লিলির একাডেমিতে মাত্র ৯ বছর বয়সেই যাওয়া-আসা শুরু করলেন বেঞ্জামিন জ্যাকস মার্সেল পাভার্ড।
ছেলেকে একাডেমিতে দেয়া, প্রশিক্ষণ শেষে আবার নিয়ে আসা- সপ্তাহে চারবার ফ্রেডেরিক পাভার্ড ও নাথালি পাভার্ডকে করতে হতো এ কাজ। প্রতিদিন ছেলের জন্যে ভ্রমণ করতেন প্রায় ৬০ মাইল দুরত্ব।ছেলের জন্য বাবা-মা কতই না ত্যাগ করেন! পাভার্ড দম্পতিও করতে থাকলেন। একমাত্র ছেলের জন্যও অবশ্যই কঠিন ছিল বাড়ি থেকে এত দূরে ট্রেনিংয়ের জন্য যাওয়া-আসা করা। পুরো পরিবারের ত্যাগের ফল- ২০১৫ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লিগে বেঞ্জামিন পাভার্ডের অভিষেক।
তৎকালীন লিলি কোচ ফ্রেডেরিক আন্তোনেত্তির পরিকল্পনায় পাভার্ডের জায়গা হতো খুব কম। প্রথম দলে ছিলেন না নিয়মিত। লিলিতে কাটানো দুই মৌসুমে লীগের প্রায় ৭২ শতাংশ ম্যাচ কাটাতে হয়েছে বেঞ্চে বসে। ২০১৪-১৫ ও পরের মৌসুম মিলে লিগ ওয়ানের ৭৬ ম্যাচে পাভার্ড খেলতে পারেন মোটে ২৫ ম্যাচে। সুযোগের সন্ধানে আগের মৌসুমে প্রথম বিভাগ থেকে অবনমন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে আসা ভিএফবি স্টুটগার্টে যোগদানের ঝুকি নিতেও তাই পিছপা হন না এই ফ্রেঞ্চ ফুটবলার।
****
হারশাদ মেহতার 'রিস্ক হে তো ইশক হেয়' এমন ডায়লগ শুনে পাভার্ডের অনুপ্রাণিত হওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠে না। চ্যাম্পিয়নরা চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন। পাভার্ডও তো চ্যাম্পিয়নই! ২০১৬ সালের আগস্টে সেই অবনমিত স্টুটগার্টের সাথে ৪ বছরের চুক্তির সঙ্গে যেন নতুন চ্যালেঞ্জও নিলেন পাভার্ড।
স্টুটগার্টে এসে পাভার্ডের সাথে পালাবদলের শুরু হলো স্টুটগার্টে্রও। ২০১৪-১৫ সালের আগের মৌসুমে বুন্দেসলিগায় ১৭তম হওয়া স্টুটগার্ট এবার বুন্দেসলিগা-টুতে হয় প্রথম। আগের মৌসুমে ৭৫ গোল খাওয়া স্টুটগার্ট এ মৌসুমে গোল হজম করে মাত্র ৩৭টি। রক্ষণভাগের গুরুত্বপুর্ণ অংশ পাভার্ডের এতে আছে যথেষ্ট অবদান। চ্যাম্পিয়ন হয়ে ভিএফবি স্টুটগার্ট ফিরে বুন্দেসলিগায়।
****
৬ নভেম্বর ২০১৭। অন্য সব দিনের মতো হয়েও পাভার্ডের জন্য একটু অন্যরকম দিন। জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস শেষে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন পাভার্ড। এদিকে একের পর এক কল আসছে তাঁর ফোনে। কিন্ত পাভার্ডের সেদিকে খেয়াল নেই। এরপর খেয়াল করতে পেরে কল ব্যাক করলেন। অপরপাশ থেকে খুশির কান্না মিশ্রিত গলায় শুনতে পেলেন- তিনি ফ্রান্স জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। তিনিও আর নিজেকে আটকাতে না পেরে কাদলেন খুশির কান্না। সকল ত্যাগের ফল পাওয়ার কান্না। এর প্রায় ৬ মাস পরে আবার ফিরে এল এরকমই একটা দিন। সেদিন তিনি শুনতে পেলেন বিশ্বকাপের স্কোয়াডে ডাক পাওয়ার খবর।
বিশ্বকাপে পাভার্ডের অভিষেক হলো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফ্রান্সের প্রথম ম্যাচেই। গ্রুপ পর্ব শেষ হলো। এরপর শেষ ষোলোর লড়াইয়ে সেই শট, সেই গোল। গোল অব দ্য টুর্নামেন্ট। সে গোলের পর পাভার্ড বলেছিলেন- এ ধরনের ভলি তিনি খুব পছন্দ করেন। কিন্ত এটা চেষ্টা করেন খুব কমই। সেই চেষ্টা তাকে ঘুমুতে দেয়নি এক পলকও। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৪-৩ এ জয়ের পর যে রাতে চোখ বুঝতেই পারেননি পাভার্ড!
