দুই পক্ষই রাজি, তারপরও মেসিকে বার্সা ছাড়তে হলো কেন? জেনে নিন সবকিছু...
লিওনেল মেসি এখন আর বার্সেলোনার নন। এটাই এখন নির্মম সত্যি। বার্সেলোনার অফিসিয়াল ঘোষণার পরও যদি কোনো অনিশ্চয়তা থেকে থাকে, সেটা কেটে গেছে বার্সা সভাপতি জোয়ান লাপোর্তার বিবৃতির পর। তবে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে এটাই যে, মেসি আর বার্সা দুই পক্ষ রাজি থাকার পরও কেন মেসিকে ক্লাব ছাড়তে হলো? এমনকি ৫০ ভাগ কম বেতন না নেওয়ার পরও মেসি ক্লাবে থাকতে পারলেন না কেন? পুরো ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক
গত কালও মেসির চুক্তি সই করার তারিখ ঠিক ছিল। একদিনের মধ্যে সবকিছু বদলে গেল কীভাবে?
মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, মেসি আর বার্সেলোনা দুই পক্ষই চুক্তি সই করতে রাজি ছিল। কিন্তু লা লিগার নিয়মের মারপ্যাঁচে মেসিকে সই করাতে পারছে না বার্সা। ব্যাপারটা অনকটা এমন, আপনি একটা দামি ল্যাম্বরগিনি কিনতে চাচ্ছেন। ল্যাম্বরগিনি কর্তৃপক্ষও বিক্রি করতে চাচ্ছে। কিন্তু ব্যাংক থেকে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে সেটা মেনে আপনি কিনতে পারছেন না। মেসির ক্ষেত্রেও লা লিগা নিয়মের ব্যতিক্রম করেনি। সেজন্যই বার্সা শেষ পর্যন্ত আর রাখতে পারেনি তাকে। বার্সেলোনার এই মুহূর্তে দায় আছে ৮০০ মিলিয়ন ইউরোর মতো, শুধু গত মৌসুমেই ক্ষতি হয়েছে ৫০০ মিলিয়নের মতো। এই দায় শোধ না করে বার্সা মেসিকে দলে নিতে পারছে না।
কিন্তু ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হলো? বার্সা কি এটা আগে থেকে টের পায়নি?
এই ব্যাপারটাই আসলে একটু গোলমেলে। এমন নয় এই মৌসুমে বার্সা একদমই টাকা খরচ করেনি। ফ্রি ট্রান্সফারে এর মধ্যেই নিয়ে এসেছে আগুয়েরো, এরিক গার্সিয়া আর ডিপাইকে, যদিও রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি তারা। এমনকি এমারসনের জন্য তারা ৯ মিলিয়ন ইউরো খরচও করেছে। কিন্তু এসব খরচ না করে মেসির জন্য কি টাকাটা রেখে দিতে পারত না? লা লিগায় নিয়ম তো হুট করে বদলায়নি। তাহলে মেসির সঙ্গে ৫০ মিলিয়ন চুক্তির কথা কেন হলো? বার্সা সভাপতির দাবি, আগের অডিটেও ক্লাবের আর্থিক অবস্থা এতোটা যে খারাপ সেটা তারা বোঝেননি। শেষ মুহূর্তে এসে বুঝতে পেরেছেন পরিস্থিতি আসলে তাদের নাগালের বাইরে।
লা লিগার দায় এখানে কতটা?
বার্সা সভাপতি আদতে দায়টা চাপাচ্ছেন লা লিগার ওপর। স্পষ্ট করে বলেছেন, মেসি ও তারা রাজি থাকার পরেও তারা লা লিগার নিয়মের কারণে চুক্তিটা করতে পারছে না। এমনকি তারা দুই বছরের চুক্তির টাকা পাঁচ বছর ধরে দেওয়ার একটা প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাতে রাজি হয়নি লা লিগা। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বার্সা আশা করেছিল, মেসির জন্য এই নিয়মটা শিথিল করবে লা লিগা। কিন্তু সেটা তারা করেনি বলে জানাচ্ছেন লাপোর্তা।
কিন্তু লা লিগায় তো নতুন করে বিনিয়োগ এসেছে...
