বাংলাদেশের ক্রিকেটের 'ব্যাড-বয়' বলছি.....
'' বিকেএসপিতে সবাই ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়। আমি হয়েছিলাম ক্লাস এইটে। নড়াইলের এক মাসের এক ক্যাম্প আমাকে তুলে এনেছিল মাগুরার শহরতলী থেকে একেবারে এদেশের শীর্ষ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাও আবার ক্রিকেটে। পরিবার ফুটবলের, আমি অবশ্য দুটোই খেলতাম। বাবা ফুটবল খেলতেন, এক ভাই (কাজিন) তো ন্যাশনালেই খেলেছিলেন। বিকেএসপির বাপ্পী স্যার (আশরাফুল ইসলাম) আব্বাকে বুঝিয়েছিলেন, আমার নাকি ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ ভাল, এইসব। পড়াশুনার কোন ক্ষতি হবে না, এই শর্তে আব্বা রাজি হয়েছিলেন বিকেএসপিতে আসতে দিতে। অনূর্ধ্ব-১৫ তে একবার এক সিনিয়র খেলতে পারলেন না, তার জায়গায় নেমে ৫২ বলে একটা সেঞ্চুরি করেছিলাম।
এরপর কেমন করে জানি নিজেকে আবিষ্কার করলাম জাতীয় দলে। নাহ, খুব সহজ আর মসৃণ ছিলনা এই যাত্রা, তবে সে লম্বা ইতিহাস। মাগুরার সেই ফয়সাল হয়ে উঠলাম সাকিব আল হাসান, বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন আমার সবসময়ের।
সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। কিসব বোর্ড-খেলোয়াড় ঝামেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামলো কোনমতে একটা দল নিয়ে, মুহূর্তেই সব চাপ এসে হাজির আমাদের দিকে। ম্যাশ ভাই (মাশরাফি বিন মর্তুজা) চোট পেলেন, দলের নেতৃত্ব এসে পড়ল আমার কাঁধে। সে সফরের পর তো পুরো মেয়াদেই।
এরপর থেকেই শুরু আমার আরেক কাহিনী, যে কারণেই আমার ‘ব্যাড বয়’ তকমাটা ফিরে ফিরে আসে, যে কারণে আসে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, কোনো দেশের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট খেলতে।
সেবার নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চতুর্থ ওয়ানডে। ওই যে যেবার তাদেরকে প্রথম সব ম্যাচে হারালাম। প্রচন্ড গরম। ৯২ রানে ব্যাট করছি। এক ভদ্রলোক তখন সাইটস্ক্রীনের আশে পাশে ঘুরাঘুরি করছেন সাদা শার্ট পরে। আম্পায়ার আলীম দার, বোলার টাফি, এইদিক থেকে আমি, সবাই সরে যেতে বলছি তাঁকে। ওপরে ইন্টারন্যাশনাল গ্যালারীর ছাতাগুলোও বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু উনার ভ্রুক্ষেপই নেই! কী আর করার, নিজে গিয়ে ভদ্রলোককে দেখিয়ে দিয়ে আসতে হল, কোনদিকে সরে যেতে হবে! ম্যাচ রেফারী আমাকে সতর্ক করলেন, বিসিবি অবশ্য তখন কিছু বলেনি।
এরপর বিশ্বকাপের আগে ম্যাশ ভাই ‘ফিট’ হতে পারলেন না, অধিনায়কত্ব আমাকেই করতে হল। অনেকেই বললেন, উনার দলে না থাকার পেছনে আমার ‘হাত’ আছে। অথচ তিনি নিজেই পরে বলেছেন, আমাদের সম্পর্কটা ভাইয়ের মতো!
