শেষের ব্রেকথ্রুতে উজ্জীবিত ভারত, তবে জেমিসন-কনওয়েতে নিউজিল্যান্ডের দিন
ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল, সাউদাম্পটন
৩য় দিন, চা-বিরতি
ভারত ১ম ইনিংস ২১৭ অল-আউট, ৯২.১ ওভার (রাহানে ৪৯, কোহলি ৪৪, রোহিত ৩৪, গিল ২৮, আশ্বিন ২২, জেমিসন ৫/৩১, ওয়াগন্যার ২/৪৭, বোল্ট ১/৪৬, সাউদি ১/৬৪)
নিউজিল্যান্ড ১ম ইনিংস ১০১/২, ৪৯ ওভার (কনওয়ে ৫৪, ল্যাথাম ৩০, ইশান্ত ১/১৯, আশ্বিন ১/২০)
নিউজিল্যান্ড ১১৬ রানে পিছিয়ে
গত কয়েকদিনে যা চলেছে সাউদাম্পটনে, তারই ধারাবাহিকতাই সূর্য ঢেকে দিয়ে আকাশে কালো মেঘ জমা হলো হুট করেই। রবীন্দ্র জাদেজাকে সরিয়ে বিরাট কোহলি আনলেন ইশান্ত শর্মাকে। চাপ বাড়ছিল নিউজিল্যান্ডের, টানা ২৬টি ডট বলের চাপ। তাতেই লেগস্টাম্পের ওপর ইশান্তের ফুললেংথের বলটা ফ্লিক করতে গেলেন ডেভন কনওয়ে। এভাবে যিনি আউট হয়েছিলেন সম্প্রতি, হলেন এবারও, ধরা পড়লেন মিড-অনে। রস টেইলর নামার কিছুক্ষণ পরই আলোকস্বল্পতায় বন্ধ হয়ে গেল খেলা, যদিও বর্ধিত সেশনের খুব বেশি বাকি ছিলও না। শেষের ব্রেকথ্রু পাওয়া উজ্জীবিত ভারতই মাঠ ছাড়লো তাই।
অথচ দিনের গল্পটা এমন নয়। দিনের গল্পটা নিউজিল্যান্ডের দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর, দুর্দান্ত কাইল জেমিসনের আরেকটি পাঁচ উইকেটের, কনওয়ের স্বপ্নযাত্রার পথে আরেকটি ফিফটির। জেমিসনের ৫ উইকেটের পথে বিরাট কোহলির প্রতিরোধ ভেঙেছিল সকালেই, এরপর বিলো-পার ২১৭-তে আটকে গেছে তারা। টম ল্যাথাম ও কনওয়ে এরপর দীর্ঘ সময় হতাশ করে গেছেন ভারতকে, অবশেষে ব্রেকথ্রু পেয়েছিল তারা রবিচন্দ্রন আশ্বিনে ভর করে। এরপর কনওয়ের ফেরা, তবে এর আগে পিছিয়ে থাকার ব্যবধান ১১৬ রানে নামিয়ে এনেছে নিউজিল্যান্ড। আর ভারত আশা করবে, এদিন নিউজিল্যান্ডের প্রত্যাবর্তনের মতো কিছু করতে।
লাঞ্চের পর ভারত গুটিয়ে গিয়েছিল দ্রুতই, ল্যাথাম-কনওয়ে এরপর ছিলেন দারুণ সতর্ক। অবিচ্ছিন্ন থেকে চা-বিরতিতে গিয়েছিলেন দুজন। সেশনের সে অংশে ভারত আঁটসাঁট বোলিং করেছে, তবে সেভাবে সুইংয়ের দেখা পায়নি তারা। শেষদিকে মোহাম্মদ শামির বাড়তি বাউন্স একটু ঝামেলাও ফেললেও ল্যাথাম-কনওয়ে ছিলেন নিরাপদই। ভারতের মতো ওপেনিংয়ে ফিফটি জুটি গিয়েছিল ৭০ রান পর্যন্ত, এরপরই আশ্বিন এসে দিয়েছেন ব্রেকথ্রু। তার ফ্লাইটেড ডেলিভারিটা ছিল তুলনামূলক কম গতির- ঘন্টায় কিলোমিটার হিসেবে আগের চেয়ে ৫ কম। ড্রাইভে প্রলুব্ধ হওয়া টম ল্যাথাম তাতে ধরা পড়েছেন এক্সট্রা কাভারে, যেখানে সময়মতো ভাল এক লাফে সেটি নিয়েছেন কোহলি। ফলে শেষ ৮ ইনিংসে- যখন ভারত প্রথম ২০ ওভারেও উইকেট পায়নি- ব্রেকথ্রু দিলেন আশ্বিন।
কনওয়ে এরপর ফিফটি পেয়েছেন, যেন কতো আগে থেকেই টেস্ট ক্রিকেট তার অনেক আপন। বেশ সরল টেকনিকের এই বাঁহাতির ইনিংস ছিল দারুণ ছন্দময়। ৬টি বাউন্ডারি মেরেছেন, সেসবও ছিল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর শট। এরপরই ইশান্তের ওই বলে ঘটেছে বিপত্তি। এর আগে জাসপ্রিত বুমরাহ বেশ চাপ তৈরি করেছিলেন। ৪৩তম ওভারের আগে এদিন জাদেজাকে আনেননি কোহলি, তিনি তেমন ছাপ না রাখলেও প্রথম চাপ তৈরির কাজটা করেছিলেন শামি। অবশ্য দিনশেষে উইকেটশূন্যই থেকেছেন তিনি।
এর আগে তৃতীয় দিন সকালে দারুণ এক সেশন কাটিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড বোলাররা। প্রথম দিন সকালে হয়তো এই বোলিং পারফরম্যান্সটাই তার পেসারদের কাছ থেকে চেয়েছিলেন কেন উইলিয়ামসন। ৬৫ রান, ৪ উইকেট- বিরাট কোহলি, ঋষভ পান্ট, আজিঙ্কা রাহানে, রবিচন্দ্রন আশ্বিনকে ফিরিয়েছিলেন তারা। তবে তখনও ২০০ পেরিয়ে ম্যাচে ভালভাবেই ঝুলে ছিল ভারত।
