• " />

     

    আলফ্রেড শ: এক ম্যাচে দুই হ্যাটট্রিক এসেছিল যার হাত ধরে

    আলফ্রেড শ: এক ম্যাচে দুই হ্যাটট্রিক এসেছিল যার হাত ধরে    

    ক্রিকেটার হলে টাকা আর টাকা! আলফ্রেড শ বলতে গেলে সারাটা জীবনই ব্যয় করেছেন ক্রিকেটে। সেকালের ক্রিকেট তো অবশ্যই ছিল না একালের মতো। তাই আলফ্রেড শয়ের বংশ-বুনিয়াদ তার উপার্জিত আয়ে যে আরাম-আয়েশে জীবন অতিবাহিত করেছে, সেটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। তিনি নিজেও যে খুব বিলাসপূর্ণ জীবন যাপন করেছেন তাই হয়তো না। তবু ভালোবাসার ক্রিকেট ছেড়ে মৃত্যুর পুর্বে যখন আলফ্রেড শ পেছন ফিরে তাকাবেন, নিজের গড়া কিছু ইতিহাসের কথা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন নিশ্চয়ই। তার মাঝে একটি রেকর্ড স্বস্তির বদলে তাকে গর্ববোধের অনুভুতিই এনে দিবে। এই পৃথিবীকে তিনিই তো প্রথম বুঝিয়েছেন এক ম্যাচে দুইবার হ্যাটট্রিক করাও সম্ভব! 

    তা সে রেকর্ডই যে সম্ভব হতো না! আলফ্রেড শয়ের ক্রিকেট খেলারই তো তেমন সম্ভাবনা ছিল না। ভাইয়ের বাতরোগে দেখা দিয়েছে, তাই আলফ্রেড শ গেছেন ভাইকে দেখতে। যেখানে গেছেন সেখানে এক ভদ্রলোকের নেটে ব্যাট করার ইচ্ছে জাগল। সে ইচ্ছেপুরণে সহায়তা করতে অনুরোধ পেলেন তিনি। খেলাটার প্রতি পুর্বের টান এবং সেই টানের ফলে কাজের ফাঁকের সুযোগে খেলা- এ দুয়ের সংমিশ্রণে তার মন অনুরোধ রক্ষা না করে আর পারল না। ওই ভদ্রলোকের তাই আলফ্রেড শয়ের প্রতি মুহুর্তের জন্য হলেও কৃতজ্ঞতা দেখানোর কথা। কিন্ত সে অনুরোধ রক্ষার্থে শয়ের জীবন পাল্টে যাওয়ার দরুণ উল্টো শ'রই যে সারাজীবন ওই ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কথা!

    যখন আপনি জানবেন আলফ্রেড শ তার ক্যারিয়ারে ২০২৭টি উইকেট নিয়েছেন, আপনার চোখের তখন কপালগমনের সম্ভাবনা বিদ্যমান। পরক্ষণেই আবার সে বিস্ময় কেটে যাবে যখন জানবেন, আরো ৩২ জনও তাদের জীবনে দুই হাজারের বেশি উইকেট নিয়েছেন। কিন্ত ৩৩ জনের এ তালিকায় তার গড় সবচেয়ে কম এবং একমাত্র তারই ইকোনমি দুইয়ের নিচে- এটা জানলে আপনার বিস্ময় ফিরে আসতে বাধ্য। আলফ্রেড শয়ের সে ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তিকাল দীর্ঘ ৩৩ বছর। সেসময়ে তিনি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন ৪০৪টি, যাতে ২০২৭ উইকেটের প্রতিটি নিতে লেগেছে মাত্র ১২ বল(১২.১২) এবং ওভারপ্রতি খরচা করেছেন মাত্র ১.৪৪ রান। তবে শয়ের এই ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে যতটা না বের করিয়ে আনবে, সে কাজটা করতে তার চেয়ে বেশি সক্ষম দুটি অন্য রেকর্ড। যে দুটি রেকর্ডই আসলে তার অমরত্ব নিশ্চিত করে দিতে যথেষ্ট। 