তবে সেই অধিনায়কত্ব দেয়ার পর আমি বলেছিলাম, যদি দিতেই চান, পাকাপাকিভাবে তাহলে দিয়ে দেন, নাহলে দেখেন অন্য কাউকে। তারপর আমরা ৫৮ তে অলআউট হলাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। সাবেক ক্রিকেটাররা আমাদের ধুয়ে দিলেন একেবারে, পত্রিকায়-টিভিতে। আমার মনে হল, আচ্ছা,উনাদের আমলে যেন কী ছিল? পত্রিকাতে বললাম এই কথাটা, উঠে গেল ঝড়, আমি সিনিয়রদের সম্মান দেই না, এদেশের ক্রিকেটের অতীতে আমার কোন শ্রদ্ধা বা সম্মান নেই! ঐ ম্যাচেরই পরে কিছু ‘ভিআইপি’ দর্শক আবার বললেন, আমি নাকি তাদের দুয়ো শুনে প্রতিক্রিয়াটা একটু ‘বেশী’ই দেখিয়েছি! বিসিবি আমাকে আর দলকে ‘চুপটি’ করে থাকতে বললো, আমরা চট্টগ্রামে গিয়ে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলাম।
এরপর আবার দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে অলআউট হলাম ৭৮ রানে। আমাদের পয়েন্ট সমান হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। ৫৮ আর ৭৮ এর ‘কলঙ্ক’ নিয়ে, মানে রানরেটে পিছিয়ে থেকে ঘরের মাটির বিশ্বকাপ থেকে আমরা বিদায় নিলাম।
এরপর জিম্বাবুয়ে সফর। জিম্বাবুয়ের কাছে টেস্ট হারলাম, ওয়ানডে সিরিজ হারলাম। সব ‘ব্যর্থতার’ দায় এসে পড়ল আমার আর তামিমের ওপর, আমাদের বরখাস্ত করা হল। ঠিক কী কারণে, তা অবশ্য এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তবে আমি আবার দলের ‘সাধারণ’ একজন হয়ে গেলাম, মুশফিক ভাই অধিনায়ক হলেন। ২০১২ এর এশিয়া কাপ গেল, কী হয়েছিল মনে আছে আপনাদের? যাক সে কথা।
এরপর এল ২০১৪, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আউট হয়ে এসে ড্রেসিংরুমে বসেছি, পাশে সুহাস(শফিউল ইসলাম)। এরপর দেখলাম ক্যামেরা শুধুই আমাকে দেখায়, একটু পরপর আমাকে দেখায়। মেজাজ একটু খারাপই হল, উল্টা পালটা অঙ্গভঙ্গী করলাম, তা আবার ক্যামেরায় উঠলো, দেখলো সারা বিশ্ব। বিসিবি আমাকে নিষিদ্ধ করল তিন ওয়ানডে, এশিয়া কাপের প্রথম দুই ম্যাচ খেলতে পারলামনা। এরপর ভারতের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে আবার কিছু ‘ভিআইপি’ দর্শক আমার স্ত্রীকে উত্যক্ত করল, আমি সহ্য করতে পারলাম না। কিছু নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়ে শাসিয়ে এলাম তাদেরকে। বিসিবি প্রেসিডেন্ট তখন বলেছিলেন, আমি নাকি আইপিএল সিপিএল-এ গেলে এরকম ড্রেসিং রুম ছেড়ে যাই না, এদেশে কেন এরকম করি? কিন্তু সেসব দেশে তো আমার স্ত্রীর সাথে এমন ঘটনা ঘটেনা! এর আগে আবার এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিলাম, ক্রিকেটে এখন ‘পাওয়ার’ যে কাজে লাগে অনেক সেটা বোঝাতে কিছু উদাহরণ দিলাম। হ্যাঁ, দায় যে সবার, দর্শকদের, সাংবাদিকদের সেটা বলেছিলাম, একটু খোলাখুলিভাবেই। আবার ঝড় উঠল, সোশ্যাল মিডিয়ায়!