‘এটি আমি পরে বুঝতে পেরেছিলামঃ এই গোল, এই শট, সারাজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। ২০ বছর পরে যখন আপনি ইউটিউবে ‘পাভার্ড’ লিখে সার্চ করবেন তখন এটি ‘আর্জেন্টিনার বিপক্ষে এই গোল’ নিয়ে আসবে।’
এই গোল আমাদের সঙ্গেও থেকে যাবে সারাজীবন, ফুটবলের সঙ্গে থেকে যাবে আজীবন।
****
পাভার্ডের আগে সর্বশেষ ফ্রান্সের কোন ডিফেন্ডার বিশ্বকাপে গোল করেন ১৯৯৮ সালে। তা ক্রোয়েটিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে সেটি করেছিলেন লিলিয়ান থুরাম। লিলিয়াম থুরাম তাঁর ক্লাবের হয়ে সেন্ট্রাল ব্যাক হিসেবে এবং জাতীয় দলে রাইট ব্যাক হিসেবে খেলেছেন। থুরামের মতো ভিন্ন পজিশনে খেলার ক্ষমতা থাকার কারণে আজ পাভার্ডও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
বেঞ্জামিন পাভার্ড সেন্টার ব্যাকে খেলতে পারেন। এছাড়াও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড ও রাইট উইংয়েও খেলার ক্ষমতা আছে তাঁর। তবে দিদিয়ের দেশমের রাইট ব্যাক হিসেবে প্রথম পছন্দ হওয়ার সুবাদেই বিশ্বমঞ্চে সুযোগ পেয়েছিলেন পাভার্ড। সেই পজিশনে মানিয়ে নিতে পারার কারণেই তিনি আজ বিশ্বকাপজয়ী। তবে পজিশন যেটাই হোক না কেন, রক্ষণভাগ সামলানোই তো তাঁর মুল কাজ। এজন্য পজিশন বদল তাঁর কাছেও তেমন গুরুত্বপুর্ণ না। পাভার্ড বলেন, ‘একজন ডিফেন্ডারকে অবশ্যই প্রথমে ভালোভাবে ডিফেন্ড করতে হবে। অবশ্য, লেফট ব্যাক অথবা রাইট ব্যাক হিসেবে আমাকে বেশি আক্রমণ করতে হবে, তবে আমার জন্যে, এটা একই।'
আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর একে একে উরুগুয়ে, বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লেস ব্লুজরা। ২ বছর আগে দর্শক হয়ে ফ্রান্সের খেলা দেখা পাভার্ড ফ্রান্সের হয়ে জিতলেন বিশ্বকাপ। বিশ্বসেরা লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরও ভাগ্যে জুটেনি যে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ জয়ের গুরত্ব তুলে ধরতে পাভার্ডও মনে করিয়ে দিলেন সে কথা, ‘এটা আমার জীবনের সেরা মুহুর্ত ছিল। এটা সবাই জিততে পারেনা। এমনকি রোনালদো এবং মেসির মতো সেরা খেলোয়াড়েরাও কখনও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। এটি ব্যতিক্রমী। এই আমি, ২২ বছর বয়সী এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। চমৎকার।’
