আইপিএল ২০২১: কী হারাচ্ছে আর কী পাচ্ছে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা
আরব আমিরাতে ২০২০ সালের আইপিএল শুরু হয়েছিলো ১৯ সেপ্টেম্বর। আরেক ১৯ সেপ্টেম্বরেই এবার আরব আমিরাতেই শুরু হচ্ছে আইপিএলের আরেকটি আসর। তবে আদতে এ আসরের ‘শুরু’টা হয়েছিল বেশ আগেভাগেই, এখন সেই ‘থেমে যাওয়া’ আইপিএলই আবার শুরু হচ্ছে যেখানে ছিল সেখান থেকেই। থেমে যাওয়ার আগে খেলা হয়ে গেছে ২৯ ম্যাচ, তাতে কয়েক দল প্লেঅফে যাওয়া প্রায় নিশ্চিতই করে ফেলেছে, আরও কয়েক দল সে আশা নিয়ে লড়াই করে যাবে। সবমিলিয়ে দেখা নেয়া যাক, বর্তমানে কোন দলের অবস্থা কেমন এবং তাদের সে অবস্থার কারণ, সাথে সামনে তাদের জন্য কি কি চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে...
দিল্লি ক্যাপিটালস
৮ ম্যাচে ৬ জয়ে ১২ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে
অদল-বদল
ইন- শ্রেয়াস আয়ার, বেন ডোয়ারশুইস, কুলওয়ান্ত কেজরলিয়া
আউট- ক্রিস ওয়েকস, অনিরুদ্ধ জোসি, মানিমারান সিদ্ধার্থ
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আইপিএলের আগের সিরিজেই চোট পেয়ে পুরো আইপিএল থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন শ্রেয়াস আয়ার। অধিনায়ক আয়ারের চেয়ে ব্যাটসম্যান আয়ারের অনুপস্থিতিই এরপর ভুগিয়েছে দিল্লিকে। যদিও পয়েন্ট টেবিলে তাদের অবস্থান ভিন্ন কিছুই বলছে। পৃথ্বী শ ও শিখর ধাওয়ানের ঝড়ো সুচনা তাদের বেশিরভাগ ম্যাচেই এগিয়ে রেখেছিল অনেকাংশেই। শ ১৬৬.৫ স্ট্রাইক রেটে ৩০৮ রান করে আছেন সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহকের তালিকায় চারে, আর ধাওয়ান ১৩৪.০৩ স্ট্রাইক রেটে ৩৮০ রান করে সে তালিকায় সবার উপরে। শ শুরু থেকেই আগ্রাসী হলে ধাওয়ান এক পাশ আগলে রাখছেন, পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী ধাওয়ানও আক্রমণাত্বক হয়েছেন। ‘পারফেক্ট’ এই জুটির বদৌলতে তাই পাওয়ারপ্লেতে নয়ের উপরে (৯.০৪) রান রেট ছিল একমাত্র দিল্লি ক্যাপিটালসেরই। তবে আয়ারকে হারানোয় দলের ব্যালেন্সে কিছুটা ঘাটতির দরুণ বিপত্তি বেধেছে মিডল অর্ডারে।
স্মিথ ছিলেন ব্যর্থ, সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি রাহানে। পান্টকেও ‘পান্টস্বরুপ’ ব্যাটিং করতে দেখা যায়নি। তবে বোলিং অ্যাটাক তাদের খুব একটা বিপদের মুখে পড়তে দেয়নি। আভেশ খান সব পর্যায়েই ছিলেন দুর্দান্ত, ১৪ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। তবে তাকে ছাড়া বাকি ফাস্ট বোলারদের ফর্ম ছিল পড়তির দিকেই। আয়ারকে হারানোর ফলে ব্যাটিংয়ে বিদেশী স্মিথকে আনলে সুযোগ মিলছিলো না নরকিয়ার, অর্থাৎ দেশিদের উপরই সেজন্য ভরসা করতে হচ্ছিলো। যেখানে ভালো করতে পারেননি কেউই, আবার রাবাদাও ছিলেন না স্বরুপে। কিন্ত দিল্লির জন্য স্বস্তির খবর, আইপিএল এখন যেখানে, সেই আরব আমিরাতে গেলবারের আইপিএলের সেরা উইকেট শিকারীর একজন রাবাদা। দিল্লির ভাগ্য তাই এখন ইনজুরি থেকে ফিরে আসা আয়ারের ফর্ম, আরব আমিরাতে নরকিয়ার আগের ফর্মের পুনারাবৃত্তি করা, রাবাদা-পান্টের স্বরুপে ফেরা এবং শ-ধাওয়ান জুটির উড়ন্ত যাত্রার চলতে থাকার উপরই নির্ভর করছে বলাই যায়। গত দুই মৌসুমেই শেষ চারে যাওয়া দিল্লির আসল লক্ষ্য চ্যাম্পিয়নশীপের অপেক্ষার অবসান কি তাহলে এবার হতেই চলেছে?
