এমি মার্টিনেজের টাইব্রেকার বীরত্বে ফাইনালে আর্জেন্টিনা
ফুলটাইম স্কোর: আর্জেন্টিনা ১-১ কলম্বিয়া
কলম্বিয়া শেষ কোপার শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল সেই ২০০১ সালে। এই শিরোপার জন্য আর্জেন্টিনার প্রতীক্ষা আরও লম্বা। সেই ১৯৯৩ সালের কোপা জয়ের পর যে আর কোন আন্তর্জাতিক ট্রফির মুখ দেখেনি আলবিসেলেস্তেরা। সর্বকালের অন্যতম সেরা মেসি যখন আকাশী-নীল শিবিরের খেলোয়াড় তখন সমর্থকদের এই শিরোপা জয়ের হাহাকার হয়ত বেড়ে যায় বহগুণে। গত তিনবারই সেমি-ফাইনাল খেলা মেসি যে এবার ছিলেন উদ্দীপিত, বদ্ধপরিকর এক নেতা তার প্রমাণ তিনি দিয়ে এসেছেন পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই। শিরোপার আক্ষেপ ঘুচানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া সেই মেসির অ্যাসিস্টেই লাউতারো মার্টিনেজের গোল ও লুইস দিয়াজের গোলে নির্ধারিত সময়ে ১-১ সমতার পরে ত্রাতা হয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন এমি মার্টিনেজ। আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক টাইব্রেকারে ঠেকিয়েছেন তিনটি পেনাল্টি, ফাইনালে নিয়ে গেছেন আর্জেন্টিনাকে।
শুরু থেকেই আর্জেন্টিনা রক্ষণের লাইন এগিয়ে নিয়ে প্রেস করে খেলতে থাকে। কলম্বিয়াকে জায়গা না দেওয়া আর্জেন্টাইনরা গোলের সুযোগ তৈরি করে ৪ মিনিটের মাথায়। তিনজনকে কাটিয়ে ডি বক্সে ঢুকে সেখানে ডিফেন্ডারকে বিভ্রান্ত করে জায়গা বানিয়ে মেসি ক্রস বাড়ান লাউতারো মার্টিনেজের উদ্দেশ্যে। তবে লাউতারোর হেড পোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। গোলের জন্য অবশ্য তাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মিডফিল্ড থেকে মেসির উদ্দেশ্যে আসে নিখুঁত এক পাস। তবে সেই পাস থেকে বল নিয়ন্ত্রণে নিতে নিতেই ইয়েরি মিনা তার পিছে চলে এলে মেসি শরীর ঘুরিয়ে বলের দখল নিয়ে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেন। বক্সে লাউতারো ফাঁকা হতেই তার উদ্দেশ্যে মাপা পাস দিলে সেখান থেকে ঠাণ্ডা মাথায় জালে বল জড়াতে ভুল করেননি লাউতারো। এই গোলের অ্যাসিস্টের মাধ্যমেই মেসির অ্যাসিস্টসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ৫-এ, যা কোপার এক আসরের সর্বোচ্চ।
তবে মুহূর্তেই ঘুরে দাঁড়ায় কলম্বিয়া। ৯ মিনিটের মাথায় বাঁ প্রান্ত থেকে কুয়াদ্রাদোর দিকে নিচু ক্রস বাড়ানো হলে সেখান থেকে তিনি শট নেন। তবে ক্রস পড়ে ফেলে দ্রুততার সাথে এমি মার্টিনেজ এগিয়ে এলে বুক দিয়ে সেই শট আটকিয়ে দেন তিনি। আক্রমন-পাল্টা আক্রমণের খেলায় এরপর দুই দলই তৈরি করেছিলো সুযোগ, বলের দখল নিতে মধ্যমাঠে ছিল তৎপর। তবে গোলমুখে সুবিধা করে উঠতে পারছিল না কোন দলই।
৩৬ মিনিটের দিকে গিয়ে সুযোগ তৈরি করে কলম্বিয়া। ডি-বক্সে বল ভাসানো হলে ওটামেন্ডি সেটা হেডে ক্লিয়ার করেন। তবে বল গিয়ে বক্সের একটু বাইরেই থাকা ব্যারিয়সের পায়ে গিয়ে পড়লে তিনি সজোরে ভলি নেন। ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে সামান্য দিক পরিবর্তন করে বল গিয়ে লাগে বারে। সেখান থেকে কর্নার পেয়ে গেলে বক্সে কুয়াদ্রাদো বল ভাসান। লাফ দিয়ে মাথা লাগিয়ে মিনা হেডটা দিয়েছিলেনও জায়গামতই। তবে দুর্ভাগ্য বলতেই হয়, বল গিয়ে আবারও লাগে পোস্টে।
কলম্বিয়ার উপর্যুপরি আক্রমণের স্রোত সামলে ৪৪ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনা পেয়েছিলো সুবর্ণ সুযোগ। মেসির বাড়ানো কর্নার থেকে মাথা লাগান নিকোলাস গঞ্জালেজ, সংযোগটাও হয়েছিলো মনমত। তবে ওস্পিনা অসামান্য দক্ষতার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে তালু দিয়ে নিচ থেকে বল বারের উপরে তুলে দিয়ে সেবারের মত কলম্বিয়াকে ম্যাচে রাখেন। দারুণ এই সেভের কারণেই এক গোলের ব্যবধানে এগিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় আর্জেন্টিনাকে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বলের