এরপর এল সবচেয়ে বড় ঝড়টা। সিপিএল খেলতে যাব, বিসিবি সিইওকে চিঠি দিলাম ১ তারিখে। আকরাম (বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আকরাম খান) ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ঢাকায় এসে তিনি এনওসি সাইন করবেন, আমি যাতে চলে যাই আর ভাল খেলি। এর মাঝেই বিসিবিতে রব উঠে গেল,সাকিব কাকে বলে গেল? কোচও নাকি আমাকে শুরু থেকেই ক্যাম্পে চান, আমি যাতে তখনই ফেরত আসি। কোচকে ফোন করলাম একটা, কোচের সাথে তো কথা বলিই কতো রকমের! সে কথাই নাকি কোচ আবার বোর্ড সভাপতিকে একটা মেইল করে বলেছিলেন। আমি নাকি বলেছি, দরকার পড়লে আমি দেশের হয়ে আর খেলবনা। সেই মেইল আবার ফাঁস হয়ে গেল।
আমি ফিরে আসলাম, বোর্ড সভাপতির সাথে সঙ্গে দেখা করলাম, ক্যাম্পে যোগ দিলাম। বিসিবি এরপর আমাকে নিষিদ্ধ করল, বিসিবি অবশ্য আমার নিষেধাজ্ঞার খবরটা আমাকেই দেয়নি শুরুতে!
সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে বিসিবি। আমি আবার খেলেছি বাইরের লিগে। আবার আউট হওয়ার পর হতাশ হয়ে স্ট্যাম্পে ব্যাট দিয়ে আঘাত করতে গিয়ে ম্যাচ রেফারির ‘ভর্ৎসনা’ শুনেছি।
আজ জন্মদিনে একটা উপহার পেতে পারতাম, দল জিতলে। জেতা ম্যাচটা আমরা মুঠো থেকে ফেলে দিলাম। আপনাদের খারাপ লেগেছে? লাগবেই। আমি জানি। খারাপ তো আমাদেরও লাগে! কিন্তু কী আর করার! আমি বা আমরা যে পেশাদার! সব ভুলে তাই আবার মাঠে নামবো।
আবার কিছু একটা করে বসবো, হায় হায় উঠবে। আমি ফিরে আসবো! তবে একটা কথা, এই যে আমাকে নিয়ে এতো সমালোচনা হয়, আবার খেলতে পারলে প্রশংসার বান বয়ে যায়, এটা কেন! আমি কি তবে পড়ে গেলাম শেন ওয়ার্ন, শোয়েব আখতার, মোহাম্মদ আসিফ, জেসি রাইডারদের মতো ক্রিকেটের 'ব্যাড-বয়'দের কাতারে? কী করেছিলেন তারা, জানেন তো? ড্রাগ-স্মোক-নারী কেলেঙ্কারী, মাতলামো, মারামারি, পিচের ব্যাপারে বাইরে বলা, আরও কত কী!আর আমি? সে অবশ্য আপনারাই ভাল জানেন, নাকি?
তবে তারাও ‘ব্যাড-বয়’, আমিও ‘ব্যাড-বয়’!
আমি শুধু এটুকু জানি, ক্রিকেট আমার কাছে শুধু একটা খেলা নয়, আমার পেশা নয়, আমার স্বপ্ন। দলের কেউ ম্যাচসেরা হলে আমি খুশী হই, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, ও পারলে আমি কেন পারবনা! আমি কেন পারলাম না? এটা আমার হিংসা নয়, যারা এটাকে আমার হিংসা হিসেবে নিবেন তারা আমাকে বা এই সাকিব অথবা ফয়সালকে চেনেননি!
যখন চারপাশটা প্রতিকূল হয়ে ওঠে, তখন তো কষ্ট হয়ই একটু। তবে একটা কথা মনে পড়ে যায়, বিকেএসপির এক স্যার তার ছেলের নাম রেখেছেন সাকিব। আর একটা স্বপ্ন দেখি ঘুরেফিরে।
একটা ড্রেসিং রুম, সেখানে আমার সতীর্থরা কেন জানি আমাকে ঘিরে গাইছে একটা গান, “আমরা করব জয়......”।
আমি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘ব্যাড’ বয়, স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি''
*পাদটীকাঃ লেখাটা সাকিব আল হাসান লিখেননি, কাজেই লেখাটা যে কাল্পনিক তা তো বুঝতেই পারছেন। তবে হ্যাঁ, কাল্পনিক হলেও, সাকিব আল হাসান সম্পর্কিত তথ্যগুলো বাস্তব। এবং সত্যিই সাকিব আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন। সেটা আপনি আমি সবাই জানি।