হ্যাঁ, দুই দিন আগে খবর এসেছে, বিনিয়োগ সংস্থা সিভিসি লা লিগায় ২.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। সেটার ফলে লিগের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ তাদের পক্ষে যাবে। শুরুতে মনে করা হচ্ছিল এই ডিলের ফলে বার্সা লাভবান হবে। কিন্তু আদতে এটার মানে দীর্ঘমেয়াদে লা লিগার লভ্যাংশ অন্য পক্ষের কাছে চলে যাওয়া। তার চেয়েও বড় কথা, এই ডিল করে রিয়াল ও বার্সাকে কোণঠাসা করতে চেয়েছেন লা লিগা সভাপতি তেবাস। বার্সা সভাপতি বলেছেন, এই চুক্তিটা তারা মেনে নেবেন না কারণ এর ফলে ক্লাবকে বাইরের কোনো পক্ষের কাছে বন্ধক রাখতে হবে। সেজন্য এর ফলে প্রাথমিকভাবে বার্সা লাভবান হবে, হয়তো মেসিকে রাখতেও পারবে, কিন্তু তখন লা লিগার কাছে একরকম জিম্মি হয়ে থাকবে বলেই ভাবছে বার্সা। রিয়াল এর মধ্যেই এই ডিলের বিরোধিতা করে অফিসিয়াল বার্তা দিয়েছে। আর এই চুক্তি সই হলে সুপার লিগের ধারণাও পুরোপুরি বাতিল করে দিতে হবে বার্সা-রিয়ালকে।
মেসির বিদায় কি লা লিগার জন্য ক্ষতি নয়?
এক কথায় বললে, হ্যাঁ। বার্সা যে শুধু কোণঠাসা তা নয়, করোনার সময় আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে লা লিগাও। রোনালদো চলে যাওয়ার পর মেসি লা লিগার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, তার বিদায়ে লিগ তার আকর্ষণ কিছুটা হারাবে নিশ্চিতভাবেই। স্বাভাবিকভাবেই সেটা লা লিগারও চাইবার কোনো কারণ নেই।
লা লিগা কি নিয়ম বদলাবে?
লাপোর্তার সংবাদ সম্মেলনের আগেও ভাবা হচ্ছিল, বার্সার ঘোষণাটা লা লিগার বিপক্ষে একটা চাল, বা দাবার ভাষায় চেক। কিন্তু লাপোর্তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা কোনো মিথ্যা আশা করতে চান না। মেসির সঙ্গে বার্সার চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই কোনো। এখন বল লা লিগার কোর্টে। এই মুহূর্তে বার্সাকে লাভবান করবে এমন কিছু লা লিগা করবে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে একবার এমন পরিস্থিতি হয়েছিল। ২০১৪ সালে গেটাফে মিডফিল্ডার পেদ্রো লিয়নকে বেতন কমিয়ে চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল তার ক্লাব। তিনি সেটা না মানায় তার সঙ্গে চুক্তি হচ্ছিল না। পরে আদালতে গিয়েছিলেন লিওন, এরপর অনুমতি পেয়ে খেলতে নেমেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রায় তার বিপক্ষেই গিয়েছিল। মেসির জন্য তাই আগেও ভালো উদাহরণ নেই।
কিন্তু বার্সার অবস্থা এতোটা খারাপ হলো কী করে? খেলোয়াড় বিক্রি করে কি অবস্থা কিছুটা ভালো করা যেত না?
এখানেও সমস্যার মধ্যে পড়েছে বার্সা। এমন নয় যে খেলোয়াড় বিক্রি তারা একদমই করে না। এই জুনিয়র ফিরিপোকে লিডস, জা ক্লেয়ার তদিবোকে নিসে ও ফুয়েন্তেকে এর মধ্যেই মার্শেইতে বিক্রি করেছে তারা। কিন্তু সেখান থেকে যথেষ্ট অর্থ ওঠেনি। যে অবস্থায় আছে তাতে তাদের আরও বেশি মূল্যের খেলোয়াড় বিক্রি করতে হবে। কিন্তু সেটা তারা করতে পারছে না। নেতো, রিকি পুই, ব্রাথওয়েটদের মতো ব্যাকআপদের বিক্রি করে দিলেও যে পরিস্থিতির খুব উন্নতি হবে তা নয়। সেটা হতো যদি আতোইন গ্রিজমানের মতো কাউকে করা যেত।
লা লিগার নিয়মটা কী?
