• ইউরো ২০২০
  • " />

     

    আট গোলের থ্রিলারে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন

    আট গোলের থ্রিলারে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন    

    অদ্ভুত। অবিশ্বাস্য। খ্যাপাটে। 

    যে স্পেন প্রথম দুই ম্যাচ গোলের জন্য মাথা কুটে মরছিল, তারা পরের দুই ম্যাচে দিল পাঁচ গোল করে। ইউরোর ইতিহাসেই যে কীর্তি নেই কারও। যে উনাই সিমনের হাস্যকর, শিশুতোষ ভুলে প্রথম গোল খেল, সেই সিমন পরে দুর্দান্ত সেভ করে বাঁচিয়ে রাখলেন দলকে। যে আলভারো মোরাতা সুযোগ হাতছাড়া করলেন সহজ, তিনিই এসে গোল দিলেন অতিরিক্ত সময়ে। আবার যে ক্রোয়েশিয়া ৩-১ গোলে পিছিয়ে ছিল, তারাই ৩-৩ করল শেষ ৬ মিনিটে দুই গোল দিয়ে। তারপরও ম্যাচটা বাঁচাতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। ৫-৩ গোলের জয়ে শেষ আটে চলে গেছে স্পেন। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ড।



    ম্যাচের শুরু থেকেই একতরফা বলের দখল রেখে দাপট দেখিয়ে গেছে স্পেন। ক্রোয়েশিয়া তাদের দুয়ারে তালা মেরে বসে থাকাতেই মনযোগী ছিল। প্রথম বিশ মিনিটে অনটার্গেটে ক্রোয়েশিয়ার শট ছিল না একটিও। তবু গোলের খাতায় তাদের নামেই উঠেছিলো প্রথম গোল। এমনভাবে যে গোলের দেখা মিলবে, তা ভাবতে পারেনি কোনও দলই। স্পেন গোলকিপারের শিশুতোষ এক ভুলে ক্রোয়েশিয়া এগিয়ে যায়। গোলটা ছিল এবারের ইউরোর নবম আত্মঘাতী গোল। আর এর আগে সব আসর মিলিয়েই আত্মঘাতী গোল হয়েছিল মোটে নয়টি। তবে সেই আত্মঘাতী গোলকারী হিসেবে উনাই সিমনের বদলে লেখা থাকবে পেদ্রিরই নাম। ৪৯ গজ দূর থেকে সিমোনের দিকে ব্যাক পাস দিয়েছিলেন পেদ্রি। এমন দুরত্ব থেকে এর আগে ইউরোতে কখনোই কোন আত্মঘাতী গোল হয়নি। বক্সের বাইরে থেকেই হয়নি যেখানে কোনদিন, সেখানে সিমোনের মনযোগের ঘাটতিতে বল জটড়িয়ে যায় জালে।


    এরপর স্পেনের সবচেয়ে ভালো সুযোগটা আসে ওই পেদ্রির পা থেকেই। ইউরোর ইতিহাসে নকআউট পর্যায়ে যার চেয়ে কম বয়সে আর কেউ খেলতে পারেননি। ক্রোয়েশিয়ার হেভি ডিফেন্স চিরে তারই এক অসাধারণ থ্রু পাসে ওয়ান অন ওয়ানে লিভাকোভিচকে পেয়ে গিয়েছিলেন কোকে। তবে একেবারে সোজাসুজি মেরে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার সুযোগটা নষ্ট করেন। আরেকবার মোরাতা ফ্রি-হেডার পেয়ে কাজে লাগাতে পারেননি। বেশ কয়েকবার ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্স ভেদ করে এগিয়ে যেতে পারলেও ক্রোয়েশিয়ার দুর্দান্ত রক্ষণে স্প্যানিশদের ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই। তবে শেষমেশ তারা প্রথমার্ধ শেষে বিরতিতে গেছে ম্যাচে সমতায় ফিরেই। 

    বারবার ডিফ্লেক্টেড হওয়ার পরে বক্সের বাইরে বল পেয়ে গিয়েছিলেন জোসে গায়া। সেখান থেকে তার শট এরপর দুর্দান্ত সেভে ক্রোয়েশিয়ান গোলকিপার লিভাকোভিচ ফিরিয়ে দেন। যদিও সারাবিয়ার ফিরতি শট জালে জড়ানো থেকে রুখবার সাধ্য হয়নি তার। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়াও কাউন্টার অ্যাটাকে কয়েকটা সুযোগও তৈরি করেছিল। তবে প্রথমার্ধে ব্যবধানটা বাড়ানোর খুব কাছে তারা আর যেতে পারেনি।

