ক্লাবের কাছ থেকে সমর্থন বা আস্থা পাইনি: জিদান
ক্লাব ছাড়ার পর মাদ্রিদদিস্তাদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন জিনেদিন জিদান।
প্রিয় রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তরা
২০ বছর আগে যখন প্রথম রিয়ালে এসেছিলাম, জার্সিটা গায়ে চড়িয়েছিলাম, তখন থেকেই ভালোবাসা পেয়েছি। আমার সবসময় মনে হয়েছে আমাদের মধ্যে বিশেষ কিছু একটা আছে। সর্বকালের সেরা ক্লাবের হয়ে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে আমি পেয়েছি দারুণ সম্মান। তবে সবকিছুর পর আমি মাদ্রিদের একজন ভক্ত। সেজন্যই আমি চিঠিটা লিখছি, আপনাদের বিদায় বলার জন্য ও আমার সিদ্ধান্ত আপনাদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য।
২০১৯ সালে আমি যখন আট মাসের বিরতির পর আবার মাদ্রিদে ফেরার প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম, তখন শুধু ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ চেয়েছিলেন বলে নয়, আপনারা চেয়েছিলেন বলেও আমি ফিরেছিলাম। যখন আমি প্রথম আপনাদের সাথে দেখা করলাম আপনাদের সমর্থন আমি পেয়েছিলাম, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনারা আবার আমাকে চাইছেন। রিয়ালের মূল্যবোধটা আমি নিজে ধারণ করি। এই ক্লাবটা তার মেম্বার, ভক্ত সমর্থক ও পুরো বিশ্বের। সেজন্য এই চেতনাটা নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করেছি, দৃষ্টান্ত হতে চেয়েছি। মাদ্রিদে ২০ বছর থাকা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার। ২০০১ থেকেই ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ যেভাবে আমার পাশে ছিলেন, কিছু লোকের বিরুদ্ধিতার পরেও আমাকে যেভাবে এনেছেন সেটা অনেক বড় ব্যাপার। সেজন্য আমি সবসময় বলি, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
এখন আমি ঠিক করেছি চলে যাওয়ার কারণটা আমি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করব। আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু হুট করে নয়, বা কোচিং করাতে করাতে ক্লান্ত সেজন্যও নয়। ২০১৮ সালের মেরে আড়াই বছর পর আমি যখন আমি চলে গিয়েছিলাম, তখন অনেকগুলো ট্রফি হয়ে গিয়েছিল আমার। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল ক্লাবের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নতুন একটা ভাবনা, একটা নির্দেশনা দরকার। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম। আমি চলে যাচ্ছি, কারণ আমার মনে হয়েছে যে আস্থা আমার দরকার সেটা ক্লাব আমার ওপর রাখতে পারছে না। আমার মনে হয়েছে মাঝারি বা দীর্ঘ মেয়াদে চলার জন্য যে সমর্থন দরকার সেটাও আমি ক্লাব থেকে পাচ্ছি না। আমি ফুটবল বুঝি, আমি জানি রিয়ালের মতো ক্লাব কী চায়। আমি জানি যখন আপনি জিতবেন না আপনাকে চলে যেতে হবে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা অনেক সময় ভুলে যাওয়া হয়, আমি কীভাবে দলকে তৈরি করেছি সেটা ভুলে যাওয়া, খেলোয়াড় ও ক্লাবের আরও প্রায় ১৫০ লোকের সঙ্গে আমি যে সম্পর্ক তৈরি করেছি সেটা ভুলে যাওয়া হয়। আমি জয়ের জন্য জন্মেছি এবং এখানে ট্রফি জিততে এসেছি। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অনুভুতি, জীবন; এসব অনেক সময় বিবেচনায় নেওয়া হয় না বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু একটা গ্রেট ক্লাবের জন্য এই ব্যাপারটা বোঝা জরুরি। এমনকি এটা নিয়ে কথা বলার জন্য আমাকে কথাও শুনতে হয়েছে।
আমরা সবাই মিলে যেটা অর্জন করেছি সেজন্য কিছুটা সম্মান আমার প্রাপ্য। আমি আশা করেছিলাম, ক্লাব ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গত কয়েক মাসে অন্য সব কোচদের চেয়ে আলাদা হবে। আমি কোনো সুবিধা আশা করিনি। আমি জানি এই সময়ে বড় ক্লাবের ডাগআউটে কোচদের আয়ু দুই মৌসুমের মতো। এর চেয়ে বেশি সময় থাকতে হলে মানবিক সম্পর্কটা দরকার। টাকা, ক্ষমতা বা অন্য যে কোনো কিছুর চেয়েও এটা বেশি জরুরি। এসবের যত্ন নিতে হয়, লালন করতে হয়। সেজন্য আমার খুব খারাপ লেগেছি যখন আমাকে সংবাদ সম্মেলনে জিজ্ঞেস করা হয়েছে পরের ম্যাচটা হারলেই আমার চাকুরি চলে যাবে কি না। এটা আমাকে ও পুরো দলকে আহত করেছে কারণ ইচ্ছে করে মিডিয়ায় এরকম নেতিবাচক কিছু বার্তা ফাঁস করা হয়েছে, যেটা আরও বেশি সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করেছে। আমার ভাগ্য ভালো, আমার এমন একটা স্কোয়াড ছিল যারা জীবনও দিতে পারে আমার জন্য। যখন ব্যাপারগুলো বাজে হয়ে যাচ্ছিল তারা দারুণ জয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। তারা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে, আমিও তাদের ওপর বিশ্বাস রেখেছি। অবশ্যই আমি বিশ্বের সেরা কোচ নই। কিন্তু খেলোয়াড়, মেম্বার, কোচিং স্টাফ বা রিয়ালের যে কারও যে শক্তি আর আত্মবিশ্বাস দরকার, সেটা আমি দিতে পারি বলেই মনে করি। আমি জানি দল কী চায়। মাদ্রিদে ২০ বছরে আমি শিখেছি ভক্তরা সবসময় জয় চায়, কিন্তু তার আগে কোচ, স্টাফ, খেলোয়াড়সহ সবাইকে নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। আমি নিশ্চিত করতে পারি, সেই শতভাগ আমি দিয়েছি।
এই সুযোগে আমি সাংবাদিকদেরও একটা কথা বলতে চাই। আমি শয়ে শয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে ফুটবল নিয়ে কথা খুব কমই হয়েছে। আমি জানি আপনারা ফুটবল ভালোবাসে, এই খেলাটাই আমাদের একসাথে রেখেছে। কিন্তু কোনো উপদেশ না দিয়েই বলতে চাই, খেলাটা নিয়ে হয়তো আমরা আরও বেশি কথা বলতে পারতাম, কারণ দিন শেষে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই ফুটবলের জন্যই আমরা বেঁচে আছি।
মাদ্রিদিস্তারা, আমি তোমাদের আছি, সবসময়ই থাকব।
হালা মাদ্রিদ!
জিনেদিন জিদান