• ইউরো ২০২০
  • " />

     

    এক যে আছে ডেনমার্ক...

    এক যে আছে ডেনমার্ক...    

    দুর্নীতির তালিকায় একেবারে নিচের দিকে থাকা ডেনমার্ক শান্তির দেশের তালিকায় আছে উপরের দিকেই। ডেনমার্কের রাজধানী ঘুরতে গেলে কোপেনহেগেনের সৌন্দর্য্যে ঝলমল আপনার চোখ এড়িয়ে যেতে পারবেনা কয়েকটি স্ট্যাচু। স্বাভাবিক দুনিয়ায় স্বভাবতই সেসব স্ট্যাচু ঘিরে মানুষের জটলা তৈরি হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি ‘দ্য লিটল মারমেইড’। জলে বসবাসকারী রুপকথার গল্পের মৎসকন্যাকে স্থান দেওয়া হয়েছে জলেতেই, পা ছড়িয়ে বসে আছেন কয়েকটি পাথরের উপর ভিত্তি করে।

    পুরো শহর চক্কর দিলে এরকম আরও নানান আকৃতির স্ট্যাচু আপনার চোখে পড়বে। কোপেনহেগেনের সিটি হলের পাশে রাস্তার ধারে এক ভদ্রলোককে বসে থাকতেও দেখবেন। মাথায় হ্যাট, একহাতে একখানা বই, অপর হাতে চাবুক। ওই মানবমুর্তি যে মানবের তার নাম হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসেন। ‘দ্য লিটল মারমেইড’ তারই মস্তিস্কপ্রসূত। তিনি রুপকথার গল্প লিখতে পারতেন। দুই শতাধিক বছর আগে মরে যাওয়ার আগে তার রচিত রুপকথার গল্পগুলোই তার পরিচয়। সেই সুবাদে ডেনমার্কেরও পরিচয় হয়ে গেছে তাই। ডেনমার্ক রুপকথার মতো কিছু ঘটালে তার ফিরে আসাটা সেজন্যে অনিবার্যই। 

    ****



    দুই লাউড্রপ ভাই- মাইকেল ও ব্রায়ান। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস সবখানে খেলে মাইকেল লাউড্রপের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় জায়গা পাকাপোক্ত। ইয়োহান ক্রুইফের ড্রীম টিমের এ সদস্য তখন খেলছিলেন বার্সেলোনাতে, ব্রায়ান লাউড্রপ বায়ার্ন মিউনিখে। তারা সহ দলের অন্যতম সেরা আরো দুজনকে মাঝপথে হারাতে হলো নীলসেনকে। কোচ নীলসেনের রক্ষণাত্মক কৌশলে আপত্তি ছিল লাউড্রপ ভাইদের। বাকি দুজনের শৃঙ্খলা নিয়ে আপত্তি ছিল নীলসেনের। 

    ডেনমার্কের প্রথম পুর্ণ মেয়াদে চাকরিপ্রাপ্ত পেশাদার কোচ ছিলেন সেপ পিয়োনটেক। জার্মান এই ফুটবলারের অধীনে ডেনমার্ক ১৯৮৪ সালে ইউরোর সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছে। পরের বিশ্বকাপে পার করতে পেরেছে গ্রুপ পর্ব। তবে ১৯৮৮ সালের ইউরোতে ভরাডুবির পর বিশ্বকাপেও জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয় ডেনমার্ক।  দীর্ঘ ১১ বছরের ডেনমার্ক অধ্যায়ে তাই ইতি টানতে হয় পিয়োনটেকের। ১৯৯০ সালে পিয়োনটেক পদত্যাগ করলে ডেপুটি রিচার্ড মুলার নীলসেনই তার স্থলাভিষিক্ত হন। এর আগে  পিয়োনটেকের অনুপস্থিতিতে অলিম্পিকের কোয়ালিফায়ারে কিছুদিন দলের দায়িত্ব সামলেছিলেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে অনুর্ধ্ব-২১ দলের দেখাশোনা করেছেন। তবে সবার ‘মাথা’ হয়ে এত বড় দায়িত্ব পেলেন সেবারই প্রথম। ১৯৯২ ইউরোর কোয়ালিফাই উতরানোটাই নীলসেনের সামনে ছিল প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। 