চেন্নাই সুপার কিংস
৭ ম্যাচে ৫ জয়ে ১০ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে
অদল-বদল
ইন- জস হ্যাজলউড
আউট- জেসন বেহরেনডরফ
ধোনি ও ধোনির চেন্নাই পরিবর্তনে কম বিশ্বাসী, লম্বা দৌড়ের সুযোগ দিতে মনযোগী। রুতুরাজ গায়কোয়াড় প্রথম তিন ম্যাচে ৫৪.০৫ স্ট্রাইক রেটে ২০ রান করার পরেও তারঁ প্রতি বিশ্বাস রেখেছে। গায়কোয়াড় বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছেন পরের তিন ম্যাচের তিনটিতেই ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলে। ১৪৫.৪৫ স্ট্রাইক রেটে ৩২০ রান করে ডু প্লেসিস তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কয়েক ম্যাচ বাদ দিলে বাকিগুলোতে এই দুজনের জুটি থেকে চেন্নাই পেয়েছে ভালো শুরু। আর ভালো শুরুর ফায়দাটাও নিতে পেরেছে দারুণভাবে। অলরাউন্ডের আধিক্যের সুবাদে দীর্ঘ ব্যাটিং লাইনআপ থাকায় তাদের ব্যাটসম্যানেরা শুরু থেকেই চড়াও হওয়ার সুযোগ নিতে পেরেছেন। মিডল ও ডেথ ওভারে চেন্নাইয়ের রান রেটই ছিল তাই সর্বোচ্চ। পাওয়ারপ্লের পরের ১৪ ওভারে সবচেয়ে বেশি ১২৮টি বাউন্ডারি মেরেছে তারাই। মিডল ওভারে একমাত্র সুপার কিংসেরই রান রেট ছিল ৯ এর উপরে। ডেথ ওভারে অন্য কোন দলেরই যেখানে রান রেট ১১ পাড়ি দেয়নি, সেখানে তাদের রান রেট ছিল ১২.৮৬।
ব্যাটিং সহায়ক পিচে খেললেও জাদেজা-মঈনের স্পিনও একইসাথে ছিল কার্যকর। দুজনের মিলিত ইকোনমি ছিল ৬.৫৩, দুজনে মিলে নিয়েছেন ১১ উইকেট। ৭ ম্যাচে ৬ উইকেটের সাথে জাদেজা ১৬১.৭২ স্ট্রাইক রেটে রানও করেছেন ১৩১, মঈন ৬ ম্যাচে ১৫৭.২৫ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ২০৬ রান। আরেক অলরাউন্ডার কারানের ইকোনমি ৮.৬৮ হলেও গুরুত্বপুর্ণ সময়ে উইকেট এনে দিয়েছেন বাহাতি এই পেসার। তাছাড়া ৯ উইকেটের পাশাপাশি তার রানের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। বরাবরের মতোই পাওয়ারপ্লেতে চাহার ছিলেন দুর্দান্ত। তবে কারান-চাহার বাদে বাকি পেসারদের অবস্থা বলতে গেলে নাজুকই ছিল। এনগিডি-ব্রাভো-শার্দুলের সম্মিলিত ইকোনমি ছিল ৯.৭৭। আরব আমিরাতে পেস ফ্রেন্ডলি কন্ডিশনে পেসারদেরই রাখতে হবে বড় ভুমিকা। সেজন্য হ্যাজলউডের ফেরাটা তাদের জন্য ভালো খবরই বলতে হয়। রায়না তার আগের ফর্মে নেই, ব্যাটসম্যান ধোনির দিন শেষ বললেও আপত্তির জায়গা অতি সূক্ষ্মই! তবে সেসব যে চেন্নাই দলে খুব প্রভাব ফেলছে না তার প্রমাণ- ক্যাপ্টেন ধোনির নেতৃত্বে চেন্নাই প্লেঅফের দৌড়ে বেশ এগিয়েই! আরব আমিরাতে হওয়া গেলবারের আইপিএলে দেখা মিলেছিল ভিন্ন এক চেন্নাইয়ের। ২০২১ এ এসে চলতি আইপিএলে চেন্নাই ফিরেছে তাদের আসল রুপে, এবার আরব আমিরাতেও চেন্নাইয়ের সে রুপটাই দেখতে চাইবে সুপার কিংসের ভক্তরা!