    টেস্ট ক্রিকেটের শুভযাত্রাটা হয়েছিলো যে বল দিয়ে, সেটি তো ছুটেছিলো শয়ের হাত থেকেই। অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটের সুচনার কথা যতদিনই উঠবে, ততদিনই আসবেন আলফ্রেড শ, টেস্ট তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেরই প্রথম বলটা যিনি করেছিলেন। এই প্রথমে ভাগ্যের কিছুটা অবদান থাকলেও আরেকটি প্রথমে কিন্ত সেভাবে ভাগ্যের ভাগ বসানোর সুযোগ সংকীর্ণ। ডাবল হ্যাটট্রিকের মতো অকল্পনীয় বিষয়কেও বাস্তবতায় হাজির করানোর পুরো কৃতিত্বই তো শয়ের। রেকর্ডে ভরপুর খেলা ক্রিকেটে শয়ের ক্যারিয়ারেও আছে রেকর্ডের সমাহার। অবশ্য ক্রিকেটার না হলে আলফ্রেড শয়ের তো এতসব পাওয়া হয়না। আর ওই ভদ্রলোক না হলে হয়তো আলফ্রেড শ'র ক্রিকেটার হওয়ার লুকায়িত বাসনাটাই 'পৃথিবীর মুখ দেখতে পায় না'।

    ক্রিকেট খেলে জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারটা আসলে বিশ বছর বয়সী শয়ের ধারণার বাইরেই ছিল৷ কাজের ফাঁকে ভালোবাসার টানে ক্রিকেট খেলা, এই যা! দুঃখের সময়েও নাকি খুঁজে নিতে হয় সুখ। শয়ের ভাইয়ের বাত রোগের সময়ে সুখই খুঁজে নিয়েছে আলফ্রেড শকে৷ ওই 'ইচ্ছেপুরণের নেট সেশন' শেষে ভদ্রলোক বলেছিলেন, 'তুমি তো আর্থারের থেকেও ভালো বল করো'। শয়ের ক্রিকেট খেলুড়ে দুই ভাইয়ের একজন আর্থার। ছিলেন তারঁ ক্লাবের মুল বোলার। ওই ভদ্রলোক ছিলেন সে গ্র‍্যান্থাম ক্রিকেট ক্লাবেরই একজন ক্রিকেটার। সেই ক্রিকেটার আর ভাইয়ের রোগ অমুক্তি- এ দুয়ে মিলে আলফ্রেড শর হাতে এনে দেয় সুযোগ। যা তিনি মুঠোবন্দী করেছেন বেশ জোরেশোরেই, যার কারণে ক্লাবে ভাইয়ের জায়গাটা পরে হয়ে গেছে তারই। 

    ক্লাব, কাউন্টি, জাতীয় দল- আলফ্রেড শ খেলে গেছেন ৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ৮ আন্তর্জাতিক টেস্টের একটি বাদে সবই খেলা হয়েছে আলফ্রেড শয়ের। ইংল্যান্ড তার নেতৃত্বে চার টেস্টে দুই ড্রয়ের বেশি কিছু ফল পায়নি। তবে নটিংহ্যামশায়ারকে টানা চারবার চ্যাম্পিয়ন করার গৌরবটাও যে হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়া যায় না!

    অবসর নেয়ার দুই ম্যাচ আগে কনকনে শীতে চলছিল কাউন্টির এক ম্যাচ। জানা যায়, রঞ্জিতসিংজি মাঝে মধ্যে হাত পকেটে ঢুকিয়ে পা দিয়েই ফিল্ডিং করছিলেন- শীতের মাত্রা বুঝতে এই উদাহরণই যথেষ্ট। ম্যাচটা ছিল নটিংহ্যামশায়ার আর সাসেক্সের মধ্যকালীন। ১৮৭১ থেকে ১৮৮০, এই দশ সিজনের দুটি বাদে সবটিতেই নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে আলফ্রেড শ প্রতি মৌসুমে শিকার করেছেন ১০০টির বেশি উইকেট।

    নটিংহ্যামশায়ারের আলফ্রেড শই রেকর্ড বুকের অনেক পাতা জুড়ে। তবে ওই ম্যাচটায় তার প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকা দলটির নামই ছিল নটিংহ্যামশায়ার। নটিংহ্যামশায়ারে থাকাকালীন অবসর নিয়ে আবার ফিরেছিলেন সাসেক্সের হয়ে। মাঝখানে আম্পায়ারিং ও কোচিংয়ের মাধ্যমে ক্রিকেটের সঙ্গেই থেকেছেন। ১৮৯৪ সালে এরপর অবসর ভেঙ্গে ৫২ বছর বয়সে আবার নেমেছেন বল হাতে। পরের বছরই আরো দুই ম্যাচ খেলে পুরোপুরি অবসরে চলে যাওয়ার আগে ওই ম্যাচটা। কনকনে শীতে বরফ হয়ে যাওয়ার অবস্থা প্রায়, ওই ম্যাচটা। 