    নীলসেনের মুখে স্বপ্ন পুরণের হাসি

    সে যাত্রায় প্রথম তিন ম্যাচ শেষ হতে না হতেই দলে উদয় হলো এমন অবস্থার। দুই লাউড্রপ ভাই নীলসেনের ডেনমার্ককে 'না' করে দিলেন। তবু নীলসেন তার মতাদর্শে অনড় থাকলেন ওই স্ট্যাচুগুলোর মতোন। তাদের ছাড়াই ডেনমার্ক কোয়ালিফায়ারের পরের পাঁচটি ম্যাচ খেললো, জিতলো সবকটিতেই। ৮ ম্যাচ শেষে ডেনমার্কের মোট পয়েন্ট দাঁড়াল ১৩, যুগোস্লাভিয়ার চেয়ে এক পয়েন্ট কম। গ্রুপ সেরা মুল ইউরোতে যেতে পারে, গ্রুপে রানার্সআপ হয়ে তাই ডেনমার্কের ১৯৯২ ইউরোর আশা ভেস্তে গেল। যদিও যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধ ডেনমার্কের ইউরো আশা একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দিচ্ছিলো না। শেষমেশ অশান্তির যুদ্ধটাই ডেনিশদের মনে শান্তি হয়ে ধরা দিলো। যুগোস্লাভিয়াকে উয়েফা নিষিদ্ধ করলো। ইউরো শুরুর দশদিন আগে ডেনমার্ক জানতে পারলো, তাদের খেলতে হবে ইউরোর মুল পর্বে। 

    নীলসেনের ডাকে সবাই হাজির। ডেনমার্ক ছাড়ার আগে কোপেনহেগেনে ট্রেনিংয়ে সবাইকে জড়ো করে নীলসেন বললেন, 'একটা কথা পরিষ্কার করা যাক। আমরা সুইডেন যাচ্ছি শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরবার জন্যেই।' তখন হাসলেন কেউ কেউ, মনে মনে। 

    ****

    কিম ভিলফোর্ট একই সাথে দুটি দুনিয়ায় বসবাস করছেন। দুই দুনিয়ায় পালন করছেন দুটি ভিন্ন দায়িত্ব। এক দুনিয়ায় থাকলে, আরেক দুনিয়া যাওয়া মানা৷ সাত বছরের মেয়ে তার লড়ছে ক্যান্সারের সঙ্গে। খেলা বাদে হাসপাতালেই কাটছে জীবন। ডেনমার্ক ইউরোতে সুযোগ পেলে পাড়ি দিতে হলো অপর দুনিয়ায়। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের আগে জানতে পারলেন, হাসপাতালে তার থাকা চাই। সুইডেন থেকে তাই ফিরলেন ডেনমার্কে। 

    ওদিকে ফ্রান্স পুঁচকে ডেনমার্ককে পাত্তা দিচ্ছে না খুব একটা। আগেভাগেই জানিয়ে দিচ্ছে ম্যাচের ফলাফল। বাঁচা-মরার এ ম্যাচে ডেনমার্কের জয়ই শুধু যথেষ্ট ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য ইংল্যান্ডের হারও প্রয়োজন ছিল। খেলা শুরুর আট মিনিট পরই ফ্রান্সের দাম্ভিকতায় আঘাত হানলেন লারসেন৷ ডেনমার্ক এগিয়ে গেলেও অন্যদিকে এর আগেই লিড নিয়ে নিয়েছিল ইংল্যান্ড।

    ভিলফোর্ট তখন হাসপাতালে। মেয়ের সাথে ডেনমার্কের পতাকা সঙ্গে করেই খেলা দেখছিলেন। প্রথমার্ধ শেষে ফেভারিট ফ্রান্সের সাথে এগিয়ে ডেনমার্ক। বাবা-মেয়ের মনে কি যে আনন্দ! দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর মিনিট পনেরো পরে এরপর সেই আনন্দের জায়গা বাগিয়ে নেয় নিরাশা৷ পাপিনের গোলে সমতা চলে আসে ম্যাচে।

    ডেনমার্কের '৯২ রুপকথায় ভিলফোর্ট

    মাসকয়েক আগেই নিজের সিদ্ধান্ত বদলে জাতীয় দলে আবার ফিরেছিলেন ব্রায়ান লাউড্রপ। লাউড্রপের ওই দিনটা তেমন ভালো যাচ্ছিলো না। নীলসেন তাই তাকে নামাতে বাধ্য হলেন। বদলি নেমে ইলস্ট্রুপ এরপর অবিশ্বাস্য কিছুর জন্ম দিলেন ৭৮ মিনিটে গোল করে। 