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু
৭ ম্যাচে ৫ জয়ে চেন্নাইয়ের সমান ১০ পয়েন্ট নিয়েও নেট রান রেটে পিছিয়ে পড়ে তৃতীয় স্থানে
অদল-বদল
ইন- টিম ডেভিড, দুশমান্তা চামিরা, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, জর্জ গার্টন, আকাশ দিপ
আউট- অ্যাডাম জাম্পা, কেন রিচার্ডসন, ড্যানিয়েল শামস, ওয়াশিংটন সুন্দর, ফিন অ্যালেন
মিডল ওভারে ব্যাটিংয়ে ভোগান্তি দূর করার পাশাপাশি ভিলিয়ার্স-কোহলি নির্ভরতা কমাতে ব্যাঙ্গালুরু এনেছিল ম্যাক্সওয়েলকে। শেষ আইপিএলেও মিডল ওভারে বেঙ্গালুরুর রান রেট ছিল ৬.৯৪, সব দলের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। এবার সেখানে তাদের রান রেট ৭.৫১ তে নিয়ে যাওয়াতে ম্যাক্সওয়েলের আছে যথেষ্ট অবদান। ১৪৪.৮০ স্ট্রাইক রেটে ম্যাক্সওয়েল রান করেছেন ২২৩। স্বভাববিরুদ্ব চিপকেও তারা অপরাজেয় থেকেছে ম্যাক্সওয়েল-ভিলিয়ার্সের নৈপুণ্যেই। সাইত্রিশেও যে সেখানে উড়েছেন ডি ভিলিয়ার্স। ডেথ ওভারে তাদের রান রেট ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০.৩২। তবে শুরুটাও ভালো পেয়েছে তারা পাড়িক্কালের সৌজন্যে, ৬ ম্যাচে বাহাতি এই ওপেনার ১৯৫ রান করেছেন ১৫২.৩৪ স্ট্রাইক রেটে। কোহলির ১২১.৪৭ স্ট্রাইক রেটও তাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি ব্যাঙ্গালুরুর জন্য।
বোলিংয়ে সাইনি ছন্নছাড়া থাকলেও সিরাজ আশানুরূপ ফলাফল দেখিয়েছেন, জেমিসন বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন। এবারও যদিও ডেথ বোলিং নিয়ে তাদের একটা দুশ্চিন্তা থেকেই গিয়েছিল। কিন্ত সে দুশ্চিন্তা অনেকটাই আগন্তক হিসেবে হাজির হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়েছেন হার্শাল প্যাটেল। দারুণ সব স্লোয়ার কাটার, ইয়র্কারে রানের চাকার গতি রুখার সাথে সাথে সাথে ১৭ উইকেট নিয়ে ‘পার্পল ক্যাপ’ এখন তার মাথায়ই। যদিও আরব আমিরাতের উইকেটে হার্শাল কতটা কার্যকর হতে পারেন সেটিও দেখার বিষয়, এবং বলা যায় তার কার্যকারিতা বেশ প্রভাব ফেলবে পুরো ব্যাঙ্গালুরুর উপরই। অন্যদিকে চাহাল-সুন্দরের স্পিন প্রথম পর্যায়ে ছিল একেবারেই নিস্প্রভ। বিশ্বকাপে জায়গা হারানো চাহালের বাড়তি মনযোগে থাকা এই আইপিএল হচ্ছে আরব আমিরাতে, যেখানে আগেরবারের আইপিএলে চাহাল ১৫ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়েছিলেন।
সুন্দরের না থাকাও তাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। অবশ্য বেশ কয়েকটা পরিবর্তনই এসেছে তাদের ক্যাম্পে। কোচ সাইমন ক্যাটিচের অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্ব সামলাবেন মাইক হেসন। আগের দলের পাঁচজনকেই হারিয়েছে তারা, তবে নিলামে পরিকল্পনায় স্বচ্ছ থাকা ব্যাঙ্গালুরু এবার ‘বদলি’ যোগাড়েও বেশ ভালোই করেছে বলতে হয়। হাসারাঙ্গা-চামিরা দুই শ্রীলঙ্কান ভালো ফর্মেই আছেন, সিঙ্গাপুরের টিম ডেভিডও ফর্ম সঙ্গে করে ব্লাস্ট-বিগ ব্যাশ-সিপিএল মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন, গার্টন হান্ড্রেডে নিজেকে চিনিয়েছেন। তবে তারা সবাই-ই আইপিএলে এই প্রথম। আইপিএলের চাপ সামলানোটাও তাদের জন্য তাই বড় চ্যালেঞ্জ। প্লেঅফে যেতে পারলেও ব্যাঙ্গালুরুরও যে একটা শিরোপা চাই! তবে এত বদল আসা ব্যাঙ্গালুরুর জন্য সেটিও নিশ্চয়ই বড় এক চ্যালেঞ্জই!