    অবশ্য প্রথমার্ধে স্পেন যেভাবে খেলেছে, এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাদেরই। দ্বিতীয়ার্ধেও সেভাবেই শুরু করে তারা। স্পেনের জার্সিতে আজপিলিকুয়েতার প্রথম গোলে স্পেনই সেবার লিড নেয়। বাঁ পাশ থেকে করা ফেরান তোরেসের দারুণ এক ক্রসে দুর্দান্ত হেডে বল জালে পাঠিয়ে দেন আজপিলিকুয়েতা। ৫৭ মিনিটে তার সে গোলের পরে ক্রোয়েশিয়াও কয়েকবার গোলের কাছে গিয়েছিল। বক্সের বাঁ দিক থেকে নেওয়া রেবিচ ও গাভার্দিওল এর দুটি শট সেভ দিয়ে তাদের গোলবঞ্চিত করেছেন সিমোন। ৭৬ মিনিটে এরপর আরেকটি গোলে জয় নিশ্চিতের দিকে এগুচ্ছিল স্পেন। লং বল থেকে বল পেয়ে চমৎকার ফিনিশিংয়ে ব্যবধান বাড়ান ফেরান তোরেস। তবে ম্যাচে নাটকীয়তা বাকি ছিল তখনও। 

    নির্ধারিত সময় শেষ হতে যখন বাকি ৫ মিনিট, তখনই বদলি নামা অরসিচের গোল ম্যাচে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। মদরিচের কাটব্যাকের পর শট ব্লক হওয়ার পরে আবার সামনে থাকা ক্রোয়েশিয়ান জটলার মধ্য থেকে অরিসিচ পেয়ে গেলে বল জড়িয়ে দেন জালে। ক্রোয়শিয়ানরা সহজেই হার মানার পাত্র নন, শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে জানে তারা। ম্যাচের আগে স্প্যানিশ খেলোয়াড় দানি অলমো বলেছিলেন এমনটাই। বদলি হিসেবে তখন মাঠে নেমেছেন অলমো, তার কথার প্রমাণটা এরপর বিশ্বের সাথে সাথেও তিনিও দেখতে পেলেন স্বচক্ষেই। যোগ করা সময়ে বাঁ পাশ থেকে করা অরসিচের দুর্দান্ত ক্রসে দারুণ হেডে বল জালে পাঠিয়ে দেন পাসালিচ। ক্রোয়েশিয়ার হয়ে মেজর টুর্নামেন্টে বদলি নেমে এক ম্যাচে অ্যাসিস্ট ও গোল দুটিই করেছেন এই প্রথম অরিসিচ। তার সাথে আরেক বদলি পাসালিচ, এই দুই বদলির বদৌলতে ক্রোয়েশিয়া বেঁচে থাকে ইউরোতে।

    অতিরিক্ত সময়ে এরপর ক্রোয়েশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনাল আশা মুমুর্ষ হয়ে যায় মোরাতার গোলে। ডান প্রান্ত থেকে ক্রসে মোরাতার দিকে বলটা বাড়িয়ছিলেন দানি অলমোই। এতদিন ধরে যেই ফিনিশিংয়ের জেরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়া মোরাতার পাশাপাশি তার পরিবার পর্যন্ত দুয়ো শুনা থেকে রক্ষা পায়নি। সেই মোরাতা এমন ফিনিশিং করলেন, নিরপেক্ষ সমর্থক হলে অবিশ্বাসের সুরে যা দেখে আপনি অস্ফুটে উচ্চারণ করবেন ‘ওয়াও!’ এর আগে প্রায় নিশ্চিত গোল সেভ দিয়ে স্পেনকে রক্ষা করেছেন সিমোন, এরপরে তারই আরও দুর্দান্ত সেভে স্পেন দুই গোলের লিড ধরে রাখতে পারে। ওয়ারজাবালের আরেকটি গোলে অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধ স্পেন শেষ করেছিল ৫-৩ স্কোরলাইন নিয়েই। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয় অর্ধে দুদলের দুটি সহজ সুযোগ নষ্টে স্কোরলাইনে আর কোন পরিবর্তন আসেনি। 

     

    লড়াকু ক্রোয়েশিয়াকে হারাতে লড়ে গেছেন দানি অলমোরা। দুটি অ্যাসিস্ট করে সে লড়াইয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন অলমো। শেষের দিকে গোলপোস্ট বাধা না হয়ে আসলে গোলের দেখাও পেয়ে যেতে পারতেন। তবে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উনাই সিমোন কিংবা আলভারো মোরাতা, আলদা করে কাউকেই এ ম্যাচের নায়ক বলা যায় না। এটা এমন একটা ম্যাচ, যেটা দর্শকদের মন রাঙাতে দুই দলের সবাই ধন্যবাদ পেতেই পারেন।