অঘটন আর নাটকের ইউরো: এবার চমকে দেবে কোন দল?
বিশ্বকাপ আর কোপা আমেরিকার সাথে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সাথে দুইটি বড় পার্থক্য আছে। একটা পার্থক্য অবশ্যই বিশ্বকাপ আর কোপার বয়সের তুলনায় ইউরো এখনো বেশ তরুণ (যদি শিশু নাও বলা যায়)। আমাদের দেশে বিশ্বকাপ তো বটেই, একটা সময় কোপা নিয়েও যে আগ্রহ ছিল, ইউরো নিয়ে তার সিকিভাগও ছিল না। মূল কারণ অবশ্যই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিপুল ভক্ত সমাবেশ। বিশ্বকাপে তাই নীল-হলুদ আর আকাশী-নীলের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান দেশগুলোর পতাকা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। ইদানীং ক্লাব ফুটবলের কল্যাণে ইউরো নিয়ে আগ্রহটা বেশ কিছুটা বেড়েছে, আর খেলার গুণগণ মানের দিক দিয়ে ইউরো কোপার চেয়ে যোজন এগিয়ে তো বটেই, বিশ্বকাপের চেয়েও এগিয়ে বই পিছিয়ে নয়। তবে বিশ্বকাপ বা কোপার চেয়ে আরেকটা বড় পার্থক্য, ইউরো নিয়ে আগাম কোনো অনুমান করা যায় না। এমন কিছু অঘটন বা চমক এখানে হয়েছে, যার নজির ফুটবল তো বটেই, অন্য খেলাতেও বেশি নেই।
ইউরো অবশ্য একটা সময় শুধু কুলীনদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ১৯৬০ সালে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্ট শুরু হয় মাত্র চারটি দল নিয়ে, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত খেলে গেছে এই চারটি দলই। অথচ সেই ১৯৩৪ বিশ্বকাপেই ইউরোপ থেকে খেলেছিল ১২টি দল। বিশ্বকাপে ইউরোপের দল সংখ্যা ইউরোর চেয়ে তাই বেশি ছিল সবসময়েই। ১৯৭৬ সালের পর ইউয়েফার মনে হয়েছে, এত কম দল নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করাটা একটু বেশি খারাপ দেখায়। তারা এরপর আটটি দলের অনুমতি দিল। তখনও সুইডেনের মতো দল ইউরো খেলতে পারেনি, অথচ তারা এর মধ্যে বিশ্বকাপ ফাইনালেও খেলে ফেলেছে। তবে আটটি দল করার পর বড় দলগুলো নিয়মিত খেলতে শুরু করে। তবে ইউরোটা ঠিক মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট তখনও হয়নি। বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া বা স্কটল্যান্ডের মতো দেশগুলো যেখানে বিশ্বকাপ শুরুর দিকেই খেলে ফেলেছে, সেখানে ইউরো খেলার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক অনেক বছর।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ইউরোর ইতিহাস বলা নয়। তবে একটা গল্প এখানে বলা যেতে পারে। ১৯৭৬ ইউরো জিতেছিল চেক প্রজাতন্ত্র, টাইব্রেকারে জার্মানিকে হারিয়ে। সেই টাইব্রেকে গোল পেয়েছিলেন এমন একজন, যাকে আধুনিক ফুটবলের সবাই একনামে চেনেন। পেনাল্টি থেকে চিপ করে গোলের নাম হয়ে গেছে পানেনকা, যেটা সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়েছিলেন চেক প্রজাতন্ত্রের হয়ে আন্তোনিন পানেনকা নামের এক ভদ্রলোক। ১৯৮০ ইউরো থেকে দল বেড়ে আট হলো, কিন্তু তখনও ইউরো নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহই ছিল না। টিভিতে দর্শকও ছিল না তেমন, ক্লাব ফুটবলের ইউরোপিয়ান কাপ বা কাপ উইনার্স কাপের ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিল ইউরো।