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স
৭ ম্যাচে ৪ জয়ে ৮ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে
অদল-বদল
ইন- রুশ কালারিয়া
আউট- মহসিন খান
মুম্বাইয়ের এই আইপিএল শুরু হয়েছিলো রোহিত শর্মার মুম্বাইয়ের জার্সিতে ভালো ফর্মে আসার সুখবর নিয়ে। কিন্ত অন্যদিকে তাদের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিষান-হার্দিকের ফর্ম। শুধু ‘ব্যাটসম্যান’ বনে যাওয়া হার্দিক ৭ ম্যাচে ১১৮.১৮ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন মাত্র ৫২ রান। কিষানের অবস্থাও ছিল খারাপ, ৫ ম্যাচে ৮২.৯৫ স্ট্রাইক রেটে ৭৩ রান। শুরুতে কিছুটা ভুগলেও শেষের দিকে চেন্নাইয়ের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে পোলার্ড স্বরুপে ফিরেছেন। আর বিধ্বংসী এই ত্রয়ীর স্বরুপে ফেরাটাই মুম্বাইয়ের জন্য হবে অনেক বড় পাওয়া। এই ত্রয়ী জ্বলে উঠতে না পারার ফলেই তো ডেথ ওভারে মুম্বাইয়ের রান রেট (৮.৮১) ছিল সর্বনিম্ন! বোলিংয়ে মুম্বাইয়ের সাফল্যের কারিগর পেসাররা এবার তেমন কোন ভুমিকাই রাখতে পারেননি। রাহুল চাহার ছিলেন দুর্দান্ত, ৭.২১ ইকোনমিতে নিয়েছেন ১১ উইকেট।
আরব আমিরাতে মুম্বাই তাদের পেসারদের থেকে বেশি কিছুরই আশা রাখবে। আরব আমিরাতে হওয়া করোনাকালীন প্রথম আইপিএলে মুম্বাইয়ের শিরোপা জয়ে অন্যতম হাত ছিল যে পেসারদেরই, বিশেষ করে পাওয়ারপ্লেতে তাদের বোলিং! পাওয়ারপ্লেতে মুম্বাইয়ের পেসাররা ৭ ম্যাচে ৩৩ ওভার বল করে ৯৯ স্ট্রাইক রেটে এবার উইকেট নিতে পেরেছেন মাত্র দুটি, যেখানে গত বছর তারা ১৬ ম্যাচে ১৬.৯ স্ট্রাইক রেটে নিয়েছিলেন ২৮টি উইকেট। মুম্বাইয়ের জন্য ভালো সংবাদ, অ্যাডাম মিলনে আছেন দারুণ ফর্মে, যৌথভাবে হান্ড্রেডের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর সাথে ছিলেন সবচেয়ে ইকোনমিকাল বোলারও। হার্দিক পান্ডিয়া বিশ্বকাপে পুরো ৪ ওভার বল করবেন, জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচক। মুম্বাই হার্দিকের বল পেলে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আরব আমিরাতের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে কিষান-হার্দিকদের ব্যাটে রান আসার সম্ভাবনাই বেশি। আর তাই যদি হয়, প্লেঅফে যাওয়ার কাজটা মুম্বাইয়ের জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। টানা তৃতীয় শিরোপা জেতার রেকর্ড নেই কোন দলেরই, মুম্বাইয়ের চোখ থাকবে সেদিকেই!