****
ব্রাজিলের দুঙ্গা ও ওয়েস্ট জার্মানির গুইডো বুচওয়াল্ডের পর স্টুটগার্টের তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার বেঞ্জামিন পাভার্ড। রাশিয়ায় স্বপ্নীল সময় পার করে ক্লাবে ফিরলেন পাভার্ড। নামের পাশে ‘বিশ্বকাপজয়ী’ ট্যাগ লাগলেও তাঁর মাঝে ছিল না কোন পরিবর্তনের ছাপ। তৎকালীন স্টুটগার্ট বস তাইফুন কর্কুটও তারঁ মাঝে অহংকারের ছিটেফোটাও লক্ষ্য করেননি, 'আমি ওকে আগে শুরুতে যেভাবে পেয়েছিলাম এখনও ওভাবেই পেয়েছি। সে বাড়িতে (স্টুটগার্টে) ফিরেছে।’
সে বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারলেন না পাভার্ড। বিশ্বজয়ের পর ইউরোপ জায়ান্ট ক্লাবগুলোর নজরে তিনি। অবশ্য ২০১৭-১৮ সিজনে বুন্দেসলিগায় তাঁর পারফরম্যান্সেও তিনি ছিলেন নজরে। পুরো বুন্দেসলিগায় চারজন খেলোয়াড় ৩৪ ম্যাচের সবকটি ম্যাচে খেলে এক সেকেন্ডও বাদ দেননি। এদের মধ্যে একজন বেঞ্জামিন পাভার্ডও। ৩৪ ম্যাচে ৩০৬০ মিনিটের সবসময়েই তিনি ছিলেন মাঠে।
২০১৮ সালের জানুয়ারীতে টাইফুন করকুট কোচ হিসেবে স্টুটগার্টে যোগ দেয়ার পরে পাভার্ড খেলেছিলেন সেন্টার ব্যাক হয়ে। একসময় স্টুটগার্ট ছিল রেলিগেশনের শঙ্কায়। সেই স্টুটগার্ট পরে সর্বশেষ ১৪ ম্যাচে মাত্র ১০ গোল হজম করে লীগ শেষ করে ৭ম স্থানে। একটুর জন্য, এক পজিশনে পেছনে পড়ে ইউরোপা লীগ খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয়।
স্টুটগার্টের হয়ে প্রথম দুই মৌসুম ভালো কাটালেও তৃতীয় মৌসুম বেশ ভালো যায়নি পাভার্ডের। ২০১৮-১৯ সালে লিগ টেবিলে ১৬তম স্থানে লিগ শেষ করে রেলিগেটেড হয়ে পুনরায় বুন্দেসলিগা-২ এ যায় স্টুটগার্ট। এবং গিয়ে ২য় স্থান অর্জন করে স্টুটগার্ট। তবে সেবার পাভার্ড ছিলেন অন্য ঠিকানায়, মার্সিডিজ-বেঞ্জ অ্যারেনায়। পাঁচ বছরের চুক্তিতে ওই মৌসুমের আগেই ৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে পাভার্ড যান বায়ার্ন মিউনিখে। স্টুটগার্টে গিয়ে তারঁ জীবন পেয়েছে নতুন পথ, সে পথের যাত্রী হয়ে বায়ার্নে গিয়ে তারঁ জীবন হয়েছে আরও সুন্দর।
****
বিশ্বকাপ জয়ের পর পাভার্ড বলেছিলেন, ‘আমাকে জিততে হবে, জিততে হবে এবং আবার জিততে হবে। দুই বছরের মাঝে উয়েফা ইউরো ২০২০ আছে, যেটা আমি জিততে চাই। আমি এই সব কিছু চাইঃ আরও বিশ্বকাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, যত ট্রফি সম্ভব। আমি একটা বিশাল অর্জনের তালিকা নিয়ে শেষ করতে চাই। আমি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছি, এখন সময় আবারো যুদ্ধে নামার।’
ওই চ্যাম্পিয়ন্স লীগ যে পাভার্ড জিতেছিলেন সেটা তো আর বলার প্রয়োজন নেই। এখন অবধি সম্ভাব্য সবকিছুই জেতা হয়ে গেছে তারঁ! বিশ্বকাপের পর বায়ার্নের হয়ে এবার জিতেছেন হেক্সা, যে কীর্তি এর আগে ছিল শুধু বার্সার। আর ফাইনালের মঞ্চে গোল করে আরও একবার আলো তারঁ ওপর।