আগেরদিন যে প্রতিরোধ গড়েছিলেন কোহলি, এদিন সকালে সেটি ভেঙে গেছে দুর্দান্ত কাইল জেমিসনে। ভেজা আউটফিল্ডে দেরিতে শুরু হওয়া সেশনে কোহলির উইকেটের আগে-পরে ছিল ৬টি মেইডেন। জেমিসন আগেরদিনের চেয়ে বেশ ফুললেংথে গেছেন, পেয়েছেন সাহসিকতার পুরস্কারও। সামনে ঝুঁকে খেলতে যাওয়া কোহলির ডিফেন্স চিড়ে ঢুকেছে তার বল, আম্পায়ার মাইকেল গফের এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্তটা শেষ মুহুর্তে রিভিউ করলেও বাঁচেননি ভারতীয় অধিনায়ক, আগেরদিনের স্কোরেই ফিরতে হয়েছে তাকে। স্টাম্পে হিট করতো, ম্যাচে এমন মাত্র ৭ম ডেলিভারি ছিল সেটি জেমিসনের।
ঋষভ পান্ট ছিলেন স্বভাববিরুদ্ধ অতি-সতর্ক, তবে সেটিও কাজে আসেনি। একবার নিউজিল্যান্ড রিভিউও করেছিল তার বিপক্ষে, যেটি কাজে আসেনি। ২০তম বলে গিয়ে রানের কলামে শূন্য কাটিয়েছিলেন তিনি বাউন্ডারি দিয়ে, তবে জেমিসনেরই অফসটাম্পের বেশ বাইরের বলে প্রলুব্ধ হয়ে ড্রাইভের চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়েছে এজড হয়ে, স্লিপে ধরা পড়ে। সকালের প্রথম স্পেলে জেমিসন ৬ ওভারে ১২ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট, করেছেন ৩টি মেইডেন।
সকালে কোহলিকে ফিরিয়ে টোনটা সেট করে দিয়েছিলেন জেমিসন/আইসিসি
আজিঙ্কা রাহানের ইনিংস বেশ দৃঢ় মনে হচ্ছিল, কোহলির উইকেটের পর দায়িত্বও বেড়ে গিয়েছিল। তবে ফিফটি থেকে এক রান দূরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক শটে ফিরেছেন তিনি। নিল ওয়াগন্যার এদিন ফিরেছিলেন তার শর্ট বল থিওরিতে, তেমনই এক শর্ট বলে শুধু বলের লাইন পরিবর্তন করে নিয়ে স্কয়ার লেগের কোলের ওপর ফেলেছেন ভারতের সহ-অধিনায়ক। ১৮২ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে তখন ২০০-এর নিচেই গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়েছিল ভারত।
সেটি হতে দেয়নি আশ্বিনের ছোট-অথচ-দারুণ-গুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস। প্রতি-আক্রমণ শুরু করেছিলেন তিনি, জাদেজার সঙ্গে ছোটখাট এক জুটিও গড়েছিলেন। তবে ম্যাচে টিম সাউদির প্রথম শিকার বনতে হয়েছে তাকে, অফস্টাম্পের বাইরে অ্যাওয়ে সুইংয়ে ব্যাট চালিয়ে স্লিপে ধরা পড়ার আগে করেছেন ২৭ বলে ২২ রান। দুই স্পিনার খেলানোর আইডিয়া ভারতের কতোখানি সফল হবে, সেটি সময়সাপেক্ষ হলেও দুই স্পিনারের ব্যাটিং-সামর্থ্যের প্রমাণ আশা জুগিয়েছিল তাদের।
অবশ্য জাদেজাকে রেখে দুই টেইল-এন্ডার জেমিসনের শিকার হওয়ার পর তেমন কিছু করতে পারেননি তিনি। লাঞ্চের পর মাত্র ৬ রান যোগ করতেই শেষ ৩ উইকেট হারিয়েছে ভারত। পরপর দুই বলে ইশান্ত শর্মা ও জাসপ্রিত বুমরাহকে ফিরিয়েছেন জেমিসন। প্রথমে ইশান্ত স্কয়ারড আপ হয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছেন, পরে ফুললেংথের বল মিস করে এলবিডব্লিউ হয়েছেন বুমরাহ। পরের উইকেট দিয়ে ক্যারিয়ারে ৫ম বার ৫ উইকেট হয়েছে জেমিসনের। এখন পর্যন্ত ১৪.১৩ গড়ে নিউজিল্যান্ড পেসারের উইকেট ৪৪টি, উনবিংশ শতাব্দির পর থেকে এতো কম গড়ে এতো উইকেট পাননি আর কোনো বোলার। এরপর বোল্টের ডাউন দ্য লেগের বলে গ্লাভড হয়েছেন জাদেজা, যিনি এর আগে ১৫ রানে দাঁড়িয়েই স্লিপে জীবন পেয়েছিলেন একই বোলারের বলে সাউদির হাতে।