    ফ্রান্সের সাথে জয় পেলো ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড-সুইডেন ম্যাচেও তাদেরই হলো জয়। ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিলো সুইডেন। তাতে ইংলিশদের সাথে টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ফ্রান্সকেও বাড়ির পথ ধরতে হলো। ভিলফোর্টকে ইতিহাস গড়তে আবার রওয়ানা হতে হলো সুইডেনের পথে। 

    ****

    মার্কো ফন বাস্তেন, রোনাল্ড কোম্যান, ডেনিস বার্গক্যাম্প। টানেলে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বসেরাদের বিস্ময়ের চোখে দেখছেন ব্রায়ান লাউড্রপ। ডাচদের দেখে লাউড্রপের মনে হলো তাদের ভাবখানা এমন যেন নামলেই তাদের জয় নিশ্চিত, ফাইনালের একটা টিকিট বুকিং করে আগেভাগেই রাখতে হবে তাদের জন্য। আনুষ্ঠানিকতার জন্য নামা আরকি! শুধু ডাচরা কেন, সকলের ভাবনাই ছিল এমন। কেবল ডেনিশদের ছাড়া! 

    ভিলফোর্ট বলেন, 'প্রত্যেকের মাঝে জয়ের ক্ষুধা ছিল। আর এত বড় মঞ্চে জয়ের সাহসটা থাকা খুবই গুরুত্বপুর্ণ।' দশ মিনিটেরও খেলা শেষ হয়নি তখন, স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠলো- ডেনমার্ক ১-০ নেদারল্যান্ডস। এরপর ২৩ মিনিটে বার্গক্যাম্প সমতা ফেরালে দশ মিনিট পর আবার ডেনমার্ককে এগিয়ে দেন লারসেন। প্রথমার্ধ শেষে স্কোরলাইন দেখায় এমন- ডেনমার্ক ২-১ নেদারল্যান্ডস। দ্বিতীয়ার্ধ শেষের পথে, স্কোরলাইন যেমন ছিল তেমনই আছে। ডেনিশদের ইতিহাস গড়তে আর অপেক্ষা মাত্র চার-পাচঁ মিনিটের। ৮৬ মিনিটে রিজকার্ড গোল করে অপেক্ষাটা আরও বাড়িয়ে দিলেন। খেলা গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে, সেটি কোন ব্যবধান গড়ে দিতে পারলো না। টাইব্রেকারে সবাই গোল করলো, দশজনের মধ্যে পারলেন না শুধু মার্কো ফন বাস্তেন, স্মাইকেল পারতে দিলেন না বলে! তাতেই বেজে উঠলো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডসের বিদায় ঘণ্টা। 

    ডাচদের সাথে ওই সেমিফাইনালের আগে নীলসেনকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'আপনি কি এই চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের জন্য আরও একটি চমক রাখতে যাচ্ছেন?' উত্তরে নীলসেন বলেছিলেন, 'আমি তো তাই আশা করি, কেন নয়!' বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালের আগেও যদি তাকে একই প্রশ্ন করা হতো, তাহলে নীলসেন নিশ্চয়ই বলতেন, 'কেন নয়?'

    ****

    জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে কাজ চলছে। চ্যাম্পিয়নরা ঘরে ফিরবে। তৈরি হচ্ছে ইউরোপ সেরাদের স্বাগতম জানানোর মঞ্চ। নাহ, জার্মানির তখনও চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাকি! 

    পরদিন ফাইনাল। জার্মান ফুটবলার স্টিফান এফেনবার্গের ফোন কল এলো ব্রায়ান লাউড্রপের কাছে। শেষ বাঁশি বাজার পরে জার্সি অদল-বদলের প্রস্তাব পেলেন। ব্রায়ান লাউড্রপের মনে হলো এফেনবার্গের গলার সুর বলছে, জার্মানি তো জিততে যাচ্ছে সহজেই! 

    জার্মানদের কাছে আনুষ্ঠানিকতার রুপ পাওয়া সে ফাইনাল চলছে। বক্সের কিনারা থেকে হঠাৎ করে কেউ একজন জোরে একটা শট নিলেন, যেন জাল ছিড়ে পড়বার উপক্রম! সেটি এমন এক গোল, যেটি দেখবার পরে আপনার নিশ্চিতভাবেই জানার আগ্রহ জাগবে, কে করলো এই গোল? মেজর টুর্নামেন্টে সেবারই প্রথম জার্সির পিছনে নাম লেখার চলের শুরু। লাল-সাদা জার্সি পরিহিত ওই একজনের পেছনে লেখা ছিল- Jansen।