পরের ১৯৮৪ ইউরোটা নিজের করে নিলেন মিশেল প্লাতিনি নামের এক জাদুকর, এবং সত্যিকার অর্থে ইউরো উদ্ভাসিত হলো কোনো তারার আলোয়। ফ্রান্স ১৯৮২ বিশ্বকাপের জোর দাবিদার হয়েও জিততে পারেনি, তবে প্লাতিনিরা সেই দুঃখ ভুলেছিলেন ইউরোতে এসে। কাকতালই বটেই, ১৯৮৮ ইউরো উঠল এমন একটা দলের কাছে, যাদের হাতে তখনও বিশ্বকাপ না ওঠাটা ছিল মিরাকলের মতো। মার্কো ফন বাস্তেনের নেদারল্যান্ডস ছিল প্রায় ড্রিম টিম, ইউরোতে ফন বাস্তেনের ভলি করে করা গোলটা টুর্নামেন্টকে পাইয়ে দিল অনেকটা বৈশ্বিক পরিচিতি।
তবে ইউরোর সত্যিকার অঘটনের শুরু তখনও হয়নি। সেটা হয় ১৯৯২ সালে এসে। সেবারও ছিল আটটা দল, খেলার কথা ছিল যুগোস্লাভিয়ার (এখন যেটা সার্বিয়া)। কিন্তু তখন গৃহযুদ্ধের কারণে যুগোস্লাভিয়া বাদ পড়ে যায়, কোয়ালিফাইং রাউন্ডে দ্বিতীয় হওয়ার সুবাদে শেষ মুহূর্তে হুট করে ঢুকে পড়ে ডেনমার্ক। সেই দলে ছিল দুই লাউড্রাপ ভাই-মাইকেল ও ব্রায়ান। আর ছিলেন একজন বিশালদেহী গোলরক্ষক- পিটার স্মাইকেল। এই স্মাইকেলই সেমিতে ফন বাস্তেনের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিলেন, আর ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে দিয়ে শিরোপা জিতে নিল ডেনমার্ক। পুরো ২০০ সালের আগ পর্যন্ত ডেনমার্কের ওই শিরোপাকে ধরা হতো বড় আসরের সবচেয়ে বড় আপসেট, যেটা ২০০৪ সালে এসে ছাপিয়ে গেল আরেকটি দল।
এতদিনে ইউরো মোটামুটি মহাদেশীয় গন্ডি ছাড়িয়ে বাইরের দর্শককে টানতে শুরু করেছে। দলের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬, টিভি স্বত্ব বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। ২০০৪ সালে পোর্তো জিতল চ্যাম্পিয়নস লিগ, নিজেদের মাটিতে পর্তুগাল বিভোর প্রথম বড় শিরোপার। ওদিকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির মতো প্রথাগত বড় শক্তিরা তো আছেই। চেক প্রজাতন্ত্রও ছিল দারুণ একটা দল। কিন্তু টুর্নামেন্টের শুরু থেকে চমকে দেওয়া শুরু করল আনকোরা গ্রিস। সেট পিস থেকে হেডে গোল কর আর ডিফেন্স সামলাও-শুনতে সহজ এই কাজটা দারুণভাবে করে কোয়ার্টারে হারাল ফ্রান্সকে, সেমিতে চেকদের। ফাইনালে পর্তুগালে হারিয়ে তারা লিখল আরেকটি অঘটনের গল্প, অথচ তার আগ পর্যন্ত তারা বড় আসরে খেলেছিলই দুইবার।