রাজস্থান রয়্যালস
৭ ম্যাচে ৩ জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম স্থানে
অদল-বদল
ইন- গ্লেন ফিলিপস, অশেন থমাস, এভিন লুইস, তাবরেইজ শামসি
আউট- জস বাটলার, অ্যান্ড্রু টাই, বেন স্টোকস, জফরা আর্চার
আর্চার, বাটলার, স্টোকস- একই দলে তিনজনকেই পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে। কিন্ত এই ত্রিরত্নকে পেয়েও রাজস্থানের দুর্ভাগ্য, আগে ‘না পাওয়া’ স্টোকস-আর্চারের সাথে সাথে এবার তারা পাচ্ছে না বাটলারকেও। রাজস্থানের ব্যাটিং যে দুচাকার গাড়ির উপর ভর করে চলেছে, তার একটি তো ছিলেন বাটলারই। ৭ ম্যাচে ১৫৩.০১ স্ট্রাইক রেটে ২৫৪ রান করেছেন এই ইংলিশম্যান। আরেকজন স্যাঞ্জু স্যামসন ১৪৫.৭৮ স্ট্রাইক রেটে ২৭৭ রান করে আছেন সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহকের তালিকায় পাঁচে। বোলিংয়ে মরিস ১৪ উইকেট নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। সাকারিয়া,উনাদকেট, মুস্তাফিজ ভালো সমর্থন দিয়ে গেছেন মরিসকে। তবে শ্রেয়াস গোপাল ও তেওয়াতিয়ার অবস্থা ছিল একেবারেই বিবর্ণ। ৪ উইকেট দুজনে মিলে নিয়েছেন ৮৩ গড়ে, সব দলের মধ্যে স্পিনে সবচেয়ে কম ওভার করিয়েছে রাজস্থানই। আরব আমিরাতে গোপাল গেলবারের আইপিএলে এর থেকে অনেক ভালো করেছিলেন, তার কাছ থেকে সেটাই এবার প্রয়োজন রাজস্থানের।
রাজস্থানের আরেকটা চিন্তার বড় জায়গা, ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং। বদলি হিসেবে আসা লুইস সিপিএলে ছিলেন বেশ ফর্মে, লিভিংস্টোন মাঝের বিরতির সময় নিজেকে চিনিয়েছেন। রাজস্থানের টপ অর্ডার তাই বেশ শক্তিশালীই বলা চলে। কিন্ত মিডল-লেট অর্ডারে রাজস্থানের ভরসা করতে হচ্ছে ভারতীয় ব্যাটারদেরই উপর, যেখানে দুবে-পারাগ-তেওয়াতিয়ারা ব্যর্থ। এই তিনজনের ২০ ইনিংস মিলিয়ে ১৭.১৭ গড়ে ৩০৯ রান এসেছে ১২৬.৬৪ স্ট্রাইক রেটে। প্লেঅফে কোয়ালিফাই করতে হলে রাজস্থানের স্যামসন, লুইস, লিভিংস্টোনদের ফর্ম ধরে রাখা যেমন চাই, মিডল-লেট অর্ডারেরও তেমনি রাখতে হবে বড় ভুমিকা। শুরুর কয়েক ম্যাচ হবে তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপুর্ণ, সেখানে ফসকে গেলে ঘুরে দাঁড়াতে দেরি হয়ে যাবে বড্ড বেশি।
পাঞ্জাব সুপার কিংস
৮ ম্যাচে ৩ জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে ষষ্ট স্থানে
অদল-বদল
ইন- আদিল রশিদ, নাথান এলিস, এইডেন মারক্রাম
আউট- জাই রিচার্ডসন, রাইলি মেরেডিথ, ডেভিড মালান
পাঞ্জাবের দুই ওপেনার- লোকেশ রাহুল ও মায়াঙ্ক আগারওয়াল, দুজনই আছেন সেরা ছয়জন রান স্কোরারের মধ্যে। ৭ ম্যাচে ৩৩১ রান করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক রাহুল, সমান ম্যাচে ১৪১.৩০ স্ট্রাইক রেটে ২৬০ রান করেছেন আগারওয়াল। রাহুলের স্ট্রাইক রেট ১৩৬.২১ অত্যন্ত খারাপ না হলেও তা নিয়ে সমালোচনার কারণ, রাহুলের সামর্থ্য যে এর চাইতে অনেকখানি উপরে! কিন্ত হেভি টপ অর্ডারের পরে বাকিদের ব্যর্থতারও যে রাহুলের রক্ষণশীল মনোভাবের এ ভুমিকা নেওয়াতে দায় আছে যথেষ্ট! পুরান ৬ ম্যাচে করেছেন ২৮ রান, চারটিতে মেরেছেন 'ডাক'। দিপাক হুদা প্রথম ম্যাচে ফিফটি হাকিয়ে পরে একেবারেই রানের দেখা পাননি৷ শাহরুখ খানও সম্ভাবনা জাগিয়ে বেশি কিছু করতে দেখাতে পারেননি। হেনরিকস, মালানরাও নিরাশ করেছেন পাঞ্জাবকে।