লা লিগার আর্থিক নীতি কিছুটা ইউয়েফার ফিনান্সিয়্যাল পাওয়ার প্লের মতো, কিন্তু এর চেয়ে ভিন্ন। ইউয়েফা যেখানে শুধু বর্তমান অবস্থার কথা বলে, লা লিগার নিয়মে বলা আছে পরের মৌসুম শুরুর আগেই দলবদলের নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। যেমন সামনের মৌসুমে বার্সার মোট খরচের মধ্যে ক্লাবের খেলোয়াড়-স্টাফের বেতনের খরচও আসবে, কিন্তু সেটা এই মৌসুমেই সীমার মধ্যে থাকতে হবে।
বার্সার অবস্থা আসলে কেমন?
এক কথায় বলতে গেলে, ভয়াবহ। আগের সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর সময় বার্সা আকন্ঠ দেনায় ডুবে গিয়েছিল। বার্সার কাগজে কলমে এখন দেনা ১.৩ বিলিয়ন। দুই বছর আগে তারা বেতনের পেছনে খরচ করতে পারত ৬৭১ মিলিয়ন ইউরো। গত মৌসুমে সেটা কমে এসেছিল ৩৪৭ মিলিয়ন ইউরোতে। আর এই মৌসুমে সেটা কমে ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর কাছাকাছি এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যার মানে দুই বছর যা খরচ করতে পারত বেতনের অন্য, এখন তার মাত্র ২৫ শতাংশ খরচ করতে পারছে বার্সা। আর খেলোয়াড়দের চুক্তির টাকায় এর মধ্যেই ১৪৪ মিলিয়ন ইউরো পুর্ণ হয়ে গেছে বার্সার। যার মধ্যে আছে কুতিনিওর ২০ মিলিয়ন, গ্রিজমানের ২৭ মিলিয়ন ও দেম্বেলের ২৪ মিলিয়ন। কিন্তু সেভাবে কাউকে বেতন কমাতে রাজি করাতে পারেনি বার্সা। মেসির জন্য তাই ১০ মিলিয়ন খরচ করাও এখন তাদের জন্য অনেক অনেক কঠিন হয়ে গেছে।
কিন্তু বার্সা বেশি বেতনের খেলোয়াড় বিক্রি করছে না কেন?
এখানে ক্লাব পড়ে গেছে আরেক বিপদে। এই মুহূর্তে ক্লাবের শীর্ষ বেতনভোগীদের মধ্যে মোটামুটি দামে যে দুজন বিক্রি হতে পারেন, সেই কুতিনিও আর দেম্বেলে দুজনেই এখন চোট পেয়ে বাইরে। এই মুহূর্তে তাদের নিতে আগ্রহী ক্লাব নেই তেমন। সিনিয়রদের মধ্যে আছেন পিকে, বুস্টেকটস, আলবা, সার্জি রবার্তো। এর মধ্যে পিকে এর মধ্যেই বেতন কমাতে রাজি হয়েছেন, বুস্কেটস ও আলবার সঙ্গে আলোচনা চলছে। সার্জি রবার্তোর চুক্তি বাকি আছে এক বছরের, তাকে ছেড়ে দিতে চায় বার্সা, কিন্তু তার ১০ মিলিয়ন বেতন কমানোর ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেনি। আর গ্রিজমানকে বার্সা ছেড়ে দিতে চাইলেও এই মুহূর্তে তার ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছা নেই। ২০২৪ পর্যন্ত তিনি থাকতে চান বার্সাতে।
এখন মেসি কী করবেন?
মেসি পিএসজিতে যাচ্ছেন, এখন পর্যন্ত সেই সম্ভাবনাই সবচেয়ে জোরালো। এর মধ্যেই পচেত্তিনোর সঙ্গে তার কথা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে, পিএসজিও আর্থিক নীতি মেনে মেসিকে সই করাতে পারবে বলে আশাবাদী বলে শোনা যাচ্ছে। ম্যান সিটি হতে পারত আরেকটি গন্তব্য, কিন্তু পেপ গার্দিওলা বলেছেন গ্রিলিশকে দলে নেওয়ার পর আপাতত মেসিকে আনার চিন্তা তারা করছেন না। মেসিকে তাই পরের মৌসুমে নেইমার, ডি মারিয়া, এমবাপেদের সঙ্গে খেলার সম্ভাবনাই বেশি।