• " />

     

    টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ওপেনিং চতুষ্টয়: সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা

    টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ওপেনিং চতুষ্টয়: সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা    

    টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ওপেনারদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন মাহেদী হাসান। মাহেদীর আগে 'সর্বশেষ' হিসেবে থাকা নাঈম শেখের অভিষেক হয়েছিল ২০১৯ সালের নভেম্বরে। এরপর মাহেদীর ওই এক ম্যাচের ওপেনিং বাদ দিলে বাংলাদেশ খেলিয়েছে মোট চারজন ওপেনার। এ সময়ে কমপক্ষে দশ ম্যাচ খেলেছে এমন পুর্ণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে কম। 

    ২০১৬ এশিয়া কাপ থেকে আজ অবধি সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে কম ওপেনার খেলিয়েছে শুধুই আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। কিন্ত সে 'কম' সংখ্যাটা হচ্ছে ১০, আর এসময়ে বাংলাদেশের হয়ে খেলা খেলোয়াড়দের সংখ্যা ৩৯।

    গেল পাচঁবছরে যেসব ম্যাচে ওপেনিং জুটি ৩০ রানের আগেই ভেঙ্গে গেছে, সেসবের প্রায় ৭১ শতাংশ (৭০.৯৬) ম্যাচেই হেরেছে বাংলাদেশ। এমনিতেই গুরুত্বপুর্ণ ওপেনিং পার্টনারশিপ বাংলাদেশের জন্য তাই হয়ে উঠে আরও গুরুত্বপূর্ণ। এবার খতিয়ে দেখা যাক, বাংলাদেশের চার ওপেনারের পারফরম্যান্স।

    তামিম এবং স্ট্রাইক রেট

    বারবার একই কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত তামিম শেষমেশ যেন অনুরোধই করলেন, স্ট্রাইক রেট নিয়ে আর প্রশ্ন না করতে। কারণটা অবশ্যই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না তা নয়, উত্তর দিতে দিতে তিনি আদতে রীতিমতো ক্লান্ত। তারপরেও কি প্রশ্নটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়?

    আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বিশ ম্যাচ খেলা শেষে তামিমের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট কত ছিল জানেন? ৯৯.১৯। ২১তম ম্যাচে এসেই শেষমেশ তামিমের স্ট্রাইক রেট প্রথমবারের মতো তিন অঙ্কের ঘর ছুয়েছিল। এরপর ৪৮তম ম্যাচ খেলার আগেও কখনো তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ১১০ এর উপরে যায়নি। ৪৮তম সেই ম্যাচে তা হবার পর থেকে তার স্ট্রাইক রেট বেড়ে চলেছে ঠিকই, তবে তা ১২০ এর উপরে যেতে পারেনি আজও। 

    আইসিসি বিশ্ব একাদশের হয়ে তামিম খেলেছেন চারটি ম্যাচ। সেগুলি বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে খেলা ৭৪ ম্যাচে তার স্ট্রাইক রেট ১১৭.৪৭। সময়টা গত পাচঁ বছর ধরে নিলে তা হয় ১২৪.০৩। ২৪.৬৫ গড়টা সামান্য বেড়ে হয় ২৪.৮৬। এই পাচঁ বছরে যেসব ওপেনারদের স্ট্রাইক রেট ১২৫ এর কম এবং গড় ২৫ এর নিচে, তাদের মধ্যে তামিমের চাইতে বেশি ম্যাচ খেলতে পেরেছেন কেবলই একজন। সেই গুনাতিলিকার তামিমের থেকে বেশি খেলা ম্যাচের সংখ্যাটা মাত্রই 'দুই'। সেসময়ে বাংলাদেশের খেলা ৪৫ টি-টোয়েন্টির ২২টিতেই ছিলেন তামিম ইকবাল। যা মিস করেছেন তা ইনজুরি কিংবা ব্যাক্তিগত কারণেই, বাদ পড়তে হয়নি কখনোই।

    ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি। আরও পাচঁটি শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে ও ওমানের সাথে। এই সাতটি ইনিংসের প্রত্যেকটিতেই তামিমের রান ছিল ত্রিশ কিংবা তার বেশি। তামিম তার জীবনে মোট ২১টি ত্রিশ কিংবা তার অধিক রানের ইনিংস খেলেছেন। তবে আলাদাভাবে শুধুমাত্র ওই সাতটি ইনিংসেই তামিমের স্ট্রাইক রেট ছিল ১৪০ এর উপরে। 

    বাকি ম্যাচগুলির মধ্যে ২৫ কিংবা তার কম রানে আউট হয়ে তামিম প্যাভিলিয়নে ফিরছেন, এমনটা হয়েছে ৪৯টি ম্যাচে। সেই ৪৯ ম্যাচের ২৮টিতেই যখন তামিম উইকেট খুইয়ে ফিরছেন, তখন তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১০০ এর নিচে। 

    তামিমের পারফর্ম্যান্সে পিচের ভূমিকা কতখানি, বাকিদের পারফরম্যান্স থেকে সেটা খতিয়ে দেখা যায়। এক্ষেত্রে হিসাবে আসছেন শুধু দুদলের প্রথম আটজন ব্যাটসম্যানই। ২০১৭ থেকে এ পর্যন্ত তামিম যেসব ম্যাচে খেলেছেন, সেসব ম্যাচে তামিম বাদে বাকিদের মিলিয়ে স্ট্রাইক রেট ১৩১.৯১। এটি আসলে ধারণা দেয়, সেইসব পিচে স্কোরিং রেটটা কিরকম। সাথে এও ধারণা দিবে, বাকিদের তুলনায় তামিম কেমন ছিলেন।

    ওই ২২ ম্যাচে তামিমের স্ট্রাইক রেটটা ছিল ১২৪.০৪। অর্থাৎ বাকিদের চেয়ে ৭.৮৭ কম স্ট্রাইক রেটেই সেসব পিচে রান করেছিলেন তামিম ইকবাল। আর সেসব ম্যাচে বাংলাদেশের বাকি সাত ব্যাটসম্যানের মিলিত স্ট্রাইক রেটের তুলনায় তামিমেরটা ১.৯৪ কম। 

    সৌম্য, প্রতিভা এবং ধারাবাহিকতা

    ক্যারিয়ারের ৪৫.৯০ শতাংশ ইনিংসেই ১০ রানেরও বেশি করার আগেই নিজের উইকেট হারিয়েছেন সৌম্য সরকার। যার মানে, ০ থেকে ১০ রানে প্রতি ২.১৮ ম্যাচেই একবার আউট হয়েছেন তিনি। এমনকি ১০ বলের উপরে খেলার আগেই ফিরতি পথে সৌম্য সরকার, ৬১ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ২৮টিতেই হয়েছে এমনটা। 

    তারপরেও তাকে কেন এত সুযোগ দেওয়া হয়? প্রশ্নটার উত্তরে 'প্রতিভা' শব্দের উপস্থিতি অনিবার্যই। মাঝে মধ্যে সেই প্রতিভার ঝলক পারফর্ম্যান্সে রুপায়িত হতে দেখা যায়। তবে সেটির পরিমাণ এতই কম যে, তা অধারাবাহিকতার বিশাল ভারে চাপা পড়ে যায়। 

    গেল পাঁচবছরে সৌম্য যে ৪২ ম্যাচে খেলেছেন, সেসব ম্যাচে সৌম্য বাদে বাকিসবের মিলিত স্ট্রাইক রেট ১২৯.০৯। সময়টাতে সৌম্যের স্ট্রাইক রেট ১২৮.৫৪, পার্থক্যটা মাত্রই ০.৫৫। সৌম্য সরকার তাই ম্যাচের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছেন বলাই যায়। এবং ওই ম্যাচগুলিতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের তুলনায় সৌম্যের স্ট্রাইক রেট ৬.২৫ বেশিই। 

    স্ট্রাইক রেট যথেষ্ট ভালো থাকলেও সৌম্যর ব্যাটে অভাব যেটির, সেটির নাম ধারাবাহিকতা। অবশ্য সৌম্যের কিন্ত ধারাবাহিকতার একটা পরিসংখ্যানে আপনি চমকেই উঠতে পারেন। ৩৯,৪২,২৯,৩৪,৪৭,৪৪,৫১- টানা সাত ম্যাচে সৌম্যের স্কোর, যার দুটি এসেছে ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, এরপর শ্রীলঙ্কার সাথে তিনটি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দুটি ম্যাচে। তবে ক্যারিয়ারে আর মাত্র একটিবারই টানা দুই ম্যাচে ত্রিশ কিংবা তার অধিক রান করতে পেরেছিলেন সৌম্য। 