    ডেনমার্কের এই মিডফিল্ডার এর আগে তার জীবনে ৪৮ ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন মাত্র একটি। তার দ্বিতীয় গোলটা যখন ডেনমার্কের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচে এলো, তখনই লাউড্রপের মনে হলো, সুযোগ আছে তাদের। লিড নেওয়ার চাইতে লিড ধরে রাখাই যে কঠিন! ১৮ মিনিটে ইয়ানসেনের ওই গোলের পরে তা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে ডেনমার্ক, বিশেষ করে পিটার স্মাইকেল। তবু বহু চেষ্টায় স্মাইকেলের জালে জার্মানরা বল পাঠাতে পারেনি একবারও। শেষের দিকে কিম ভিলফোর্ট গোল করে ইতিহাসের পথে এগুলেন আরেকটু। খেলা শেষের বাঁশি বাজলো একসময়। ডেনিশরা পাগলা ঘোড়ার মতো বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন। উদযাপন শেষে চারিদিকে তাকালেন লাউড্রপ, স্টিফেনবার্গকে খুঁজে পেল না তার চোখ। 

    রুপকথা লিখে ডেনমার্ক ইউরোপ সেরা

    সুইডেনে হওয়া ওই ইউরোর স্লোগান ছিলো 'স্মল ইজ বিউটিফুল'। আট দেশের মাঝে হওয়া পনেরোটি ম্যাচের ছোট্ট টুর্নামেন্টটাও তো সুন্দরই ছিল। আট দেশের অংশগ্রহণে হওয়া সর্বশেষ আসর ছিল সেটিই। অভাবনীয়-অকল্পনীয় ঘটনায় ভরপুর ইউরোটিতে সবশেষে শিরোপা যার হাত উঠেছে, সেই দেশটিও ছিল পাচঁ মিলিয়ন মানুষের ছোট্ট একটা দেশ। স্লোগানটা তাই মিলে যায় একেবারে খাপেখাপ।

    শিরোপাবিহীন খালি হাতে ফেরা জার্মানরা ফ্রাঙ্কফুর্টে কিভাবে স্বাগত হয়েছিল জানা নেই। তবে নীলসেনের দেখা স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নেবার পরে এক সুন্দর গ্রীষ্মে উল্লাসে মাতোয়ারা ছিল সমগ্র ডেনমার্ক। আমজনতার উৎসবে পরিণত হয়েছিল সে ইউরো জয়। হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় থেকে হয়তো সে উপলক্ষে যোগ দিয়েছিলেন কিম ভিলফোর্টের মেয়েও। বাবার ঐতিহাসিক সেই গোলটা দেখার মাসখানেক পরে, ভিলফোর্টের সাত বছরের মেয়ে শেষমেশ দীর্ঘদিনের লড়াইয়ে হেরে যায় ক্যান্সারের সঙ্গে। ভিলফোর্টের দুই দুনিয়ার একটি তাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভিলফোর্ট তখন হয়তো শোকে পাথর হয়ে যাবেন, ওই স্ট্যাচুগুলোর মতোন। 

    ****

    কিম ভিলফোর্টের ইতিহাসের সঙ্গে যোগসুত্র ছিল। ভিলফোর্ট বলেন, 'আপনি ইতিহাস থেকে একটি জিনিস শিখেন যে এটি প্রায়শই আবার ফিরে আসে’। '

    ‘৯২ ইউরোয় পরের পর্বে পাড়ি দেওয়ার জন্য গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে জয়ের সাথে যেমন অন্য শর্ত জুড়ে দেওয়া ছিল, একুশে হওয়া ইউরো ‘২০ এও তাই। তবে সেবার ডেনমার্ক প্রথম দুই ম্যাচে সুইডেনের সাথে হারলেও ইংল্যান্ডের সাথে ড্র করেছিলো। এবার দুটিতেই হেরেছে ডেনিশরা। এমন দশার পরে ইউরোর ইতিহাসে কেউ যেখানে নকআউটের ঘরেই পা রাখতে পারেনি, সেখানে ডেনমার্ক সেমিফাইনালে পা রেখেছে। অলৌকিক ‘৯২ ইউরোয় জিততে হতো এমন সমীকরণে মাঠে নেমে তিনটি ম্যাচ জিতেছিল ডেনমার্ক, এবারও তিনটিই জিতেছে। তবে '৯২ ফিরিয়ে আনার জন্য এই ইউরোতে আরও যে দুটি জয়ের দরকার ছিল তা পারেনি ডেনমার্ক। শিরোপা না এলেও তবু যে দুর্দশা থেকে তারা এতদুর যেতে পেরেছে, সেটাও রুপকথার গল্পই বটে। 