এরপর ইউরোতে আপসেট আর সেই অর্থে হয়নি। ২০০৮ ইউরোতে স্পেনের সোনালী প্রজন্মের শুরু, শুরু টিকি-টাকা যুগের। জাভি-ইনিয়েস্তারা শুধু সেবার নয়, পরের বারও ইউরো নিজেদের করে নিলেন, মাঝে একবার বিশ্বকাপও হয়েছে তাদের। গার্দিওলার অজেয় বার্সেলোনার সুবাস পেতে শুরু করেছে স্পেনও, রিয়াল-বার্সার একঝাঁক দারুণ ফুটবলারে তারাও প্রায় অজেয়। তবে ইউরোতে কিছু কিছু অঘটন ঘটছিলই। ২০০৮ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে যেমন রাশিয়া ও তুরস্ক উঠে গেল সেমিতে। অথচ ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডডস কোয়ার্টারও পার হতে পারল না। বরং ২০১২ সালে চমক ছিল না সেই তুলনায়- পর্তুগাল, স্পেন, জার্মানি, ইতালি সবাই সেমিতে ছিল ফেবারিট হিসেবেই। ২০১৬ ইউরোতে চমক ছিল গ্যারেথ বেলের ওয়েলস, সবাইকে চমকে দিয়ে তারা চলে গেল সেমিতে। এমনকি রোনালদোর পর্তুগালও ঠিক সেই অর্থে বড় ফেবারিট ছিল না, ফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের দিকেই পাল্লা ছিল ভারি। কিন্তু ইউরোতে যেটা হয়েছে অনেক বার, পর্তুগালই শেষ পর্যন্ত সব পাশার দান উলটে জিতেছে শিরোপা।
হিসেব করে তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইউরোতে প্রতিবারই শেষ চারে অন্তত একটা চমক থাকে। এবারের আসরে অবশ্য ফ্রান্সের দিকেই পাল্লা ভারি। এমবাপেরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বলে শুধু নয়, তারা শেষ চারে না গেলে সেটা হবে বড় অঘটন। স্কোয়াড ডেপথের বিচারে পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম কাছাকাছি, সবাই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার। জার্মানি ও ইতালি অনেক দিন ধারে না কাটলেও ভারে তারা ভালোমতোই কাটতে পারে। ইতালির বিশেষ করে সাম্প্রতিক ফর্ম দারুণ, যদিও তাদের ঠিক ফেবারিট বলা যাচ্ছে না। তবে শেষ চার কেন, ফাইনালে তারা চলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। জার্মানির ফর্ম অতটা ভালো না হলেও স্কোয়াড দারুণ, কোচ জোয়াখিম লোকে বিদায়ী উপহার তারা দিতে চাইতেই পারে। কিন্তু এদের কেউ শেষ চারে গেলে আপসেট বলার উপায় নেই। যেমন নেদারল্যান্ডসও ঐতিহ্যগতভাবে বড় দল, আগের সেই ধার না থাকলেও তারা যথেষ্ট সমীহ জাগানো দল।
তাহলে গতবার যেমন ওয়েলস বা ২০০৮ এ তুরস্ক বা রাশিয়ার মতো কে চমকে দিতে পারে? ফর্ম আর শক্তির বিচারে কয়েকটা দলের নাম করা যায়। ডেনমার্কের রক্ষণ বেশ গোছানো, শুধু কোনো ক্লিনিকাল স্ট্রাইকার ছাড়া সব পজিশনেই দারুণ কিছু খেলোয়াড় আছে। ইউক্রেনের ফর্মও দারুণ, তাদের মধ্যমাঠ ও আক্রমণ বেশ ভালো। এ ছাড়া তুরস্কও চমকে দেওয়ার মতো দল, সেই প্রমাণ তারা কিছুদিন আগে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েও দিয়েছে। তবে এর বাইরে এমনকি প্রথমবার খেলতে আসা ফিনল্যান্ড বা উত্তর মেসিডোনিয়াও সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে এসেছে ইউরোতে। ইউরোতে কোনো ম্যাচেই কাউকে নিরংকুশ ফেবারিট বলার উপায় নেই।
এবারের ইউরোতে তাই কী চমক অপেক্ষা করছে, সেটার জন্য আরও কদিন অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।