    সেখানে আলফ্রেড শয়ের হৃদয়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা নাম নটিংহ্যামশায়ার ব্যাট করতেই থাকে, শ বল করতেই থাকেন। যদিও এ অভ্যাসটা তার নতুন নয়। ওভারের পর ওভার, এরকম বোলিং করে গেছেন অনেক ম্যাচেই। তবে একটি ম্যাচ তারঁ মস্তিস্কের নিউরনে আলাদাভাবেই স্মৃতিতে জমা আছে। সে ম্যাচেও শুধু বলই করে গেছেন শ। অপরপ্রান্তে আরেকজনকেও বল করার সুযোগ দিতে হয় বলে অ্যাটওয়েলকে বোলিং সঙ্গী বানিয়েছেন। তাই পুরো ম্যাচেই এ দুজন বাদে তাদের দলের আর কারোরই বল করার সুযোগ মেলেনি। তবে ম্যাচটা তারঁ স্মৃতির জাদুঘরে অন্যরকম মর্যাদায় আসীন একমাত্র এই কারণেই নয়। এ ম্যাচে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আলফ্রেড শর এক ম্যাচে দুই-দুইবার হ্যাটট্রিক করা সম্ভব জানানোটাই যে মুখ্য!

    টানা দুই বলে দুই উইকেট, বোলার অন অ্যা হ্যাটট্রিক। পুরো ম্যাচে এভাবে আলফ্রেড শ হ্যাটট্রিকের সুযোগ তৈরি করেছেন পাঁচবার, যার মধ্যে দুবার তিনি সফল হয়ে মেতেছেন বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে। যেন বাঁধ ভেঙ্গে আসা পাগলা স্রোত আর ঢেউয়ের মতোন। এ যে অমুল্য হ্যাটট্রিক প্রাপ্তির আনন্দ। সেই হ্যাটট্রিকের অমৃত স্বাদ যখন একই ম্যাচে দুইবার আস্বাদনের সুযোগ মেলে, সে ভাগ্যবানের তখনকার অবস্থা বুঝে নেওয়ার দায়িত্বটা আপনার কল্পনাশক্তির উপরই না-হয় ছেড়ে দিলাম! 

    ম্যাচে যখন আর কারোরই বল করার প্রয়োজন পড়ছে না, তখন এটা বুঝে নিতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা না যে ম্যাচটা বোলিংপক্ষই জিততে চলেছে। কাপ্তান আলফ্রেড শয়ের সাথে এটওয়েল মিলে ৩২৭ বলে প্রথমে অলআউট করেছিলেন গ্লস্টারশায়ারকে। পরের ইনিংসে এ দুজনে মিলে খেল খতম করেছেন ৩০২ বলে। মাঝখানে নটিংহ্যামশায়ার ১০৫ রানেই আটকে গেছে। অবশ্য গ্লস্টারশায়ারের ৪৯ ও ৬৩ রানের দুই ইনিংসের মিলিত প্রয়াস ৮ রানের বেশি লক্ষ্য ছুড়ে দিতে পারেনি। যা পেরিয়ে যেতে আট বলেরও বেশি সময় নেয়নি নটিংহ্যামশায়ার। এখনকার সময়ানুযায়ী আলফ্রেড শ সে ম্যাচে ৫২.৪ ওভার বল করেছিলেন মাত্র ১.২৩ ইকোনমিতে, তাতে তার শিকার ১৪ উইকেট। এতক্ষণ ওভারের পরিবর্তে বলে হিসাব দেওয়ার কারণটা হচ্ছে- তখন আসলে ওভার হতো চারটি বলে!

    এবং মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। আজি হতে শতবর্ষ আগের করা এক কর্মকান্ডের জন্য আজও তাই আলফ্রেড শ স্মরণীয়। কর্মই এনে দেয় অমরত্ব। আর আলফ্রেড শয়ের অমরত্ব লাভে তার 'ডাবল হ্যাটট্রিক' কর্মের অবদানই তো সবচেয়ে বেশি!

    তার মৃত্যুর পরে আজ অবধি আরও সাতজন ডাবল হ্যাটট্রিকের দেখা পেয়েছেন। তবে আলফ্রেড শ মৃত্যু পুর্বে এটাই জেনে গেছেন যে তিনিই এ জগতের একমাত্র ডাবল হ্যাটট্রিকিয়ান। তার জীবদ্দশায় কেউ এ কীর্তির পরশ পাননি, একমাত্র ভেবে তাই তিনি গর্ব করতেই পারেন! যে অনুভুতি টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় না, যা মিলে না ওই 'টাকা আর টাকা'য়!