৪২ বছর বয়সে নয়ন দোশীর আইপিএল স্বপ্ন
টি-টোয়েন্টির আগমনে স্পিন বোলিংয়ের অস্তিত্ব সংকটের যে আশঙ্কা দেখা হয়েছিল কালের বিবর্তনে তা-ই এখন অস্তিত্ব হারিয়েছে। এতে আছে বহুজনের অবদান। তবে প্রথমে সবাইকে ভুল প্রমাণ করার কাজটা করেছিলেন নয়ন দোশীই। টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে ৫০ উইকেট নেয়ার কীর্তি বাহাতি নয়ন দোশীর। ২৯ ম্যাচে দোশি তা নিয়েছিলেন বামহাতে স্পিন করেই! তা আইপিএলের জন্মের প্রায় মাস দশেক আগে।
তারপরে আরও ১৬ জন পেসার ৫০ উইকেটের এ মাইলফলক অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে দোশীর ২৩ মাস পরে যা অর্জন করেছিলেন মুত্তিয়া মুরালীধরন। টি-টোয়েন্টির রমরমা এ যুগে তবু আপনার খুব বেশি দেখার সুযোগ হয়নি এই নয়ন দোশীকে।
****
বয়স কি শুধুই সংখ্যা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই 'না'। সংখ্যায় বয়সের সাথে সাথে মনের সংখ্যা(কাল্পনিক) বৃদ্ধি না পেলেও, তরুণ সময় পার করা বয়সে মন তরুণ থাকলেও একটা সময় সেই তরুণ মনের আবাসস্থল যে শরীর, তা আর মনের সাথে সায় দেয় না। মন দুরন্ত হলেও শরীর তাতে সায় দেয় না, তা বিশেষ করে ক্রিকেটেই। শুরুতে করা প্রশ্নের উত্তর 'না' এর পরিধি আরও প্রসস্থ হয় ক্রিকেটে এসেই। মনের সাথে এখানে শরীরেরও যে খুব বেশি সখ্যতার প্রয়োজন পড়ে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে বয়স কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। যেমনটা পারেনি নয়ন দোশীর বেলায়।
শেষ স্বীকৃত ক্রিকেট খেলেছেন বছর আটেক আগে। নির্বাসন থেকে ফিরে এরপর আবার ক্রিকেটে ফিরেছেন গেল বছরের জানুয়ারীতে। মনের বায়নার কাছেই হার মেনে এ ফেরা! মন যে তার আসক্ত ক্রিকেটে। তাই ৪২ বছর বয়সী নয়ন দোশী বিশ্বের সেরা ক্রিকেট লীগে খেলার স্বপ্ন দেখেন। দোশীর নেই কোন এজেন্ট। তাই আইপিএলের নিলামে নিবন্ধনের জন্য নিজেই ফর্ম পুরণ করে গিয়ে জমা দিয়েছিলেন ইসিবিতে। তা করতে পেরেছিলেন বাবার সমর্থন পেয়েই। বাবা তারঁ ভারত জাতীয় দলে খেলা স্পিনার দিলীপ দোশী, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যার শিকার ৮৯৮ উইকেট। যার মধ্যে ১১৪টি উইকেট ৩৩ আন্তর্জাতিক টেস্টে।
ছেলের মতো দিলীপ দোশীও বাহাতি স্পিনার। ছেলের কাছে তিনিই মহান বাহাতি স্পিনার! বাবা যখন তারঁ বোলিং দেখে পাশ মার্ক দিয়েছেন তখন দোশি নিজ সামর্থ্যে বিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। এরপর বিশ্বের ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো থেকে প্রায় হাজারখানেক নিবন্ধিত ক্রিকেটারদের থেকে ২৯২ জনের বাছাইকৃত তালিকায় তার জায়গা পাওয়া বলে দেয়- ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও তারঁ সামর্থ্যে বিশ্বাস রাখে। ১১১৪ জনের থেকে পছন্দ অনুযায়ী বাছাইয়ের কাজটা যে করে ফ্র্যাঞ্চাইজিরাই!
নয়ন দোশীদের ক্ষেত্রেই শুধু বয়স মাত্রই একটি সংখ্যা। দোশীর দর্শনেও তাই পরিষ্কার, 'বয়স তাদের জন্যই বাধা যারা চায় বয়স তাদের পথে বাধা হিসেবে আসুক'। এবার সুযোগ পেলে আইপিএলের মঞ্চে দোশীর প্রমাণ করে বিশ্বকে জানানোর পালা- বয়স সংখ্যা বৈকি অন্য কিছুই নয়!