    কার্ডিয়াক অ্যারেষ্টে খেলার মাঝেই মাঠে লুটিয়ে পড়ে সতীর্থ ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন যেন মরণের সন্নিকটে। পুরো বিশ্বের বুকেই লাগলো ধাক্কা। আর সে ধাক্কাটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছেন তো এরিকসেনের সতীর্থরাই! এমন দুরবস্থায় থেকে ডেনমার্কের সেমিফাইনালে যাওয়াটা তাই অলৌকিকের চেয়েও কম কিছু নয়। এরিকসেনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভিলফোর্টও তাতে অবাকই হয়েছেন।

    ফিনল্যান্ডের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে ডেনমার্ক হেরেছিল, সেদিন স্মাইকেলদের হৃদয়ে এরিকসেনের বসবাস সুখকর হয়নি। কায়ের-স্মাইকেলদের জন্য এরিকসেন সেদিন পরিণত হয়েছিলেন দুর্বলতায়, সেই এরিকসেনই এরপর তাদের শক্তি হয়ে উঠলেন। সে শক্তিতে ডেনমার্ক নিজেদের সক্ষমতাকেও যেন ছাড়িয়ে গেলো। এরিকসেনের জন্যে লড়ে যাওয়া ডেনমার্ক বেলজিয়াম ম্যাচেই আভাস দিচ্ছিল কিছু একটা করার। সেদিন পারেনি, তবে এরপর ইতিহাস গড়েই কোয়ার্টার ফাইনালে পৌছে গেছে। টানা দুই ম্যাচে দিলো চারটি করে গোল। যে দলটা কয়েকদিন আগেই সতীর্থের মরণাপন্ন অবস্থা দেখে এসেছে। এই অবস্থায় খেলতে নামাটাই যেখানে ভীষণ কঠিন, সেখানে এমন দাপটের সাথে খেলা তো তার চেয়েও বেশি কষ্টকর। সেই কঠিন কাজটাই তারা করেছে তাদের সেরা খেলোয়াড়কে ছাড়াই। এরিকসেনের প্রত্যক্ষ ভুমিকা না থাকলেও তবু তার পরোক্ষ ভুমিকাটা ডেনমার্কের এগিয়ে যাওয়ার পথে জ্বালানী হিসেবেই কাজ করেছে। আর সে জ্বালানী ডেনমার্কের পারফর্ম্যান্সের গতি বাড়িয়ে পৌছিয়ে দিয়েছে সেমিফাইনালে।

    ****

    চেক প্রজাতন্ত্রকে বিদায় করে সেমিফাইনালে পৌছেছিল ডেনমার্ক। বাবাও যা পারেননি, সেমিফাইনালে তা-ই করে দেখিয়েছেন ক্যাসপার স্মাইকেল। ডেনমার্কের হয়ে ইউরোতে এক ম্যাচে তার চেয়ে বেশি সেভ দিতে পারেননি আর কেউই। সেদিন দশটা সেভ দিয়ে ডেনমার্ককে রক্ষা করেছিলেন তিনি। তবে শেষমেশ বিতর্কিত এক পেনাল্টির সিদ্ধান্তে  থামতে হয়েছে তাদের। অবশ্য ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের ট্রফিটা ছুয়ে দেখার সৌভাগ্য একবার হয়েছে তার। ১৯৯৬ সালের ইউরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছয় বছর বয়সী ক্যাসপার স্মাইকেল শিরোপার ছোঁয়া পেয়েছিলেন, তবু শিরোপা জয় করে সেটা নিজের ভেবে আপন মনে ছোঁয়াটা তো ভিন্ন অনুভুতির ব্যাপার। বাবা পিটার স্মাইকেলের মতো ক্যাসপার স্মাইকেল তা না পারলেও, বাবা-ছেলে দুজনেই সামিল হয়েছেন দুটি অসামান্য রূপকথার গল্পে। 

    এমন গল্প রূপকথার সম্রাট হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসেনেরও কি লিখার সাধ্য ছিলো? উত্তরটা তো তিনি মৃত্যুর আগেই দিয়ে গেছেন। 

    ‘লাইফ ইটসেলফ ইজ দ্যা মোস্ট ওয়ান্ডারফুল ফেইরিটেল’ 

    আসলেই তো! জীবনের চেয়ে বড় রুপকথা আর কিই-বা হতে পারে!