    অন্যদিকে একবার টানা ৯ ম্যাচেই ১৫ অথবা এরও কম রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন সৌম্য। এইসব ম্যাচ বাদে বাকিসব ম্যাচগুলির মধ্যেও টানা দুই ম্যাচে ১৫ অথবা এর কম রানে আউট হয়েছেন সৌম্য- এমনটা হয়েছে ১০ বার। 

    সৌম্যের ইনিংসের প্রথম দশ বলের স্ট্রাইক রেট ১০৪.৩৬। ধীরলয়ে শুরু পুষিয়ে নেন পরে ভালোমতোই, পরের দশ বলে তার স্ট্রাইক রেট ১৪৮.৬৪। কিন্ত ৪৭.০৬% ম্যাচেই যে দশ বল পাড়ি দেওয়ার আগেই তার ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে গেছে। 

    লিটনের ‘অজানা’ সমস্যা

    লিটন কুমার দাস। নামটার সঙ্গে যেন অদৃশ্যভাবে জুড়েই আছে আরেকটি শব্দ, প্রতিভা। তিনি ‘স্পেশাল’, মাঝে মাঝে প্রতিভার ঝলক দেখা গেলেও তাই তার থেকে আশার মাত্রাটা একটু বেশিই। 

    লিটন দাসের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৩৪.০২। বাংলাদেশের হয়ে যারা কমপক্ষে ২০০ রান করেছেন, তাদের মধ্যে লিটনের এই স্ট্রাইক রেট দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। মাশরাফির সর্বোচ্চ ১৩৬.১০ থেকে যা মাত্রই ২.০৮ কম। 

    গত পাঁচ বছরে লিটন দাস যে ৩০ ম্যাচে খেলেছেন, সেখানে লিটন বাদে বাংলাদেশের অবশিষ্ট ব্যাটসম্যানেরা সম্মিলিতভাবে রান যা করেছেন, তা ১২৪.৩৮ স্ট্রাইক রেটে। লিটন তার থেকে ১২.২৩ বেশি স্ট্রাইক রেটেই রান তুলেছেন স্কোরবোর্ডে। সেইসব পিচে বাকি সকলে যেখানে রান করেছেন ১৩০.৬৯৮ স্ট্রাইক রেটে, লিটন সেখানে রান যোগ করেছেন ১৩৬.৬১ স্ট্রাইক রেটে।

    শুধু ওপেনার লিটনকে বিবেচনায় নিলে অবিশ্বাস্যভাবে তার স্ট্রাইক রেটটা হয়ে দাঁড়ায় ১৪৫.২৯। ওপেন করে লিটন ২৩ ইনিংসের ৯টিতে পঁচিশ কিংবা তার অধিক রান করেছেন। তার মধ্যে দুটি বাদে বাকি সব ইনিংসেই স্ট্রাইক রেট ছিল ১৫০ এর উপরে। সেই দুটি ইনিংসেও স্ট্রাইক রেট ১৩০ এর নিচে যায়নি এই ওপেনারের। তবু লিটনের ক্ষেত্রেও ওই একই সমস্যা। 

    টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে খুব বেশি ধারাবাহিকতার আশা করাও যায় না, তবু নুন্যতম ধারাবাহিকতাও তো দেখানো প্রয়োজন। সামর্থ্যের প্রমাণ মাঝে মধ্যে দিলেও যা পারছেন না লিটনও। ৬২.৫% ইনিংসেই পনেরো বলের বেশি খেলার আগেই আউট হয়ে গেছেন এই ব্যাটসম্যান। ৩২ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ২২ বারই পঁচিশের কম রানে আউট হয়েছেন লিটন, তার মাঝে ১১ ইনিংসেই তার স্কোর ছিল এক অঙ্কের। 

    নাঈম আপাতত ‘সম্ভাবনাময়’

