নেট সেশন: দেড়শ বছর পর টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম 'ফাইনাল ড্যান্স'
আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ
ফাইনাল, ২০২১
কবে, কখন
১৮-২২ জুন
বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩.৩০টা (১৫৩০)
ডেভিড গ্রেগরি বা জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়র- অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের অধিনায়ক তখন জানতেনই না, ইতিহাসের অংশ হচ্ছেন তারা। ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ এমসিজিতে যে ম্যাচ শুরু হয়েছিল, সেটিই যে পরে প্রথম টেস্টের মর্যাদা পাবে, সেটা তো তখন ধারণাতে ছিল না তাদের। অফিশিয়াল প্রথম টেস্টের প্রায় দেড়শ বছর পর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নতুন দুই সংস্করণে ছেলে ও মেয়েদের ৩৬টি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট বা ট্রফির পর অবশেষে টেস্ট ক্রিকেট দেখছে একটা ‘বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট ফাইনাল’। ভাবতেই পারেন, এতো দেরি কেন! তবে ক্রিকেট যেসব দিক দিয়ে ‘ইউনিক’ খেলা, হয়তো তারই একটি হিসেবে ধরে নিতে পারেন এই বিলম্বকে। অবশ্য সাউদাম্পটনের ফাইনালে আগে বিরাট কোহলি ও কেন উইলিয়ামসন- ভারত ও নিউজিল্যান্ডের দুই অধিনায়ক নিশ্চিতভাবেই জানেন, ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছে তাদের দল।
প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘুরে-ফিরে এসেছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এই আইডিয়া, তবে আলোর মুখ দেখেনি সেটি (অবশ্য এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল বলতেই পারে, সে আইডিয়া তাদের ছিল, তবে তারাও চালিয়ে যেতে পারেনি এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ)। অবশেষে যখন দেখলো, সেটিও এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন কোভিড-১৯ নামের ভাইরাসে বদলে গেছে মনুষ্য পৃথিবীর প্রেক্ষাপট। সেটির প্রভাবে এই চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট পদ্ধতি বদলে গেছে, বদলে গেছে ফাইনালের সম্ভাব্য ভেন্যু। এমসিজি, লর্ডস বা ইডেন-ওয়াঙ্খেড়ে ছাপিয়ে ফাইনালের জন্য হ্যাম্পশায়ারের যে এজিয়েস বোউলকে বেছে নেওয়া হয়েছে- তার অন্যতম কারণ মাঠলাগোয়া হোটেলের সুবিধা। প্রায় বছরখানেক ধরে যে বায়ো-সিকিউরিটি বলয় হয়ে গেছে ক্রিকেটের অন্যতম এক টার্ম, সেটিই যে কাজে লাগছে এখানেও।
ঘরের মাঠের দাপটে সেখানে একটি দল নিউজিল্যান্ড, ভারতের সে দাপট আছে আগে থেকেই, এবার যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া-জয়। আর যদি ক্রিকেটের তিন সংস্করণের মাঝে অদৃশ্য ঠোকাঠুকির সময়ে এমন দুজনকে বেছে নিতে বলেন- যারা প্রতি ফরম্যাটে আলাদা আলাদা বিজ্ঞাপন হতে পারেন- তাহলে দুই দলের দুই অধিনায়ক থাকবেন ওপরের দিকেই। দুই বিপরীতমুখী অথচ ক্রিকেটের অতি-প্রয়োজনীয় দুই চরিত্র যখন ফাইনালে টস করতে নামবেন, আপনি তখন বলতেই পারেন- পারফেক্ট! স্থিতধী উইলিয়ামসন সেখানে মুখোমুখি প্যাশনে থিকথিক করা কোহলির। আপনি বলতেই পারেন- নিঃশব্দের সঙ্গে ঝঙ্কারের লড়াই! দুই দলের পেস আক্রমণ সময়ের অন্যতম সেরা। ভারতের স্পিন-জুটির ব্যাটিং সামর্থ্য অবশ্য বেশ খানিকটা এগিয়ে রাখবে তাদের আক্রমণের বৈচিত্রের দিক দিয়ে।
চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের হিসেবে সবচেয়ে তরতাজা স্মৃতি নিউজিল্যান্ডের- বছর দুয়েক আগে ইংল্যান্ডেই ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচের অংশ হয়ে অন্যতম ট্র্যাজেডির শিকার তারা। তবে একটা দিক দিয়ে স্বস্তি পেতেই পারে নিউজিল্যান্ড, অন্তত এবার টাই হলে শিরোপার ভাগ পাবে তারা। ভারতের শেষ ফাইনাল অভিজ্ঞতা অবশ্য বেশ আগের- ২০১৪ সালের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি (যেটি এখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ) ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরেছিল তারা। শেষ ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল, নিউজিল্যান্ড সেখানে হারিয়েছিল ভারতকে। এসব অবশ্য আপাতত একটু সংযোগ টানার স্বার্থেই বলা, ১৮ জুন শুরু হওয়া ফাইনালে নিশ্চিতভাবেই সেসব আপাত দৃষ্টিতে প্রভাব ফেলবে না কোনো।
অবশ্য একটা দিক দিয়ে একটু এগিয়ে নিউজিল্যান্ড, এ ফাইনালের আগেই ইংল্যান্ডের মাটিতে দুই টেস্টের সিরিজ খেলার সুযোগ হয়েছে তাদের। সেখানে জয় নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাসের দিক দিয়েও বাড়তি রসদ হিসেবে কাজ করছে তাদের। ভারত সেখানে এসেছে স্থগিত হয়ে যাওয়া আইপিএলের রেশ নিয়ে। অবশ্য নিজেদের শেষ সিরিজে নিউজিল্যান্ডের মতো ভারতেরও আছে ইংল্যান্ডকে হারানোর স্মৃতি।
সেসব ছাপিয়ে আপাতত ক্রিকেটের আদিমতম ফরম্যাটের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের রোমাঞ্চ। রবি আশ্বিন যেমন বলেছিলেন, তার মতো যারা শেষ বিশ্বকাপেও সুযোগ পাননি, সীমিত ওভারে সেভাবে খেলেন না, সেই চেতেশ্বর পুজারা, আজিঙ্কা রাহানেদের (বা বিজে ওয়াটলিং) জন্য এটিই বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো। দেড়শ বছর পর, লিলিহোয়াইট, গ্রেগরি থেকে কোহলি, উইলিয়ামসনের মাঝে আসা ৩০৫৭ জন ছেলে টেস্ট ক্রিকেটারের মাঝে ২২ জন হবেন ইতিহাসের অংশ- প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের অংশ। সেটির তাৎপর্য কেমন, সেটি বুঝতে হয়তো আরও কয়েকটি ফাইনাল, সামনের কয়েক বছরে টেস্ট ক্রিকেটের গতিপথের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে যাই ঘটুক না কেন, আরও দশটি টেস্ট ম্যাচ, বা সিরিজের মতো এই ফাইনালের আগেও আপনি আশা করতে পারেন পারেন- দিয়ার ইজ নাথিং লাইক টেস্ট ক্রিকেট। এবং সেটি যদি হয়ে এমন চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের 'কনটেক্সটে' আসা কিছু, তাহলে তো কথাই নেই।
রঙ্গমঞ্চ
এজিয়েস বোউল, সাউদাম্পটন
ম্যাচের আগেরদিন নেমেছে ঝুম বৃষ্টি। এমনিতে আইসিসি টুর্নামেন্ট বলে স্পোর্টিং পিচের আশা করাই যায়, সঙ্গে হেড কিউরেটরও বলেছিলেন, উইকেটে পেস, বাউন্স আর ক্যারি থাকবে। তবে বাগড়া বাধাতে পারে ওই বৃষ্টি। তবে সম্ভাব্য পাঁচদিনের রোমাঞ্চে বৃষ্টি-ফ্যাক্টর তো সবসময় যোগ করতেই হবে আপনার!