****
বিদেশী ক্রিকেটাররা এসে খেলতে পারবেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে। বিসিসিআই যখন এমন ঘোষণা দিল নয়ন দোশী চলে এলেন পিতার মাতৃভুমিতে। ৭ বছর বয়সেই ক্রিকেটের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরপর ক্রিকেট দীক্ষা-শিক্ষা সবই হয়েছে ইংল্যান্ডে। কাউন্টি ক্রিকেট শুরু করেছেন সারের হয়ে। তারপর সে ঘোষণা আসাতেই তিনি যোগ দিলেন স্বরাষ্ট্র দলে।
ক্রিকেটের জন্মদাতা ইংল্যান্ড জন্ম দিল নতুন আরেক ফরম্যাটের। ইংল্যান্ডে শুরু হলো ২০ ওভারের নতুন এক সংস্করণ। শুরুতে গুরুত্ব না পেলেও দর্শক চাহিদায় তা একসময় গুরুত্ব পেতে লাগলো৷ এই টি-টোয়েন্টির বর্তমান অবস্থান না বললেও চলছে! এই টি-টোয়েন্টিতে যাদের বিপদ দেখা হয়েছিল সেই স্পিনারদেরই আজ ভাবা হয় দলের মুল অস্ত্র। তা একসময় দেখিয়েছিল সারে-ই, নয়ন দোশীকে অস্ত্র বানিয়ে।
২০১০ সালে সেই দোশীকে দলে ভেড়াল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। সারে সতীর্থ অনিল কুম্বলের অধীনে সেবার তিনি খেলতে পারলেন মাত্র এক ম্যাচ। সে ম্যাচে বোলিংয়ে ছিলেন উজ্জ্বল। ৪ ওভার বল করে, মাত্র ১৭ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ১টি উইকেট। পরেরবার গেলেন আরেক কিংবদন্তী লেগ স্পিনারের দল রাজস্থান রয়্যালসে। শেন ওয়ার্নের দলে তিনি খেললেন তিনটি ম্যাচ। তিন ম্যাচে করতে পারলেন মাত্র ৫.২ ওভার। সেখানে ১১.৬৩ ইকোনমিতে ৬২ রান দিয়ে নিতে পেরেছিলেন মাত্র ১টি উইকেট।
****
২০১৪ সালে এরপর ব্যক্তিগত কারণ বাধা হয়ে দাড়িয়েছে নয়ন দোশীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। ৫২ টি-টোয়েন্টিতে ১৬.৮০ গড়ে ৬৮ উইকেটে বিরতিতে গেছে তারঁ ক্যারিয়ার। সে ক্যারিয়ারে তিনি প্রতি উইকেট নিয়েছেন প্রায় ১৫(১৪.৮) বলে, ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৬.৮০। পাচঁ বছর পর দোশী ক্রিকেটে ফিরেছেন ২০২০ সালের জানুয়ারীতে। মিডলসেক্স প্রিমিয়ার লীগে খেলে ৮৫ ওভার বল করে ১৪.৫৩ গড়ে সেখানে উইকেট নিয়েছেন ১৭টি।
শেষ যেবার নয়ন দোশী আইপিএল খেলেন তখন তিনি ছিলেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটার। এবার তিনি নিলামে বিদেশী ক্রিকেটার হিসেবে। জেসন রয়, লিয়াম লিভিংস্টোনদের সাথে নিবন্ধিত ১৭ জন ইংলিশ ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিও একজন। শেষ যেবার দোশী ব্যাঙ্গালুরুতে খেলেন তখন তার জার্সি নাম্বার ৪২। এবার সে নাম্বারের বয়সে এসে আবার কী পরতে পারবেন ৪২ নাম্বারের জার্সি? উত্তর নিহিত ১৮ ফেব্রুয়ারির নিলামেই!
১৮ ফেব্রুয়ারিতে যা হলোঃ ফ্র্যাঞ্চাইজিদের আগ্রহের কারণে নিলামের জন্য বাছাইকৃতদের তালিকায় নয়ন দোশীকে রাখা হয়েছিল, পরে নিলামের দিনে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজিদের অনাগ্রহে তাকে আর নিলামেই তোলা হয়নি। তাই তিনি থেকেছেন অবিক্রিত। তবু ৪২ বছর বয়সে এসে হাজারজনের মধ্যে সেরা শ তিনেকের মধ্যে জায়গা পাওয়াই-বা কম কিসে!