বোলিংয়ে মোহাম্মদ শামি আশানুরুপ পারফরম্যান্স করতে পারেননি। আর্শদিপ ২০২০ আইপিএলের ফর্ম এবারের আইপিএলে ধরে রাখতে পারেননি। দুই অস্ট্রেলিয়ান পেসার- মেরেডিথ ও রিচার্ডসনের সম্মিলিত বোলিং গড় ছিল ৪০.২২ ও ইকোনমি ৯.৭৮। বোলিং ডিপার্টমেন্টে 'টিম পারফর্ম্যান্স' পায়নি পাঞ্জাব। জর্দান-সামিদের সাথে এবার যোগ দিয়েছেন আরেক অজি পেসার নাথান এলিস। দুই লেগির সাথে আরেকজন আদিল রশিদ। মালানের বদলে ফর্মে থাকা মারক্রামও ভালো চয়েজ। কিন্ত ওদিকে গেইলও ভুগছেন ফর্মহীনতায়। তবে পাঞ্জাবের যে দরকার ‘টিম পারফর্ম্যান্স’! প্লেঅফের আশা এখনও বেচেঁ থাকলেও নিঃসন্দেহে পাঞ্জাবের জন্য তা অনেক কঠিন কাজই হবে। এবং পাঞ্জাব সেই আশা বাঁচিয়ে রাখতে পারে কতক্ষণ, সেটিও দেখারই বিষয়!
কলকাতা নাইট রাইডার্স
৭ ম্যাচে ২ জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম স্থানে
অদল-বদল
ইন- টিম সাউথি
আউট- প্যাট কামিন্স
মরগান ‘ভয়ডরহীন ক্রিকেট’ খেলতে পছন্দ করেন। কিন্ত নাইট রাইডার্সে তার সে দর্শনের কোনই ছাপ দেখতে পাওয়া যায়নি এখনও! আগেরবারের আইপিএলে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং পজিশন কিংবা ভুমিকা নিয়ে অদল-বদল করতে দেখা গেছে, এবার কলকাতা স্থির থেকেছে। তারপরেও ব্যাটসম্যানেরা ব্যর্থই থেকেছেন। নিতিশ-শুবমান-ত্রিপাতির তরুণ টপ অর্ডার ক্লিক করেনি। এই তিনজন ২১ ইনিংস মিলিয়ে রান করেছেন ২৪.৭৬ গড়ে, তাদের সম্মিলিত স্ট্রাইক রেট ছিল ১২৫.৬০। আর পাওয়ারপ্লেতে আলাদাভাবে প্রত্যেকেরই স্ট্রাইক রেট ছিল ১২০ এর নিচে। এরপরে মরগান-কার্তিকও তাদের সামর্থ্যে অনুযায়ী খেলতে পারেননি। মরগান তো তার সামর্থ্যের ধারেকাছেও ছিলেন না, ১১২.১৯ স্ট্রাইক রেটে ১৫.৩৩ গড়ে রান করেছেন মোটে ৯২।
বোলিংয়ে কামিন্স বাদে বাদবাকিদের কেউই খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারেননি। সেরা দশ উইকেট শিকারীর মধ্যে কলকাতার একমাত্র কামিন্সই আছেন সপ্তম স্থানে। নারিন তার সক্ষমতার খুব কাছে ছিলেন না। তবে কলকাতার ব্যর্থতার মুলে আসলে ব্যাটিংই। আর তাদের ব্যাটিংয়ে ব্যর্থতার মুলে রয়েছে ‘ব্যর্থতার ভয়’! হেড ক্যাচ ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কলকাতার ব্যাটিংয়ে দুর্দশার কারণ বলছেন এই ‘ভয়’টাকেই। এবার অবশ্য বলতে গেলে সব দলই নতুন করেই শুরু করছে এই আইপিএল। ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে কিছুটা দূরে থাকার সুযোগ পেয়েছে তাই কলকাতা। এই আসরে তাদের আর কিছু হারানোরও ভয় নেই! কলকাতার জন্য এখন যা আছে, তা শুধুই পাওয়ার! বাকিদের অবস্থানের সাপেক্ষে কলকাতার এই অবস্থান থেকে প্লেঅফে যাওয়াটা অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে, তবু ‘নতুন শুরু’ বলে আশা করতেই পারে কলকাতা!