    নাঈম শেখ নিজের প্রথম সিরিজেই ভারতের বিপক্ষে ৮১ রানের দারুণ ইনিংস খেলে জানান দিয়েছিলেন তার আগমনের। অন্যদের অনুপস্থিতি এরপর তাকে সুযোগ করে দিয়েছে আরও ম্যাচ খেলার। তবে ১৭ ম্যাচ খেলা সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটার এখনই ‘ফার্স্ট টু চয়েস’ হওয়ার জায়গায় পৌছাতে পারেননি নিশ্চয়ই।

    তামিম, সৌম্য, লিটন, নাঈম- বাংলাদেশের এই চার ওপেনারের মধ্যে প্রথম দশ বলে একমাত্র নাঈমের স্ট্রাইক রেটই একশের নিচে। ধীরলয়ে শুরুর পরে দ্রুততার সাথে রান তুলতেও যদিও দেখা যায় না তাকে। প্রথম দশ বলে ডট খেলার হারটাও তারই বেশি। পরের দশ বলে ১২২.৮০ স্ট্রাইক রেটে রান করলেও সেভাবে তা পুষিয়ে দিতে সক্ষম হন না তিনি। 

    কারণ তার ইনিংসের প্রথম দশ বলের স্ট্রাইক রেট ৯৫.৯৫, এর থেকেও কম ২১-৩০ বলে। ইনিংসের এ পর্যায়ে ৮৯.১১ স্ট্রাইক রেটের সাথে বাউন্ডারি মারার পারসেন্টেজও সবচেয়ে কম তারই, বিশ বল খেলে ক্রিজে সেট হয়ে থাকার পরেও মাত্র ১০% বলে সীমানা ছাড়া করতে পারা তার বাউন্ডারি মারার দুর্বলতাটাই জানিয়ে দেয়। কিন্ত তার রানের ৫৩.৩৩ শতাংশই তো এসেছে বাউন্ডারি থেকে! আসলে বাউন্ডারি পেতে নাঈমকে কিছুটা বেগ পেতে হয় পাওয়ারপ্লের পরেই। এবং নাঈমের মারা বাউন্ডারির ৭৩.৬৮ শতাংশই এসেছে পাওয়ারপ্লেতে। পাওয়ারপ্লেতে প্রতিটি বাউন্ডারি মারতে তার যেখানে লাগে প্রায় ৬ (৬.১৭) বল, সেখানে শুরুর ছয় ওভারের পরের ওভারগুলিতে একেকটা বাউন্ডারি মারতে তিনি নিয়েছেন ১০.৬ বল।

    নাঈম তার যেসব ইনিংসে ৩০ বলের বেশি খেলেছেন, সেখানে ত্রিশ বলের পরের বলগুলিতে রান করেছেন ১২৪.২৪ স্ট্রাইক রেটেই। কিন্ত নাঈম বেশিরভাগ ম্যাচই খেলেছেন স্লো এন্ড লো পিচে। সেখানে তাকে স্লো বলতে গেলে তো সেজন্যে পিচকেও হিসাবে আনতে হয়!

    নাঈমের খেলা ১৭টি ম্যাচে তিনি বাদে বাংলাদেশের বাকিরা রান করেছেন ১১৫.৫৭ স্ট্রাইক রেটে। বেশিরভাগেই যদিও ফিল্ডার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার সময়ই ব্যাট করেছেন। তবুও এটাকে তো হিসাবে আনার উপায় নেই, তাই সেটা ধারণায় রেখেই বরং এগুনো যাক। এবং ইনিংসের শুরুতেই নামা নাঈম সেইসব ম্যাচে রান করেছেন তাদের থেকে ৪.৩৩ কম স্ট্রাইক রেটেই। দুদলের ব্যাটসম্যানদের বিবেচনায় নিলে নাঈমের পার্থক্যটা হয়ে দাঁড়ায় চার ওপেনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। লাইনে থাকা ওপেনারদের মধ্যে নাঈমের স্ট্রাইক রেটই সর্বনিম্ন। কিন্ত তার ২৯.০৬ গড়টাও সবার থেকেই বেশি। 

    এই চারজনের কাকে তাই এগিয়ে রাখবেন? সে সিদ্ধান্ত এখন আপনার।