ব্রাজিলকে হারিয়ে ২৮ বছর পর শিরোপা জিতল মেসির আর্জেন্টিনা
ফুলটাইম স্কোর: ব্রাজিল ০-১ আর্জেন্টিনা
একটা শিরোপার জন্য চাতক পাখির মত তৃষিত অপেক্ষা ছিল আর্জেন্টিনার। অবশেষে মারাকানায় এল স্বস্তিটা। আনহেল ডি মারিয়ার একমাত্র গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে তাদেরই মাঠে হারিয়ে ২৮ বছর পর কোপা আমেরিকা জিতল আর্জেন্টিনা। টানা চার ফাইনালে হারার পর মেসিও পেলেন অধরা আন্তর্জাতিক ট্রফির স্বাদ।
ফাইনালের উত্তেজনা শুরু থেকেই হয়ত কিছুটা পেয়ে বসেছিল খেলোয়াড়দের। মধ্যমাঠের দখলে মনযোগী হওয়া দুই দল বলের দখল নিতে গিয়ে শুরু থেকেই ফাউল করতে থাকে। খেলা কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে ১৩ মিনিটের মাথায় বক্সে সুযোগ তৈরি করেছিল ব্রাজিল। রিচার্লিসন বক্সে ঢুকে পিছে থাকা নেইমারের উদ্দেশ্যে বল বাড়ালে সেখান থেকে তিনি নিয়েছিলেন জোরালো হাফ ভলি। তবে জায়গামত থাকায় কোনো বিপদ ঘটতে দেননি ওটামেন্ডি। ২০ মিনিটের মাথায় একইভাবে সুযোগ তৈরি করেছিল স্বাগতিকরা। তবে এবার নেইমারের হাফ ভলি ঠেকিয়ে দেন ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো।
খেলার ধারার বিপরীতে এরপরেই অবশ্য গোল পেয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ২৩ মিনিটের মাথায় মাঝমাঠেরও পেছন থেকে লম্বা করে বল বাড়ান রদ্রিগো ডি পল। সেই বল সহজেই ফিরিয়ে দিতে পারতেন রেনান লোদি। তবে তিনি ভুল করে বসায় পেছনেই ওঁত পেতে থাকা ডি মারিয়া বল পেয়ে যান। বিপদ আঁচ করতে পেরে পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এডারসন। তবে ডি মারিয়া যে বড় ম্যাচের খেলোয়াড় সেটা তিনি প্রমাণ করলেন আরও একবার। ২০০৮ অলিম্পিক ফাইনালের গোলটাকে মনে করিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তিনি আগুয়ান এডারসনের মাথার উপর দিয়ে চিপ করে বল জালে জড়ান। ২০০৫ সালের পর এই প্রথম কোনও বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে গোল পেল আর্জেন্টিনা।
গোলের পর আর্জেন্টিনা উজ্জীবিত হয়ে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। ৩২ মিনিটের মাথায় মার্কিনিয়সকে কাটিয়ে বিপদজনক জায়গায় গিয়েও মেসি গোলমুখে রাখতে পারেননি শট।
প্রথমার্ধের শেষে এসে অবশ্য চেপে বসেছিল ব্রাজিল। ৪২ মিনিটের মাথায় বাঁ প্রান্তে জায়গা বানিয়ে জোরালো শট নিয়েছিলেন এভারটন। তবে ডিফেন্ডাররা পা বাড়িয়ে শট দুর্বল করে দিলে সহজেই বল লুফে নেন এমি মার্টিনেজ। ৪৫ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে হেডের সুযোগ পেয়েছিলেন রিচার্লিসন। তবে তার হেড পোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে গেলে এক গোলের ব্যবধানে এগিয়ে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই তেড়েফুঁড়ে আক্রমণে যায় সমতা ফেরাতে মরিয়া ব্রাজিল। পাকেতার বাড়ানো বল ৫২ মিনিটের মাথায় ডান প্রান্তে ফাঁকায় পেয়ে যান রিচার্লিসন। সেখান থেকে শট নিলে প্রথমবার এমি মার্টিনেজ তাকে ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি শটে বল জালে জড়ান। তবে পাকেতার পাস দেওয়ার সময় তিনি অফসাইডে ছিলেন বলেই সেই গোল বাতিল হয়ে যায়।
৫৫ মিনিটের মাথায় চমৎকার আরেকটি সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিল। দারুণভাবে জায়গা ফাঁকা করে নেইমার বল বাড়িয়েছিলেন রিচার্লিসনের উদ্দেশ্যে। বলের নিয়ন্ত্রণ ঠিকভাবে নিতে না পারলেও শট তিনি ঠিকই নিয়েছিলেন। তবে দারুণ ফর্মে থাকা এমি মার্টিনেজও কোনো ভুল করেননি।