দখল নিতে গিয়ে দুই দলকেই খানিকটা ছন্নছাড়া লাগছিল। মেসিকে কলম্বিয়ানরা জায়গা নেওয়ার কোন সুযোগই দিচ্ছিলেন না। ছয় মিনিটের মাঝে মেসিকে তিনবার ফাউলের শিকার হতে হয়। মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণ তাও ছিল আর্জেন্টাইনদের দখলেই। তবে স্রোতের বিপরীতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন কলম্বিয়ানরা। ৬১ মিনিটের মাথায় ফ্রি-কিক পায় কলম্বিয়ানরা। তবে নিজেদের জায়গা ঠিক করতে আর্জেন্টাইনরা কিছুটা গাছাড়া থাকলে সুযোগ বুঝে দ্রুত ফ্রি-কিক নেন কারদোনা। সেখান থেকে বল পেয়ে আকস্মিক বিস্ফোরণে বক্সে ঢুকে জার্মান পেজ্জেলাকে ছিটকে ফেলে গোলমুখে শট নেন তিনি। পেজ্জেলার চাপে নিজে একটু নিয়ন্ত্রণ হারালেও দারুণভাবে জালে বল জড়ান তিনি। এই আসরে এই নিয়ে মাত্র তৃতীয় বারের মত বল জড়িয়েছে আর্জেন্টিনার জালে।
৭৪ মিনিটের মাথায় অবশ্য এগিয়ে যেতে পারত আর্জেন্টিনা। মধ্যমাঠ থেকে ব্যাক পাস দিলে সেটা গিয়ে পড়ে ডি মারিয়ার পায়ে। সেখান থেকে তিনি ক্ষিপ্রতার সাথে এগিয়ে গেলে ওস্পিনাও বেরিয়ে আসেন পোস্ট ছেড়ে ডি-বক্সের বাইরে। অনায়াসে তাকে কাটিয়ে বের হয়ে গেলেও সামনে ডিফেন্ডার থাকায় ডি মারিয়া বল বাড়ান বক্সে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা লাউতারোর উদ্দেশ্যে। পোস্টে গোলরক্ষক না থাকায় সেখান থেকে লাউতারোর বল জালে জড়ানো সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিলো। তবে প্রথম প্রচেষ্টায় শট না নিয়ে বলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ওই মিলিসেকেন্ড সময়ের মধ্যে নিজেকে জায়াগামত হাজির করেন মিনা। এরপর গোলমুখে লাউতারোর নেওয়া শট অবিশ্বাস্যভাবে গোললাইন থেকে ফিরিয়ে দেন মিনা। সাইডলাইন থেকে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না স্কালোনি।
৮২ মিনিটের মাথায় আবারও সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। বক্সের বাইরে ডিফেন্ডারকে শরীরের মোচড়ে বোকা বানিয়ে দারুণভাবে জায়গা বানিয়ে বক্সে মেসির উদ্দেশ্যে নিখুঁত পাস বাড়ান ডি মারিয়া। বাঁ প্রান্ত থেকে মেসি জোরালো শট নিলে বাধা হয়ে দাঁড়ান ওস্পিনা, তার হাতের আলতো ছোঁয়ায় পোস্টে লেগে বল কোন আরজেন্টাইনের পায়ে পড়ার আগেই দ্রুততার সাথে ক্লিয়ার করায় সেই যাত্রায়ও বেঁচে যায় কলম্বিয়া। এরপর কোন দলই গোলমুখে সুবিধা করতে পারেনি, কলম্বিয়ার রক্ষণে মিনা ছিলেন দেয়াল হয়ে। এবারের কোপায় অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটের খেলা বাতিল করা হয়েছে বলে নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে ১-১ সমতা থাকায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারে নিজেদের প্রথম শট জালে জড়াতে ভুল করেননি কুয়াদ্রাদো ও মেসি। এরপর থেকেই শুরু হয় এমি মার্টিনেজের বীরত্বগাঁথা। ডেভিনসন সানচেজের নিচু পেনাল্টি ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণভাবে থামিয়ে দেন তিনি। তবে এরপরের পেনাল্টি উড়িয়ে মারেন রদ্রিগো ডি পলও। আর্জেন্টাইনরা এরপর অবশ্য আর কোন ভুল করেননি, লক্ষ্যভেদে সফল ছিলেন পারেদেস ও লাউতারো। আর এমি মার্টিনেজের দেয়াল ভেদ করতে পারেননি বোরহা বাদে কেউই। এরপর মিনা আর আর কারদোনার পেনাল্টি অসাধারণ দুই সেভে ফিরিয়েছেন, দলকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। ৩-২ ব্যবধানে টাইব্রেকার জিতে আলবিসেলেস্তেরা চলে গেছে শিরোপা জয়ের শেষ ধাপে।
কোপা শুরুর আগে থেকেই ফুটবলপ্রেমীদের আকাঙ্খা ছিল আরও একটি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনালের। হতাশ করেনি কোন দলই, মারাকানায় মঞ্চস্থ হতে চলেছে বহুল প্রতীক্ষিত ফাইনাল। ১১ জুলাই ভোর ৬ টায় মুখোমুখি হবে মেসি-নেইমাররা। ঘরের মাঠে ব্রাজিল কি পাবে তাদের ১০ম কোপা নাকি মেসির একটি আন্তর্জাতিক শিরোপার আক্ষেপ অবশেষে ঘুচবে সেটা সময়ই বলে দেবে।