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ
৭ ম্যাচে ১ জয়ে ২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তলানীতে
অদল-বদল
ইন- শেরফেইন রাদারফোর্ড
আউট- জনি বেইরস্টো
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ধারণা করেছিলেন হায়দরাবদের এই অবস্থা হবে, এমন কেউ কি আছেন? তাদের অবস্থা এমনই ছিল যে টুর্নামেন্টের ৭ ম্যাচের মধ্যেই তারা খেলিয়েছে ২১ জনকে। শেষমেশ বাদ দিয়েছে ক্যাপ্টেনকে পর্যন্ত। ৬ ম্যাচে ওয়ার্নার রান করেছিলেন ১৯৩, কিন্ত তা মাত্রই ১১০.২৮ স্ট্রাইক রেটে। ওয়ার্নারের স্লো স্ট্রাইক রেট যদিও পুষিয়ে দিচ্ছিলেন বেইরস্টো অসাধারণ ব্যাটিং করে। ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ কঠিন চেন্নাইয়ের যে পিচে সবাই রান করছিলেন ১২০.৩৩ স্ট্রাইক রেটে, সেখানে বেইরস্টো ১৪১.৬১ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ২১১ রান। অবিশ্বাস্যভাবে পাওয়ারপ্লেতে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৭৬। হায়দরাবাদ ভালো শুরু পাচ্ছিলো, কিন্ত সেটাকে ‘ভালো শেষে’ রুপান্তরিত করতে পারছিলো না। পাওয়ারপ্লেতে তাদের ৮.১৯ রান ছিল সবার থেকে বেশি। আর মিডল ওভারে ৬.৮৯ রান রেট সবার থেকে কম, ডেথের ৮.৮৫ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। অভিজ্ঞ কেদার যাদব, বিজয় শঙ্করদের যেমন ব্যাটে খরা ছিল, অনভিজ্ঞ সামাদ,অভিষেকরাও ভালো করতে পারেননি।
বোলিংয়েও রশিদ খান বাদে বাকি সবাই-ই ছিলেন আউট অফ ফর্মে। রশিদ ৬.১৪ ইকোনমিতে নিয়েছেন ১০ উইকেট, যেখানে সানরাইজার্সের অন্য কোন বোলার চার উইকেটের বেশি নিতে পারেননি। ভুবনেশ্বর নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন, নাটরাজনকে তারা ইনজুরিতে হারিয়েছিলো। এবার নাটরাজনকে পাচ্ছে তারা, তবে তাদের ব্যাটিংয়ের মুল স্তম্ভ বেইরস্টোকে যে হারাতে হচ্ছে। অবশ্য সানরাইজার্সের এবারের আইপিএলের গল্পের শেষ দৃশ্য লেখা সারা। টানা গত পাঁচ বছর প্লেঅফে কোয়ালিফায়াই করেছে হায়দরবাদ, কিন্ত এবার সে আশা দুরাশাই! রশিদ খান তাইতো বলেন, যে কয়টি ম্যাচ আছে, তা ফাইনাল ভেবেই নিজেকে উজাড় করে দিবেন! দেখা যাক, সেই শেষ দৃশ্য তারা বদলাতে পারেন কিনা!