ব্রাজিল এরপর মুহুর্মুহু আক্রমণ করে গেলেও আর্জেন্টাইন রক্ষণের দৃঢ়তায় গোলমুখে একেবারেই সুবিধা করতে পারছিলো না। বরং ম্যাচের ধারার বিপরীতে গিয়ে ৬৫ মিনিটের মাথায় মেসি পেয়ে যাচ্ছিলেন গোল। নিজেদের অর্ধে মার্কিনিয়স ভুল করে বসলে সেখান থেকে মুহূর্তেই বল ছিনিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন মেসি। তবে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা ডি মারিয়াকে তিনি খেয়াল না করায় সামনে ডিফেন্ডার থাকলেও শট নিলে সেই যাত্রায় প্রতিহত করা হয় তাকে।
এই ভুল থেকে কোনো বিপদ না হওয়ায় আবারও জোরেসোরে আক্রমণে ওঠে ব্রাজিল। দারুণ প্রচেষ্টায় আবারও নেইমার বক্সের মাঝে খুজে নেন পাকেতাকে। তবে বাঁ পায়ের শট গোলমুখে রাখতে পারেননি তিনি।
শেষ দশ মিনিটে ব্রাজিলের আক্রমণের ঢেউ দৃঢ়তার সাথে সামলেছে পুরো আর্জেন্টাইন রক্ষণ। ৮৩ মিনিটের মাথায় বাঁ প্রান্তে বিপদজনক জায়গায় বল পেয়ে যায় বদলি হিসেবে নামা গ্যাব্রিয়েল বারবোসা। তবে অসাধারণভাবে একরকম উড়ে এসেই তার শটের সামনে গা পেতে দেন ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। ৮৫ মিনিটের মাথায় নেইমার দারুণ কর্নার ভাসিয়েছিলেন সিলভার উদ্দেসশ্যে। গোলমুখে অবশ্য হেড রাখতে পারেননি তিনি। ৮৭ মিনিটের মাথায় বাঁ প্রান্ত থেকে নেইমারের ভাসানো ক্রস ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করলে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা গাবি বক্সের মধ্যে বল পেয়ে নেন জোরালো শট। এমি মার্টিনেজ অবশ্য ছিলেন অটল, শেষ মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রেখে করেন গুরুত্বপূর্ণ সেভ।
ব্রাজিলের উপর্যুপরি আক্রমণের ঢেউ সামলে প্রতি-আক্রমণে উঠে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ৮৯ মিনিটে মেসি করে বসেন স্বভাববিরুদ্ধ এক মিস। বক্সের মাঝে রক্ষণচেরা পাসে মেসিকে একা অবস্থায় বল বাড়িয়ে দেন ডি পল। মেসি সেখান থেকে এডারসনকে কাটিয়ে বের হবার চেষ্টা করলে তাকে প্রতিহত করেন তিনি। ৯৩ মিনিটের মাথায় বক্সের মাঝে এমারসন একদম ডি পলের পায়ে বল তুলে দিয়েছিলেন। তবে আবারও শরীর প্রসারিত করে গোলমুখে প্রচেষ্টা প্রতিহত করেন এডারসন।
তবে তাতে কী আর লাভ হয়! ব্রাজিলের যে প্রয়োজন ছিল গোল। নেইমার যদিও এদিনও ছিলেন বেশ সপ্রতিভ, কিন্তু ফরওয়ার্ডদের গোলমুখে অপারদর্শিতা নিয়ে যেই চিন্তা তিতের কপালে ভাঁজ ফেলেছিল তাতেই আর খোলেনি আর্জেন্টাইন রক্ষণের গেরো। মন্তিয়েলের পা দিয়ে ঝরছিল রক্ত, তবে দলের জন্য নিজেকে বলের সামনে পেতে দিতে কার্পণ্য করেননি। স্কালোনির চিন্তার জায়গা ছিল যেই ওটামেন্ডি, সেই তিনিও দেখিয়েছন দারুণ পারফরম্যান্স। আর ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো বরাবরের মতই ছিলেন দেয়াল হয়ে। ব্রাজিল আর তাদের প্রতীক্ষিত গোলের দেখা না পাওয়ায় ডি মারিয়ার গোলটাই তাই গড়ে দেয় ব্যবধান। নেইমারদের কাঁদিয়ে আকাশী নীল শিবির ভাসে বাধভাঙ্গা উল্লাসে।
১৯৫০ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা ব্রাজিলিয়ানরা কেঁদেছিল উরুগুয়ের কাছে হেরে এই মারাকানাতেই। এরপর ৭১ বছর ধরে ব্রাজিল আর কখনো হারেনি সেখানে। লিওনেল মেসির অধরা ট্রফির অপেক্ষার অবসান হল সেই মারাকানাতেই, যেখানে সাত বছর আগে অল্পের জন্য বিশ্বকাপে চুমু খাওয়া হয়নি তার। শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে তাই মেসি কাঁদলেন। এই কান্না আনন্দের, এই কান্না বিজয়ের, এই কান্না বহু বছরের আক্ষেপ ঘোচানোর, এই কান্না সমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়ার!