যাদের ওপর চোখ
বিজে ওয়াটলিং
ওপরে আশ্বিন যে কথাটা বলেছিলেন বিশ্বকাপের সঙ্গে, নিউজিল্যান্ড উইকেটকিপারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন হলে উপলক্ষ্যটা বড় হবে কয়েকগুণ। এ ম্যাচ দিয়েই যে অবসরে যাবেন তিনি। ইংল্যান্ড সিরিজের শেষ টেস্টটা খেলতে পারেননি চোটের কারণে, ফাইনালে উইকেটের পেছনে ফেরার কথা তার। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের ‘আদর্শ’ ধারকের শেষটা যদি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মতো মঞ্চে চ্যাম্পিয়ন-রূপে হয়, গল্পটা আরও মনমতো হবে তার।
ঋষভ পান্ট
ওয়াটলিংয়ের যেমন চরিত্র, সে হিসেবে ঠিক উলটো মেরুতে পান্ট। ওয়াটলিংয়ের যখন শেষ, বলা যায় পান্টের শুরু মাত্র। তবে অস্ট্রেলিয়া সফরের পর দেশের মাটির ইংল্যান্ড সিরিজ ক্রিকেটার পান্টকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা, ভারতের নতুন দিনের প্রতিনিধি নিশ্চয়ই চাইবেন এমন মঞ্চেও নিজের ছাপটা রেখে দিতে।
সম্ভাব্য একাদশ
ফাইনালের আগের দিনই একাদশ ঘোষণা করে দিয়েছে ভারত। রবিচন্দ্রন আশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজা- আছেন দুজনই। ফলে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে হনুমা বিহারির অপশনের দিকে যায়নি তারা। ইশান্ত শর্মা ও জাসপ্রিত বুমরাহর সঙ্গে আরেক পেসার হিসেবে ভারত বেছে নিয়েছে মোহাম্মদ শামিকেই।
ভারত
রোহিত শর্মা, শুবমান গিল, চেতেশ্বর পুজারা, বিরাট কোহলি (অ), আজিঙ্কা রাহানে (স-অ), ঋষভ পান্ট (উই), রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন আশ্বিন, জাসপ্রিত বুমরাহ, ইশান্ত শর্মা, মোহাম্মদ শামি
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে ৬ পরিবর্তন নিয়ে নেমেছিল নিউজিল্যান্ড, ছিলেন না উইলিয়ামসনও। ফাইনালের আগে ফর্মে থাকা পেস আক্রমণ নিয়ে প্রশ্নটা আছে তাদের- কজন নিয়ে নামবে তারা। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নেইল ওয়াগন্যারের সঙ্গে কি যুক্ত হবেন কাইল জেমিসন বা ম্যাট হেনরি? কলিন ডি গ্র্যান্ডোমের বদলে কি খেলবেন আজাজ প্যাটেল?
নিউজিল্যান্ড (সম্ভাব্য)
টম ল্যাথাম, ডেভন কনওয়ে, কেন উইলিয়ামসন (অ), রস টেইলর, হেনরি নিকোলস, বিজে ওয়াটলিং (উই), কলিন ডি গ্র্যান্ডোম, টিম সাউদি, আজাজ প্যাটেল/কাইল জেমিসন/ম্যাট হেনরি, নেইল ওয়াগন্যার, ট্রেন্ট বোল্ট
সংখ্যার খেলা
- প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ ভেন্যুতে টেস্ট খেলবে ভারত
- টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সর্বোচ্চ রান-স্কোরারের মাঝে ৫ ও ৬ নম্বরে আছেন ভারতের দুজন- রাহানে ও রোহিত
- সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারির তালিকায় পাঁচে আছেন সাউদি
- সাউদাম্পটনে পেসারদের গড় ৩২.৪৫, স্পিনারদের ৩৪.৫৮
- এ ভেন্যুতে ৬ টেস্টের মাঝে দুটিতে জিতেছে টসে জেতা দল
তারা বলেন
“প্রতিটি দলেরই চ্যালেঞ্জ থাকে, অনেকেই আমাদেরটি মনে করেন যে একটু কম জনসংখ্যার ব্যাপারটি। তবে আমরা এই চ্যালেঞ্জ নিতে মুখিয়ে আছি, যে ধরনের ক্রিকেট আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটি খেলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমরা।
কেন উইলিয়ামসন, নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক
এটা একদিনের ক্রিকেট না, টি-টোয়েন্টি না যে কয়েক ঘন্টার মাঝে শেষ হয়ে যাবে। এটা হার্ড-ব্র্যান্ড ক্রিকেট, যেটি খেলতে পেরে আমাদের গর্ব অনেক। একটা বড় উদাহরণ হলো অস্ট্রেলিয়াতে যা দেখেছেন আপনারা।
বিরাট কোহলি